ড. ক্রুক একটি শীতল কক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর সামনে ৩০৪টি বেডে ৩০৪টি নবজাতক। প্রতিটি বেডের পাশে দাঁড়ানো একটি করে রোবট। এরা এই হাসপাতালে অনেকটা নার্সের কাজে নিয়োজিত। নবজাতকগুলোর বয়স সাড়ে আট মিনিট। সবাই সমস্বরে চির করে কাঁদছে।
—‘x-370 সুপার রোবট গ্রুপ, স্টার্ট ইয়োর অপারেশন।’
—‘অলরাইট, মহামান্য ক্রুক।’
একসঙ্গে প্রতিটি রোবট প্রতিটি বেডের শিশুকে একটি করে ইনজেকশন দিয়ে দিল। সেই ইনজেকশনের ব্যথায়ই হোক কিংবা ভয়ংকরদর্শী রোবটগুলোর চেহারা দেখেই হোক, প্রতিটা শিশু আগের চেয়ে অনেক জোরে চিৎকারর দিয়ে কেঁদে উঠল। আর এই কান্নাই ছিল কয়েক লাখ বছরের মধ্যে শোনা শেষ অবুঝ শিশুর কান্না।
পরক্ষণে প্রতিটি শিশুর কান্না থেমে গেল। এতক্ষণ তাদের কান্নায় চারপাশ যতটা আলোড়িত ছিল, এক মুহূর্তেই তা ততটাই নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল।
ড. ক্রুকের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল, ‘অপারেশন সাকসেসফুল।’
২
শ্রিহার বয়স তিন দিন। এই তিন দিনে সে থিওরি অব রিলেটিভিটি পড়ে শেষ করল, আজ ধরেছে কোয়ান্টাম মেকানিকস। ওর বাবা পাশে বসে ওকে ল্যাপটপে বিভিন্ন প্রোগ্রাম সেট করে দিচ্ছেন আর মা সকালের নাশতা প্রস্তুত করছেন।
—‘শ্রিহা, তুমি এখনো কোয়ান্টাম মেকানিকস পড়তে পারোনি! আমি তোমার বয়সে এসব প্রাথমিক বিষয় সবটুকুই আয়ত্ত করে ফেলেছিলাম।’ মা রান্নাঘর থেকে নিজ প্রশংসা করে বললেন।
বাবা একদৃষ্টে কাজ করে যাচ্ছেন। মা আর কিছু বলার আগেই শ্রিহা ওর ল্যাপটপ আর যন্ত্রপাতি নিয়ে অন্য রুমে চলে গেল।
ঘরের দরজা বন্ধ করে ও ল্যাপটপটা ওর কোলের ওপর নিল। ল্যাপটপটা বেশ বড়। ওর নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে। বাবার ঠিক করা প্রোগ্রামগুলো একটু চেক করতে গিয়ে সে ভুলবশত ক্লিক করে ফেলল অন্য একটি প্রোগ্রামে। মনিটরের পর্দায় ভেসে এল একটি মানবশিশুর ছবি। কিন্তু ছবির শিশুটি ওর মতো নয়। আশ্চর্য মায়াবী চেহারার শিশুটির অবুঝ মুখে হাসি লেগেই আছে। সবচেয়ে বেশি মায়া ওর চোখে, যেন হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকছে।
ছবিটি দেখে শ্রিহার প্রচণ্ড অবাক লাগছে। সেই সঙ্গে সে কিসের যেন প্রচণ্ড অভাব অনুভব করছে।
৩
কয়েক দিন ধরে শ্রিহা প্রচণ্ড কৌতূহলে ফেটে পড়ছিল। তার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল ল্যাপটপে দেখা শিশুটি সম্পর্কে। তাই সে একদিন ঢুকে পড়ল ‘হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি’ নামক লাইব্রেরিতে এবং সন্ধান পেল এক আশ্চর্য বইয়ের, বইটি ছিল কয়েক লাখ বছর আগের মানুষদের নিয়ে। সে বইটিতে যা পড়ল তাতে তার মুখ বিস্ময়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বইটিতে লেখা, তখনকার মানুষদের পরিণত হতে অনেক সময় লাগত। শিশু বয়সে তারা একদম অবুঝ ছিল। কথা বলতে পারত না, হাঁটতে পারত না। তাদের শরীরের গঠনও ছিল একদম অন্য রকম। এখনকার সময়ের মতো শিশু-বৃদ্ধ সবার মস্তিষ্ক একই রকম গঠনের ও সমান ক্রিয়াশীল ছিল না।
আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, তাদের বাবা-মা তাদের অনেক যত্ন, অনেক আদর দিয়ে বড় করতেন। পড়াশোনা না করলেও ভালোবাসতেন, আদেশ অমান্য করলেও ভালোবাসতেন। কিন্তু কেন?
শ্রিহা এক মাস ধরে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। এটা নিয়ে বাড়িতে রীতিমতো তাকে খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তার মা বলেছেন, আর দুদিনের মাঝে সে যদি পড়ালেখা শুরু না করে তাহলে তাকে হত্যা করা হবে। কিন্তু শ্রিহা বইটিতে পড়েছে একটি শিশুকে তার বাবা-মা সব বিপদ থেকে রক্ষা করতেন, নিজের জীবন দিয়ে হলেও বাঁচিয়ে রাখতেন। কিন্তু কেন?
এসব কেনর উত্তর সে কখনোই খুঁজে পেত না যদি সেও ক্রুকের ‘অপারেশন ০০৩’-এর ওয়েবসাইটের সন্ধান না পেত।
ড. ক্রুক নামের একজন নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ একবার এ রকম একটি প্রজেক্ট দাঁড় করালেন, যাতে বয়সভেদে অর্থাৎ বৃদ্ধ, শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের বুদ্ধি ও বিকাশে কোনো পার্থক্য না থাকে। দীর্ঘ ৬৫ বছর ধরে তিনি বহু শিশুর মস্তিষ্কে অপারেশন চালালেন। এতে বহু শিশু মারা গেল, অনেকে হয়ে গেল প্রতিবন্ধী। তার করা শেষ অপারেশন ০০৩-তে তিনি কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভ করতে পারলেন। শিশুদের মস্তিষ্ক হয়ে উঠল পরিণত মানুষের মতো, পরিণত মানুষ ও একটি শিশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য রইল না। সবাই হয়ে উঠল সমান।
কিন্তু এর ফল হলো অন্য রকম। শিশুদের সবাই সম্মান করতে শুরু করল ঠিকই, কিন্তু তাদের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা কমে যেতে থাকল। কারণ, তাদের অবুঝ দৃষ্টি, মনভোলানো হাসি, অসহায় কান্না আর শোনা গেল না। সন্তানদের নিয়ে মানুষের চিন্তা কমে গেল এবং সেই সঙ্গে ভালোবাসাও। মাতৃস্নেহ একসময় এতটাই কমে গেল যে সবাই নিজের কথা ছাড়া অন্য কিছু ভাবাটাই পাপ মনে করতে থাকল। মায়ের ভালোবাসার অভাব সন্তানদের করে তুলল নিষ্ঠুর ও স্বার্থপর।
আজ কোথাও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা নেই। আজ সকলেই স্বার্থপর।
৪
শ্রিহাকে আজ সন্ধ্যায় মেরে ফেলা হবে। তার আগেই ও নিজের ক্লোন তৈরি করে ফেলতে চায়। ও বেঁচে থাকতে চায় কারণ, এক অদ্ভুত চিন্তা ওকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। ওর বাবা-মা ওকে সন্ধ্যা সাতটার দিকে খুন করে ফেলল। ডাক্তার ওর মৃত্যু নিশ্চিত করল, ওকে নিয়ে যাওয়া হলো পরিত্যক্ত স্থানে ফেলার জন্য। কিন্তু তারা জানে না যে শ্রিহাকে তারা মারতে পারেনি।
৫
শ্রিহার বয়স এখন ১৬।
একটি শীতল কক্ষের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সে। সামনে ৩০৪টি বিছানায় ৩০৪টি নবজাতক। সবাই চা-কফি খাচ্ছে। ওরা জানে না যে এই পানীয়ের মাঝে স্বল্পকালীন ঘুমের ওষুধ মেশানো আছে।
পাঁচ মিনিটের মাঝে প্রতিটি শিশু ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল। আর শ্রিহা শুরু করল তার অপারেশন। যে অপারেশনের নাম দিয়েছে সে ‘খাঁটি মানব শিশু।’