কঙ্কাল

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

অনেক দেরি হয়ে গেল লামিয়ার। রাস্তায় বেরিয়ে সময়টা আন্দাজ করতে পারছে না সে। বাড়িতে মা নিশ্চয়ই বকাঝকা করছেন তাকে। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। তার আগে একটা ফোঁটা সময় নষ্ট হোক, তা চান না তিনি। লামিয়া মাকে বলে এসেছিল, আমি লাবণ্যদের বাড়িতে একটা বই আনতে যাচ্ছি, কেবল যাব আর আসব। এতটুকু সময় নষ্ট করব না। তবু দেরি হয়েই গেল।

বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। থেকে থেকে বাতাস আসছে হু হু করে। থমকে থমকে একটা কান্নার শব্দ ভেসে আসছে সেই বাতাসে।

বইটা হাতে নিয়ে দৃঢ় পায়ে হাঁটছে লামিয়া। এতটুকু বিচলিত হচ্ছে না সে। এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম, তার মাঝে কতটুকুই–বা পথ। মাঝে ভয় করার মতো এমন কী থাকতে পারে! ভূত-পেতনি-দৈত্য-দানব—এই সবের অস্তিত্বে কোনো বিশ্বাস নেই লামিয়ার। কারণ, ক্লাসে বিজ্ঞান স্যার একদিন সগর্বে বলেছেন, পৃথিবীতে ভূত–প্রেত বলতে কিছুই নেই। এসব মানুষের মুখে মুখেই আছে শুধু।

গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে তাকে। বৃষ্টিতে কাদা না হলেও পিচ্ছিল হয়ে গেছে পথটা। অসাবধানতাবশত পা পিচ্ছিল হয়ে গেলে চক্কর খেতে খেতে গড়িয়ে পড়তে হবে নিচের ধানখেতে। আবার রাস্তায় উঠতে কষ্ট হবে খুবই।

সামনেই ডান দিকে পাশাপাশি কয়েকটি গাবগাছ। গাছগুলোর নিচে অন্ধকার থাকার কথা কিন্তু সেখানে কোনো অন্ধকার নেই। কোথাও কোথাও জোনাকিরা জ্বলছে। জোনাকির আলো ঠিক আকাশের তারার আলোর মতো মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্যজনক। সেখানে নিজ চোখে যা দেখছে, সেটা বিশ্বাস না করে উপায় নেই।

মচমচ শব্দ করতে করতে একটি লোক গাবগাছ থেকে নেমে আসছে। লামিয়া ওদিকেই তাকিয়ে আছে। লোকটা আস্তে আস্তে হেঁটে তার কাছে এসে দাঁড়ায়। লামিয়া লোকটার দিকে তাকাতেই দেখে লোকটা নেই। দাঁড়িয়ে আছে একটি ছায়ামূর্তি। মূর্তিটা আবার মানুষ হয়ে গেল। তার ডান হাতে একটি নরমুণ্ডু ঝুলছে। বাতাসে নড়াচড়া করছে মুণ্ডুটা। দমফাটানো একটা চিত্কার মেরেই দৌড় দিল লামিয়া। কিছু দূর গিয়ে ধপাস করে পড়ে গেল মাটিতে।

দ্রুত সেখান থেকে উঠে আবার দৌড়াতে লাগল লামিয়া। মুণ্ডুটা বুঝি তার পেছনে ধেয়ে আসছে। হঠাৎ সামনে থেকে পরিচিত কারও গলা। ‘লামিয়া, এমনভাবে দৌড়াচ্ছ কেন?’

লামিয়ার থামার কোনো ইচ্ছে নেই। বাঁয়ে-ডানে-পেছনে—কোনো দিকেই তাকাবে না সে। একদম বাড়ির উঠানে গিয়ে থামবে।

আবার বাতাসে শব্দ ভেসে আসে, ‘লামিয়া, তুমি আমাকে চিনতে পারোনি? কী বোকা মেয়ে বাবা! আমি তোমার বন্ধু মাহিনের বাবা। আমি যেখানে আছি, সেখানে তোমার বিপদ থাকতে পারে না।’

থামল লামিয়া। মাহিনের বাবা কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে অভয় দেওয়ার স্বরে বললেন, ‘ব্যাপার কী। কেনই–বা এমন বেপরোয়াভাবে দৌড়াচ্ছিলে, আমার কাছে খুলে বলো তো?’ লামিয়া পুরো ঘটনাটাই বলল। ঘটনাটি শুনে তিনি হেসেই মরেন। ‘তুমি এসব কী বলছ? চোখে শর্ষে ফুল দেখছ নাকি? একজন মানুষের হাতে একটা মানুষের কঙ্কাল মুণ্ডু ঝুলে থাকে কী করে?’ ‘বিশ্বাস করুন কাকা, এক ফোঁটাও মিথ্যে বলছি না আমি।’ ঢোঁক গিয়ে বলল লামিয়া।

এবার খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠলেন কাকা।

‘আমার বিপদের সময়ে আপনি এমনভাবে হাসছেন কেন কাকা?’

কাকা আস্তে আস্তে তার ডান হাতটা ওপরে তুলতে তুলতে রহস্যময় কণ্ঠে বললেন, ‘ঠিক এ রকম ছিল?’ লামিয়া আতঙ্কিত চোখে দেখল তার হাতেও একটা মানুষের কঙ্কাল মুণ্ডু।

এবার লামিয়া আর কোনো চিত্কার করতে পারল না। জীবন বাজি রেখে একটা দৌড় দিল। একেবারে নিজের বাড়ির উঠানে গিয়ে পড়ল হুমড়ি খেয়ে। এরপর আর হুঁশ নেই।

লামিয়ার যখন জ্ঞান ফিরে এল, তখন ভোর হয় হয় ভাব। চারদিকে একটু একটু ফরসা হচ্ছে। আর মুখের ওপর ঝুঁকে আছেন মা। পাশেই বাবা ও বাড়ির অন্যরা। মাহিনের বাবাও আছেন। তিনি ‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করলেও কোনো উত্তর দিল না লামিয়া। ভয়ে ভয়ে তাকাল মাহিনের বাবার দিকে। তার হাতে এখনো মুণ্ডুটা ধরা। তিনি স্কুলের বায়োলজির শিক্ষক। ক্লাসে আজ মানবদেহের কঙ্কাল নিয়ে পড়াবেন। তাই গতকাল রাতে ডাক্তার সাহেবের কাছ থেকে চেয়ে এনেছিল। পথে দেখা লামিয়ার সঙ্গে।

সবাই হেসে উঠল। খুব লজ্জা পেল লামিয়া। তবে এটাও বুঝল, ভূত বলে আসলে কিছুই নেই, সবই মনের কল্পনা।

লেখক: শিক্ষার্থী, জামালপুর জিলা স্কুল, জামালপুর