অভিকর্ষ ও আমি

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

সারা জীবন আমাকে একটা কথাই শুনতে হয়েছে, কম খাও! অথচ আমি কিন্তু কখনোই বেশি খাই না। তবে আমার হস্তীসম পেটের দিকে তাকিয়ে কেউ এ কথা বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। এই পেটের জন্য যন্ত্রণার শেষ নেই আমার। আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে স্কুলের বন্ধুরা পর্যন্ত আমাকে ‘তুলতুলে রাতুল’ বলে ডাকে। বিরক্ত হয়ে একবার দুই সপ্তাহ খাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কাজের কাজ কিছুই হয়নি বরং অসুস্থ হয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল।

বরাবরের মতো আজও বন্ধুমহলে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছিল। আর পুরো সময় রাগে-লজ্জায় কান অবধি লাল হয়ে গিয়েছিল আমার। পঞ্চম পিরিয়ডে বিজ্ঞান ক্লাস। ‘পৃথিবী ও মহাকর্ষ’ অধ্যায়টা পড়াচ্ছিলেন স্যার। কিন্তু তাঁর কথাগুলো আমার এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। শুধু একটা কথাই ঢুকল এবং মগজে গেঁথে গেল, ‘মুক্তভাবে পড়ন্ত কোনো বস্তু অভিকর্ষজ ত্বরণে গতিশীল হয়, ফলে বস্তুর সাপেক্ষে বস্তুর ওজন শূন্য হয় এবং বস্তুটি ওজনহীন অনুভব করে।’

২.

ষষ্ঠ পিরিয়ডে টিচারের আসতে দেরি হচ্ছিল বলে চিৎকার-চেঁচামেচি করছিল সবাই। আমিও আমার স্বভাবমতো নিজের সিটে বসেছিলাম। যখন আমি গুটি গুটি পায়ে বারান্দায় বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম, কেউ খেয়ালই করল না। তবে রেলিংয়ের ওপর যখন দাঁড়ালাম, তখন অনেকেই চি্রতকা করে উঠল। স্যারও হেঁটে ক্লাসের দিকে আসছিলেন, আমাকে দেখেই চিৎকার করে দৌড়ে এলেন তিনি। কিন্তু তাঁদের চিৎকার ঢুকছিল না আমার কানে। শুধু একটা জিনিসই মনে হচ্ছিল, ‘মুক্তভাবে পড়ন্ত কোনো বস্তু অভিকর্ষজ ত্বরণে গতিশীল হয়, ফলে বস্তুর সাপেক্ষে বস্তুর ওজন শূন্য হয় এবং বস্তুটি ওজনহীন অনুভব করে।’ একবার, জীবনে একবার হলেও নিজেকে আমি ওজনহীন অনুভব করতে চাই।

৩.

আমার মাথার কাছে মা বসে আছে। বিছানার ধারে জনাকয়েক আত্মীয়। এত দিন তারা আমার ওজন নিয়ে জ্বালাত, এখন জ্বালাচ্ছে নির্বুদ্ধিতা নিয়ে। এক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে পড়ে আছি। হাঁটুর জয়েন্ট, কবজির জয়েন্ট, কোমরের হাড়সহ অনেকগুলো হাড়ই ভেঙেছে। কাল আমি ডিসচার্জ হয়ে বাড়ি যাব। পুরো শরীরে ব্যান্ডেজ জড়ানো, মিসরের মমিও ফেল! কয়েক দিন পরিচিত, অর্ধপরিচিত, অপরিচিত সবাই একবার করে হলেও আমায় দেখতে এসেছিল। তিনতলা থেকে লাফ দিয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও অন্তত এক মাস লাগবে উঠে বসতে। মায়ের হাতে স্যুপের বাটি। নিজে খেতে পারি না বলে খাইয়ে দিচ্ছেন। তবে এত কিছুর পরও একটা কারণে আমি দারুণ খুশি—এখন আর কেউ কম খেতে বলে না আমাকে।