আনন্দ-যাত্রা

অলংকরণ: আবু হাসান

মফস্বল শহরের এক স্কুল। স্কুলের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটা নদী। সব ক্লাসরুমে যখন শিক্ষক থাকেন, ছেলেরা তখন একেবারে চুপ হয়ে যায়। এমনই চুপচাপ যে নদীর জলের কুলকুল শব্দটাও স্পষ্ট শোনা যায় দুপুরগুলোতে। আর তখনই ঘুম নেমে আসে রনির চোখে। ঘুমের জন্য রনি যে কতবার স্যারদের কাছে শাস্তি পেয়েছে তার হিসাব নেই। ইদনীং অবশ্য ক্লাসে ঘুমায় না রনি। কারণ, ঘুম ঘুম ভাব এলেই চিমটি কাটতে থাকে ওর গ্রুপের বন্ধুরা। এমন চিমটি যে একবার খেলে ঘণ্টাখানেকের জন্য ঘুম পালায় অচিনপুরে।

প্রতিটি স্কুলের সব ক্লাসেই কিছু গ্রুপ থাকে। রনিদেরও একটা গ্রুপ হয়ে গেছে। ছয় বন্ধু ওরা। আকাশ, বিজয়, হিমাংশু, রনি, সজীব ও কাজল। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে একসঙ্গে এই স্কুলে পড়ছে ওরা। সামনে ওদের এসএসসি পরীক্ষা। স্কুলের পাশের নদীটি খুব প্রিয় রনিদের। সুযোগ পেলেই নদীর ধারের এক নির্জন জায়গায় ওরা আড্ডা দেয়। স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠান শেষে ওদের প্রিয় জায়গায় বসে পরীক্ষা শেষ করে কক্সবাজার যাওয়ার পরিকল্পনা করল। পরিকল্পনাটি বহু পুরোনো। সেটাকেই আবার ঝালিয়ে নেওয়া। সবাই একবাক্যে রাজি হলেও কিছুটা আমতা-আমতা করতে থাকে কাজল।

আকাশ বলল, দেখ কাজল, তোর জন্য আমাদের অনেক প্ল্যান পণ্ড করতে হয়। এবার দোস্ত তুই বাগড়া দিস না।

কাজল মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, না রে দোস্ত, আমি চেষ্টা করব।

বলে সে উঠে দাঁড়িয়ে কাউকে আর তেমন কিছু না বলে সাইকেল নিয়ে বাড়ির পথ ধরল। কাজল বাদে আর সবার বাসা স্কুলের আশেপাশে। কাজল কয়েক কিলোমিটার দূরের এক গ্রাম থেকে সাইকেল নিয়ে স্কুলে আসে। অন্য পাঁচ বন্ধু সবাই সবার পরিবারের সদস্যদের চিনলেও কাজলের পারিবারিক বিষয়ে ওরা তেমন কিছু জানে না। কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েদের এসব জানার আগ্রহও থাকে না।

যথারীতি এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা শেষ করেই সবাই স্কুলমাঠে জরুরি বৈঠকে বসল। কবে, কীভাবে যাওয়া হবে কক্সবাজার। রনির ছোট মামা কক্সবাজারে চাকরি করেন। রনির বাবা সবাইকে ওখানেই থাকতে বলেছেন। অচেনা জায়গায় একা একা কারও মা-বাবাই যেতে দিতে রাজি হবেন না। তাই সবাই একবাক্যে সিদ্ধান্ত মেনে নিল। ছোট মামা রনির বাবাকে ফোন করে বলেছেন, কক্সবাজারের বাসে তুলে দিলেই উনি বাস স্টপেজে এসে ওদের সঙ্গে করে বাসায় নিয়ে যাবেন। আবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে চার-পাঁচ দিন পর আবার বাসে তুলে দেবেন। রনির আবদারে তার বাবা সবার বাবাকে রাজি করানোর দায়িত্ব নিয়েছেন শুনে সবাই হাততালি দিয়ে রনিকে অভিবাদন জানাল। সবাই সবার বাবার নম্বরটা একটা কাগজে লিখে দিল। কিন্তু কাজল কোনো নম্বরই লিখল না। সজীব কাজলকে বলল, কিরে তুই তো তোর বাবার নম্বরটা লিখলি না। নাকি রনির আব্বুর ফোন ছাড়াই অনুমতি পেয়ে যাবি। তা পেতেই পারিস, প্রতি ক্লাসেই তুই ফার্স্ট হোস। তোকে কি আঙ্কেল কোনো কিছুতে মানা করবেন? সবাই হো হো করে হেসে উঠল। এতক্ষণ কাজল মাথা নিচু করে চুপচাপ সবার কথা শুনছিল। এবার উঠে দাঁড়িয়ে দেখি বলে সাইকেলটা নিয়ে চলে যেতে চাইলে বিজয় রেগে গিয়ে পেছন থেকে ওকে টেনে ধরল। প্রচণ্ড রেগে বলল, সেই ক্লাস সিক্স থেকে দেখে আসছি তোর সবকিছুতেই দেখি আর দেখি। কোথাও খেতে চাইলে দেখি, বেড়াতে গেলে দেখি। গত ঈদে সবাই এক কালারের পাঞ্জাবি কিনতে চাইলাম সেটাও তোর এই দেখির জন্য হয়নি।

এবার হিমাংশু মুখ খুলল, ভালো ছাত্র তো তাই ওর অহংকার বেশি।

সজীব বলল, তাহলে আমাদের এমন অহংকারী বন্ধু লাগবে না।

কাজল আস্তে করে সজীবের হাতটা সাইকেলের ক্যারিয়ার থেকে ছাড়িয়ে বলল, বন্ধু ভাবতে কষ্ট হলে আজ থেকে আর বন্ধু ভাবিস না। তোদের কক্সবাজার ভ্রমণ শুভ হোক। বলেই দ্রুত সাইকেল চালিয়ে চলে গেল।

কাজল চলে গেলে চারদিক অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত ওরা মাঠেই বসে রইল। সবার খুব রাগ হচ্ছিল কাজলের ওপর। এমন একটি স্বার্থপর ছেলেকে এত দিন প্রিয় বন্ধু ভাবার দুঃখে সবাই ব্যথিত ছিল। ওরা ঠিক করল কাজলকে ছাড়াই কক্সবাজার আনন্দ-যাত্রায় যাবে। দেখিয়ে দেবে ওকে ছাড়াও আনন্দ-যাত্রা নিরানন্দ হয়নি। দিন-তারিখ ঠিক হয়ে গেল। টুকটাক কেনাকাটাও করল সবাই। বেশ একটা উত্সব উত্সব ভাব। সবাই সমান হারে চাঁদা ধরেছে। সেই টাকাটা আকাশের কাছে রাখা আছে। সব প্রস্তুতি শেষ। যাত্রার দিন যত ঘনিয়ে আসতে থাকল, ওদের কাজলের জন্য মন খারাপ লাগা বাড়তে লাগল। এত আনন্দ-উচ্ছ্বাসের প্রস্তুতি, তবু কী যেন নেই!

কক্সবাজার যাওয়ার তারিখের ঠিক পাঁচ দিন আগে আকাশই প্রথম কথাটি তুলল, আচ্ছা আমরা কি আরেকটিবার কাজলকে বলতে পারি না? দেখ ওকে ছাড়া আমার ভালো লাগছে না। অন্যরা বোধ হয় এই কথাটার অপেক্ষাতেই ছিল। সবাই যার যার অনুশোচনার কথা বলতে লাগল। এরপর ওরা ঠিক করল আগামীকাল বিকেলে সবাই কাজলের বাড়ি গিয়ে কাজলের বাবাকে অনুরোধ করবে, যাতে সবাই মিলে আনন্দ-যাত্রায় যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো ওর বাড়ি কেউ চেনে না। হিমাংশু এই সমস্যার একটি সমাধান বের করল। দপ্তরি চাচার মাধ্যমে স্কুল রেজিস্টার থেকে গ্রামের ঠিকানা নিয়ে পড়ন্ত দুপুরে পাঁচটা সাইকেল ছুটল কাজলদের গ্রামের পথে। ঘণ্টাখানেক সাইকেল চালিয়ে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে থামল সবাই। আজ ওরা বুঝল কাজল কত কষ্ট করে স্কুলে যেত। তাও প্রতিদিন সবার আগে ক্লাসে গিয়ে ওদের সবার জন্য জায়গা রাখত।

এক লোককে ডেকে ওরা জানতে চাইল রতনগঞ্জ গ্রামটা কত দূর। লোকটি বলল, সামনের পাড়াটি পেরোলেই রতনগঞ্জ। তা বাবারা রতনগঞ্জ কার বাড়ি যাবে তোমরা?

রনি বলল, চাচা, আমরা কাজলদের বাড়ি যাব।

লোকটি বলল, ও তোমরা বুঝি আমাদের কাজলের সঙ্গে পড়ো? বড় ভালো ছেলে আমাদের কাজল।

রনি বলল, জি চাচা। আসলে আমরা কাজলের বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

এবার লোকটি কিছুটা অবাক হলেন। তোমরা কি আসলেই কাজলের বন্ধু?

হিমাংশু বলল, কেন চাচা? এ কথা বলেছেন কেন?

লোকটি বলল, তোমরা যদি কাজলের বন্ধু হয়ে থাকো তাহলে জানো না কেন যে কাজলের বাবা নেই? ওর যখন ছয় মাস বয়স, তখন ওর বাবা দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে গেছে। ওর মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে ওকে লেখাপড়া করাচ্ছিল। সেও আজ কয়েক দিন যাবৎ খুব অসুস্থ। টাকার অভাবে চিকিত্সা করাতে পারছে না। কিন্তু মা-ছেলের এমন জেদ, কারও সাহায্যও নেবে না।

কাজলদের গ্রামের চাচার কাছ থেকে কাজলের গল্প শুনে ওরা রাস্তার ধারে বসে অঝোরে কাঁদল। আকাশ-বাতাস ভারী করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল ওদের। কেমন বন্ধু ওরা? বন্ধু মানেই কি একধরনের ড্রেস পরা, দল বেঁধে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া কিংবা ঘুরতে যাওয়া? এক বন্ধু যদি আরেক বন্ধুর পাশেই দাঁড়াতে না পারে তবে কিসের বন্ধুত্ব! আত্মগ্লানিতে মুষড়ে পড়ল সবাই। চোখ মুছতে মুছতে আকাশ উঠে দাঁড়াল। সাইকেল ঘুরিয়ে শহরের পথ ধরতেই অন্য বন্ধুরা বলল, কই যাস? কাজলের বাড়ি যাবি না?

আকাশ বলল, যাব তো অবশ্যই। কাল আবার আসব। ওকে নিয়ে আনন্দ-যাত্রায় যাব। ওকে ছাড়া কোনোভাবেই যাওয়া হবে না। দেখি ও কীভাবে মানা করে।

পরদিন সকালে কাজল তার মায়ের কপালে জলপট্টি দিচ্ছিল আর নীরবে চোখের জল ফেলছিল। কীভাবে মায়ের চিকিত্সা করাবে ভেবে পাচ্ছিল না ও। শেষ সম্বল মায়ের স্বর্ণের চেনটা ওর পরীক্ষার ফরম ফিলআপে খরচ হয়ে গেছে। যাদের দিন না আনলেও বাকিতে ফুরোয়, তাদের সঞ্চয় বলে কিছু থাকার কথা নয়। কাজলদেরও নেই। ভিটেটুকু আছে। কিন্তু মাকে কোনোমতে রাজি করানো যাচ্ছে না। কাজল চেষ্টা করেছিল মাকে না জানিয়ে গোপনে বেচে দিতে। কিন্তু মাতবর চাচা মায়ের সই ছাড়া জমি কিনবেন না। আজ কাজল যেভাবেই হোক তার মাকে রাজি করাবেই। এসব ভাবতে ভাবতেই শুনল ঘরের বাইরে তার নাম ধরে কেউ ডাকছে। অনেক দিনের বন্ধুদের চেনা কণ্ঠের আওয়াজ শুনেই ওর মনটা উচ্ছল হয়ে উঠল। এরপর আবার চুপসে গেল নিমেষেই। নিজের দারিদ্র্য নিয়ে কোনো গ্লানিবোধ নেই কাজলের। কিন্তু ওর প্রাণপ্রিয় বন্ধুদের কোথায় বসতে দেবে? ঘরের ভেজানো দরজাটা খুলে কাজল ওদের বাড়ির যে একচিলতে উঠান আছে সেখানে নেমে এল।

আকাশ কোনো ভূমিকা না করে বলল, তোর সব গুছিয়ে নে। আমরা কক্সবাজার যাব। কাজলের চুপসে যাওয়া মুখ আরও চুপসে গেল। বলল, বন্ধু তোরা যা। আমার একটু কাজ আছে। আমি যেতে পারব না। রনি বলল, দেখ সবকিছুতেই বাগড়া দিবি না। দয়া করে তুই আর বাধা দিস না। তোর আর চাচির সবকিছু গুছিয়ে নে। আমাদের সঙ্গে চাচিও যাবেন। বিজয় বলল, তুই আসলেই স্বার্থপর। একাই মায়ের সেবা করতে চাস। উনি কি আমাদের মা না?

তোদের বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি আসে না তাই বড় রাস্তার মোড়ে অ্যাম্বুলেন্সটা রেখে এসেছি। মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাব। কিছুদিন চিকিত্সা করালেই মা সুস্থ হয়ে যাবেন। আবার মায়ের মুখে হাসি ফুটবে। সেই হাসির জন্য যে যাত্রা, এর চেয়ে বড় আনন্দ-যাত্রা আর কী হতে পারে?

কাজল হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, তোরা কিরে? তোরা কি মানুষ? ওর অন্য পাঁচ বন্ধু ওর পাশে মাটিতে বসে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। কিছু দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়া সম্ভব হয় না। কারণ, ঝাপসা চোখে কি কোনো কিছু লেখা যায়?