আমার মা ও মা

‘মামা, ও মামা।’

তিনার ডাকে উত্তর না দিয়েই মামা চুপ করে বসে রইল।

তিনা আবার ডাকতে শুরু করল মামাকে।

‘মামা, ও মামা। তুমি না আমার আদরের মামা?’ মামা এবারও নিশ্চুপ, কারণ সে জানে তিনা কী বলবে। তিনা এবার ক্লাস থ্রিতে উঠেছে। ট্যাটন টাইপের মেয়ে বলতে যা বোঝায় তিনা তা-ই। মামা তিনার কথার জবাব না দিয়েই তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ টিভিতে মনোযোগ দিয়ে খেলা দেখতে শুরু করল। তিনাদের বাসাতেই তার মামা থাকে। মামার কাজ একটাই, আর তা হলো সারা দিন টিভিতে খেলা দেখা। তিনা নাকি সুরে মামাকে খোঁচাতে লাগল। ‘তুমি জানো মামা কাকে বলে?’ এবার আর মামা কথা না বলে থাকতে পারল না। জিজ্ঞেস করেই ফেলল, ‘কাকে বলে?’ ‘মামার সংজ্ঞা হচ্ছে—মা+মা=মামা অর্থাৎ মা-এর স্কয়ার। মামা হচ্ছে ডাবল মা। মানে মায়ের যা দায়িত্ব মামার তার ডাবল দায়িত্ব।’ মামা গলায় রাগত স্বর এনে জিজ্ঞেস করল, ‘তো আমাকে কী করতে হবে?’ তিনা মুখে একটা মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘মামা, তুমি শুধু রিমোটটা আমাকে দাও আর লক্ষ্মী ছেলের মতো দুধটা খেয়ে নাও। আজকের মতো মামা। বাঁচাও প্লিজ।’ মামা প্রায় চিত্কার করে বলল, ‘আপা যদি জানতে পারে তাহলে আমার অবস্থাটা কী হবে, একবার ভেবে দেখেছিস?’ ‘আম্মু ভুলেও জানতে পারবে না মামা। আজকেই শেষ মামা। আর জ্বালাব না। প্রমিজ।’ ‘যেই প্রমিজ রাখতে পারিস না, সেটা করবি না।’ এই কথা বলে মামা দুধের গ্লাসটা এগিয়ে নিল। রাতে গ্লাসভর্তি দুধ খাওয়া থেকে বাঁচার জন্য প্রতিদিনই তিনা আর তার মামার ভেতর একতরফা নাটক হয়ে যায়। মামার কাছ থেকে খালি গ্লাসটা নিয়ে আম্মুর কাছে ফেরত দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে লক্ষ্মী মেয়ে সেজে তিনা ঘুমিয়ে পড়ল। প্রজাপতির পাখায় চড়ে তিনা আকাশে উড়ছে। প্রজাপতিরা তাদের রাজ্যে তিনাকে নিয়ে যাচ্ছে। সে পরেছে প্রজাপতির পাখার রঙের সুন্দর একটা ফ্রক আর মাথায় মুকুট। তিনার খুব আনন্দ হচ্ছে। প্রজাপতির রাজ্যে না যেতে যেতে ঘুমটা ভেঙে দিল তিনার আম্মু।

‘তিনা, তাড়াতাড়ি উঠ। দেখ কে এসেছে।’ ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে তিনা তো পুরোই ভ্যাবাচ্যাকা। তার সবচেয়ে পছন্দের মানুষ স্বয়ং তার সামনে দাঁড়িয়ে। শরীরে চিমটি কাটল তিনা। না, সে স্বপ্ন দেখছে না। কোনো কথা না বলে এক ঝাঁপ দিয়ে নানাভাইয়ের কোলের ওপর পড়ল সে। খুব খুশি লাগছে তার। কত দিন পর নানাভাই এসেছে। একটা উত্সব উত্সব ভাব নিয়ে সবাই খেতে বসল। খেতে বসে তিনা যা শুনল তাতে নানাভাই পছন্দের মানুষ থেকে লাফ দিয়ে অপছন্দের তালিকায় চলে গেলেন।

কথাগুলো এই রকম, ‘বুঝলি রেখা, আমি গাধাটাকে (গাধা হচ্ছে ছোট মামা) নিতে এসেছি। ওকে দিয়ে যে পড়াশোনা হবে না সেটা আমি তোদের অনেক আগেই বলেছিলাম। তোরা তো আমার কথা শুনলি না। চারবারের বারও ইন্টার ফেল! গাধাটাকে বিয়ে দেব। পাত্রী ঠিক করে এসেছি।’

নানাভাইয়ের কথার ওপর কথা বলার সাহস কারও নেই, তাই তিনার আম্মুও চুপ করে শুধু মাথা নাড়লেন। পরদিন তিনার নানা তার ছোট মামাকে সঙ্গে তিনাদের সবাইকে নিয়ে রওনা হলেন গ্রামের বাড়িতে।

বিয়েবাড়িতে চারদিকে উৎসব উৎসব ভাব। সবাই অনেক মজা করছে। শুধু মন খারাপ করে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে তিনা। নতুন বউকে দেখে সবাই খুব খুশি। অখুশি শুধু তিনা। নতুন বউয়ের দিকে তিনা এমনভাবে তাকাল যে চোখ থেকে আগুন বের হওয়ার কোনো সিস্টেম থাকলে লাল শাড়ি পরা সাজুগুজু করা মেয়েটা এতক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে যেত হয়তো। এই মেয়েটার জন্যই কাল থেকে তিনাকে প্রতি রাতে গ্লাসভর্তি দুধ খেতে হবে। এমনকি হোমওয়ার্কগুলোও তার নিজেকে করতে হবে।