আমাদের হাসিখুশি সেন্টার

অলংকরণ: শিখা

আমাদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, বাংলার টিচাররা নরম-সরম হবেন, ইংরেজির টিচাররা হবেন খানিকটা গরম প্রকৃতির। এ বছরের শুরুতে আমাদের করিমুন্নেসা গার্লস স্কুলে দুজন পুরোনো টিচার চলে গেছেন, এরই মধ্যে শূন্যস্থান পূরণ করেছেন নতুন দুজন। সেই সঙ্গে আমাদের ওই ধারণাও পাল্টে গেছে। আমাদের নতুন বাংলার টিচারের নাম আনিকা আলীম, বয়স ৩০-৩২ হবে। ইংরেজি টিচারের নাম নুসরাত জাহান, বয়স আন্দাজ করা কঠিন। তারপরও আমরা ক্লাস এইটের মেয়েরা বিস্তর গবেষণা করে বের করেছি, তাঁর বয়স ষোলো হতে পারে আবার চল্লিশও হতে পারে। নুসরাত ম্যাডামের বয়স আন্দাজ করা কঠিন কারণ, তাঁর আচরণ। এই কিশোরীদের মতো চঞ্চল, আবার এই তো একেবারে চুল পাকা বুড়োদের মতো গম্ভীর! অন্যদিকে আনিকা ম্যাডামের মেজাজ সারাক্ষণ স্কুলের সবচেয়ে উঁচু নারকেলগাছটার ওপরে উঠে থাকে! ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলা সাহিত্যের চেয়ে আমরা এখন ইংরেজি সাহিত্যের অনুরাগী হয়ে উঠেছি। আমাদের উপজেলায় সেভাবে ইংরেজি গল্পের বই পাওয়া যায় না। কিন্তু নুসরাত ম্যাডাম আমাদের মজার মজার ছবিওয়ালা সব বইয়ের ভান্ডার দিয়েছেন। সেগুলো পড়ে কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না। যেগুলো বুঝি না, ম্যাডাম সেগুলো চমৎকারভাবে বুঝিয়ে দেন! এই যেমন কদিন আগে ম্যাডাম একটা বই দিলেন, বইটার নাম দ্য বিএফজি। বিএফজি মানে হচ্ছে বিগ ফ্রেন্ডলি জায়ান্ট—বিরাট দৈত্য বন্ধু!

বইটা নিয়ে একটা সিনেমাও বের হয়েছে। ম্যাডাম মুঠোফোনের প্রজেক্টর দিয়ে সেটা দেখিয়েছেনও আমাদের! কী যে অদ্ভুত একটা সিনেমা! বইটার প্রধান চরিত্রের নাম সোফি। আমাদের ক্লাসে একজন আছে, যার নাম সুফিয়া। ম্যাডাম এখন ওকে সোফি নামেই ডাকেন। ম্যাডাম ডাকেন, ফলে আমরাও ওকে সোফি নামেই ডাকতে শুরু করেছি। সোফি প্রথম প্রথম গাঁইগুঁই করলেও এখন হাসিমুখে উত্তর দেয়। সেই সোফি তিন দিন ধরে ক্লাসে আসছে না দেখে নুসরাত ম্যাডাম বললেন, ‘ও থাকে কোথায়?’

সোফিদের বাসা উপজেলা সদর থেকে একটু দূরে, শ্মশানঘাট বাঁয়ে রেখে সোজা চলে যেতে হয়। ওর আশপাশে কেউ থাকেও না। ফলে এ-ওর দিকে তাকিয়ে জুঁই বলল, ‘ম্যাডাম, অনেক দূরে।’

: অনেক দূরে আবার কেমন জায়গা?

: অনেক দূরে মানে ম্যাডাম, শ্মশানঘাট থেকে আরও দুই কিলোমিটার।

: ও স্কুলে আসছে না কেন, জানো?

আমরা একসঙ্গে ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ালাম। ম্যাডামও ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘এটা তো ভালো বন্ধুদের লক্ষণ না! ওর বাসার কারও মোবাইল ফোন নম্বর নেই তোমাদের কাছে?’

আমরা আবারও একে-অপরের মুখের দিকে চাইলাম, না, কারও কাছেই নেই। তাই শূন্য দৃষ্টিতে ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ম্যাডাম রোলকলের খাতা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘রুবা, তুমি আজকেই ওর খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাবে। ওর সমস্যা কী, সেটা জানতে চাই।’

আমি একান্ত অনুগতের মতো মাথা নেড়ে বললাম, ‘জি, ম্যাডাম।’

২.

ক্লাস শেষে সোফির পাশের বাসায় থাকে এমন একটা মেয়েকে খুঁজে বের করলাম আমি। ক্লাস সিক্সে পড়ে মেয়েটা, নাম পারুল। ও বলল, ‘সুফিয়া বুর পেটব্যথা।’ শুধু পেটব্যথার জন্য তিন দিন স্কুল কামাই দেওয়ার মেয়ে নয় সোফি। নুসরাত ম্যাডামকে সেটা বলার পর তিনিও মাথা নাড়লেন, বললেন, ‘কালকে ওর বাসায় যেতে হবে। পারবে না যেতে?’ আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম।

পরদিন স্কুল শেষে নুসরাত ম্যাডাম, পারুল আর আমি সোফিদের বাসায় গেলাম। গ্রামের বাড়ি যেমন হয়, সোফিদেরটাও তেমন। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ঝুম বৃষ্টি নামল। ঘরের ভেতরটা এমনিতেই অন্ধকার, তার ওপর মেঘলা বিকেলে ঘরের ভেতরের সবকিছু পরিষ্কার হতে কিছুটা সময় নিল।

সোফির মা আমাদের দেখে মাথার আঁচল আরও সামনে টেনে বললেন, ‘সুফির তো সমস্যা চলে। তার ওপর পেটব্যথা। বিছানা ছাইড়া উঠতেই পারে না! স্কুলে যাইব ক্যামনে!’

চোখে অন্ধকার সয়ে যাওয়ার পর আমরা সোফিকে বিছানায় আবিষ্কার করলাম। কুঁকড়ে-মুকড়ে শুয়ে আছে বেচারি। নুসরাত ম্যাডাম ওর কপালে হাত রেখে বললেন, ‘ব্যথা কি খুব বেশি?’

একে তো পেট ব্যথা, তার ওপর সোজা ওর বাসায় হাজির হওয়ায় বেচারি ভীষণ বিব্রত। কোনো রকমে উঠে বসার চেষ্টা করে বলল, ‘খুব!’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওষুধ খেয়েছিস?’

সোফির মা পাশ থেকে বললেন, ‘এইটা এমনেই ঠিক হইয়া যাইব।’

নুসরাত ম্যাডাম মাথা নেড়ে বললেন, ‘এমনি এমনি ঠিক হবে না।’ সোফির মায়ের দিকে ঘুরে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, ‘ও কী খাচ্ছে?’

: কী আর খাইব, আপা! এই সময় নরম ভাত ছাড়া আর কিছু খাওন ঠিক না।

: না না, এটা ভুল ধারণা! আপনি ওকে পুষ্টিকর খাবার খেতে দেন। এমনি সময় যা খায়, তা-ই বেশি করে খাক। এ সময় তো শরীরের জন্য আরও বেশি পুষ্টি দরকার।

কথা বলতে বলতে খেয়াল করলাম, সোফির মুখটা আরও কাতর হয়ে উঠছে। নুসরাত ম্যাডাম ওর হাত ধরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পেটব্যথা কি আরও বাড়ছে?’

সোফি ঠোঁট কামড়ে, চোখ বন্ধ করে মাথাটা নাড়ল শুধু। ম্যাডাম আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওকে এখনই হসপিটালে নিতে হবে।’

সোফির মা কিছুতেই রাজি হবেন না। ম্যাডাম অনেক বলে-কয়ে রাজি করালেন। সোফিকে নিয়ে হাসপাতালে আসতে আসতে রাত আটটা বেজে গেল।

৩.

ডাক্তার দেখানোর আরও দুই দিন পর সোফি স্কুলে আসতে পারল। চেহারায় ধকলের ছাপ স্পষ্ট। নুসরাত ম্যাডাম ওকে দেখে খুশি হয়ে বললেন, ‘সোফি, এখন কেমন আছ?’

সোফি মাথা নেড়ে বলল, ‘ভালো আছি, ম্যাডাম।’

নুসরাত ম্যাডাম ক্লাসের সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শোনো, তোমাদের বয়সে প্রত্যেককেই সোফির মতো এই ব্যাপারটা মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এটা কোনো সমস্যা না বা রোগও না। পিরিয়ডকে আর দশটা সাধারণ ব্যাপারের মতোই দেখো। তবে প্রতি মাসে এটা খুব সাধারণ ব্যাপার হবে তখনই, যখন আমরা এটার জন্য ভালোভাবে প্রিপেয়ার হতে পারব। সোফির মতো অন্য কেউ যেন না ভোগে, এ জন্য একটা কাজ করতে চাই। তোমাদের হেল্প দরকার।’

আমরা সবাই একসঙ্গে বলে উঠলাম, ‘কী হেল্প, ম্যাডাম?’

: আমরা স্কুলে একটা হেল্প সেন্টার খুলতে চাই। যেখানে তোমাদের স্বাস্থ্যসমস্যার সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। এছাড়া তোমাদের মানসিক নানা সমস্যা, নারী নির্যাতন, জীবন বা পরিবার গঠন, যৌতুক, কম বয়সে বিয়ের মতো সমস্যাগুলোর সমাধানের পথ খোঁজা হবে। চাইলে এখানে তোমাদের মা-বাবাদের সঙ্গেও কথা বলব আমরা। সেদিন পত্রিকায় পড়লাম, দেশে এখন কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ। কিন্তু এত কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্যের জন্য মাথাপিছু সরকারি ব্যয় বছরে মাত্র ৮৬ পয়সা!

‘মাত্র ৮৬ পয়সা!’ বিস্ময়ের একটা গুনগুনানি ছড়িয়ে পড়ল পুরো ক্লাসে।

: হ্যাঁ, মাত্র ৮৬ পয়সা। দেশের ২ কোটি ৯০ লাখ কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে কারও মাথাব্যথাই নেই, তেমন কার্যক্রমও নেই। তাই আমি ঠিক করেছি, এটা নিয়ে ফেসবুকে লেখালেখি করব। যাতে আমাদের এখানকার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আমাদের হেল্প করে। তোমরা কী বলো?

আমরা সবাই সমস্বরে বলে উঠলাম, ‘আমরা আপনার সাথে আছি, ম্যাডাম!’

৪.

এক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের স্কুলে নুসরাত ম্যাডামের হেল্প সেন্টার খুলে গেল। সেটা খোলা হলো আন্তর্জাতিক যুব দিবসে মানে আগস্ট মাসের ১২ তারিখে। নুসরাত ম্যাডাম হেল্প সেন্টার খোলার আগে বললেন, ‘বিশ্বব্যাপী তরুণ ও যুবদের সমৃদ্ধ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক যুব দিবস পালিত হয়। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ দিবসটা পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০০ সালের ১২ আগস্ট থেকে এটি পালন করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বিভিন্নভাবে তরুণ ও যুব সমাজকে সচেতন করা হয়। আমরাও তো যুবক-তরুণদের মধ্যে পড়ি। তাই এই দিনে আমাদের হেল্প সেন্টারটা খোলা হলো।’

আমাদের হেল্প সেন্টারের নাম রাখা হলো হাসিখুশি সেন্টার। খুঁজে দেখা গেল, প্রায় সব ক্লাসের মেয়েদেরই অনেক সমস্যা। আশার কথা হলো, সবাই এখন হাসিখুশি সেন্টারে আসছে। কাউকেই এখন আর স্কুল কামাই দিতে হবে না। নুসরাত ম্যাডাম এত চমৎকার কাজ করলেন, এ জন্য আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তাই আমরা তাঁর একটা নতুন নাম দিয়েছি। বিগ ফ্রেন্ডলি জায়ান্টের অনুকরণে বিগ ফ্রেন্ডলি অ্যাঞ্জেল!