আয়নায় কার মুখ?

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

এক

কাচের দরজাটা ঠেলে ফাঁক করতেই ঠান্ডা হাওয়ার পরশ পেল রবিন, সেই সঙ্গে নাকে এল ছাতাপড়া ধরনের পুরোনো একটা গন্ধ। ঢুকে পড়ল ও দোকানটার ভেতর। সুইং ডোরের পাল্লাটা ছেড়ে দিতেই লেগে গেল আপনাআপনি।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না রবিন। ভেতরে রয়েছে বোধ হয়। এগিয়ে গেল সে কাউন্টারটার দিকে। অপেক্ষা করতে লাগল কাউন্টারের সামনের অংশে পিঠ ঠেকিয়ে।

সদর দরজাটার ডাইনে-বাঁয়েও গ্লাস প্যানেল করা। চিকের পর্দা ঝুলছে ওখানে। পর্দার ফাঁক গলে ফালি ফালি হয়ে ভেতরে ঢুকছে পড়ন্ত বিকেলের যাই-যাই রোদ্দুর; সৃষ্টি হয়েছে স্নিগ্ধ একটা পরিবেশ। এসির মৃদু গুঞ্জনটাও ভূমিকা রাখছে মায়াবী এ আবহ সৃষ্টিতে।

সারা অ্যান্টিক শপে চোখ বোলাল রবিন। মুখোশ, অস্ত্রশস্ত্র, ঝাড়বাতি, পেইন্টিং, মূর্তি, আয়রন স্যুট, পালতোলা জাহাজের মিনিয়েচার, কাচ আর চিনামাটির জিনিসপত্র—আগেই দেখা ওর এসব। নতুনের মধ্যে চোখে পড়ল কফিন আকৃতির লম্বা একটা বাক্স আর ব্রোঞ্জের একটা ঘণ্টা। লস অ্যাঞ্জেলেসের শহরতলিতে দোকানটা, রবিনদের স্কুলটার কাছেই। ক্লাস ছুটির পর প্রায়ই ঢুঁ মারে ও এখানে, এডমান্ড ফিটজেরাল্ডের গল্পের আকর্ষণে।

‘অ্যাই, কে তুমি? কী চাই এখানে?’

পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল রবিন। দুটো হার্টবিট মিস হয়ে গেছে কর্কশ কণ্ঠের আচমকা এই ধমকে। কণ্ঠের মালিককে দেখে আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেল সে দুই কদম।

কাউন্টারের পেছনের দরজা দিয়ে উদয় হওয়া লোকটার পরনে বাদামি আলখাল্লা, হুড তুলে দিয়েছে মাথার ওপর। ধবধবে সাদা, তুলোর মতো ভুরুর নিচ দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রবিনের দিকে। ইগলের ঠোঁটের মতো বাঁকা বুড়োর নাকের ডগাটা, চওড়া গোঁফ নেমে এসেছে ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে। ওরই সমান লম্বা এক আঁকাবাঁকা, কালো কুচকুচে লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুঁজো হয়ে, লাঠির মাথাটা সাপের ফণার মতো! সব মিলিয়ে ফ্যান্টাসি গল্পের পাতা থেকে উঠে এসেছে যেন আজব এই চরিত্র।

‘কী হলো? কথা বলছ না কেন?’ খেঁকিয়ে উঠল আলখাল্লাধারী।

‘আমি...আমি...।’ তোতলাতে লাগল রবিন।

‘আমি, আমি কী?’

‘আমি...মানে এডমান্ড...।’ কথা শেষ করতে পারল না ছেলেটা, তার আগেই খনখনে গলায় হেসে উঠল বুড়ো। তারপর এমন একটা কাজ করে বসল, রবিনের মনে হলো কেউ যেন খামচে ধরেছে ওর হৃৎপিণ্ডটা। একটানে নিজের নাকটা ছিঁড়ে ফেলল বুড়ো!

‘ইয়া আল্লা!’ চোখ দুটো কপালে তুলেই পালাতে ঘুরল রবিন।

খপ করে ওর কবজি চেপে ধরল বুড়োটা।

‘ছেড়ে দিন! ছেড়ে দিন আমাকে!’ শুরু হলো ধস্তাধস্তি।

‘আরে, দাঁড়াও! দাঁড়াও!’ পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর কানে যেতেই ছটফটানি থেমে গেল রবিনের। বদলে গেছে বুড়োর গলার স্বর। ঝটকা দিয়ে মাথা থেকে ফেলে দিল হুডটা। কুঁজো অবস্থা থেকে সটান সিধে হয়েই টান দিয়ে তুলে ফেলল নকল গোঁফ।

‘আরে, এডমান্ড চাচা, আপনি!’ বলল রবিন বিস্ময়াভিভূত গলায়। খেয়াল করে দেখল, আসল নাকের ওপর আলগা ওই ‘ইগলের ঠোঁট’টা লাগিয়েছিলেন এডমান্ড ফিটজেরাল্ড।

হাসি একান-ওকান হয়েছে প্রৌঢ় দোকানমালিকের। ছেলেমানুষের মতো চঞ্চল চোখ দুটো নাচিয়ে বললেন, ‘হেহ্ হে...চিনতে পারোনি তো!’

‘আউফ্!’ হাঁপ ছাড়ল রবিন, ‘যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন না! কিন্তু আপনি কেন এভাবে...?’

সাপের ফণাওয়ালা দণ্ডটা কাছের এক তাকের ওপর তুলে রাখলেন এডমান্ড। লাজুক হেসে বললেন, ‘যুবক বয়সে টুকটাক অভিনয় করতাম থিয়েটারে। এখনো মাঝেমধ্যে চাগিয়ে ওঠে নেশাটা, পুরোনো অভ্যাসটা ঝালিয়ে নিই তখন।’

‘তা-ই বলেন! আমি ভাবলাম কি–না–কি।’

এলোমেলো হয়ে পড়া কাঁচাপাকা চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিকঠাক করছেন এডমান্ড, জিজ্ঞেস করলেন, ‘গল্প শুনবে তো?’ পুরোনো অনেক জিনিসপত্রের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নানা রকম গল্পগাথা, সেসব শোনার লোভেই হাজির হয় এখানে এইটথ গ্রেডে পড়া বাঙালি ছেলেটা।

‘জি, চাচা।’ বলল রবিন, ‘তবে বিশেষ একটা জিনিসের গল্প শুনতে চাই এবার। অবশ্য যদি কোনো গল্প থেকে থাকে ওটার পেছনে।’

‘কিসের কথা বলছ, বলো তো!’

‘আয়নাটা...কাল যেটা কিনে নিয়ে গেলেন আব্বু।’

‘ওহ্, ওটা!’ হাসি মুছে গেছে মিস্টার ফিটজেরাল্ডের মুখ থেকে।

ব্যাপারটা লক্ষ করল রবিন। ‘ইন্টারেস্টিং গল্প মনে হচ্ছে!’

‘চলো, বসা যাক।’ একদিকের দেয়াল ঘেঁষে ফেলা সোফাসেটটা ইঙ্গিত করলেন এডমান্ড ফিটজেরাল্ড।

‘যদ্দুর জেনেছি, সোফিয়া নামে এক মেয়ের ছিল আয়নাটা। আত্মহত্যা করেছিল মেয়েটা।’ শুরুতেই বোমা ফাটালেন অ্যান্টিক বিক্রেতা।

‘তা-ই নাকি, আঙ্কেল? কবেকার ঘটনা এটা, বলুন তো!’

‘সপ্তদশ শতকের কোনো একসময়ের।’

‘বাপ রে, এত আগের!’

‘হুম। ইংল্যান্ডের কোনো এক গাঁয়ের জমিদারের ছেলের সঙ্গে মন দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক ছিল সোফিয়ার। জমিদার সাহেব জানতেন না বিষয়টা, পাত্রী ঠিক করেন তিনি ছেলেটির জন্য। বাপের সিদ্ধান্তের ওপর দিয়ে কিছু বলার সাহস ছিল না পুত্রের, মত দিতে বাধ্য হয় সে বিয়েতে। এদিকে বিয়ের খবরটা শোনামাত্র মেয়ের বাবা ছুটে আসে জমিদারবাড়ি। অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হয় তাকে।’

‘খাইছে! এ যে দেখছি সিনেমার কাহিনি! তারপর?’

‘বিয়ে হয়ে গেল জমিদারপুত্রের। এই কষ্ট সইতে পারল না সোফিয়া। পূর্ণিমার এক রাতে পাহাড় থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে শেষ করে দিল সে নিজেকে।’

‘ইশ্!’

‘শোনা যায়, লাশটা নাকি পাওয়াই যায়নি আর। দিন কয়েক পর বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেল মেয়ের শোকে আধপাগল স্যামুয়েল। বেমালুম গায়েব যাকে বলে। কেউই আর দেখেনি তাকে কোনো দিন।

‘অনেক কটা বছর কেটে গেছে এরপর। স্যামুয়েল আর ওর মেয়ের কথা ভুলতেই বসেছে লোকে। চার্লস নামের এক সন্তান হয়েছিল জমিদারপুত্রের। কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে পা দিয়েছে ছেলেটা, এ সময় একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে। প্রত্যেক পূর্ণিমায় পাহাড়ের দিক থেকে ভেসে আসতে লাগল রক্ত হিম করা চিৎকার। ভয়ংকর কোনো দানব যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে যেন!

‘শহরের বোর্ডিংয়ে থেকে পড়াশোনা করত জমিদারের নাতি, ছুটিছাটায় বাড়ি আসত। এমনই এক ছুটির রাতে ডাইনিং টেবিলে খেতে খেতে গল্প করছিল দাদা-নাতি, এ সময় শব্দ হলো সদর দরজায়। দেখতে গেল এক চাকর। নাহ্, কাউকেই দেখা গেল না দরজা খুলে। বদলে একটা কাগজ পাওয়া গেল দোরগোড়ায়—নেকড়ের থাবার রক্তাক্ত একটা ছাপ আঁকা ওতে! কোনো ধরনের হুমকি যেন! পাহারা এড়িয়ে কীভাবে কেউ রেখে গেল কাগজটা, এর কোনো সদুত্তর দিতে পারল না কেউ।

‘পূর্ণিমার সে রাতে বাড়ি ছিল না চার্লসের মা-বাবা, গিয়েছিল একটা দাওয়াতে। রাতে আর ফেরেনি ওদের ক্যারিজটা। সকালে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় ওটা রাস্তার ধারে। খোঁজাখুঁজি করতেই স্বামী-স্ত্রীর লাশ পাওয়া গেল পাশের জঙ্গলে, ক্যারিজচালক লাপাত্তা। দেখে মনে হয়, নেকড়ের হামলার শিকার হয়েছিল জমিদারের পুত্র আর পুত্রবধূ। অথচ ওই এলাকায় নাকি নেকড়েই ছিল না কোনো!’

‘আশ্চর্য!’ হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে রবিনের বুকের মধ্যে।

‘হ্যাঁ। কিনারা হয়নি এই রহস্যের। শোক সামলে বোর্ডিংয়ে ফিরে গেল এতিম ছেলেটা। ওখানেই টেলিগ্রামে পেল সে আরেক দুঃসংবাদ—ঘুমের মধ্যে মারা গেছেন বৃদ্ধ জমিদার!’

‘আমি কিছুই বলতে চাইছি না।’ গম্ভীর স্বরে বললেন এডমান্ড, ‘মানুষের ধারণা এগুলো। এটুকুই বলব, একটু সাবধান থেকো, বাছা!’

‘সেদিন কি পূর্ণিমা ছিল?’

‘ঠিকই ধরেছ। ...বুঝতেই পারছ, চার্লসের মনের অবস্থা তখন কী রকম। একদিন লক্ষ করল সে, প্রায়ই একটা শকুন এসে বসছে ওর বোর্ডিং রুমের জানালায়। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল ছেলেটার কাছে। মড়াই নেই যেখানে, সেখানে করছেটা কী মড়াখেকো কুৎসিত পাখিটা? তাড়িয়ে দিলেও লাভ হয় না, খানিক বাদেই এসে বসে আবার। এমনকি রাতেও রেহাই নেই এ উৎপাত থেকে। বাধ্য হয়ে জানালা বন্ধ রাখতে শুরু করল চার্লস। তবে তা-ই বা পারা যায় কদিন? হাঁসফাঁস লেগে উঠল এক জ্যোৎস্নাভরা সন্ধ্যায়। ছাদে উঠল সে তাজা বাতাসের জন্য। কিছুক্ষণ পরই বিকট আওয়াজে চমকে উঠতে হলো আশপাশের লোকজনকে। ছাদের ওপর থেকে আছড়ে পড়েছে ছেলেটা পাথরবাঁধানো রাস্তায়! সঙ্গে সঙ্গে ডেড। এটা কি আত্মহত্যা, নাকি অন্য কিছু, তারও কোনো সুরাহা হয়নি।’

কয়েক মুহূর্ত গুম হয়ে রইল রবিন। শেষে বলল, ‘হোয়াট আ ট্র্যাজেডি!’

মাথা ঝাঁকালেন এডমান্ড। ‘উপসংহারে আসি। স্যামুয়েল উধাও হওয়ার পর পুরো একটা বছর খালি পড়ে ছিল ওর খামারবাড়ি। কোনো আত্মীয়স্বজন নেই, দাবিদার নেই। তারপর লোকটা আর ফিরবে না ধরে নিয়ে যাবতীয় জিনিসপত্রসহ নিলামে তুলে দেওয়া হলো বাড়িটা। আয়নাটা যার হাতে পড়েছিল, শেষ জীবনে নাকি দেউলিয়া হয়ে যায় লোকটা। এরপর যারাই ওটার মালিক হয়েছে, কোনো না কোনো দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে তাদের জীবনে। লোকের ধারণা, মেয়েকে হারিয়ে ব্ল্যাক ম্যাজিকের দিকে ঝুঁকে পড়ে স্যামুয়েল। জমিদার ও তাঁর বংশধরদের ওপর শোধ নিয়েছে কালো জাদুর মাধ্যমে। অভিশাপ লেগে গেছে ওর মেয়ের সমস্ত জিনিসে।’

মেরুদণ্ডে শিরশির করে উঠল রবিনের। ‘বলতে চাচ্ছেন, আয়নাটা অভিশপ্ত?’

‘আমি কিছুই বলতে চাচ্ছি না।’ গম্ভীর স্বরে বললেন এডমান্ড, ‘মানুষের ধারণা এগুলো। এটুকুই বলব, একটু সাবধান থেকো, বাছা!’

দুই

দুদিন পর। পূর্ণিমা আজ। কেন যেন মনে হচ্ছে রবিনের, কিছু একটা ঘটবে আজ রাতে, আর সেটা ভয়ংকর কিছু।

অন্য ঘর থেকে নিজের ঘরে নিয়ে এসেছে আয়নাটা, টেবিলের ওপর দাঁড় করিয়ে রেখে তাকিয়ে আছে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে। আয়নাটা যেন সম্মোহন করছে ওকে। টেবিল ল্যাম্পের আলোটা ছাড়া গোটা ঘর অন্ধকার।

হঠাৎ করেই ঘটতে শুরু করল অলৌকিক ঘটনাটা। শ্মশ্রুমণ্ডিত এক প্রৌঢ়ে বদলে যাচ্ছে রবিনের প্রতিবিম্ব! বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটা, হাসির ভঙ্গিতে বেঁকে যেতে লাগল প্রৌঢ়ের ঠোঁটের দুই প্রান্ত। ধকধক করছে চোখজোড়া।

স্যামুয়েল ছাড়া আর কেউ হতে পারে না ওই প্রতিবিম্ব!

অশুভ আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল রবিন: ‘সোফিয়া...সোফিয়া!’

শুনে বিহ্বল হয়ে পড়ল স্যামুয়েলের প্রেতাত্মা।

দরজা থেকে রবিনের চেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়াল শুভ্র গাউন পরা তন্বী এক তরুণী!

আলো-আঁধারিতে অনিন্দ্যসুন্দর চেহারাটা দেখে দুহাতে মুখ ঢাকল স্যামুয়েল। দ্রুত রূপ নিচ্ছে এখন স্বাভাবিক প্রতিবিম্বে। হাহাকারের মতো একটা প্রলম্বিত আওয়াজ ভেসে এল যেন রবিনের কানে। পরক্ষণেই দেখে, চেয়ে আছে সে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে।

খুট করে বাতি জ্বলে উঠল কামরার।

‘সবই তো করলাম তোর কথামতো, কিন্তু বলবি তো, কী মানে এসবের!’ দুহাত কোমরে রেখে ছোট ভাইয়ের কাছে জবাব চাইল এলিজা।

‘সবই বলছি, আপু। তার আগে বলো তো, কী দেখলে তুমি!’

‘কী দেখব আবার?’ বিরক্ত হলো রবিনের বড় বোন।

‘কী আশ্চর্য! কিছুই কি দেখোনি, আপু?’

‘আরে, জ্বালা! দেখবটা কই, সেটা তো বলবি!’

‘কেন, আয়নার মধ্যে!’

আয়নায় তাকাল মেয়েটা। ‘তোর চাঁদবদন ছাড়া তো কিছুই দেখছি না, বাবা!’

এ-ও কি সম্ভব? অবিশ্বাসে চোয়াল ঝুলে পড়ল রবিনের। একাই দেখেছে ও স্যামুয়েলকে?

‘দেখ, রবিন!’ শাণিত কণ্ঠে বলে উঠল এলিজা, ‘বললে বল, না বললে চললাম! আর এসব জবরজং পোশাক জোগাড় করলি কোত্থেকে?’

‘এডমান্ড চাচার কাছ থেকে।’ ধরা গলায় জবাব দিল রবিন, ‘থিয়েটারে ব্যবহারের জিনিস এগুলো।’

শুতে যাচ্ছে, কী ভেবে দাঁড়াল রবিন আয়নাটার সামনে। নাহ্, ভয় লাগছে না আর। নিশ্চিত ও, কেটে গেছে বিপদ। চিরকালের জন্য অদৃশ্য হয়েছে স্যামুয়েলের অতৃপ্ত আত্মা। দূর হয়েছে আয়নাতে ভর করা অভিশাপ। ঠিকই অনুমান করেছিল ও, আবছা আলোতে আসল-নকলের পার্থক্য ধরতে পারবে না স্যামুয়েল। এলিজা আপুকে নিজের মেয়ে মনে করে চমকে যাবে ভীষণ। তারপর হয়তো ভালো মানুষ থেকে খলনায়কে পরিণত হওয়ার অনুশোচনায় লজ্জিত মুখটা দেখাতে চায়নি মেয়েকে। পালিয়ে বেঁচেছে কালবিলম্ব না করে।

...কিন্তু তাহলে...তাহলে...বদলে যাচ্ছে কেন ওর প্রতিবিম্বটা?

কয়েক মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল রবিনের প্রতিচ্ছবি, সেটার জায়গা নিয়েছে এখন—স্যামুয়েল নয়—শুভ্রবসনা এক নারীমূর্তি!

বিমোহিত রবিন মেয়েটির সৌন্দর্যে। কী নিষ্পাপ চেহারা!

সোফিয়া! সোফিয়া ছাড়া আর কেই–বা হবে এই মেয়ে!

কৃতজ্ঞতা উপচে পড়ছে মেয়েটির নীল নয়ন থেকে। গাঢ় স্বরে বলল সে, ‘ধন্যবাদ, রবিন...অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে! তোমার কারণেই অবশেষে মুক্তি পেয়েছে আব্বুর অতৃপ্ত আত্মা। চিরতরে চলে গেছে অন্য ভুবনে!’