অর্জুনবাবা

অলংকরণ: মাহাতাব রশীদ

আমার সহকর্মী সারোয়ার আলম একদিন অফিসের ক্যানটিনে আমার পাশে বসে খানিকটা আমতা-আমতা করে জানতে চাইলেন, পরদিন সোমবার সন্ধ্যার পর আমার বিশেষ কোনো কাজ আছে কি না। আমি যখন বললাম যে আমার কোনো কাজ নেই, আমি ফ্রি, তখন তিনি তাঁর বাসায় যেতে বললেন। জন্মদিনের দাওয়াত। কার জন্মদিন?

অর্জুনবাবার।

অর্জুনবাবা নামটা বিদঘুটে হলেও এ নাম আমার কাছে অপরিচিত নয়। সারোয়ার আলম আমার কাছে নানা সময়ে অর্জুনবাবার গল্প করেছেন।

অর্জুনবাবা একটা কাপড়ের পুতুল। তিন বছর ধরে এটা সারোয়ার আলমদের বাসায় আছে। গল্প শুনে বুঝেছি, পুতুলটা নিয়ে এই পরিবারে কিছু পরিমাণে বাড়াবাড়ি আছে। পুতুলটার সঙ্গে তাঁরা এমন আচরণ করেন, যেন ওটা তাঁদের পরিবারের সদস্য। বিশেষ করে সারোয়ার আলমের ক্লাস থ্রি পড়ুয়া মেয়ে রোকসানা সারাক্ষণই পুতুলটাকে নিয়ে পড়ে থাকে। ওটা বাসায় আসার পরে সে বাকি সব পুতুলকে বিদায় করে দিয়েছে। এখন তার একটাই খেলার পুতুল। সেটাকে সে খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায়, এমনকি প্রতিদিন একবার করে শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করায়। পরিবারের বাকিরা এসবে শুধু যে সায় দেন তা-ই নয়, তাঁরা নিজেরাও এটায় যোগ দেন। পুরো পরিবারটাই যেন পুতুল খেলায় মেতে উঠেছে। সারোয়ার সাহেবরা রেস্টুরেন্টে খেতে বসলে পুতুলটার জন্য একটা বাড়তি চেয়ার রাখেন। ট্রেনে করে বেড়াতে গেলে পুতুলটার জন্যও একটা টিকিট কাটা হয়। সেই বাড়তি আসনে পুতুলটাকে বসানো হয়। না হলে পুতুলটা নাকি মন খারাপ করবে।

এমনিতেই আমি বাচ্চাদের জন্মদিনের নিমন্ত্রণ এড়িয়ে চলি, তাও আবার এই আদিখ্যেতার পুতুল। যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। আমি না করে দিলাম।

তখন সারোয়ার সাহেব এমন একটা কাজ করলেন, যেটার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি আমার হাত চেপে ধরে বললেন, প্লিজ আসুন। আপনাকে একটা জিনিস দেখাব। একটু পরামর্শও দরকার।

আমি অবাক হয়ে সারোয়ার সাহেবের দিকে তাকালাম। তাঁর চোখে এমন একটা উদ্ভ্রান্ত আকুতি, যেটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। আমি নিমরাজি হয়ে কথা দিলাম, যাব।

পুতুলের জন্মদিনে কী উপহার নেওয়া যায়? অনেক ভেবেও কিছু না পেয়ে একটা বিদেশি চকলেটের প্যাকেট নিয়ে রওনা দিলাম।

সারোয়ার সাহেবদের বাসাটা ইত্তেফাক অফিসের পেছনে স্বামীবাগ এলাকায় চিপা গলির মধ্যে। আগে কখনো যাইনি। একে-ওকে জিজ্ঞাসা করে তাঁদের ছয়তলা বাড়িটা খুঁজে বের করতে হলো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সংকীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে ছয়তলায় বাসা। তবে দরজা দিয়ে ঢুকে দেখি বাসাটা বড়। ঘরগুলো প্রশস্ত। পুরোনো আমলের বাড়িগুলোর যা বৈশিষ্ট্য।

বাসায় জন্মদিনের অনুষ্ঠান জমে গেছে। একগাদা বাচ্চাকাচ্চা তো আছেই, সেই সঙ্গে কয়েকজন পূর্ণবয়স্ক লোকও দাওয়াতে এসেছেন।

সারোয়ার আলম সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বাচ্চাগুলো সব এই ভবনেরই অন্যান্য ফ্ল্যাটের। একটা বাচ্চা রোকসানার স্কুলের সহপাঠী। তারা সবাই এই ঘর-ওই ঘর দৌড়াদৌড়ি করছে, বেলুন ফোলাচ্ছে। ভেঁপু বাজাচ্ছে।

একটু পরেই কেক কাটার সময় হয়ে গেল। বাচ্চারা জড়ো হলো টেবিলের সামনে। বড়সড় একটা ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক। তিনটা মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। তৃতীয় জন্মদিন। যার জন্মদিন উপলক্ষে এই আয়োজন, সেই অর্জুনবাবাকে এবার দেখতে পেলাম। রোকসানা তাকে কোলে নিয়ে কেকের সামনে দাঁড়িয়েছে।

বহুবার গল্প শুনেছি, এই প্রথম দেখলাম পুতুলটাকে। একটু অদ্ভুত ধরনের। এক হাত সমান হবে লম্বায়। একটা পুরুষ চরিত্র। ধুতি আর কুর্তা পরা। সুতা দিয়ে বানানো কালো কুচকুচে চুলগুলো পরিপাটি করে পেছনে আঁচড়ানো। নাকের নিচে একটা চিকন বাঁকানো মোচও আছে। এই প্রথম আমি মোচওয়ালা কোনো পুতুল দেখলাম। ফোম আর কাপড় দিয়ে বানানো দেশি পুতুল। হাত-পাগুলো ফোলা ফোলা। ততটা নিখুঁত নয় বিদেশি পুতুলগুলোর মতো। কেমন একটা মফস্বলী অপরিপক্ব ধাঁচ আছে। এ রকম পুতুল আগে কখনো দেখিনি।

রোকসানা পুতুলের মুখটা মোমবাতির কাছে নিয়ে গিয়ে নিজে এমন কায়দা করে ফুঁ দিয়ে শিখা নেভাল যেন পুতুলটাই ফুঁ দিচ্ছে। তারপর পুতুলটাকে দিয়ে কেকও কাটাল সেভাবে। আমরা সবাই হাততালি দিলাম। সমবেত স্বরে গান গাইলাম, ‘হ্যাপি বার্থডে টু অর্জুনবাবা’।

কেক কাটা শেষ হতেই বাচ্চারা আবার ছুটোছুটি শুরু করে দিল। আমরা বড়রা সোফায় বসে নানা রকম গল্পে মেতে উঠলাম। একসময় রাতের খাবার পালাও শেষ হলে আমি ওঠার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। তখন সারোয়ার সাহেব আরেকবার হাত চেপে ধরে বললেন, আরেকটু থেকে যান। প্লিজ।

আমি থেকে গেলাম।

অতিথিরা বিদায় নিলে সারোয়ার সাহেব আমাকে তাঁর শোয়ার ঘরে নিয়ে গেলেন। দরজা বন্ধ করে দিলেন। তাঁর হাতে দেখি সেই পুতুলটা ধরা। অর্জুনবাবা।

আমি বললাম, ব্যাপার কী?

সারোয়ার সাহেব বললেন, পুতুলটার ব্যাপারে আপনার একটা পরামর্শ দরকার। এটা কোথায় পেয়েছি সেটা একটু বলি। কলকাতায় গিয়েছিলাম তিন বছর আগে। সেবার ভিসা সহজ করল। সবাই ঈদের বাজার করতে যাচ্ছে। আমরাও সপরিবারে গেলাম। নিউমার্কেটের কাছেই সদর স্ট্রিটে একটা হোটেলে উঠলাম। কলকাতা চিনি না। তাই সারা দিন নিউমার্কেটের আশপাশেই ঘোরাফেরা করি। ফিরে আসার আগের দিন গ্র্যান্ডের নিচে বারান্দায় হকারের একটা ডালিতে দেখি কিছু কাপড়ের পুতুল রাখা। তার মধ্যে রোকসানার এই পুতুলটা পছন্দ হয়ে গেল। অন্য সব পুতুলের অনেকগুলো করে কপি ছিল। কিন্তু এইটা একটাই। বুড়ো হকারকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা কী পুতুল এটা? বলল, অর্জুনবাবা। কিনে ফেললাম। দেড় শ রুপি। সেই থেকে পুতুলটা আমাদের বাসায়। আমাদের সঙ্গে থাকছে। ওকে নিয়ে আমরা যে একটু বাড়াবাড়ি করি, সেটা বুঝতে পারি। কিন্তু এসব করতে ভালোই লাগে। একটা ফান। ফানটা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি অনেক দিন ধরে।

তো?

গত সপ্তাহে একটা ঘটনা ঘটল। রোকসানার একটা কাজিন আছে। নাম ফাহিম। ওর সমবয়সী। ধানমন্ডিতে থাকে। মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। ভয়ানক দুষ্টু। একটু হাইপার ধরনের। অস্থির। এটা ভাঙছে। ওটা ফেলছে। সোফার ওপর দাঁড়িয়ে লাফাচ্ছে। বিছানায় ডিগবাজি দিচ্ছে। বালিশের তুলো বের করে ফেলছে। ও এলে রোকসানা পুতুলটা লুকিয়ে রাখে। কেননা ফাহিম পুতুলটাকে নানা রকম শাস্তি দেয়। গত সপ্তাহে হয়েছে কী, ফাহিম বেড়াতে এল। রোকসানা তখন স্কুলে। স্কুল থেকে ফিরে যেই শুনেছে ফাহিম এসেছে, ও সবার আগে অর্জুনবাবার খোঁজ করল। দেখে কোথাও নেই পুতুলটা। ফাহিমকে জিজ্ঞেস করল। ফাহিম আবেগহীন গলায় বলল, অর্জুনবাবাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। সর্বনাশ! কোথায়? ছাদে। রোকসানা পড়িমরি ছুটল ছাদে। গিয়ে দেখে, ফাহিম সত্যি সত্যি ভয়ানক ওই কাণ্ডটা করেছে। সে একটা দড়ি দিয়ে ফাঁস বানিয়ে অর্জুনবাবাকে ছাদের রেলিংয়ের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখেছে। দড়ির ফাঁসটা শক্ত করে বসে গেছে পুতুলটার গলায়। রোকসানা তাড়াতাড়ি পুতুলটাকে ছাড়িয়ে আনে। ফাঁস খুলে দেয়। রাতে আমি বাসায় ফিরলে কাঁদতে কাঁদতে ও আমাকে বলেছে ঘটনাটা। আমি বলেছি, ফাহিমকে আমি বকা দিয়ে দেব। আর কখনো এ রকম করবে না। তারপর ব্যাপারটা একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিলাম। দুই দিন আগে একটা ব্যাপার লক্ষ করে একটু অবাক হয়ে গেলাম।

কী সেটা?

সারোয়ার সাহেব পুতুলটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, ভালো করে দেখুন তো পুতুলটা, কিছু বুঝতে পারেন কি না।

আমি ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখলাম। তেমন কিছুই চোখে পড়ল না। ফুটপাতের পুতুল। ভেতরটায় সস্তা ফোম ভরা। ফোমের ওপরের আবরণ ধূসর। এখন পুরোনো হওয়ায় ময়লা পড়ে কিছুটা কালচে হয়ে গেছে। ধুতিটায় জরির কাজ। পায়ে নাগরা জুতা।

বললাম, কিছু তো বুঝতে পারলাম না।

পুতুলের গলাটা লক্ষ করুন।

আমি লক্ষ করলাম। তখন চোখে পড়ল একটা লালচে বৃত্তাকার দাগ পুতুলের গলায়। আঁটসাঁট করে বসানো একটা মালার মতো সেটা বসে আছে গলায়। খুব স্পষ্ট না। হালকা দাগটা।

হুম। একটা দাগ দেখছি।

আমি গত পরশু প্রথম দেখেছি দাগটা। রোকসানাকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল, ওই দিন ছাদের ঘটনার পর থেকেই নাকি সে দাগটা দেখছে। আমাদের বলেনি।

আমি তাকালাম সারোয়ার সাহেবের দিকে। তাঁর চোখে কেমন একটা অসহায় চাহনি।

বললাম, কলম-টলমের দাগ হবে হয়তো।

না। কলমের দাগ নয়। সাবান দিয়ে ঘষে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। ওঠেনি। এটা কোনো রঙের দাগ নয়। ভালো করে দেখুন।

আমি হাত বুলিয়ে দেখলাম। কাপড় পুড়ে গেলে যেমন দাগ বসে সে রকম দাগ। বললাম, দড়িটা যদি নাইলনের হয়, সে ক্ষেত্রে কাপড়ের সঙ্গে সেটার কোনো কেমিক্যাল রি-অ্যাকশন হয়ে থাকবে।

হ্যাঁ, একটা কোনো ব্যাখ্যা তো থাকতেই হবে। কিন্তু কী জানেন, এই ঘটনার পর থেকে আমি আর আমার স্ত্রী একধরনের অস্বস্তিতে ভুগছি। কিসের অস্বস্তি ঠিক বোঝাতে পারব না। কিন্তু কেমন একটা ব্যাপার যেন। কী করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। এখন পুতুলটার দিকে তাকালে ওই দাগটায় চোখ যায়। গা ছমছম করে।

পুতুলটা আমার হাতে ধরা ছিল। মুখটা আমার দিকে ঘোরানো। একবার মনে হলো, তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি সেটাকে পাশে বিছানার ধারে পা ঝুলিয়ে বসিয়ে দিলাম। দিব্যি বসে আছে।

আমার এখন কী করা উচিত বলুন তো? আমার দেখা সবচেয়ে যুক্তিবাদী লোক আপনি। তাই আপনাকে ডেকে আনা।

বললাম, কী আর করবেন, খুব অস্বস্তি হলে ফেলে দিন। বিদায় করে দিন।

ওখানেই তো মুশকিলটা। ফেলে দিলে রোকসানাকে সামলানো কঠিন হয়ে যাবে। ও ভীষণ শক পাবে। দিনরাত ও এটাকে নিয়ে আছে।

আমি দেওয়ার মতো তেমন কোনো পরামর্শ খুঁজে পেলাম না।

আমরা আরও কিছুক্ষণ ওভাবে গল্প করলাম। আমরা মানে আমরা তিনজন—আমি, সারোয়ার সাহেব এবং বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে থাকা সেই পুতুলটা।

তারপর আমি বিদায় নিলাম।

অলংকরণ: মাহাতাব রশীদ

ফিরতি পথে ফ্লাইওভারে জ্যামের মধ্যে বসে বঙ্গভবনের ফ্লাডলাইটগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা ব্যাপার মনে হলো। সারোয়ার সাহেব আসলে ঠিক পরামর্শ নেওয়ার জন্য ডাকেননি আমাকে। উনি আসলে পুতুলের ঘটনা কাউকে বলার সুযোগ খুঁজছিলেন। হয়তো আরও অনেককে বলেছেন। বলার মতো একটা মুখরোচক কাহিনি পেয়েছেন তিনি। সেটাকে যতটা পারা যায় নাটকীয় ভঙ্গিতে পরিবেশনের চেষ্টা। আর এই যে তাঁর চোখেমুখে একটা ভয়ের ছায়া, ওটায় কোনো খাদ নেই বটে, তবে ভয় পেতেই হয়তো তাঁর ভালো লাগছে। একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি।

পরের কয়েকটা দিন পুতুলটার কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করলাম। পুরো ব্যাপারটাকে বিরাট একটা ঠাট্টা বলে মনে হলো। অফিসে সারোয়ার সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। কিন্তু পুতুলের প্রসঙ্গ আমরা কেউ তুলি না। তবে যতই ভুলে থাকার চেষ্টা করি না কেন, আমার মাথার ভেতরে অর্জুনবাবা নামটা ঘুরতে থাকল। কোথা থেকে এল এই নাম? মহাভারতে অর্জুন নামে একটা চরিত্র আছে। পঞ্চপাণ্ডবের এক পাণ্ডব। তির চালাতে পারদর্শী। কিন্তু সেই অর্জুনের সঙ্গে এটার যে কোনো সম্পর্ক নেই, এটা স্পষ্ট। অর্জুনবাবা কি তাহলে কোনো কমিকস হিরো? অনেক পুতুল কমিকস হিরোর আদলে বানানো হয়ে থাকে। কলকাতার এক বন্ধুকে ফোন দিলাম। অর্জুনবাবা নামে কোনো কমিকস ক্যারেক্টার আছে কি না। সে বলল, খোঁজ করে জানাবে। কিন্তু সেও ভুলে গেল, আর আমিও লেগে থাকলাম না।

মাসখানেক পর একদিন মাঝরাতের দিকে সারোয়ার সাহেব আমাকে ফোন করলেন। বেপরোয়া কণ্ঠস্বর। বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে আদনান সাহেব!

কী হয়েছে?

ওই পুতুলটা...

হ্যাঁ, পুতুলটা?

আমি আপনার কাছে আসছি। আপনার সাহায্য দরকার আমার।

কী হয়েছে বলবেন তো!

আমি আসছি।

সারোয়ার সাহেব ফোন রেখে দিলেন। আমি অস্বস্তি নিয়ে বসে থাকলাম।

আধা ঘণ্টা পর বাইরে স্কুটার থামার শব্দ। আমি দরজা খুলে দিলে বসার ঘরে যে লোকটা ঢুকলেন, তাঁকে শুরুতে সারোয়ার আলম বলে চিনতে কষ্ট হলো। আলুথালু, বিধ্বস্ত চেহারা। চুল উষ্কখুষ্ক। ঢুকেই ধপ করে সোফায় শরীর ছেড়ে দিলেন।

দুপুর থেকে ঢাকা মেডিকেলে ছিলাম। সরাসরি সেখান থেকে আসছি।

কেন কী হয়েছে?

ফাহিম। রোকসানার কাজিন। স্কাল ফ্র্যাকচার। কলার বোন ভেঙে গেছে। পাঁজর আর পায়েও কয়েক দফা ফ্র্যাকচার। তাকানো যায় না ছেলেটার দিকে।

হয়েছে কী?

ছাদ থেকে পড়ে গেছে। আজ দুপুরে।

একটু ভেঙে বলুন।

ফাহিম আজ এসেছিল বেড়াতে। রোকসানা তখন ছাদে। খেলছিল অর্জুনবাবাকে নিয়ে। ফাহিম ছাদে চলে যায়। তারা দুজন খেলছিল ছাদে। রোকসানা কী একটা কাজে নিচে নামে। ওর মা ডেকেছিল সম্ভবত। ছাদের নিচেই ছয়তলায় আমাদের ফ্ল্যাট। অল্পক্ষণের জন্য নেমেছিল।

অর্জুনবাবা কি ছাদেই থেকে গিয়েছিল?

হ্যাঁ। অর্জুনবাবা ও ফাহিম। পুতুলটা তখন ফাহিমের হাতে ধরা। রোকসানা মিনিট পনেরো ছিল বাসায়। আবার ছাদে গিয়ে দেখে ফাহিম নেই। পুতুলটা রেলিংয়ের এক ধারে পড়ে আছে। আমরা কেউ কোনো পতনের শব্দ পাইনি। ড্রেনের মধ্যে পড়েছিল ছেলেটা। নিচে লোকজন ধরাধরি করে বাসায় আনে।

কী বীভৎস! বাঁচবে তো?

বুঝতে পারছি না। ইন্টারনাল হেমারেজ আছে। ডাক্তাররা বলছেন, ২৪ ঘণ্টা অবজার্ভ করবেন। এই সময়টা খুব ক্রিটিক্যাল। একটা জিনিস কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারছি না, জানেন?

কী সেটা?

ছাদের রেলিং মোটেই নিচু নয়। আমাদের পূর্ণবয়স্ক লোকজনের কোমরসমান। ফাহিম যখন পড়ে যায়, ছাদে তখন ও আর অর্জুনবাবা ছাড়া আর কেউ ছিল না।

আমি তাকালাম সারোয়ার সাহেবের দিকে। তিনিও তাকিয়ে আছেন। চোখে অসহায় দৃষ্টি।

আমি এখন কী করব বলে দিন। একটা কোনো পরামর্শ দিন।

ওটা এখন কোথায়?

আমার সঙ্গে।

এই প্রথম লক্ষ করলাম, সারোয়ার সাহেবের পাশে একটা পেপারে মোড়ানো প্যাকেট। বুঝলাম, ওটার মধ্যেই পুতুলটাকে পেঁচিয়ে এনেছেন তিনি।

কী করতে হবে যেন আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছি। বললাম, আসুন আমার সঙ্গে।

যন্ত্রচালিতের মতো কাজ করলাম আমরা। বাসা থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিলাম। মাঝরাতে রাস্তাঘাট ফাঁকা। গোঁ গোঁ শব্দ তুলে ট্রাক ছুটছে। অল্পক্ষণেই পৌঁছে গেলাম ধানমন্ডি লেকের ধারে। রিকশা থেকে নেমে পানির কাছে চলে গেলাম আমরা দুজন।

পুতুলটা দিন, আমি বললাম।

পেপারে মোড়ানো প্যাকেটটা আমার হাতে দিলেন সারোয়ার সাহেব। বাসা থেকে একখণ্ড দড়ি এনেছিলাম। একটা ভারী ইটের টুকরার সঙ্গে বাঁধলাম প্যাকেটটা। তারপর ছুড়ে দিলাম লেকের মাঝখানে।

ঢুপ করে একটা শব্দ হলো। লেকের নিস্তরঙ্গ পানিতে ছোট ছোট ঢেউ উঠল। স্ট্রিট লাইটের আলোয় দেখলাম ডুবে যাচ্ছে প্যাকেটটা।

লেকের ধারে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম আমরা। ঝিরঝির করে বাতাস দিচ্ছে। শিরীষগাছের পাতা ঝরে পড়ছে পায়ের কাছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দারুণ মেঘ করেছে। ভারী বৃষ্টি নামবে। আমরা রওনা দিলাম।

এর একদিন বাদে সকালবেলা চায়ের কাপ হাতে পেপার খুলে বসেছি। তিন-এর পাতায় একটা ছোট্ট নিউজে চোখ আটকে গেল। এই নিউজটাই খুঁজছিলাম আমি যেন। সকালবেলা ধানমন্ডি লেকের পানিতে একটা শিশুর লাশ ভেসে থাকতে দেখে জগাররা পুলিশে খবর দিয়েছে। পুলিশ এসে লাশ পানি থেকে তোলে। ছেলেটার বয়স এগারো-বারো হবে। রায়ের বাজারের দিকে বস্তিতে থাকে। কাকডাকা ভোরে ওরা বস্তির ছেলেপেলেরা লেকের ধারে শানবাঁধানো চত্বরে ফুটবল খেলছিল। বন্ধুদের রেখে ছেলেটা লেকের পানিতে সাঁতার দিতে নামে। সে যে কখন ডুবে গেছে কেউ লক্ষ করেনি।

পেপারে লিখেছে, ছেলেটার ডুবে যাওয়াটা অস্বাভাবিক। কেননা বন্ধুরা বলেছে, সে ভালো সাঁতার জানত।

খবরে ছেলেটার ডুবে যাওয়ার জায়গাটা লক্ষ করলাম। তারপর পেপার নামিয়ে রেখে চা-টা শেষ করলাম এবং ধীরেসুস্থে কাপড় পাল্টে রাস্তায় নেমে এলাম। আজ আর অফিস যাওয়া হবে না। রাস্তায় জ্যাম। হেঁটে রওনা দিলাম ধানমন্ডি লেকের দিকে।

লেকের যে জায়গাটায় রাতের বেলা আমরা এসে দাঁড়িয়েছিলাম, সেটার উল্টো পারে গিয়ে দাঁড়ালাম।

রাতে ভীষণ বৃষ্টি হয়েছে। লেকের পাড়ে প্যাচপেচে কাদা। সেই কাদায় আমি যে জিনিসটা খুঁজছি, সেটা পেতে বেশি সময় লাগল না।

ছোট ছোট পায়ের ছাপ। ইঞ্চি দেড়েক লম্বা হবে। নাগরা জুতার।

লেক থেকে উঠে ছাপগুলো পাড়ের ঘাসের চত্বরে মিশে গেছে।