আজবগড়ের আজব বিজয়

অলংকরণ: রিদম

সে অনেক অনেক কাল আগের কথা। তখন এখানে আজবগড় বলে এক রাজ্য ছিল। রাজ্যের সবাই খুব সুখে–শান্তিতে বসবাস করত। হাতিশালে হাতি ছিল, ঘোড়াশালে ছিল ঘোড়া। রাজ্যে সুখেরও কোনো কমতি ছিল না। কমতিই বা থাকবে কেন, এই রাজ্যের রাজার যে প্রজাদের সুখ–শান্তির দিকে খুব খেয়াল।

রাজার আবার এক ছেলে, এক মেয়ে। বড় মেয়ের নাম রাজকুমারী কঙ্কাবতী। আর ছোট ছেলেটার নাম ডালিম কুমার। খেলাধুলায় কঙ্কাবতী অসম্ভব ভালো। তার মতো দ্বিতীয় কোনো খেলোয়াড় রাজ্যে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু খেলাধুলায় ভালো হলে কী হবে, লেখাপড়াতে তার একদম মন নেই। কোনোরকমে পাঠ্যবইটাই যা একটু ঠিকঠাক নেড়েচেড়ে দেখে। অন্যদিকে ডালিম কুমার তার বড় বোনের ঠিক উল্টো। সময় পেলেই হরেক রকমের বই নিয়ে বসে পড়ে সে। খেলাধুলাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তার। তবে এই দুই ভাইবোন সম্পূর্ণ দুই রকম হলেও রাজ্যের সবাই ভীষণ ভালোবাসে তাদের। দুই ভাইবোনও আবার রাজা–রানির চোখের মণি। রাজ্যের মানুষ পারলে তাদের মাথায় করে রাখে।

এই রাজকন্যা-রাজপুত্রের সঙ্গে রাজ্যের সবারই খুব সুখে–শান্তিতে দিন কাটছিল। কিন্তু একদিন গভীর রাতে রাজ্যের এক ঝিলের তলে এসে নামল ভিনগ্রহবাসীদের এক ফ্লাইং সসার। সেখান থেকে বেরিয়ে এল বিশাল এক রোবক্ষস। রোবট ধরনের রাক্ষসদের বলে রোবক্ষস। এই রোবক্ষসরা কিন্তু একা নামল না, তাদের সঙ্গে সঙ্গে পিলপিল করে নেমে এল ছোট ছোট মিনিক্ষসের দল। এরা রোবট রাক্ষসদের চেয়ে আকারে ছোট বলে এদের এমন অদ্ভুত নাম। রোবক্ষসদের বনসাইও বলা যায়।

এই ভয়ানক রোবক্ষস আর মিনিক্ষসরা মিলে রাজ্যে শুরু করল অত্যাচার, কারও পোড়াল গাড়ি, কারও পোড়াল বাড়ি। আর যাকে সামনে পেল তাকেই টপাটপ টফির মতন গিলে ফেলতে লাগল। চারদিকে শুরু হলো ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার।

এই চিৎকার শুনে বের হয়ে এলেন রাজা। রাজ্যের দুর্যোগে কোনো রাজাই ঘরের দরজা লাগিয়ে বসে থাকতে পারেন না, তাই আজবগড়ের রাজাও প্রজাদের রক্ষা করতে লেজার তলোয়ার হাতে বের হয়ে এলেন। তিনি তাঁর সব সেনাপতি আর সৈন্যদের নিয়ে রোবক্ষসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন বীরের মতো। কিন্তু ভিনগ্রহ থেকে আসা রোবক্ষসদের প্রযুক্তির কাছে রাজা আর তাঁর সেনাপতিদের সব অস্ত্র হার মানল।

রাজা তখন বাধ্য হয়ে রোবক্ষসদের সঙ্গে জেতার আশা েছড়ে দিলেন। শুধু তাদের কোনোরকমে ঠেকিয়ে রাখতে লাগলেন, যাতে সাধারণ নিরস্ত্র প্রজারা নিজেদের জীবন নিয়ে পালাতে পারে। প্রজারাও উপায় না দেখে আজবগড় রাজ্য ছেড়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে শুরু করল।

এদিকে রাজা হাল ছেড়ে দিলেও রাজপুত্র আর রাজকন্যা কিন্তু হাল ছাড়েনি। বুদ্ধিমান রাজপুত্র ফ্লাইং সসারের নেটওয়ার্ক হ্যাক করে ফেলল। শুধু হ্যাক করেই ক্ষান্ত হলো না ডালিম কুমার, সে বের করে ফেলল সসারের অবস্থানটাও। হ্যাক করে সেখান থেকে আরও জানল এই সসারের ভেতরেই আছে একটা সোনালি রঙের ডিভাইস আর রুপালি রঙের ডিভাইস। এই দুই ডিভাইসকে এক করলেই চিরতরে ঘুমিয়ে পড়বে রোবক্ষসের দল।

এ কথা জানার সঙ্গে সঙ্গেই দুই ভাইবোন রওনা দিল ঝিলের উদ্দেশে, যেটার নিচে আছে সেই ভিনগ্রহের ফ্লাইং সসার।

ঝিলের ধারে গিয়ে দুই ভাইবোন দেখতে পেল, ঝিল পাহারা দিচ্ছে একগাদা দুষ্ট মিনিক্ষস। দুই ভাইবোন বড় কাউকে ডেকে মিনিক্ষসগুলোকে যে সরিয়ে নেবে, এমন সুযোগ তখন আর নেই। কারণ কেউবা তখন যুদ্ধে ব্যস্ত আর কেউবা পালাতে। ভাইবোন বুঝে গেল, যা করার নিজেদেরই করতে হবে।

রাজকন্যা কঙ্কাবতী তখন ভাইকে ডেকে বলল, ‘ভাই ডালিম কুমার, আমি মিনিক্ষসদের একটা ছোট্ট আক্রমণ করে দৌড় লাগাব। তাতে ওরা আমাকে ধরতে আমার পেছনে দৌড় শুরু করবে, আর এই সুযোগে তুমি নেমে পড়বে লেকের তলায়। পারবে না?’

বোনের অমঙ্গলের আশঙ্কায় কেঁপে উঠল ডালিম কুমারের বুক। সে তাই আপত্তি করে বলল, ‘আমি তো পারব, কিন্তু তোমার যদি কিছু হয়?’

আশ্বাস দিল কঙ্কাবতী। সে বলল, ‘আরে ধুর, বোকা ভাই আমার, আমাকে তো ওরা ধরতেই পারবে না। খেলাধুলাতে কেউ আমাকে আজ পর্যন্ত হারাতে পারেনি। দৌড়ে আমি সবার সেরা।’

বোন যে দৌড়ে সবার সেরা, সেটা ডালিম কুমার ভালো করেই জানত। তাই সে আর দ্বিতীয় উপায় না দেখে বোনের মতেই মত দিল।

রাজকন্যা কঙ্কাবতী তার কথামতো কাজ করল। মিনিক্ষসদের আক্রমণের ছল করে কঙ্কাবতী দিল দৌড়। বোকা মিনিক্ষসরাও পিলপিল করে দৌড় লাগাল তার পিছে পিছে। সুযোগ বুঝে ডালিম কুমার চলে এল ঝিলের কাছে। কিন্তু নামতে গিয়ে দেখতে পেল ঝিলজুড়ে একগাদা রোঙর ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই রোঙর হচ্ছে যান্ত্রিক হাঙর। রোবট ধরনের হাঙর বলেই এদের নাম রোঙর।

ডালিম কুমার তাতে কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে তার গাড়ির কাছে ফিরে এল। সে গাড়ির ট্যাংক থেকে বের করে নিল অল্প কিছু পেট্রল। আর সেটা ছড়িয়ে দিল ঝিলের জলে। বাইরের হাবিজাবি বই পড়ার কারণে সে আগে থেকেই জানে রক্তের গন্ধ পেলে যেমন হাঙরের দল পাগলের মতো সেদিকে ছুটে আসে, তেমনি রোঙরের দলও ছুটে আসে পেট্রলের গন্ধ পেলে।

ঝিলের এক কোণ পেট্রলের গন্ধ পাওয়ামাত্র সাঁই সাঁই করে ছুটে এল রোঙরের দল। আর এই সুযোগে রাজপুত্র বুক ভরে দম নিয়ে লেকের অন্য কোনা দিয়ে নেমে গেল ঠিক পানির নিচে। একদমে গিয়ে উঠল ফ্লাইং সসারের ভেতরে।

ভেতরে ঢুকে একটু খুঁজতেই সে পেয়ে গেল তার কাঙ্ক্ষিত রুপালি ডিভাইস আর সোনালি ডিভাইস। সেটা দেখামাত্র রাজপুত্র একমুহূর্ত দেরি না করে ডিভাইস দুটোকে এক করে দিল।

সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল পুড়ো রোবক্ষস আর মিনিক্ষসের দল। রাজপুত্র ভাবল মিশন সাকসেসফুল, কিন্তু টিকটিক শব্দ শুনে টনক নড়ল তার! একটু খেয়াল করেই বুঝতে পারল ডিভাইস দুটি এক করার সঙ্গে সঙ্গে চালু হয়ে গেছে একটা টাইমবোমা। কয়েক সেকেন্ডের ভেতরই বিস্ফোরিত হবে পুরো ফ্লাইং সসারটা।

রাজপুত্র ডালিম কুমার জীবন বাঁচাতে দ্রুত সাঁতার কেটে ওপরে উঠতে গিয়ে টের পেল তার হাত–পা অসাড় হয়ে আসছে। খেলাধুলা না করার কারণে তার হাত–পায়ে তেমন জোর নেই। এতক্ষণ পানির নিচে থাকার কারণে তার দমও শেষ হয়ে গেছে প্রায়। রাজপুত্র সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল সে আসলে জ্ঞান হারিয়ে ডুবে যাচ্ছে পানির অতল তলে। ঝিলের ওপরে তার পক্ষে আর কোনোভাবেই যাওয়া সম্ভব না, আর এদিকে সসারটা বিস্ফোরিত হতেও খুব একটা বাকি নেই।

রাজপুত্র বুঝতে পারল তার শরীর বিবশ হয়ে গেছে। তার আর কিছুই করার নেই। হাল ছেড়ে দিল ডালিম কুমার। ক্রমশ পানির নিচে তলিয়ে যেতে লাগল সে!

ডুবতে ডুবতে একদম শেষ মুহূর্তে রাজপুত্র টের পেল কেউ একজন তার হাত ধরে টানছে। সেই টানের কারণে কোনোরকম জলের ওপরে উঠে আসতে পারল সে। কিন্তু ওপরে আসামাত্র ভীষণ বিস্ফোরণের শব্দে জ্ঞান হারাল সে।

জ্ঞান ফিরলে রাজপুত্র দেখতে পেল তার পাশেই তার দিদি কঙ্কাবতী বসে আছে। দিদির শরীরও তার মতো পানিতে ভেজা। ডালিম কুমারের বুঝতে বাকি রইল না আসলে তার দিদি কঙ্কাবতীই তাকে শেষ মুহূর্তে টেনে তুলে এনেছে।

তারপর...

তারপর, রাজা–রানি সৈন্য–সামন্ত নিয়ে ছুটে এলেন তাঁর দুই ছেলেমেয়ের কাছে। সবটা শুনে রাজ্যের সবাই রাজকন্যা আর রাজপুত্রকে মাথায় তুলে ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করল। নাচবে নাই–বা কেন? তাদের জন্যই তো আজ রক্ষা পেয়েছে সবার জীবন। সাত দিন, সাত রাত চলে এই নাচানাচি। রাজা অবশ্য এর নাম দিয়েছিলেন বিজয় উৎসব। উৎসব হোক বা শুধু নাচানাচি, অনুষ্ঠানটা কিন্তু জমে ছিল বেশ।

যা হোক, এই বিশাল ঘটনার পর ডালিম কুমার আর কঙ্কাবতী দুজনেই এখন আগের চেয়ে অনেকখানি বদলে গেছে। ডালিম কুমার বুঝতে পেরেছে পড়াশোনা যতই করা হোক শরীর সুস্থ না থাকলে সবই বৃথা। অন্যদিকে কঙ্কাবতী বুঝতে পেরেছে শুধু খেলাধুলা করলেই হবে না দরকার মগজের জোর, তাই দুজন এখন পড়ার সময় পড়ে আর খেলার সময় ঠিকঠিক খেলাধুলা করে। কোনোটাতেই একটুও ফাঁকি দেয় না।

আমার আধুনিক রূপকথা ফুরাল

নটেগাছটিও মুড়াল।