আয়নাবন্ধু

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

সামনে মহাবিপদ!
এ রকম বিপদের মুখোমুখি শেফালি আগে কখনো হয়নি। অবশ্য আজ শেফালি একা নয়। সঙ্গে আছে অন্য চারজন—রুবী, রাসেল, সুমী ও আরমান।
ওরা পরিচিত ‘পঞ্চরত্ন’ নামে। পড়ে একই ক্লাসে। আমিরাবাদ বি সি লাহা উচ্চবিদ্যালয়ে। এইটে।
পাঁচজনই লেখাপড়ায় ভালো। দুষ্টুমিতে পটু। বুদ্ধিতে পাকা। কিন্তু এই মুহূর্তে সবার মাথাই যেন ফাঁকা। কোনো বুদ্ধিই খেলছে না।
অথচ ‘কষা স্যার’কেও কতবার যে বুদ্ধির খেলায় বোকা বানিয়েছে ওরা। বাংলার শিক্ষক লালমোহন সেনই হলেন ‘কষা স্যার’। ছাত্রছাত্রীদের শাস্তি হিসেবে কষিয়ে চড় মারায় তার খ্যাতি আশপাশের দশ স্কুলে। লালমোহন সেনের চড় একবার যে খায়, তাকে মিনিমাম তিন দিন কিছু খেতে হয় না। আসলে খেতে পারে না। চড়ের চোটে দাঁতের মাড়ি ফুলে যায়। চোখে শর্ষে ফুলের পুরো খেত ভেসে ওঠে। মাথা চক্কর দেয় লাটিমের মতো। মুখ ‘হাঁ’ করতে গেলে ‘আহ্’ শব্দ বেরিয়ে আসে।
কিন্তু এখন চড় না খেয়েও শেফালিদের মুখ সত্যিই হাঁ হয়ে আছে। সবার চোখ সামনের চারপেয়ে প্রাণীটার দিকে। অপলক, সাবধানী দৃষ্টি।
স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরছিল শেফালিরা। গল্প করতে করতে সবাই চলে আসে তিন রাস্তার মোড়ে। হঠাৎ, খুব কাছেই ভয়ংকর শব্দটা কানে আসে—ঘেউ ঘেউ, ঘরর...ঘেউউ... ঘরর...ঘেউউ...।
সবার সামনে ছিল শেফালি। চমকে ওঠে। তাকায় এদিক-ওদিক। পাশের একটা নারকেলগাছের আড়াল থেকে রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়ায় প্রাণীটা। চোখে-মুখে হিংস্রতা। জিব বেয়ে লালা ঝরছে।
‘ও মাগো, পাগলা কুত্তা...।’ মৃদু চিৎকার করে ওঠে সুমী। পেছন থেকে খামচে ধরে শেফালির কাঁধ।
‘ওরে ভিতুর ডিম, শুধু শুধু ভয় পাচ্ছিস।’ পাশ থেকে চাপা কণ্ঠে বলে রাসেল।
‘শুধু শুধু মানে?’ আড়চোখে রাসেলের দিকে তাকায় আরমান, ‘দেখছিস না, কুকুরটা কেমন ভয়ংকরভাবে ঘেউ ঘেউ করছে।’
‘আরে, সে জন্যই তো বলছি’, রাসেল জ্ঞান দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, ‘গতকালই না কষা স্যার পড়িয়েছেন, ঘেউ ঘেউ করা কুকুর ক্বদাচিৎ কামড়ায়।’
রুবী ধমকে ওঠে, ‘গাধার গাধা, সেটা কষা স্যার জানে। আমরাও জানি। কিন্তু কুকুরটা তো জানে না!’
তখনই আবার গর্জন করে ওঠে কুকুরটা—ঘেউ ঘেউ...ঘররর...ঘেউ...।
শেফালি চোখ দিয়েই দূরত্ব মেপে নেয়। কমপক্ষে ১২ ফুট। কুকুরটার চোখে চোখ রেখেই বলে, ‘অ্যাই, কী করা যায়, কোনো বুদ্ধি?’
কারও জবাব আসে না।
শেফালি আড়চোখে যতটা সম্ভব পেছনে তাকায়। না, কেউ নেই। বুকটা ধক করে ওঠে তার। পাশের একটা আমগাছের দিকে দৃষ্টি যায়। গাছটার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে আরমান। ইশারায় ডাকছে তাকে। কিন্তু শেফালির পা যেন কেউ মাটির সঙ্গে আটকে রেখেছে। নাড়াতে পারছে না।
এখন পাগলা কুকুরের মুখোমুখি শেফালি। একা।
কুকুরটা যেন তাতে আরও সাহসী হয়। আবার ঘেউ ঘেউ করে ওঠে।
শেফালি এখন কী করবে? এই তো, গত মাসেই সে স্কুলে দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল। সে কি দৌড়াবে বাড়ির দিকে? কিন্তু কুকুরের সঙ্গে দৌড়ে কি পারবে? তা ছাড়া এটা তার একার বিপদ নয়। বন্ধুদের ফেলে নিজেকে বাঁচানোর জন্য দৌড় দেওয়া মোটেই উচিত হবে না।
শেফালির মনে পড়ে মায়ের কথা। মা একদিন বলেছিলেন, পাগলা কুকুর সামনে পড়লে কখনো দৌড় না দিতে।
হঠাৎ গাছের আড়াল থেকে কে যেন ঢিল ছুড়ল। গায়ে লাগতেই কুকুরটা ‘ঘেউ ঘেউ’ করে ওঠে। আরও জোরে। ভয়ংকরভাবে।
মধ্যদুপুর। চারদিক নীরব। নিজের হার্টবিটের শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছে শেফালি। আচমকা একটা বুদ্ধি খেলে যায় মাথায়। আস্তে করে ডাক দেয়, ‘রুবী, শুনছিস?’
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আসে, ‘হ্যাঁ, বল।’
‘তোর স্কুলব্যাগটা আমার দিকে ছুড়ে মার।’
‘কেন? আমার ব্যাগ দিয়ে কী করবি?’
‘যা বললাম, তা-ই কর।’ শেফালি তাড়া দেয়।
কয়েক সেকেন্ড পরই শেফালির পায়ের কাছে ‘ধপ’ করে আওয়াজ হয়। কুকুরটার থেকে চোখ না সরিয়েই শেফালি একটু নিচু হয়। মাটি থেকে রুবীর ব্যাগটা তুলে নেয়। শেফালির কর্মকাণ্ডে কিছুটা বিভ্রান্ত হয় কুকুরটা। ঠিক বুঝে উঠতে পারে না শেফালি কী করতে যাচ্ছে।
বাঁ হাত দিয়ে রুবীর স্কুলব্যাগটা বুকের সামনে ধরে শেফালি। ডান হাতে ব্যাগের চেইন খোলে। রুবী একটু ফ্যাশন-সচেতন। শেফালি জানে, রুবীর ব্যাগের মধ্যে সব সময় মেকআপের কিছু জিনিসপত্র থাকে।
কুকুরটা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শেফালির দিকে।
হ্যাঁ, যা খুঁজছিল, পেয়ে গেছে শেফালি। জিনিসটা শক্ত করে ধরে আস্তে আস্তে ব্যাগ থেকে ডান হাতটা বের করে। গাছের আড়াল থেকে বাকিরা অবাক হয়ে দেখে, শেফালির হাতে একটা আয়না। ওরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। শেফালি কী করতে যাচ্ছে, বুঝে উঠতে পারে না।
ওদিকে পাগলা কুকুরটাও মনে হয় ধৈর্যহারা হয়ে গেছে। এবার আর ঘেউ ঘেউ নয়, কয়েকবার ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে ওঠে। সামনের দুই পা দিয়ে মাটিতে আঁচড় কাটে।
শেফালি হাতে ধরা আয়নাটা নিয়ে কুকুরটার দিকে এক পা এগোয়। গাছের আড়াল থেকে চিৎকার করে ওঠে রুবী, ‘কী করছিস শেফালি। পাগল হয়ে গেছিস। কামড় দেবে তো।’
শেফালির পূর্ণ মনোযোগ কুকুরটার দিকে। ডান হাতটা বাড়িয়ে ধরে কুকুরটার মুখের সামনে। আয়নার চোখ পড়তেই চমকে যায় কুকুরটা। ভীষণ জোরে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে একবার। তারপর সাবধানে, খুব সতর্ক ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে কয়েক পা। আয়নার কুকুরটার মুখোমুখি হয়।
‘শেফালি সাবধান...!’ আরমানের চাপা কণ্ঠ শুনতে পায় শেফালি। বাঁ হাতে রুবীর ব্যাগটা শক্ত করে ধরে। প্রয়োজনে সেটা সামনে রেখে নিজেকে আড়াল করতে পারবে। আয়না ধরা ডান হাত আরেকটু বাড়িয়ে দেয় কুকুরটার দিকে।
এবার ভয়ংকর শব্দে ঘেউ-উ-উ করে ওঠে পাগলা কুকুর। আয়নার নিজের প্রতিবিম্বটাকেও একই ভঙ্গিতে চিৎকার করতে দেখে আচমকা থমকে যায়। দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভঙ্গিতে কয়েক পা পেছায়। এরপর ঘুরে উল্টো দিকে দেয় দৌড়।
দীর্ঘক্ষণ চেপে রাখা নিশ্বাস ছাড়ে শেফালি। গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে রাসেল, সুমী, আরমান ও রুবী।
রাসেল চোখ বড় বড় করে বলে, ‘শেফালি, আরেকটু হলেই তো হার্ট-অ্যাটাক হতো...’
‘হ্যাঁ, কুকুরটার!’ রাসেলকে কথা শেষ করতে না দিয়ে হাসতে হাসতে বলে শেফালি।
‘উফ, যা দেখালি না। সত্যি, তোর সাহস আর বুদ্ধি আছে রে।’ শেফালির হাত থেকে নিজের ব্যাগটা নিতে নিতে রুবী বলে।
‘ধন্যবাদ। কিন্তু রুবী, তোর আয়নাটা এই প্রথম আমাদের সবার কোনো উপকারে লাগল!’
শেফালির কাছ থেকে আয়নাটা হাতে নেয় সুমী, ‘ঠিকই বলেছিস শেফালি। এত দিন আয়নাটা শুধু রুবীর একার সঙ্গী ছিল। আজ থেকে সবার বিপদের বন্ধু হয়ে গেল।’
‘তাহলে তো বিপদের বন্ধুকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।’ আরমান বলল।
আরমানের আহ্বানে সবাই এসে দাঁড়ায় সুমীর হাতে থাকা আয়নাটির সামনে।
আয়নায় দেখা যায় ‘পঞ্চরত্ন’র হাসিমুখ!