আমাদের মালেক

অলংকরণ: জুনায়েদ

মালেক আর মঞ্জুকে ডেকে বলি, তালমা নদীর পাড়ে যে পীতরাজগাছটা আছে, ওর মাথায় উঠে যা। নদীর ওপারে শত্রুর গতিবিধি ওখান থেকে দেখা যাবে। সন্দেহভাজন কিছু দেখলে দৌড়ে এসে খবর দিবি। ঠিক আছে কমান্ডার ছাহেব বলে ওরা চলে যায়।

আমাদের হাইড আউট তখন গুয়াবাড়ির জোনাব আলীর বাড়িতে। গত রাতেই এসেছি এখানে। আশপাশের এলাকা এখনো রেকি করা হয়নি। শত্রুর গতিবিধিও জানি না। ডানে আড়াই-তিন মাইলের মধ্যে অমরখানা, শত্রুর দুর্গতুল্য ঘাঁটি সেখানে। তার মাইল দুয়েক পেছনে জগদলহাট, শত্রুর রেয়ার হেডকোয়ার্টার। পঞ্চগড়ের উত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর শেষ অগ্রবর্তী ঘাঁটি অমরখানা এবং পার্শ্ববর্তী অন্য ঘাঁটিগুলো সেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ হয়। আগস্টের শেষাশেষি সময়। বৃষ্টি-বাদলার দিন। অঝোরধারায় বৃষ্টি ঝরে যখন-তখন। সেই বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে আমাদের রাতের অপারেশনে যেতে হয়। একটা কথা তখন চালু হয়ে গেছে, ’বৃষ্টি মানেই যুদ্ধে যাওয়া।’

এখানে এসেই মালেক মঞ্জুকে কাজে লাগাই। দুজনের বয়স কম। দেখতে একদম বাচ্চা ছেলের মতো। এরা মুক্তিবাহিনীতে ঢোকার সুযোগ পেল কেমন করে, সে এক রহস্য। বয়স হবে চৌদ্দ-পনেরো। পাতলা-পুতলা গড়ন। রাইফেল কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটার সময় তার নল মাটির সঙ্গে লেগে যায়। টানতে কষ্ট হয়। তখন এরা আড়াআড়ি করে রাইফেল কাঁধে ধরে রেখে দলের সঙ্গে পা মেলায়। দেশে থাকতে স্কুলে পড়ত। মালেক এইটে, মঞ্জু নাইনে। যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা এরা বুঝতে পারত না। যুদ্ধ যে ছেলেখেলা নয়, মারবেল খেলাও নয়, যুদ্ধের বিভীষিকা যে কত ভয়াবহ হতে পারে, তা এরা ধারণাও করতে পারত না। জয় বাংলা আর বঙ্গবন্ধু ছাড়া কিছু বুঝত না। বিশাল একটা আবেগ এদের সব সময় ঘিরে রাখত। উৎসাহের আতিশয্যে সব সময় টগবগ করত। বলত, কুনঠে যাবা হবে কমান্ডার ছাহেব কহেন দি?

মালেকের চেহারা ছিল একেবারে গ্রামীণ ধাঁচের। রাতের যুদ্ধে গেলে গেঞ্জি পরার উপায় ছিল না। সাদা রঙের জামাও পরা যাবে না। শত্রুর টার্গেট হয়ে যেতে হবে। তিন পকেটের রঙিন শার্ট সরবরাহ করা হয়েছিল ট্রেনিং সেন্টার থেকে। সেই তিন পকেটিয়া শার্ট আর চকরাবকরা রঙের লুঙ্গি ছিল আমাদের যুদ্ধের পোশাক। তো, সেই পোশাকে সজ্জিত হয়ে মালেক মঞ্জু যখন ফল-ইনে দাঁড়াত, তখন ওদের চেহারা হয়ে যেত কিম্ভূতকিমাকার ধরনের। ঢোল ঢোল করছে জামা হাঁটুর নিচ অবধি। রাইফেল ঝুলছে পায়ের পাতা অবধি।

মালেক ছিল খুবই সাহসী আর বিশ্বাসী। যেকোনো অপারেশনে পাঠালে ওর কখনো না ছিল না। শুধু ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলেই হলো। নির্দ্বিধায় চলে যাবে শত্রুঘাঁটির দিকে। আরোপিত কাজটি সফলভাবে করে সে ফিরবে। কথাবার্তা বোকাসোকা ধরনের। কিন্তু অপারেশনকালে সে তার প্রখর বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ ঘটাত। বহুবার সে মরতে মরতে বেঁচে এসেছে। শত্রুর শক্ত ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়েও ঠিক পিছল কেটে বের হয়ে এসেছে।

কথাবার্তাও তার স্পষ্ট ছিল না। কথা বলার সময় ছ অক্ষরটির উচ্চারণ চলে আসত। যেমন বলত, কমান্ডার ছাহেব, অপারেছন, ছবখানে, ছবাই এই ধরনের। যুদ্ধের টার্মগুলোও ভালোভাবে বলতে পারত না। নিজেকে বলত গরিলা। গেরিলা কথাটি বলতে পারত না। বলত, হামরালা তো গরিলা বাহে, গরিলা যুদ্ধ করেছি। হল্ট কথাটা বলত হল্টাও বলে। অ্যামবুশকে বলত এমবুছ। সব সময় আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলত। ঠাকুরগাঁওয়ের চিলারং গ্রামের ছেলে। বাড়িঘরের জন্য কোনো চিন্তাভাবনা ছিল না। মাঝেমধ্যে বলত, মুই তো মুক্তিবাহিনীত অসিছু, মোর বাপমাক বুঝিল খানের ঘর মারি ফেলাইছে গে। এতটুকুই। বাচ্চা ছেলেদের যেমন বাড়িঘরের প্রতি পিছুটান থাকে, মা-বাবা আত্মজনের জন্য যেমন সব সময় মনের ভেতর হাহাকার থাকে। মালেকের এসব কিছু ছিল না। বরঞ্চ অন্যদের মনমরা দেখলে সে বলত, তোমরা বেটি ছাওয়ার মতো মন খারাপ করেছেন ক্যান গে? হামরা তো মুক্তিযুদ্ধ করেছি। শালা খানের ঘরোক শ্যাষ করিয়া দ্যাশ স্বাধীন করিমো, জয় বাংলা করিমো। স্বাধীন দ্যাশ হইলে দেখবেন হামার কত খাতির! মানুষ মাথাত তুলিয়া নাচিবে। মন খারাপ করেন না গে। যুদ্ধের মইধ্যে মন খারাপ ভালো না হায়।

গেরিলা যুদ্ধে মাঝেমধ্যে একক অভিযানে পাঠাতে হয়। এটাকে বলা হয় সুইসাইড মিশন। মালেক, একাব্বর, লাল মিয়া, সজিমউদ্দিন, চাঁন মিয়া, মাজেদ, শম্ভু, খলীল, মতিয়ার—এরা সব সুইসাইড মিশনের সদস্য। তবে মালেকের সফলতার হার অনেক বেশি। এ জন্য ওকেই অধিকাংশ দুঃসাহসিক একক মিশনগুলোর জন্য নির্বাচন করি। রাতে সে পথ চলে ভূতের মতো। দিনে একবারে দেহাতি বালক। কোমরে গামছায় প্যাঁচানো থাকে গ্রেনেড, দুটা কিংবা চারটা। গোঁজানো থাকে বেয়নেট। এই তার অস্ত্র। সুবোধ বালকের মতো সে হেঁটে যায় রাস্তা ধরে। মিশে যায় জনপদের মানুষদের সঙ্গে। সেই ফাঁকে সে শত্রু অবস্থানের নকশা করে ফেলে, শত্রুর সংখ্যা, তাদের বাংকার ট্রেঞ্চ লাইন, অস্ত্রগুদাম, রসদ সরবরাহ লাইন, শত্রুর সাহায্যকারী শান্তি কমিটির নাম, তাদের বাড়িঘর—সব জেনে আসে নির্ভুলভাবে। আবার শত্রুর কোনো অবস্থানে গ্রেনেড চার্জের জন্য পাঠালে চুপিসারে সেখানে গিয়ে সফল গেনেড হামলা চালিয়ে তাদের ক্ষয়ক্ষতি করে আসে।

সেদিন সন্ধ্যায় ওকে ডেকে বলি, মালেক, তোকে আজ একখানে পাঠাব। কাজটি কিন্তু কঠিন। সপ্রতিভভাবে সে বলে, কহেন গে কমানাডার ছাহেব, মোক কুনঠে যাবা হবে। বলি, একবারে বাঘের ঘরে, পারবি? পারিমো, তুমরা যেইঠে যাবা কহিবেন অছুবিদা নাই। বাঘের ঘর হউক আর সিংহের ঘর হউক। ওকে বুঝিয়ে দিই। অমরখানা পাকঘাঁটি আমরা আক্রমণ করব। এ জন্য নির্ভুল রেকি করা দরকার।

ভোর ভোর সময়ে মালেক ফিরে আসে। বিধ্বস্ত চেহারা। বলে, পানি খাম। এক বদনা পানি সে ঢকঢক করে খেয়ে বলে, কমান্ডার ছাহেব, আইজ খালি বরাতগুণে বাঁচি আসিছি। তারপর সে যে ঘটনা বলে, তা রীতিমতো রোমহর্ষক। রাতের অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গিয়ে সে হনহন করে হেঁটে পৌঁছে গেছে অমরখানায়। দাঁড়িয়েছে একটা উঁচু ঢিবির মতো জায়গায়। কালো অন্ধকারে চারদিকটা ভালো করে দেখা যায় না। চেষ্টা করছে এর মধ্যেই সবকিছু ঠাহর করতে। হঠাৎ শুনতে পায় ঢিবির নিচ থেকে মানুষের কণ্ঠ। ব্যাপার কী? বুঝতে পারে ভীষণ ভুল হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে আছে পাকসেনার বাংকারের ওপর। তার রক্ত হিম হয়ে আসে। বুঝে নেয়, সে বাঘের ঘরেই এসে ঢুকেছে। এখন এখান থেকে নামতে গেলেই বিপদ। ঠিক শত্রুর নজরে পড়ে যাবে। আর তাহলেই ঠাঠা গুলি। একেবারেই শেষ। তখন সে বাংকারের ছাদে শব্দহীনভাবে বসে পড়ে। থাকে নিঃসাড় হয়ে। উপায় খুঁজতে থাকে পালানোর। কতক্ষণ এভাবে ছিল বুঝতে পারেনি। হঠাৎ অমরখানার ওপর মিত্রবাহিনীর বুম বুম কামানের শেল পড়া শুরু করল। কানে তালা লাগানো শব্দে সেগুলো বিস্ফোরিত হতে থাকল। শুরু হলো পাকিস্তানি সৈনিকদের ছোটাছুটি। ধোঁয়া, ধুলায় ক্যাম্প ভরে গেল। সেই ফাঁকে বাংকারের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে সে দিগিবদিকশূন্য হয়ে শুরু করল দৌড়। আকাশ ফরসা হলে সে রাস্তা চিনে হাইড আউটে ফিরে এসেছে।

ঘটনার বর্ণনা শেষে সে বলে, কেমন করি মুই বাচি আসিনু কমান্ডার ছাহেব কহেন দি? মালেককে বুকে টেনে নিই। মাথায় হাত বুলিয়ে বলি, তুই হচ্ছিস মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তির দূত। সৃষ্টিকর্তা মুক্তির দূতদের এভাবে মৃত্যু দেন না। যা, রেস্ট নে, দুদিন তোর ছুটি। শিশুতোষ হাসি দিয়ে মালেক ধীরপদে হাইড আউটের ভেতরে চলে যায়। মনে মনে বলি, না, মালেকেরা আছে, অন্যরা আছে। আমাদের স্বাধীনতাকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না। হবেই আমাদের স্বপ্নের জয় বাংলা।