অল্প ভুতুড়ে একটা ঘটনা

রোদের রং এই সময় বদলাতে থাকে।

আশ্বিনের এই সমস্ত দিনে।

সোনালি রোদ হয়, কমলা রোদ হয়।

মেঘের রকমসকমও তেমন।

আকাশের রকমসকমও।

এই ময়ূরকণ্ঠী নীল রঙের আকাশ, সাদা রঙের মেঘ উড়ছে, এই আকাশের রং বেতফলের মতো, মোষের মতো রং মেঘের। মোষরঙা মেঘরা ওড়ে না, ঝিম মেরে থাকে এবং বৃষ্টি হয়ে যায়।

এখন দুপুর। মনে হচ্ছে বিকেল। না, সন্ধ্যা। দ্বিতীয় রকমের মেঘ হয়েছে আকাশে। মাঠের ফড়িং, ফিঙেরা উড়ছে। যেকোনো মুহূর্তে নামবে ঝুমঝুম। তাতে কোনো রকম হেলদোল আছে বলে মনে হলো না একজন মানুষের। লাল ইটের হেরিংবোন রাস্তা সুনসান, আকাশের ম্লান আলোয় কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। মানুষটা সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। যে গতিতে যাচ্ছে, উজানপুরের হাটে যেতে যেতেই ভিজে একসা হয়ে যাবে বৃষ্টিতে। মানুষটা কে?

মানুষটা হলো এনায়েত মাস্টার। শিমুলকাটার সোবহান মাস্টারের ছেলে। শিক্ষক না সে। তার আব্বা সোবহান মাস্টারও না। তাদের বংশের পদবি হলো মাস্টার। সোবহান মাস্টারের আব্বা, এনায়েত মাস্টারের দাদাজানের নাম ছিল ওয়ারেস মাস্টার।

এনায়েত মাস্টারের বয়স ২৬। গেরস্থি করে। সে টাউনে গিয়েছিল সকালে। নদী পার হয়ে টাউন। চিন্তা করেছিল, টাউনের নূরজাহান টকিজে ম্যাটিনি শো দেখে ফিরবে। দেখেনি, মানে দেখতে পারেনি। থার্ড ক্লাসের টিকিট ৫০ টাকা চায়, টিকিট ব্ল্যাকারদের এত দৌরাত্ম্য! তবে তার মন খারাপ হয়নি।  অন্তরে অন্তরে  চলছে নূরজাহান টকিজে। সালমান শাহ-মৌসুমী অভিনীত সুপারহিট ছবি। এই ছবি এরই মধ্যে দুবার দেখে ফেলেছে সে। সালমান শাহর জন্য দেখেছে। তার প্রিয় নায়ক সালমান শাহ। ঢাকায় কখনো গেলে একবার সালমান শাহর সঙ্গে দেখা করবেই সে। যে করে হোক। দেখা না করে শিমুলকাটায় ফিরবে না।

উজানপুরের পর তুমুলিয়া। তুমুলিয়ার পর শিমুলকাটা। আরও আট-নয় কিলোমিটার। মোষরঙা মেঘ গড়গড় করল। বিদ্যুৎ চমকাল। বাজ পড়ল। কিছু সবুজ রং খ্যাচখ্যাচ করতে করতে উড়ে গেল টাউনের দিকে। টিয়েপাখি। কিন্তু সত্যি টিয়েপাখি মনে হলো না। সত্যি মনে হলো উড়ে যাচ্ছে কিছু সবুজ রং। কাকের কা কা আর কর্কশ কতটা, কর্কশ এই পাখিদের খ্যাচখ্যাচ! বাপরে!

আবার মেঘ ডাকল। বিদ্যুৎ চমকাল।

বাবনা একটা ঘুড্ডি আকাশে। দুই রঙের ঘুড্ডিকে তারা বলে বাবনা। আকাশের ঘুড্ডি নীল রং-হলুদ রঙের। এনায়েত মাস্টার খুবই আশ্চর্য হলো। আপন মনে বলল, ‘দেখো কাণ্ড! এই সময় ঘুড্ডি উড়ায় কেউ? পাগলের পাগল!’

কাকে বলল? কাউকেই না। একা থাকলে এ রকম অনেক কথা বলে সে। শিমুলকাটার মানুষজন মনে করে, ছিট আছে সোবহান মাস্টারের ছেলে এনায়েত মাস্টারের মাথায়। তা একটু আছে মনে হয়। নিজেও মনে করে এনায়েত মাস্টার। কী করা আর! এই সমস্ত কথা কাকে বলবে সে? কে শুনবে?

মাত্র এনায়েত মাস্টার যে কথাটা বলল, সেটা কিন্তু একজন শুনল। সে বলল, ‘অ্যাই! অ্যাই! পাগল বলো কেন? পাগল বলো কেন?’

কে রে?

এনায়েত মাস্টারের সাইকেলের ক্যারিয়ারে দেখা গেল ছোট্ট একজনকে। মেঘরঙা মেয়ে। চোখ বড় বড়। নীল-হলুদ ফ্রক পরে আছে। ঘুড্ডিটার মতো। ছোট্ট রূপবতী। এতক্ষণ দেখা যায়নি। অদৃশ্য ছিল? নাকি কোথাও থেকে উঠে পড়েছে? কোত্থেকে? দেখত না এনায়েত মাস্টার? এ ছাড়া এত ছোট্ট একজন, চলন্ত সাইকেলে কী করে উঠবে? তাও এনায়েত মাস্টার আশ্চর্য হলো না। চিন্তাও করল না, ঘটনাটা কী?

বলল, ‘কে গো?’

‘আমি গো! হি! হি! হি!’

‘হাসে দেখি আবার! পাগল!’

‘অ্যাই! অ্যাই! পাগল বলো না! পাগল বলো না! খবরদার! আমার ঘুড্ডি আমি উড়াই না খাই, তোমার কী দুঃখটা শুনি?’

ঘুড্ডিটা সে ওড়াচ্ছে? নাটাই কোথায়? এনায়েত মাস্টার বলল, ‘তা তো ঠিকই, আমার কী দুঃখ? বৃষ্টি হলেও আমার কী দুঃখ? ঘুড্ডি ভিজলেও আমার কী দুঃখ?’

‘সে আমার চিন্তা, আমি চিন্তা করব। তোমাকে অতো চিন্তা করতে হবে না। তুমি সাইকেল ঠিকমতো চালাও। অ্যাকসিডেং করতে চাও নাকি?’

অ্যাকসিডেং! বলল আর এনায়েত মাস্টারের নাকের ডগায় বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাটা পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আকাশ থেকে উধাও হয়ে গেল বাবনা ঘুড্ডি। এবং ঝুমঝুম...আকাশ উজাড় করে নামল। বৃষ্টি! কিছু দেখা যায় না এত বৃষ্টি!

‘দেখো! দেখো! বৃষ্টির রং!’

বৃষ্টির রং! এ আবার কী? বৃষ্টির আবার রং হয় নাকি? এনায়েত মাস্টার বলল, ‘বৃষ্টির  রং?’

‘মনে করে নিলেই হলো।’

একেবারে বড়দের মতো করে বলল।

মনে করে নিলেই হলো? কী মনে করে নেবে এনায়েত মাস্টার? সবুজ রঙের বৃষ্টি? হাওয়াই মিঠাই রঙের?

ছোট্ট রূপবতী, না ছোট্ট পাগলি?

কিন্তু এইটুকু একটা আন্ডাবাচ্চা, এত গুছিয়ে কথা বলতে পারে। যা বলেছে, সেই কথাও তো সত্যি। মনে করে নিলেই হলো। কোন গাঁয়ের? কার মেয়ে এ?

চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই! এই! এই! করে কী? করে কী? তোমাকে কি কানাঅলায় পেয়েছে? কোন দিকে যাও?’

কোন দিকে যাচ্ছে এনায়েত মাস্টার? বৃষ্টির জন্য কিছু দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু একটা আন্দাজ তো আছে। সাইকেল উজানপুরের দিকেই যাচ্ছে। এনায়েত মাস্টার বলল, ‘ঠিকই তো যাই।’

‘ঠিকই তো যাও? ঠিকই তো! ঠিকই তো! হি! হি! হি!’

হাসির কী হলো? আন্দাজমতো উজানপুর অল্প দূর আর। বক্স কালভার্টটা পার হলো সাইকেল। মানুষজন এই কালভার্টটাকে বলে, মাকনা ভূতের পুল। এখানে ভূত দেখেছে অনেকে। লম্বা লম্বা ঠ্যাং, মাকনা খায়। এনায়েত মাস্টার দেখেনি কখনো। ব্যাপার না। ব্যাপার হলো মাকনা ভূতের পুল একটা নিশানা। সাইকেল উজানপুরের দিকে যাচ্ছে।

বৃষ্টি এর মধ্যে বাড়ল, কমল, বাড়ল।

আবার মাকনা ভূতের পুল পার হলো সাইকেল। মনে হলো এনায়েত মাস্টারের।

‘কানাঅলায় পেয়েছে তোমাকে। হি! হি! হি! কানাঅলা! কানাঅলা!’

কানাঅলার কথাও জানে! কানাঅলা একরকমের ভূত। দিক ভুল করায়। যদি ধরে, ঘুরে-ফিরে একই রাস্তায় চক্কর খেতে থাকে মানুষজন। উজানপুর, তুমুলিয়া, শিমুলকাটার কত মানুষকে ধরেছে! এনায়েত মাস্টারকে ধরেনি কখনো। ভূতের দল কোনো কারণে মনে হয় তাকে ধরতে পছন্দ করে না।

এনায়েত মাস্টারের আবার মনে হলো, মাকনা ভূতের পুল পার হলো সে।

আবার মনে হলো।

আবার মনে হলো।

‘হি! হি! হি!...হি! হি! হি!’

পাখির মতো গলা ছোট্ট রূপবতীর। টিয়েপাখি না, দোয়েল পাখির মতো। রিনরিন করছে বৃষ্টির শব্দের মধ্যেও। খানিক বিরক্ত হলো এনায়েত মাস্টার, ‘হাসির কী হলো? কী মুশকিল!’

‘হাসব না, বলো? মুশকিল না, বলো? হি! হি! হি! কানাঅলা না, কানাউলি! হি! হি! হি! একটা কানাউলি ধরেছে তোমাকে! হি! হি! হি!’

এনায়েত মাস্টারের আবার মনে হলো...কী? মাত্র মাকনা ভূতের পুল পার হলো সে।

আবার মনে হলো।

আবার। আবার।

এমন কতবারের পর যে বৃষ্টি ধরল। আশপাশ দেখতে পেল এনায়েত মাস্টার। কিন্তু ক্যারিয়ারের মেঘরঙা ছোট্ট রূপবতীকে আর দেখতে পেল না। বিষয়টা কী?

মাকনা ভূতের পুল পার হলো এনায়েত মাস্টার। উজানপুর অল্প দূর আর। আরকুম শাহর মোকামের নিশান দেখা যাচ্ছে। ভিজে একসা হয়ে গেছে এনায়েত মাস্টার। ব্যাপার না। বৃষ্টিতে কী ঘটল আসলে? মাকনা ভূতের পুলের আগে আগে সত্যি কানাঅলায় পেয়েছিল এনায়েত মাস্টারকে? কানাঅলা না কানাউলি। ছোট্ট এক কানাউলি। কানাউলি! না, ছোট্ট এক রূপবতী। এনায়েত মাস্টার এই ঘটনা বললে বিশ্বাস করবে কেউ? শুধু কানাঅলা বললে বিশ্বাস করত। কানাঅলা না কানাউলি। তাও আবার ছোট্ট রূপবতী। বিশ্বাস করবে কেন মানুষজন? এনায়েত মাস্টারেরও বয়ে গেছে আর কী! সেই-বা বলতে যাবে কেন কাউকে?

খ্যাচখ্যাচ করে কয়েকটা টিয়েপাখি উড়ে গেল টাউনের দিকে। এনায়েত মাস্টার দেখল। তার মনে হলো টিয়েপাখি না, উড়ে যাচ্ছে কিছু সবুজ রং।

অলংকরণ: মামুন হোসাইন