শেষ পর্যন্ত যে জয়ী

এই গল্প দুই ভাইকে নিয়ে। তারা ঠিক করল, পর্যটনে বেরোবে। গ্রাম থেকে গ্রামে যাবে। ঘুরেটুরে দেখবে শহরের পর শহর। এই যে ঘোরাফেরা, বেড়ানো—তার একটা উদ্দেশ্য আছে। সেই উদ্দেশ্যটা হলো সুখের অন্বেষণ। কোথায় সুখ আছে, সেটা খুঁজেপেতে বের করবে তারা। বের করতে পারলে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। অনেক ভাবনাচিন্তা করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুই ভাই।

একদিন তারা রওনা হয়ে গেল। কবে যে আবার এই বাড়িতে ফিরে আসা যাবে, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। সে জন্য যথেষ্ট টাকা-পয়সা নিতে হবে সঙ্গে। তা নিলও তারা।

যেতে যেতে দেখা হয়ে গেল এক বুড়ো মানুষের সঙ্গে। তাঁর মুখভর্তি দাড়ি। শাদা রঙের। মানুষটি আসছিলেন ওদের উল্টো দিক থেকে। দুই ভাইকে দেখে তিনি থামলেন। দেখে মনে হয় উনি খুব ভালো মনের মানুষ। শান্ত-সৌম্য চেহারা। তাঁর চোখে-মুখে গভীর প্রশান্তি। তিনি জানতে চান, ‘কোথায় চলেছ বাবারা? তোমরা আসছই বা কোত্থেকে?’

দুই ভাইয়ের মধ্যে যে বড়, সে উত্তর দেয়। বাড়ির ঠিকানা বলে, সুখের খোঁজখবর করতে যে বেরিয়েছে, সেটাও জানায়।

বুড়ো মানুষটি বলেন, ‘বাহ! বেশ বেশ। নিতান্তই ছেলেমানুষ তোমরা। তা আমি কি তোমাদের একটু সহায়তা করতে পারি? তোমাদের দেখে খুব মায়া লাগছে কি না।’

এমন কথা বলবেন ইনি, দুই ভাই তা ভাবতে পারেনি। বেশ অবাকই হয় তারা। কোনো কথা বলে না।

মিনিট খানেক পর ভদ্রলোক আবার তাড়া দেন, ‘কই, তোমরা যে কেউ কিছু বললে না? আমার সাহায্য কি তোমরা নিতে চাও না?’

ছোটভাই মাথা চুলকে জবাব দেয়, ‘কী যে  বলেন! আপনার কোনো সহায়তা পাওয়া তো সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমরা রাজি আছি।’

এ কথা শোনার পর ভদ্রলোকের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। পকেট থেকে তিনি কয়েকটা সোনার মোহর বের করেন। দুই ভাইয়ের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার কাছে কয়েকটা সোনার মোহর আছে। তোমাদের মধ্যে কে সেগুলো চাও, বলো।’

বড়ভাই সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আমাকে দিন। আমি ওর চেয়ে বয়সে বড়। এগুলো আমারই প্রাপ্য।’

দুই ভাইয়ের মধ্যে বড়ভাইটা খুবই স্বার্থপর। নিজেরটা বোঝে ষোলোআনা। সারাক্ষণই তার মাথায় এক চিন্তা—কীভাবে ধনী হওয়া যায়। এর জন্য যা যা করা লাগবে, তার সবই করতে সে প্রস্ত্তত। এতে যদি ছোটভাইকে ঠকাতেও হয়, তা-ও সই।

ভদ্রলোক তাঁর অন্য পকেটে হাত ঢোকালেন। বের করে আনলেন খুবই দামি একটা রত্ন। এটা সোনার চেয়েও বেশি মূল্যবান। সূর্যের আলোয় চকচক করছে। মুচকি হেসে তিনি বলেন, ‘এই রত্নটা কে নিতে চাও?’

‘আমি চাই, আমি। আমাকেই দিন।’

বড়ভাই ঝটপট উত্তর দেয়। তর সইছে না তার। কখন এই রত্ন সে মুঠোবন্দী করতে পারবে, মাথায় সে চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে।

ভদ্রলোক বড়ভাইয়ের হাতে দামি রত্নটি তুলে দেন। ছোটভাই কিন্তু কিচ্ছু বলছে না। চুপচাপ দেখছে শুধু। সে লোভী নয়। কোনো বেহায়াপনাও তার স্বভাবে নেই।

কয়েক মিনিট কেটে গেল। সবাই চুপচাপ। নীরবতা ভাঙলেন অচেনা ভদ্রলোকই। বললেন,

‘আমার পিঠে ভারী একটা বোঝা আছে। তোমরা সেটা দেখতে পাচ্ছো। অনেক দূরের গ্রামে যেতে হবে আমাকে। আমি বুড়ো মানুষ। দুর্বল শরীরে অতটা ধকল সইতে পারি না। তোমাদের বয়স কম। তাকত, সামর্থ্য আমার চেয়ে ঢের ঢের বেশি। এই বোঝাটা বইতে আমাকে কেউ সাহায্য করবে তোমরা? বলো তো, কে করবে এই কাজটা?’

বড়ভাই চুপ। যেন কিছুই শোনেনি, এমন ভান করছে। রত্ন পাওয়ার আনন্দে বিভোর হয়ে আছে সে।

ছোটভাই কোনো কথা না বলে বোঝাটা কাঁধে তুলে নেয়। হাসিমুখে বলে, ‘সমস্যা নেই। মুরব্বি চলুন, আমরা এখনই রওনা হই। আপনি যেখানে যাবেন, আমি সেখানে এই বোঝা পৌঁছে দেব।’

বুড়ো মানুষটি হেসে ফেলেন ছোটজনের কথা শুনে। ছোটভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। গভীর মমতা ও আশীর্বাদ ঝরে পড়ে তাঁর হাতের মায়াবী স্পর্শ থেকে। স্নেহমাখা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘বাবা রে, এই বস্তাটা তুমি নিয়ে নাও। ভেতরে যা যা আছে, সব মালামালসহ।’

ছোটভাই সবিনয়ে বলে, ‘এ বস্তা তো আপনার। আমি এটা নিতে যাব কেন?’

বুড়ো ভদ্রলোক বলেন, ‘আরে নাও নাও। এটা তোমারই পাওনা। আমি তোমাকে উপহার হিসেবে দিলাম। তুমি না নিলে খুব কষ্ট পাব আমি। নাও, এসো।’

ছোটভাই অগত্যা বস্তাটা বুঝে নেয়। এত করে বলছেন উনি। যত্ন করে বস্তাটা সে খোলে আলগোছে। কী আছে ওই বস্তার ভেতর? আছে আছে, অনেক কিছুই আছে। দেখে সে অবাক হয় ভীষণ। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। দামি দামি রত্নে ভর্তি এই বস্তা। এ কী কাণ্ড!

বস্তাটার মুখ বন্ধ করে ছোটভাই। তারপর আগন্তুকের দিকে তাকায়। উদ্দেশ্য, ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানানো। এবার আরও অবাক হওয়ার পালা তার। সে দেখে, ভদ্রলোক আর সেখানটায় নেই। বস্তা খোলা ও বন্ধ করার ফাঁকে কোথায় যেন চলে গেছেন।