আমন্ত্রণ

স্যার,

চিনতে পেরেছেন? আমি রনি। যার পরীক্ষার খাতায় আপনি দুম করে গোল্লা বসিয়ে দিতেন, সেই রনি! আমার লেখা আপনি পড়েও দেখতেন না। কিন্তু এই চিঠিটা স্যার আপনাকে পড়তে হবে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটা বারবার পড়তে হবে। কেন? স্যার যদি বেয়াদবি না নেন, সেটা আমি একদম চিঠির শেষে বলব।

ভালো কথা স্যার...আমাকে চিনতে পেরেছেন তো? মতলবপুর জলডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়? হ্যাংলা পাতলা, কৃষ্ণকায় ছেলেটা? মনে পড়ে?

আপনি আমাদের বাংলার শিক্ষক ছিলেন। বাংলা ভালো লাগত আমার। কত আগ্রহ নিয়ে আপনার ক্লাসে বসতাম! কিন্তু ক্লাসে আপনি কিছুই পড়াতেন না। পড়াবেনই বা কেন? আমি ছাড়া ক্লাসের সবাই আপনার বাসায় প্রাইভেট পড়ত। আমার একলার জন্য আস্ত একটা ক্লাস নেওয়ার তো কোনো মানে হয় না।

আপনার ক্লাসে প্রতিদিন কান ধরতে হতো আমাকে। কেন ধরতে হতো, সেটা আজ আর মনে পড়ে না। কিন্তু একটা ঘটনা মনে পড়ে, যেটা আমার জীবন বদলে দিয়েছিল। ষাণ্মাসিকে সেবার বাংলা পরীক্ষায় গরুর রচনা এল। ‘গরু একটি গৃহপালিত প্রাণী...’—এ রকম গৎবাঁধা রচনা আমার ভালো লাগত না। আমি তাই মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখলাম! খুব আনন্দ নিয়ে লিখলাম।

যেদিন পরীক্ষার খাতা দেওয়া হবে, ভীষণ রোমাঞ্চে ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিলাম। একটা একটা করে খাতা দেওয়া হয়, আমার খাতা আর আসে না। মনে মনে ভাবছিলাম, আপনি নিশ্চয়ই আমার খাতাটা সবার পরে দেবেন। বড় মুখ করে সবাইকে বলবেন, ‘দ্যাখ, রনি কী সুন্দর লিখেছে! কই রে রনি, আয়, তোর লেখাটা সবাইকে পড়ে শোনা!’ সত্যি সত্যি আমার খাতাটা সবার শেষে হাতে নিলেন আপনি। বললেন, ‘রনি, দাঁড়া।’ আমি লাজুক লাজুক মুখ করে দাঁড়ালাম।

ক্লাসভর্তি ছেলেপুলের সামনে আপনি আমার খাতাটা উঁচু করে ধরলেন। বললেন, ‘সবাই দ্যাখ, রনির গরু ডিম পেড়েছে!’

‘হো হো হা হা!’ ক্লাসে হাসির রোল পড়ল। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এত যত্ন নিয়ে লেখা, এত সুন্দর রচনাটাতে আমি কিনা শূন্য পেলাম! স্যার আপনার নিশ্চয়ই চোখে পড়েনি, আমার চোখ ছলছল করছিল।

নম্বর পাইনি বলে আমার দুঃখ হয়নি। আমার শুধু কষ্ট হচ্ছিল, স্যার আমার লেখাটা পড়েও দেখলেন না! ক্লাস শেষে আমি আপনার কাছে গিয়েছিলাম। স্যার আপনার নিশ্চয়ই মনে নেই। আপনি আমার কান মলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুই তো ব্যাটা ১ নম্বর ফাঁকিবাজ! নয়ছয় করে সময় পার করলে চলবে? যারা আমার কাছে পড়ে, ওদের খাতায় দেখিস। কী সুন্দর গরুর রচনা নোট করে দিয়েছি।’

ঘটনাটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। হলো না। কীভাবে কী হলো, আমি জানি না। পুরো স্কুল আমাকে ‘গরুর ডিম! গরুর ডিম!’ বলে খ্যাপাতে শুরু করল। ছোটরা, বড়রা, সবাই। বাড়িতে ফিরে একদিন খুব কেঁদেছিলাম। সব শুনে বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। সাতপাঁচ ভেবে বললেন, ‘গোটা কয়েক স্কুল বদল না করলে তো জীবনের ষোলো আনাই মিছে! তোর ফুফু এমনিতেও খুব জোরাজুরি করছে তোকে যেন ঢাকা পাঠিয়ে দিই। চল ব্যাটা, কালই যাব। তোকে সেখানকার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব।’

স্যার, আপনার আর বেশি সময় নেব না। বাকি ঘটনা সংক্ষেপে বলি। ঢাকায় আমি ভালো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। রেজাল্ট ভালো ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে স্কলারশিপ পেয়ে গণিতে মাস্টার্স করেছি। দেশে ফিরেছি গত সোমবার।

স্যার, চমক জাগানিয়া তথ্যটা এবার আপনাকে দিই। আপনি নিশ্চয়ই শুনে খুব অবাক হবেন। আপনার সম্মানে আমি ‘আজগর আলী প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে একটা স্কুল চালু করতে যাচ্ছি। স্কুলটা একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তবু আমি চাই, উদ্বোধনের দিন আপনি থাকবেন।

স্যার, অজান্তেই আপনি আমার জীবনে একটা বড় পরিবর্তন এনেছিলেন। আমি এখনো বিশ্বাস করি, সেদিন গরুর রচনায় গোল্লা না পেলে আমার হয়তো আজ এই অবস্থানে আসা হতো না। আগামী ২ সেপ্টেম্বর স্কুলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। স্যার, আপনার আমন্ত্রণ। চিঠির সঙ্গে ১১ ডিজিটের একটা মুঠোফোন নম্বর দিলাম। এই নম্বরে ফোন করলেই রাজীব নামের একটা ছেলে গিয়ে আপনাকে নিয়ে আসবে।

ছোটবেলায় আমার লেখা আপনি পড়েননি। আমি খুব চাই, অন্তত আমার চিঠিটা যেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আপনি একাধিকবার পড়েন। তাই মুঠোফোনের নম্বরটা সরাসরি না দিয়ে একটু রহস্য করে দিলাম। আগামী সপ্তাহের মধ্যে আপনি যদি নম্বরটা খুঁজে না পান, আমিই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। আশা করি ছাত্রের এই ধৃষ্টতা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

ইতি
ওনি

উত্তর

চিঠির ভেতরেই আসলে ফোন নম্বরের সংখ্যাগুলো লুকানো আছে।

নম্বরটা হলো: ০১৯৬৭৫১৬২১১