অর্পির তিনটি ইচ্ছা

অলংকরণ: মামুন হোসাইন

জাহিদের অফিস সকাল দশটায়। মেয়েকে স্কুলে দিয়ে যান বলে আগে বের হন। মেয়ের নাম অর্পিতা। অর্পি বলে ডাকে সবাই।

এবার প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে অর্পি। এ জন্য আগের চেয়ে আরও সকালে উঠতে হয় জাহিদকে। মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। সাড়ে ছয়টা বাজলেই কুককুরু-কুক মোরগের ডাক শুরু হয়। একটানা বেজেই চলে।

এ সময় বিচ্ছিরি একটা অনুভূতি নিয়ে ঘুম ভাঙে জাহিদের। হাই তুলে এপাশ-ওপাশ করেন। উঠতে ইচ্ছা করে না। অর্পির মা সালমা এসে নারকেল ঝাঁকুনি দেন কাঁধে। তাড়া দেন, ‘ওঠো ওঠো, মেয়ের স্কুলে দেরি হয়ে যাবে!’

মনে মনে ‘হেঁইয়ো’ বলে উঠে পড়েন জাহিদ। ওদিকে উষ্কখুষ্ক চুলে শরীর মোচড়ায় অর্পি। চেহারাটা পাঁচ বানিয়ে বলে, ‘আজ স্কুলে যাব না, মা!’

সালমা আঁতকে উঠে বলেন, ‘কী অলক্ষুণে কথা গো! তোমাকে ভর্তি করাতে কত গেছে জানো না? গত মাসে আমরা কী কষ্ট করলাম, দেখোনি!’

অর্পি বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে, ‘যাচ্ছি বাবা, যাচ্ছি। এক স্কুল নিয়ে কত কথা! আমি কি ভত্তি করাতে বলেছিলাম! ভত্তি না হলেই তো ভালো হতো।’

কাল রাতে বার্সেলোনার খেলা ছিল। জাহিদের ছেলে অয়ন মেসির ভক্ত। ভক্ত তিনিও। বাপ-বেটা মিলে খেলা দেখে অনেক রাতে ঘুমিয়েছেন। ভোরে আবার উঠতে হয়েছে। এখন অর্পিকে নিয়ে যাচ্ছেন স্কুলে। রিকশায় বিশ মিনিট লাগে। অর্পিকে ডান হাতে আঁকড়ে আছেন। বাঁ হাতে নিজের ব্যাগ। দুপুরের ভাত-মাছ তাতে।

রিকশাওয়ালা কষে প্যাডেল মারছে। শাঁ শাঁ করে ছুটছে রিকশা। সকালে ফাঁকা রাস্তায় এরা রাজা। ঘণ্টা দুয়েক পর অবশ্য এ তেজ থাকবে না। তখন ফুটপাতের কোনো দোকানে পাউরুটি আর চা নিয়ে বসে যাবে। কোথাও যেতে বললে কঠিন স্বরে বলবে, ‘যাইতাম না।’

জাহিদেরও এখন কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। ঘুমের ভাব কাটেনি। চোখ দুটো বারবার বুজে আসছে। রাতে তিনটা পর্যন্ত জেগে খেলাটা না দেখলেই হতো।

‘তুমি কি ঘুমাচ্ছ, বাবা?’

মেয়ের কথায় চমকে ওঠেন জাহিদ। তাঁর মনে হলো পড়ে যাচ্ছে অর্পি। দুহাতে আঁকড়ে ধরেন ওকে। বাঁ হাতের ব্যাগটার কথা মনেই রইল না। ঠকাস করে ব্যাগটা পড়ল রাস্তায়। অমনি এক মুড়ির টিন মিনিবাস ওটাকে মাড়িয়ে চ্যাপ্টা করে দিয়ে চলে গেল।

রিকশাওয়ালা আস্তে ব্রেক কষল। পথচারী অনেকেই মজা পাচ্ছে ব্যাগটা দেখে। লাঠি ভর করে যেতে থাকা এক বৃদ্ধা বলল, ‘আহা-হা, কার ব্যাগ গো ওইডা!’

বাপ-মেয়ের দিকে তাকিয়ে রিকশাওয়ালাও যেন হাসি লুকানোর চেষ্টা করল। বলল, ‘ব্যাগডা কি আনমু, স্যার?’

কিন্তু নড়ার নাম নেই রিকশাওয়ালার। জানে কী জবাব আসবে। ইশারায় রিকশা চালিয়ে যেতে বলেন জাহিদ। কাঁদো কাঁদো চেহারা হয়েছে অর্পির। ব্যাকুলভাবে বলে, ‘তুমি আজ কী খাবে, বাবা? তোমার ব্যাগটা তো পড়ে গেল!’

‘ভেবো না, মা, খেয়ে নেব।’

‘আমার কলাটা দিয়ে দিই, বাবা? ডিমটা নিয়ে যাও।’

চোখ ভিজে ওঠে জাহিদের। কষ্ট ভোলানোর জন্য বলেন, ‘ক্লাসে কিন্তু দুষ্টুমি করবে না, মা। ঠিক আছে?’

মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় অর্পি।

‘টিচারদের কথা মন দিয়ে শুনবে, কেমন?’

একই ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে ও।

‘কেউ ভালো টিফিন আনলে তাকাবে না।’

এবার গাল ফোলায় অর্পি। ঘাড় বাঁকিয়ে বলে, ‘এ কথা আগেও বলেছ, বাবা। এক কথা কতবার বলবে!’

‘সরি, মা। ভুল হয়ে গেছে।’

অর্পি সেই আগের কথায়ই ফিরে আসে। বলে, ‘তুমি আজ দুপুরে কী খাবে, বাবা? বলো না।’

জাহিদ হালকা সুরে বলেন, ‘অনেক কিছু খাব। এই ধরো—পোলাও খাব, কাচ্চি খাব। ফিরনি খাব।’

অর্পি হি-হি হাসে। বাবা মজা করছেন না সত্যি খাবেন, বুঝতে পারে না। তবু বলে, ‘খেয়ো কিন্তু, না খেয়ে থাকবে না।’

‘একদম খেয়ে নেব। কিচ্ছু ভাবতে হবে না।’

অর্পি মুখ টিপে হেসে বলে, ‘আমার জন্য একটা নলি নিয়ে এসো। ভেতরে যেন মজ্জা থাকে।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, পকেটে করে নিয়ে আসব।’

আবার হি-হি শোনা যায় অর্পির।

রিকশা এসে থামে স্কুলের ফটকে। মুখোমুখি নতুন এক এলিয়েন গাড়িও এসে থামে সেখানে। গাড়ি থেকে নামে রুদাপা। অর্পির ক্লাসে পড়ে। সঙ্গে রুদাপার বাবা। সুট-কোট পরা ভদ্রলোক। অনেক লম্বা—ছয় ফুটের মত।

জাহিদের দিকে হাত বাড়ান রুদাপার বাবা রুম্মান। হেসে বলেন, ‘আরে, জাহিদ সাহেব যে! ভালো তো?’

জাহিদও হেসে হাত মেলান, ‘জি, ভালো।’

এই সৌজন্যে আন্তরিকতা খুঁজে পান না জাহিদ। সাহেব আবার কী! সমবয়সী একজনকে ভাই বলতে বাধে? তিনি কি রুম্মানের অফিসের লোক?

অফিসে পৌঁছাতে আজ একটু দেরি হয়ে গেল জাহিদের। একজন ভিআইপির জন্য রাস্তা আটকে রাখা হয়েছিল। পাশের টেবিলের হারুন টিপ্পনী কেটে বলেন, ‘আজও কি জ্যামে পড়েছিলেন?’

হারুন পদমর্যাদায় জাহিদের সমান। ভাব দেখান ঘাড়ে চড়ে বসা কর্তার মতো। জাহিদ ঝামেলা এড়াতে চান বলে সুযোগটা তিনি পুরোমাত্রায় নেন।

হারুনের কথার কোনো জবাব দিলেন না জাহিদ। মানুষের পিছে লেগে থাকা এই লোকের স্বভাব। শুরু থেকেই জাহিদের সঙ্গে তাঁর বনিবনা নেই। কাউকে খোঁচা না মারলে তাঁর পেটের ভাত হজম হয় না।

জাহিদ হিসাব করে দেখেন মাসের আজ ১৫ তারিখ। প্রতি মাসে এ সময় থেকে তাঁর দুঃসময় শুরু। টাকায় টান ধরে, দুর্গতিও কান ধরে। দেখা যাবে, ঘরের এনার্জি বাল্ব কেটে গেছে, রান্নাঘরে পানির কল বিকল হয়েছে। আজ যেমন খাবার আর কিছু দরকারি জিনিসসহ ব্যাগটা গেল। দুপুরে খেতে গেলেও তো বেহুদা কিছু টাকা যাবে। এক-দেড় শ টাকার নিচে খাওয়া যায়?

শিগগিরই বসের রুমে ডাক পড়ে জাহিদের। বস উত্তেজিত গলায় বলেন, ‘কালকে যে গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটা দিলাম, ওটা কই? হিসাবটা ঠিকমতো মিলিয়েছেন?’

বোঁ করে মাথা চক্কর দেয় জাহিদের। আরে, ওটা তো ব্যাগে ছিল। বাসায় নিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে সব ঠিক করে রেখেছেন। ইশ্, ফাইলের কথা মনে নেই। এখন উপায়?

বস তাড়া দেন, ‘হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? যান, জলদি ওটা নিয়ে আসুন।’

জাহিদ বলেন, ‘স্যার, ওটা ব্যাগের মধ্যে ছিল...’

‘ছিল মানে!’ আঁতকে ওঠেন বস।

‘ব্যাগটা হঠাৎ রাস্তায় পড়ে গেল। একটা বাস...’

‘উহ্, রাবিশ! এত কথা আমি শুনতে চাই না। ওই ফাইলটা চাই। এক্ষুনি! যান, নিয়ে আসুন।’

ঝোড়ো বেগে বেরিয়ে যান জাহিদ। হারুন চোরা চোখে মুখ টিপে হাসছেন। পরোয়া না করে বেরিয়ে যান জাহিদ। স্কুটারে ছুটে চলেন ব্যাগের খোঁজে।

নাহ্, ব্যাগটা সেখানে নেই। এতক্ষণে হয়তো কোনো পথশিশুর সম্পত্তি হয়ে গেছে ওটা। কান ঝাঁ ঝাঁ করে জাহিদের। পায়ের তলায় মাটি যেন দুভাগ হয়ে যাচ্ছে।

বসের মোবাইল থেকে কল আসে। ঝাঁজাল কণ্ঠ বলেন, ‘আপনি কোথায়? ফাইল কই? ওরা এসে গেছে!’

জাহিদ পটাপট কয়েকটা ঢোঁক গিলে বলেন, ‘ফাইলটা মিসিং, স্যার! হারিয়ে ফেলেছি!’

বাঘের মতো গর্জে বস বলেন, ‘মগের মুল্লুক পেয়েছেন! ফাইল হারিয়েছেন তো চাকরিও হারিয়েছেন। আপনার মুখ যেন আর না দেখি।’

জাহিদের মনে হলো, পায়ের নিচে দুভাগ হওয়া মাটিতে বিশাল এক খাদ। সেই খাদের ভেতর সজোরে পতন হচ্ছে তাঁর। চাকরি না থাকলে তাঁর সংসার চলবে কী করে? স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে খাওয়াবেন কী?

দুই

অর্পির স্কুল ছুটি ১১টায়। মা নিয়ে যান। তিনি অবশ্য আগেই চলে আসেন। এর মধ্যে অর্পির বন্ধু রাইসা, সূচি, ভূষণের মায়ের সঙ্গে বেশ খাতির হয়ে গেছে। কয়েকজন অবশ্য দূরেই থাকেন। যেমন রুদাপার মা। কারও দিকে তাকান না। মিল মালিক কিনা, তাই এমন ভাব।

অর্পি এসব কিছুটা বুঝতে পারে। রুদাপাদের নিয়ে ওদের সাদা এলিয়েন গাড়িটা যখন ভিনগ্রহের যানের মতো চলে যেতে থাকে, সেদিকে তাকিয়ে অর্পি মাকে বলে, ‘আমাদের এমন গাড়ি থাকলে বেশ হতো, না, মা?’

মা বলেন, ‘গাড়ির দরকার নেই। রাইসা, সূচি, ভূষণ—ওদের যে গাড়ি নেই, ওরা কি চলছে না?’

অর্পির মাকে ডেকে নেন ইংরেজির লীলা মিস। বলেন, ‘আপনার মেয়ের দিকে একটু খেয়াল দেবেন। ক্লাসে প্রায়ই উদাস থাকে ও। কী যেন ভাবে। বলে ফিক করে হেসে ফেলেন মিস। বলেন, ‘আজ কী হয়েছে, জানেন? ক্লাসের সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি—বড় হয়ে কে কী হতে চায়। ও বলেছে বড় হয়ে জলপরি হবে।’

আরেক দফা হাসি। অর্পির মা-ও এতে যোগ দেন। বলেন, ‘ও আছে ওর কল্পনার জগতে।’

মিস বলেন, ‘বড় হয়ে আপনার মেয়ে কবি হবে। তা হোক, কিন্তু পড়ায় মন না দিলে তো হবে না। জানেন তো, এখানে নিয়ম খুব কড়া। পরে অসুবিধা হবে।’

রিকশায় অর্পিকে বকুনি লাগান মা। মেয়েটাকে ভর্তি করানোর পর থেকে এই যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। পড়ায় একদম মন দিতে চায় না। ওর বন্ধুরা কত সুন্দর ছবি আঁঁকে। আর ও আঁকে কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং। সেদিন আর্টের শিক্ষিকাও এভাবে ডেকে নিয়েছিলেন।

অর্পিকে মা বলেন, ‘আজ থেকে যদি পড়ায় মন না দিস, একেবারে আস্ত রাখব না।’

অর্পির এমন ভাব যেন মায়ের কথা শোনেনি। একটু চুপ থেকে বলে, ‘বাবাকে গাড়ি কিনতে বলো তো, মা।’

‘তুই বলিস।’

‘আচ্ছা।’

অর্পি যখন বাবাকে দিয়ে গাড়ি কেনানোর কথা ভাবছে, তিনি তখন রায়েরবাজারে আফতাব কোচিং সেন্টারে বসে কুলু কুলু ঘামছেন। এসি আছে, তবু তিনি ঘামছেন। বাইরে নয়, ভেতরে ঘাম ঝরছে তাঁর। চাকরিটা তো গেল। এখন ছেলেমেয়ে নিয়ে চলবে কী করে—এই ভাবনায় তিনি অস্থির।

জাহিদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু আফতাব। এখন এক কলেজে পড়ান। পাশাপাশি এই কোচিং সেন্টার খুলেছেন। ঢাকা শহরে জাহিদের জন্য বিপদে পাশে পাওয়ার মতো লোক এই একজনই।

আফতাব ক্লাস নিচ্ছেন। জাহিদকে অপেক্ষা করতে বলেছেন। তাঁর অপেক্ষায় আছেন তিনি। আফতাবের ছোট ভাই এখন কোচিংয়ের দায়িত্বে। সে কোল্ড ড্রিংক রেখে গেছে জাহিদের জন্য। কিন্তু গলা দিয়ে নামছে না।

রিংটোন বাজছে মোবাইল ফোনের। এবারও বোধ হয় হারুন। এর মধ্যে তিনবার ফোন করেছে সে। জাহিদ ধরেননি। জানেন, জ্ঞান দেবেন, নয়তো খোঁচা। তাঁর দুঃসময়ে এ সুযোগ হাতছাড়া করবেন না তিনি।

কিন্তু রিংটোন বেজেই চলে। পকেট থেকে মুঠোফোন বের করেন জাহিদ। সালমার কল। গলা শুকিয়ে আসে তাঁর। মনে হতে থাকে, তাঁর অফিসের কেলেঙ্কারির খবর জেনে ফেলেছেন তিনি। কেউ না কেউ বলেছে। বিশেষ করে হারুন। মেঘের ঘনঘটা দেখতে পান তিনি।

ভয়ে ভয়ে ফোন ধরেন জাহিদ। ওপাশ থেকে সালমা অর্পির জন্য একগাদা জিনিসের ফরমাশ দেন। খাতা, কলম, স্কেল, পেনসিল বক্স—এসব আনতে হবে। জাহিদের কপালে ভাঁজ পড়ে। এখন না হয় কেনা গেল, দুদিন পর এই টাকার বাড়ি কোথায়?

অয়নের প্রাইভেট খরচাই বা আসবে কোত্থেকে?

অলংকরণ: মামুন হোসাইন

অয়ন এখন স্কুলে। ক্লাস সেভেনে পড়ে ও। একা একা বাসে যাতায়াত করে। ক্লাসে ব্যাকরণ পড়াচ্ছেন স্যার। কিন্তু অয়নের মন বড় উতলা। ভারত-বাংলাদেশ ওয়ানডে ক্রিকেট ম্যাচ দেখার সুযোগটা এক্কেবারে নাকের ডগায় হাজির। শুধু খপ করে ধরার অপেক্ষা। ওর এক বন্ধুর চাচাতো ভাইয়ের কাছে আছে টিকিট। ৩০০ টাকা চাইছে। কালকেই দিতে হবে। নইলে সুযোগ হাতছাড়া। পরশু ম্যাচ। মাটির ব্যাংকে কত জমেছে কে জানে।

ক্লাসে মন বসে না অয়নের। স্যার ওকে ব্যাকরণ জিজ্ঞেস করেন। অয়ন মাথা চুলকায়। বেঞ্চের ওপর নিলডাউন হয়ে থাকতে বলেন স্যার।

তিন

দুপুরে খাওয়ার পর অর্পির মা বিছানায় গড়াগড়ি যান। ভাতঘুম। এ ফাঁকে অর্পি সারা বাসায় টো টো করে ঘোরে। ওর প্রিয় কাজ হচ্ছে সাজানো জিনিস এলোমেলো করা। বিশেষ করে ভাইয়ার জিনিস।

ওর ভয়ে অয়ন টেবিলের ড্রয়ারে তালা মেরে রাখে। গুপ্তধনের চেয়েও দামি জিনিস আছে ড্রয়ারে। এ জন্য সাবধানতা। অর্পি রোজ চুপিচুপি ড্রয়ারটা টানাটানি করে। আজও করল। ওমা, টানতেই সুড়ুৎ করে খুলে গেল ড্রয়ার!

আনন্দে লাফিয়ে ওঠে অর্পিতা। একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে, ‘মা, দেখে যাও, ভাইয়া কী বোকা! ড্রয়ারে আজ তালা দিয়ে যায়নি।’

মায়ের কোনো সাড়া নেই। অর্পি এবার যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখা ভাইয়ার ছবির খাতা বের করে। এর মধ্যে ভাইয়া কিছু ছবি আঠা দিয়ে সেঁটে রেখেছে। কোনোটা খেলোয়াড়ের, কোনোটা আজব জন্তুর, কোনোটা রোবটের। নিবিষ্ট মনে পাতা উল্টে ছবি দেখে অর্পি। আই-আই নামের এক আজব প্রাণী আছে। চোখ ড্যাবড্যাবে। দেখলেই চোখ দুটো কানা করে দিতে ইচ্ছে করে। ড্রয়ার হাতড়ে ওটার চোখ কানা করার মতো জিনিস খোঁজে অর্পি।

আরে, এই তো চাই! ভাইয়ার খুব পছন্দের কালার বক্সটা পেয়ে যায় অর্পি। কাচের ছোট ছোট শিশিতে রাখা আছে রং। সেগুলো বের করে অর্পি। আঁকার জায়গার অভাব নেই। সাদা দেয়ালটাকেই ক্যানভাস বানিয়ে ফেলে। তারপর যা খুশি আঁকতে থাকে তুলি দিয়ে।

মায়ের চিৎকারে অর্পির ছবি আঁকা থেমে যায়। তিনি চেঁচিয়ে বলেন, ‘ওমা, এ মেয়ে তো দেয়ালের সর্বনাশ করে ফেলেছে! বাড়িওয়ালা দেখলে আস্ত খেয়ে ফেলবে!’

মা শুধু চিৎকারেই থেমে থাকেন না, অর্পির পিঠে দুম দুম কটা লাগিয়েও দেন। ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে অর্পি।

এর মধ্যে অয়ন এসে পড়ে গেল বেকায়দায়। লন্ডভন্ড ড্রয়ার দেখে রাগ দেখাবে কী, বোনের দুরবস্থা দেখে ওকে বরং শান্ত করতে লেগে গেল। অর্পি কাঁদলে ভারি মায়া হয় ওর। তখন বোনের সব অপরাধ মাফ।

কিন্তু অর্পি একবার গোস্সা করলে ওকে শান্ত করা কঠিন। ভয়ানক জেদি। অয়ন পত্রিকা থেকে সদ্য কেটে নেওয়া নতুন ছবিটা দিল ওকে।

তিন দিন বয়সী গরিলা শিশুর ছবিটা দেখিয়ে ঝামেলাই হলো। মায়ের বুকে আরামে ঘুমাচ্ছে শিশুটি। দেখলেই মায়া লাগে।

ছবি দেখে অর্পি খুশি। সেই সঙ্গে প্রশ্নের থলেও উপুড় করে জানতে চাইল, ‘গরিলার বেবিটার নাম কী, ভাইয়া?’

অয়ন বলল, ‘ওর নাম জুকু।’

অর্পিতা ঠোঁট উল্টে বলল, ‘এক্কেবারে পচা নাম!’

‘তাহলে তুই একটা নাম রেখে দে।’

‘বেবিটা ছেলে না মেয়ে?’

‘ছেলে।’

‘ওর নাম হবে গোলাপ।’

‘গরিলার বাচ্চার নাম গোলাপ কি ভালো হবে?’

‘তাহলে গুল্লু রাখব, ভাইয়া? আচ্ছা, গুল্লুই রাখলাম।’

অয়ন হেসে বলে, ‘এটা কী নাম রাখলি? এই কালো পুঁচকের নাম কাল্লুু রাখলেই ভালো।’

‘না, গুল্লুই।’

‘ঠিক আছে, গুল্লু।’

‘গুল্লুর মায়ের নাম কী, ভাইয়া?’

‘ছেলের নাম গুল্লু হলে মায়ের নাম লুল্লু।’

হাততালি দেয় অর্পিতা, ‘দারুণ!’

‘গুল্লুর বাবা কই, ভাইয়া?’

‘ছবি তোলার সময় বাবা ছিল না।’

‘কেন ভাইয়া? ওর বাবা কি নেই?’

‘থাকবে না কেন? নিশ্চয়ই আছে।’

‘কোথায়?’

‘চিড়িয়াখানায়।’

‘চলো, ভাইয়া, চিড়িয়াখানায় ওদের দেখে আসি।’

‘সে তো বিদেশে। অস্ট্রেলিয়ার থাকে ওরা।’

‘সেখানেই চলো। সকালে গিয়ে বিকেলেই চলে আসব।’

‘অস্ট্রেলিয়া অনেক দূর। টিকিট কেটে প্লেনে করে যেতে হয়। এক দিন-দুদিনে ঘুরে আসা যায় না। কয়েক দিন লাগে।’

‘অ। তাহলে কালকে কিন্তু টিকিট আনবে।’

‘ওই দেশের প্লেনের টিকিট কাটতে অনেক টাকা লাগে। এত টাকা কোথায় পাব?’

‘আচ্ছা, বাবা এলে বলব। বাবা নিয়ে আসবে।’

বাবার অপেক্ষায় থাকে অর্পি। টাকার দরকার তো অয়নেরও। মাকে এ নিয়ে কিছুই বলা যাবে না। গত পরীক্ষায় অঙ্কে ৬৫ পাওয়ার পর থেকে মা খেলার নাম শুনতে পারেন না। বাবার কাছে বলতে হবে। কাজ হবে কি না, কে জানে।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মাটির ব্যাংকটার কাছে যায় অয়ন। একটা মাটির ব্যাংক কিনে কয়েন ফেলতে শুরু করেছে। হিসাবের খাতাও আছে। প্রতিবার কয়েন ফেলে হিসাব টুকে রাখে। কোনো ভুল নেই। সমস্যা হচ্ছে বিশ-ত্রিশ টাকার কয়েন জমলেই লোভ সামলানো যায় না। চিকন একটা কাঠি জোগাড় করে ব্যাংকের ফাঁক দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কয়েন সব বের করে ফেলে। তারপর চকবার, নয়তো বার্গার কেনা ঠেকায় কে?

খাওয়ার পর আবার মনের ভেতর খচমচ শুরু হয়। ইশ্, কয়েনগুলো জলে গেল! এমন করলে তো বিল গেটসের মতো কোটিপতি হওয়া যাবে না। বিরস চেহারা নিয়ে হিসাবের খাতায় কাটাকুটি করে আবার নতুন হিসাব কষতে শুরু করে।

এবার অবশ্য অনেক দিন ব্যাংকে হাত দেয়নি অয়ন। কয়েনের ভারে বেশ ভারী হয়ে আছে। তবে ভাঙলে ৩০০ টাকা হবে কি না সন্দেহ। এ কদিনে খাতায় হিসাবও টোকা হয়নি। আগের মতো উৎসাহ নেই।

সন্ধ্যার দিকে ঝুম বৃষ্টি নামে। এর মধ্যে ভিজে চুবচুবে হয়ে ফেরেন জাহিদ। দেখে খেপে যান গিন্নি, ‘এভাবে ভিজলে যে! জ্বরটর বাধানোর শখ হয়েছে?’

জাহিদ কিছু বলেন না। তিনি ইচ্ছা করেই ভিজেছেন। এখন জ্বর হলে ভালোই হবে। কয়েকটা দিন বাসায় থাকা যাবে। চাকরি যখন নেই, বাইরে গিয়ে কী হবে?

বন্ধু আফতাব তাঁকে মন ভালো করে দেওয়ার মতো কিছু শোনাতে পারেননি। জাহিদের সব কথা শুনে আফতাব তুড়ি বাজিয়ে বলেন, ‘চাকরি গেছে বেশ হয়েছে! একটা যাবে, দশটা আসবে। রংপুরে আমি একটা ডেইরি ফার্ম করেছি। সেখানে চলে যা। ধর, ম্যানেজারের পোস্টটাই দিলাম তোকে।’

ঢাকায় সংসার ফেলে জাহিদকে যেতে হবে রংপুরের গ্রামে, খেয়েদেয়ে কাজ নেই। তাও কিনা গরুর খামারে!

জাহিদ মুখে কিছু বলেননি। বিপদে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে। তবে মনে মনে বলেছেন, ‘এ দুর্দিন থাকবে না রে, আফতাব। আবার সুদিন আসবে। তখন এই রঙ্গ করার মজাটা বুঝিয়ে দেব।’

অর্পি অপেক্ষা করছিল পোশাক পাল্টে বাবা কখন চা নিয়ে বসবেন। সুযোগ পেয়েই সে আবদার জুড়ে দিল, ‘বাবা, তুমি কালকেই পেলেনের টিকিট কেটে আনবে।’

‘কেন রে?’

‘আমরা সবাই মিলে অস্ট্রেলিয়ায় যাব।’

‘কেন, এত কিছু থাকতে অস্ট্রেলিয়া যাবে কেন?’

‘ওখানে চিড়িয়াখানায় গুল্লু আর লুল্লু আছে। ওদের দেখতে যাব।’

‘গুল্লু আর লুল্লু কে?’

খুলে বলে অর্পি। দুঃখের মধ্যেও হাসি পায় জাহিদের। বলেন, ‘সে তো অনেক টাকার ব্যাপার, মা। এত টাকা আমি পাব কোথায়?’

‘মেশিন থেকে নেবে।’

‘মেশিন থেকে?’

‘হ্যাঁ, ওই যে সেদিন আলাদিন কাকুর দোকানের পাশে ছোট ঘরটায় আমাকে নিয়ে গেলে, সেখানে একটা মেশিন থেকে এত্তগুলা টাকা বের করলে না?’

জাহিদ বুঝতে পারে এটিএম বুথের কথা বলছে মেয়ে। সে ধরে নিয়েছে টাকার মেশিনটা তার বাবার। বুকের ভেতর চিনচিনে কষ্ট অনুভব করেন জাহিদ। বলেন, ‘ওই টাকার মেশিন আমার না, মা। ওটা ব্যাংকের। ওরাই এসে টাকা রেখে যায় ওখানে।’

এ কথা অর্পিকে বোঝানো যায় না। ভাইয়ারও তো ব্যাংক আছে। ব্যাংকের টাকা আবার মেশিনে রাখতে হবে কেন? ব্যাংক থেকে কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে বের করলেই তো হয়।

অর্পি গিয়ে ভাইয়াকে ধরে, ‘তোমার ব্যাংক থেকে কিছু কয়েন দাও, ভাইয়া। বাবা টিকিট কিনে আনবে।’

অয়ন বোঝানোর চেষ্টা করে, এই কয়েনে কাজ হবে না। অনেক টাকা লাগবে। কিন্তু অর্পি কিছুতেই বোঝে না। মা ধমক লাগান ওকে। বলেন, ‘শুধু ঝামেলা করার তালে থাকিস তুই। যা, বই নিয়ে আয়। পড়তে বোস।’

অলংকরণ: মামুন হোসাইন

অর্পিকে একরকম তাড়িয়ে নিয়ে পড়তে বসান মা। অয়ন এই ফাঁকে বাবার কাছে যায়। আস্তে করে বলে, ‘আমাকে খেলা দেখাতে নিয়ে যাবে, বাবা?’

‘কিসের খেলা?’

‘বাংলাদেশ-ভারত ওয়ানডে ম্যাচ।’

‘সে তো টিকিট লাগবে রে।’

‘আমার এক ক্লাসমেটের কাজিনের কাছে টিকিট আছে। তুমি শুধু টাকা দেবে। ৩০০ টাকা করে।’

জাহিদের মনটা আরও খারাপ হয়ে যায়। ছেলেমেয়ে কারও কোনো আবদারই তিনি রাখতে পারছেন না।

ধমকের ভয় তুচ্ছ করে অয়ন বলে, ‘দেবে, বাবা?’

এমন ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষার সামনে না বলতে বাধে জাহিদের। বলেন, ‘দেখি। এখন যাও, পড়তে বসো।’

অয়ন টেবিলে গিয়ে আবার ফিরে আসে। বলে, ‘আমার ব্যাংকে কিছু কয়েন আছে। ওটা ভাঙব, বাবা? কম হলে বাকিটা নাহয় তুমিই দিলে।’

জাহিদ কিছু বলেন না। আজকের মতো এত মন খারাপ তাঁর কখনো হয়নি। অয়নেরও মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। বন্ধুরা কত মজা করে ক্রিকেট খেলা দেখবে, ক্লাসে এসে ছক্কা আর চারের গল্প ছাড়বে, আর ও শুধু হাঁ করে শুনবে। কিছু বলতে পারবে না।

পড়া শেষে অর্পি বাবার কাছে যায়। সাড়া দেন না জাহিদ। অর্পি বলে, ‘বাবা, তোমার মন কি খারাপ?’

‘খুব খারাপ, মা। খুব খারাপ!’

এই বলে অর্পিকে বুকে টেনে নেন বাবা। তাঁর চোখ থেকে গরম জল পড়ে অর্পির গালে। অর্পির মনও খারাপ হয়ে যায়। সে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে, ‘কী করে সুপারম্যান হওয়া যায়, বাবা?’

‘কেন, মা?’

‘তুমি সুপারম্যান হলে উড়তে পারতে। তোমার পিঠে বসে অস্ট্রেলিয়া যেতাম।’

জাহিদ আরও নিবিড়ভাবে বুকে চেপে ধরেন মেয়েকে। কোনো কথা বলেন না।

ভাইয়ার কাছে সান্ত্বনা খুঁজতে যায় অর্পি। টের পায় তারও মন খুব খারাপ। রাত নয়টার দিকে অর্পিকে খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দেন মা। ঘরের আলো নিভিয়ে ঘুমাতে বলেন ওকে। সকালে স্কুল। এখন না ঘুমালে ভোরে উঠতে পারবে না। কিন্তু অর্পির চোখে ঘুম নেই। ভাবে, একটা জলপরি হলে ভালো হতো। উড়ে উড়ে সবার দুঃখকষ্ট নিয়ে জলে ডুব দিত। সাগর থেকে তুলে আনত মণিমুক্তা। বাবার অনেক টাকা হতো তখন। রুদাপাদের মতো একটা এলিয়েন গাড়ি কিনতেন বাবা। গাড়িতে চড়ে সবাই মিলে মজা করে ঘোরা যেত। কল্পনার আকাশে পরি হয়ে উড়ে বেড়ায় অর্পি।

ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে রাত ১২টা পার হয়। অর্পি ছাড়া বাসার সবাই ঘুমে। অর্পি চোখ বুজে পড়ে আছে। কিন্তু ঘুম আসছে না। আলগোছে বিছানা থেকে নামে ও। বারান্দায় এসে ফকফকে জোছনা দেখে। রাত-দুপুরে পুুতুল নিয়ে বসে ও। একটা একটা করে পুতুল সাজিয়ে রাখে টানা বারান্দায়। এটা বিন্দু, ওটা মালা, এটা নীলকমল, ওটা কমলা...অনেক পুতুল ওর।

চার

অর্পি যখন বারান্দায় বসে পুতুল খেলছে, বাইরে তখন ঘটছে আরেক কাণ্ড। শিশুকন্যাকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে কটকটি। কটকটি একটা পেত্নি।

অনেক দূরের গ্রামে, এক জঙ্গলে শেওড়াগাছে থাকত কটকটি। মেয়েকে নিয়ে সুখেই ছিল। হঠাৎ একদল মানুষ এসে জঙ্গল কাটতে শুরু করল। কাটা পড়ল শেওড়াগাছ। আশ্রয় হারাল কটকটি।

মেয়েকে নিয়ে ফ্যা ফ্যা করে আশ্রয় খুঁজতে লাগল কটকটি। কিন্তু চাইলেই কি পাওয়া যায়? আজকাল মানুষ বসতি বাড়াতে নির্বিচারে গাছপালা কেটে সাফ করছে। ভূতপেত্নির বসবাসের জায়গা শেওড়াগাছ, তেঁতুলগাছ সব কেটেকুটে ঠেলে দিচ্ছে ইটের ভাটায়।

থাকার জায়গা খুঁজতে খুঁজতে এক গভীর রাতে ঢাকায় চলে আসে কটকটি। এখানে থাকার জায়গার অভাব নেই। কিন্তু কোথাও থিতু হওয়া মুশকিল। ঢাকার মানুষ বড় অস্থির। নিজেরা ছোটে, অন্যদেরও ছোটায়।

মেয়েটাকে নিয়ে প্রথমে একটা খালি বাড়িতে উঠেছিল কটকটি। চারতলা পুরোনো বাড়ি পুরোটাই ছিল ফাঁকা। নড়েচড়ে মজা ছিল। কিন্তু একদিন ভাঙা শুরু হলো বাড়িটা। এখন সেখানে দশতলা দালান উঠছে।

এরপর কয়েকটা দিন এক মাঠে ফেলে রাখা কংক্রিটের মোটা পাইপের ভেতর ছিল কটকটি। ওমা, সেখানেও মানুষ পোঁটলা নিয়ে হাজির। এভাবে এখানে-সেখানে গ্যাঁট হয়ে দুটো বছর পার করে দিয়েছে। এত দিনে মেয়ে কিছুটা বড় হওয়ায় কোলে নিয়ে ছুটতে হয় না। তবে ও ভারি চঞ্চল। এরই মধ্যে দুবার হারিয়েছে। দুবারই মানুষের বাসায় গিয়ে উঠেছিল। কটকটি আবার জন্ম থেকেই দূরদর্শী। কোথায় কী আছে, অনেক দূর থেকে দেখতে পায়। তবে মেয়েটা ভারি বোকা। শেষবার যে বাসায় উঠেছিল, সেখান থেকে আসতেই চায় না। ওই বাড়ির এক মেয়ে প্রতিদিন বারবি সিরিজ দেখে। ওই অ্যানিমেশন ছবি দেখার লোভে সে আর আসতেই চায় না। কটকটি অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়েছে।

এখন বর্ষা মৌসুমে থাকার জায়গা নিয়ে সমস্যা নেই। ঢাকা শহরজুড়ে নানা রকম গর্ত খোঁড়ার কাজ চলছে। প্রতিদিনই ইয়া বড় গর্ত খোঁড়া হচ্ছে। কোনোটা গোল, কোনোটা চ্যাপ্টা, কোনোটা বর্গাকার, কোনোটা লম্বা। এসব গর্তে দিব্যি আশ্রয় জুটে যায় মা-মেয়ের।

ঢাকায় একটাই কষ্ট কটকটির। জুতসই খাবার নেই। তার প্রিয় খাবার হচ্ছে মরা গরুর ঠ্যাং। কিন্তু এখানে মরা গরু বা মরা ছাগল পাওয়া দায়। মাংসের যে চাহিদা, গরু-ছাগল মরবে কখন, খাড়া থাকতেই টুকরো টুকরো হয়ে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। চাপে পড়ে খাদ্য পাল্টাতে হয়েছে কটকটিকে। মেয়ে তো এককাঠি বাড়া। সে চুকচুক করে দুধ খায়। রসুন দেওয়া নানরুটি পর্যন্ত সাবাড় করে!

আজ সন্ধ্যায় কটকটি হাওয়াই খবর শুনেছে, এদিকে কোথায় নাকি একটা গরু মরেছে। গর্ত থেকে মেয়েকে নিয়ে তারই খোঁজে বেরিয়েছে কটকটি। মেয়েটা আজ পর্যন্ত এসব চেখে দেখেনি। ভূতের ঘরে জন্ম নিয়ে মরা গরু খাবে না, এ কেমন কথা! এসব খেতে পায় না বলেই অপুষ্টিতে ভুগছে। ঠোঁটের কোণে ছুঁচাল দাঁত গজাচ্ছে না। চোখ জ্বলজ্বল করে না। এসব না থাকলে মানুষকে সে ভয় দেখাবে কী করে?

ঘুরতে ঘুরতে অনেক দূর চলে আসে কটকটি। নাক টেনে গন্ধ শোঁকে। হ্যাঁ, একটা গন্ধ আসছে। কিন্তু মরা গরুর কি না, বোঝা যাচ্ছে না। অনেক দিন না খেয়ে খেয়ে অচেনা হয়ে গেছে গরুর গন্ধ।

গন্ধের উৎস তাক করে এগোয় কটকটি। মেয়ের হাত ধরে ছোটখাটো এক মাঠের কাছে আসে। সেখানে গোল হয়ে বসে কিছু একটা করছে কয়েকজন। কৌতূহল হয় কটকটির। মেয়েকে রাস্তার পাশে বড়সড় একটা গর্তে রেখে বলে, ‘আমি না আসা পর্যন্ত নড়বি না।’

ঘাড় কাত করে সায় দেয় মেয়ে। কটকটি এগিয়ে যায় মাঠের দিকে। মেয়ে কি আর চুপ থাকে? মা চোখের আড়াল হওয়ামাত্র সুড়ুৎ করে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে সে। সামনেই একটা ছয়তলা দালান। দোতলার বারান্দায় ছোট একটা কায়া নড়াচড়া করছে। কাছে গিয়ে দেখার ইচ্ছাটা দমাতে পারে না কটকটির মেয়ে। সে দেয়াল বেয়ে খাড়া উঠতে থাকে। চলে আসে বারান্দায়।

অর্পি এখন তার পুতুলের বিয়ের আয়োজন করছে। নীলকমলের সঙ্গে বিন্দুর বিয়ে। ছোট বাক্সটা থেকে কনের লাল শাড়ি, বরের জরির শেরওয়ানি বের করে সে। বিন্দুর মা সাজে অর্পি। কিন্তু বরের মা হবে কে?

বিরক্তি ধরে যায় অর্পির। মৃদু স্বরে বলে, ‘দূর, একা একা খেলা যায় নাকি? এখন বরের মা কে হবে?’

‘আমি হই, কী বলো?’

চমকে যায় অর্পি। বারান্দার ওই কোণটাতে ওর মুখোমুখি গুটিসুটি মেরে বসে আছে কে একজন। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। আবছা কায়া। তবে ওর বয়সী হবে। এখানে হঠাৎ সে এল কী করে?

‘কে তুমি?’ জানতে চায় অর্পি।

‘আমি গুলগুলা। কটকটির মেয়ে।’

‘আমি অর্পি। কিন্তু কটকটি কে?’

‘সে আর বলতে চাই না। শুনলে ভয় পাবে। এর চেয়ে বরং দুজন মিলে খেলি।’

অর্পির ভয়টা কেটে গেছে। ওর মনে হলো এটা পরির মেয়ে। আকাশে উড়তে উড়তে চলে এসেছে।

অর্পি জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি কোনো পরির মেয়ে? বলো, ভয় পাব না।’

‘আমি ভূতের মেয়ে। মানে, পেত্নির মেয়ে।’

‘যাহ্, মিথ্যা বলছ। ভূতের মেয়ে হলে চেহারা বিকট হতো। গোল্লা গোল্লা চোখ থাকত আগুনের মতো। শূকরের মতো দাঁত থাকত। তোমার তো এসব নেই!’

‘মা আমাকে রোজ মানুষের খাবার খাওয়ায় তো। তাই হয়নি। মা বলে, আমার স্বভাব নাকি বদলে যাচ্ছে। দিন দিন মানুষঘেঁষা হয়ে যাচ্ছি। কী, খেলবে নাকি?’

গুলগুলার সঙ্গে পুতুল খেলতে বসে যায় অর্পি। গুলগুলা নীলকমলের মা, অর্পি বিন্দুর মা। পুতুলের বিয়ের আয়োজন করে ওরা। খেলতে খেলতে অনেক সময় পার হয়ে যায়। একসময় খিদের চোটে পেট চোঁ চোঁ করে গুলগুলার। সন্ধ্যা পর কিছু খায়নি। অর্পিকে সে বলে, ‘আমার খুব খিদে পেয়েছে। নিয়ে এসো না কিছু।’

‘কী খাবে?’

‘যা পাও আনো। আমি সবই খাই।’

খুঁজেপেতে আপেল, দুধ আর কলা নিয়ে এল অর্পি। মজা করে খেতে লাগল গুলগুলা।

কটকটি এদিকে অদৃশ্য হয়ে হাওয়ায় মিশে যায়। বাতাসের মতো শোঁ শোঁ করে মাঠে গিয়ে হাজির। একটা ঘূর্ণি তুলে ধুলোবালি উড়িয়ে লোকগুলোর পাশে গিয়ে হাজির হয়। কোত্থেকে টাকা আর দামি কিছু জিনিস লুটে নিয়ে এসেছে তারা। তারই ভাগাভাগি চলছে। কটকটি টের পেল, লুটেরাদের গা থেকেই দুর্গন্ধ ছুটেছে। তাহলে মানুষেরা কি আজ ভূতের চেয়েও খারাপ হয়ে যাচ্ছে?

সেই গর্তের কাছে ফিরে আসে কটকটি। গুলগুলা হাওয়া। মেয়েটা এত চঞ্চল! বিরক্ত হয় কটকটি। নির্ঘাত কোনো বাসায় ঢুকেছে। হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। কটকটি তার দূরদর্শী চোখে দেখে কাছের ছয়তলার দোতলায় একটা মেয়ের সঙ্গে বসে আছে তার মেয়ে।

দুধ-কলা খেয়ে গুলগুলা আপেলে যেই কামড় বসিয়েছে, অমনি কটকটি সেখানে হাজির। অর্পি তো তার বিকট চেহারা দেখে ভয়ে আধমরা। গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে চাইল, কিন্তু স্বর ফুটল না।

গুলগুলা বলল, ‘ভয় নেই, অর্পি। এটা আমার মা।’

কটকটি তার মেয়ের মতো নরম নয়। হিংসুটে স্বভাব পুরোপুরি যায়নি। এখনো ফাঁক পেলে মানুষের ঘাড় মটকে দিতে ইচ্ছা করে। বিশেষ করে নাদুসনুদুস মানুষের বাচ্চা পেলে। অর্পির ঘাড়টা তার খুব মটকে দিতে ইচ্ছা করছে।

গুলগুলা তার মায়ের ইচ্ছার কথা ঠিকই জেনে গেল। সে বলল, ‘ওকে একটুও ছোঁবে না, মা। ও আমার বন্ধু। ওর সঙ্গে মজা করে খেলেছি। ও আমাকে খাইয়েছে।’

এবার ফাঁদে পড়ে যায় কটকটি। ভূতের নিয়ম হচ্ছে যে উপকার করবে, ভুলেও তার অপকার করা যাবে না। বরং প্রতিদান হিসেবে তিনটা উপকার করতে হবে। না করলে আকাশের মেঘ হয়ে বৃষ্টি ঝরাতে হবে জীবনভর।

কটকটি বলে, ‘আমি তোমার কাজে খুব খুশি হয়েছি, অর্পি। এখন তোমার তিনটা ইচ্ছা পূরণ করতে চাই। বলো, তুমি কী চাও।’

‘আমি যা চাই, দিতে পারবে?’

‘চেয়েই দেখো না।’

‘আমার বাবার মনটা খুব খারাপ।’

‘ভালো হয়ে যাবে।’

‘ভাইয়ারও।’

‘তার মনও ভালো হয়ে যাবে।’

‘সত্যিই?’

‘হ্যাঁ। এখন বলো আর কী চাও?’

অর্পি একটু ভেবে নিয়ে বলে, ‘আচ্ছা, আমার বাবাকে সুপারম্যান বানিয়ে দিতে পারবে?’

‘পারব হয়তো।’

রাতের শেষ প্রহর। আর দেরি করা যাবে না। অর্পির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় কটকটি আর গুলগুলা। অর্পি বড় বড় হাই তোলে। বড্ড ঘুম পাচ্ছে তার।

পাঁচ

পরদিন ভোরে বেশ হইচই বাধান সালমা। অর্পি কই? ওকে পাওয়া গেল বারান্দায়। ছড়ানো-ছিটানো পুতুলের ওপর শুয়ে আছে। সবাই অবাক—এ কী কাণ্ড!

এদিকে পুরো এক লিটার দুধ, দুটো আপেল আর এক হালি কলা হাওয়া। এত খাবার অর্পির খাওয়ার কথা নয়। ওকে এক কাপ দুধ খাওয়াতেই কম্ম কাবার!

অর্পি অবলীলায় বলে, ‘এসব গুলগুলা খেয়েছে।’

সালমা জানতে চান, ‘গুলগুলা কে?’

‘ও একটা ভূতের বাচ্চা। আমার সঙ্গে খেলেছে।’

এ কথায় বাবা আর ভাইয়া অবাক হয়ে তাকায়। মা হতাশ সুরে বলেন, ‘কল্পনার জগতে থেকে থেকে মেয়ের কী হয়েছে, দেখেছ! সময় থাকতে ডাক্তার দেখাও।’

অর্পি ঘাড় বাঁকিয়ে বলে, ‘আমি সত্যি বলছি, মা। গুলগুলা এসেছিল।’

অর্পিকে ধমক লাগান মা। সঙ্গে গালে একটা ঠোকনাও। আর কথা নয়। স্কুলের সময় হয়ে গেছে। ঝটপট ওকে তৈরি করেন মা। বাবার সঙ্গে রোজকার মতো স্কুলের পথে বেরোয় অর্পি।

জাহিদ ভেবেছিলেন কাল বৃষ্টিতে ভেজায় জ্বরটর হবে। তা হলো না। জ্বর হলে বাসায় থাকা যেত। আজ তাঁর কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। অফিস তো নেই। অর্পিকে স্কুলে দিয়ে সারা দিন পথে পথে ঘুরতে হবে। এ ছাড়া উপায় কী? অফিসের সময়টা তো পার করতে হবে। তবে এই লুকোচুরি কয় দিন চালানো যাবে, কে জানে। সালমা জানলে তো মহা কেলেঙ্কারি।

অর্পি অনেকক্ষণ ধরে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে। বাবা একদৃষ্টে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখে পলক পড়ছে না। কপাল কোঁচকানো।

অর্পি বলে, ‘তোমার মন কি খুব খারাপ, বাবা?’

মেয়ের দিকে ফিরে আলতো মাথা ঝাঁকান জাহিদ।

অর্পি বলে, ‘চিন্তা নেই, বাবা। তোমার মন ভালো হয়ে যাবে। গুলগুলার মাকে তোমার মন ভালো করে দিতে বলেছি। সে রাজি হয়েছে। ভাইয়ার মনও ভালো হবে। একটা কথা শোনো, বাবা। কানটা এগিয়ে দাও।’

মাথা নিচু করে ডান কান বাড়িয়ে দেন জাহিদ। অর্পি ফিসফিস করে বলে, ‘তুমি না সুপারম্যান হবে। কটকটি তোমাকে সুপারম্যান বানিয়ে দেবে।’

চিন্তায় পড়েন জাহিদ। এ কী বলছে? মাথায় সমস্যা?

অর্পির স্কুলের ফটকে আজও রুদাপার বাবা রুম্মানের সঙ্গে দেখা। তিনি আজ জাহিদকে দেখেও না দেখার ভাব করেন। মেয়েকে নামিয়ে দ্রুত চলে যান। জাহিদের কেমন অপমান অপমান লাগে। লাগা স্বাভাবিক। চাকরি না থাকলে সম্মানবোধ বেশি টনটনে হয়।

অর্পিকে স্কুলে দিয়ে ফুটপাতে হাঁটতে থাকেন জাহিদ। এমন সময় মোবাইলে রিংটোন। মনটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। সালমা নাকি? জেনে গেল চাকরি খোয়ানোর খবর?

না, বসের ফোন। ধরব না ধরব না করেও ধরেন জাহিদ। একদম বদলে গেছে তাঁর স্বর। নরম সুরে বলেন, ‘ফাইলটা আমার টেবিলে রেখেছেন—ভালো কথা। অফিসে নেই কেন? আপনি কোথায়?’

অবাক হন জাহিদ, ‘ফাইল রেখে গেছি মানে?’

‘ভান ধরবেন না, জাহিদ সাহেব। আপনি আর রঙ্গ করবেন, ভাবতেও পারিনি। ফাইল হারালে আমার টেবিলে এল কোত্থেকে? হিসাবটাও দেখলাম খুব যত্ন করে মিলিয়েছেন। আপনি শিগগির আসুন।’

জাহিদ কিছুই বুঝতে পারেন না। ব্যাপারটা ভোজবাজির মতো লাগে। ওই ফাইল বসের টেবিলে যাবে কী করে? ওটা তো ব্যাগের সঙ্গে হাওয়া। তবে কি দয়ালু কেউ ফাইলটা পেয়ে দিয়ে গেছেন?

অফিসে গিয়ে হাজির হন জাহিদ। মুখ চুন করে বসে আছেন হারুন। মুখে কথা নেই। এর মধ্যে ওই ফাইলের লোকজন এসে গেছেন। কাজটা হয়ে যাওয়ায় তাঁরা খুব খুশি। সঙ্গে বসও। পারলে জাহিদকে মাথায় তুলে নেন।

এক ফাঁকে জাহিদকে ডেকে দুর্ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চান বস। পকেট থেকে দুটো খেলার টিকিট বের করে বলেন, ‘একসঙ্গে কয়েকটা টিকিট পেয়েছি। এই দুটো আপনাকে দিচ্ছি। ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশ আর ভারতের ম্যাচটা দেখে আসবেন।’

দারুণ এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে জাহিদের মনে।

বিকেলে বাবার কাছ থেকে খেলা দেখার টিকিট পেয়ে তড়াক তড়াক লাফাতে লাগল অয়ন। তা দেখে অর্পি বলল, ‘আমি বলেছিলাম না, ভাইয়া আর বাবার মন ভালো হয়ে যাবে। কটকটি বলেছিল। তোমরা তো বিশ্বাসই করো না। এখন বিশ্বাস হলো তো?’

অলংকরণ: মামুন হোসাইন

ছয়

পরদিন একটু আগেই বের হন জাহিদ। জরুরি এক কাজ সেরে অফিসে যাবেন। অর্পিকে সালমা নিয়ে যাবেন। ১০টার দিকে জাহিদ অফিসে পা রাখতেই হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলেন হারুন। খোঁচা খেতে তৈরি হন জাহিদ। ভয়ংকর খবর দেন হারুন। আগুন লেগেছে রাইজিং সান স্কুলে। অর্পির স্কুল। টিভিতে ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে।

চকিতে মেয়ের করুণ মুখটা জাহিদের চোখে ভাসে। ওই স্কুলের রুমগুলো এমনিতেই যা গুমোট, এর মধ্যে আবার আগুন! না জানি কেমন আছে মেয়ে?

ঝোড়ো বেগে রাস্তায় ছোটেন জাহিদ। সামনে একটা খালি স্কুটার। ভাড়া না মিটিয়েই উঠে পড়েন তিনি। স্কুলের ঠিকানা বলে চালককে অনুরোধ করলেন, ‘একটু স্পিডে চালিয়ো, ভাই। স্কুলে আগুন লেগেছে!’

রাস্তায় জ্যাম। চালক এর মধ্যেই কীভাবে যেন স্কুটারের পথ করে নিচ্ছে। শাঁ শাঁ ছুটছে স্কুটার। আর কেউ নয়, শুধু চালক টের পাচ্ছে ব্যাপারটা। স্কুটারের স্টিয়ারিং হ্যান্ডেল ধরে সে বসে আছে বটে, কিন্তু চালাচ্ছে আরেকজন। অদৃশ্য একটা শক্তি ভর করেছে তার ওপর।

স্কুলের সামনে প্রচুর ভিড়। ছাত্রী আর শিক্ষকেরাও আছেন সেখানে। কথা হচ্ছে, সবাই ভালোয় ভালোয় বেরিয়ে আসতে পেরেছে কি না?

বেশির ভাগ লোক দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। করবেই বা কী? আগুন বলে কথা। দোতলার জানালাগুলো দিয়ে গলগল করে বেরোচ্ছে কালো ধোঁয়া। এর মধ্যে পৌঁছে গেছে ফায়ার সার্ভিস। আগুন নেভাতে চেষ্টা করছে।

কানাঘুষা চলছে, ভেতরে আটকা পড়েছে কয়েকজন। এর মধ্যে অর্পি নেই তো? মাথা চক্কর দেয় জাহিদের। কী করা যায়? ভিড়ের মধ্যে রুম্মানের সঙ্গে দেখা জাহিদের। এ কী চেহারা হয়েছে! আলুথালু বেশ, এলোমেলো চুল। জাহিদকে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলেন, ‘আমার মেয়েটাকে পাচ্ছি না। ভেতরে আটকা পড়েছে হয়তো।’

জাহিদের মনে হলো এখুনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। তাহলে তো অর্পিও আটকা পড়েছে। একই ক্লাসে পড়ে ওরা। তেতলায় ওদের ক্লাস, আগুন লেগেছে দোতলায়, ওরা বেরোবে কী করে?

মরিয়া হয়ে ছোটেন জাহিদ। প্রাণ যায় যাক, তবু ভেতর থেকে মেয়েকে উদ্ধার করবেন তিনি। তাঁকে নিয়ে একটা শোরগোল ওঠে। ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী ছুটে আসেন। উত্তেজিত গলায় বলেন, ‘ওদিকে যাচ্ছেন কোথায়? মারা পড়বেন তো। ধোঁয়ায় দম আটকে যাবে। আগুনে পুড়ে কয়লাও হতে পারেন।’

জাহিদ পাত্তা না দিয়ে গতি বাড়ান। কে যেন সামনে পথ আটকাল। তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেন তিনি।

ভেতরে ঢুকে ধোঁয়ার ধাঁধায় পড়ে যান জাহিদ। চোখ জ্বালা করতে থাকে। খক খক কাশতে শুরু করেন। দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় এখুনি জ্ঞান হারাবেন তিনি।

এমন সময় ঘটে ঘটনাটা। অজানা একটা ঘোর পেয়ে বসে তাঁকে। জোরালো একটা ঘূর্ণি যেন আলোড়ন তোলে জাহিদকে ঘিরে। টের পান তাঁর শরীরটা বাতাসে ভাসা পালকের মতো শূন্যে উঠে যাচ্ছে।

ধুপ্! একটা মেঝেতে পা ঠেকে জাহিদের। অমনি তারস্বরে চিৎকার জুড়ে ছুটে আসে তিন শিশু। এর মধ্যে রুদাপাকে তিনি চিনতে পারেন। প্রচণ্ড ভয়ে কাঁপছে সে। মেয়েটা হাঁচড়-পাঁচড় করে জাহিদের কাঁধে চড়ে বসে। অন্য দুটিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরেন জাহিদ।

চোখের পলকে নিচে নেমে আসেন তিনি। পানি পেয়ে ধোঁয়া আরও ছড়িয়ে গেছে। দম নেওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যেই মেয়ে তিনটিকে নিয়ে বাইরে আসেন জাহিদ।

বিপুল হর্ষধ্বনি ওঠে। সমবেত জনতার প্রচণ্ড হুল্লোড়ে জাহিদের কানে তালা লাগার জোগাড়। একসঙ্গে বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা এসে ঘিরে ধরে জাহিদকে। একগাদা মাইক্রোফোন মুখের সামনে হাজির। সাংবাদিকেরা কার আগে কে কথা বলবেন, রীতিমতো হুড়োহুড়ি লেগে যায়। জাহিদের বুকের ভেতরটা শুকিয়ে আসে। এই তিনজনের মধ্যে তো তাঁর মেয়ে নেই। তাহলে অর্পি কি ভেতরেই রয়ে গেল?

সাত

জাহিদ যখন দুরু দুরু মনে অর্পির কথা ভাবছেন, সে তখন বাসায় টিভির সামনে বসে বাবার কাণ্ড দেখছে। সঙ্গে সালমাও আছেন। তিনি মোবাইল ফোনে বারবার জাহিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। কিন্তু ফোনের দিকে তাঁর কোনো খেয়ালই নেই। আসলে প্রচণ্ড শোরগোলে রিংটোন শুনতে পাচ্ছেন না জাহিদ।

অর্পির জ্বর। সালমা ওকে স্কুলের জন্য তৈরি করতে গিয়ে দেখেন গা পুড়ে যাচ্ছে মেয়ের। এ জন্য স্কুলে নিয়ে যাননি। অয়ন অবশ্য স্কুলে চলে গেছে।

অর্পিকে আজ স্কুলে না নিয়ে ভালোই হয়েছে। এই যে আগুন লাগল, এখন কী হতো! শুয়েই ছিল অর্পি। নাশতাও ভালো করে খায়নি। হঠাৎ বলল টিভি দেখবে। টিভিটা চালু করতেই পিলে চমকানো খবর। এরপরই আবার লাইভ শুরু। কোথায় উড়ে গেল অর্পির জ্বর। ছুটে এসে সোফায় বসে গোগ্রাসে গিলতে লাগল সব খবর।

অর্পির চোখ এখন আঠার মতো লেগে আছে টিভিতে। সাংবাদিকরা ওর বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত। এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ‘আপনি আজ তিনটি শিশুর জীবন বাঁচিয়েছেন। এত মানুষের মধ্যে একজনও এই সাহস করেননি। আপনি কোত্থেকে এই মনের জোর পেলেন?’

জাহিদ বলেন, ‘আরে ভাই, আমি আমার মেয়েকে উদ্ধার করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওকে পেলাম না।’

অর্পি সোফা থেকে লাফ দিয়ে চেঁচিয়ে বলে, ‘বাবা, আমি এখানে। বাসায় বসে আছি। এদিকে তাকাও।’

বাবা কি আর শুনবেন ওর কথা? তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। কে একজন চিৎকার করে বলেন, ‘ভাই, আপনি যা দেখালেন, একেবারে সুপারম্যান!’

কটকটির কথা মনে পড়ে যায় অর্পির। এ্যাঁ, বলে কী, বাবা তাহলে সত্যিই সুপারম্যান হয়ে গেছেন! কিন্তু সুপারম্যানের সেই নীল পোশাক কোথায় বাবার?

কৌতূহল দমাতে না পেরে অর্পি বলে, ‘বাবাকে যে সুপারম্যান বলছে, বাবার সেই পোশাক কই, মা?’

মা বলেন, ‘পোশাক ছাড়াও সুপারম্যান হওয়া যায়।’

আরে, ওই তো রুদাপার বাবা। কোলে রুদাপা। পাশে বাবাকে সুপারম্যানের মতো লাগছে।

এতক্ষণে মোবাইল ফোনের রিংটোন শুনতে পেলেন জাহিদ। সালমা জানালেন, অর্পি নিরাপদেই আছে।

অর্পি ছুটে মায়ের হাত থেকে কেড়ে নেয় মুঠোফোন। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘তোমাকে সুপারম্যানের মতো লাগছে, বাবা। বলেছিলাম না—তুমি সুপারম্যান হবে!’