ইটি, তুমি কেমন আছো?

অলংকরণ: তুলি

স্বাতী আর শান্তা। দুই বোন। তাদের একজন মামা আছেন। চালাকমামা। তাদের মা আর বাবা তাঁকে ডাকেন ‘চালাক’ বলে। আর ওরা দুজন তাঁকে ডাকে ‘চালাকমামা’।

চালাকমামা দেখতে কৌটার মতো। লম্বা একটা কৌটা। লম্বা না বলে ঢ্যাঙা বলা ভালো। তাঁর মুখমণ্ডল চৌকোনো। চালাকমামার এই নাম যিনিই দিয়ে থাকুন না কেন, বড় সার্থক হয়েছে এই নামকরণ। চালাকমামার চালাকির চোটে টেকা দায়।

আগেকার দিনে গ্রামগঞ্জে ‘টাউট’ বলে একটা শব্দ প্রচলিত ছিল। আজকাল আর সেই শব্দটা শোনা যায় না। হয়তো টাউটদের আর দেখা যায় না গ্রামগঞ্জে। কিন্তু সেই বিলুপ্তপ্রায় টাউট প্রজাতির শেষ নমুনা হিসেবে রয়ে গেছেন চালাকমামা।

চালাকমামা এসেছেন স্বাতী আর শান্তাদের বাসায়। এসেই ডাকলেন জরিনাকে। জরিনার বয়স ১২, সে এই বাসায় কাজ করে। গ্রামের স্কুলে সে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিল, সেটা তার কথাবার্তায় বোঝা যায়।

চালাকমামা হাঁক ছাড়লেন—জরিনা, জরিনা। জরিনা হাঁড়ি-পাতিল ধুচ্ছিল, হাত ধুয়ে তোয়ালেতে মুছে সে চলে এল। ‘জি মামা।’ তার চোখমুখে জিজ্ঞাসা।

চালাকমামা এক ব্যাগ কাপড় টেবিলের ওপরে রেখে বললেন, ‘জরিনা। নে। কাপড়গুলো ইস্তিরি করে রাখবি। পরে এসে নিয়ে যাব।’

এই হলেন চালাকমামা। তিনি থাকেন একটা মেসে। সেখানে নিজের কাপড় তিনি নিজে ইস্তিরি করেন না। বোনের বাসায় এসে জরিনার হাতে ধরিয়ে দেন।

জরিনা বলল, ‘আপনি বসেন। চা খান। আমি আপনেরে কাপড় ইস্তিরি কইরা দিই। আপনি নিয়া যান।’

চালাকমামা বললেন, ‘না না। এখন কেন ইস্তিরি করবি? এখন ইস্তিরি করলে ইলেকট্রিক বিল বেশি আসবে।’

‘তাইলে কখন ইস্তিরি করুম?’

‘যখন ইলেকট্রিক লাইন চইলা যাবে। জেনারেটর স্টার্ট দেবে। তখন ইস্তিরি করবি।’

‘জেনারেটরের লাইনের সময় বেশির ভাগ প্লাগে লাইন থাকে না।’

‘যেখানে থাকে সেখান থেকে লাইন টেনে নিবি। তাইলে কী হবে? তাইলে ইলেকট্রিক বিল দিতে হইব না। জেনারেটরের তেল বেশি লাগব। ওইটা সবাই মিইলা অ্যাসোসিয়েশন থাইকা দিব। কুড়িটা ফ্ল্যাটে ভাগ হইয়া যাইব। আর এখন যদি ইস্তিরি করিস পুরা বিল আমার বোনের ওপর দিয়া যাইব। দুলাভাইয়ের ফিক্সড ইনকাম। হালাল ইনকাম। হালাল ইনকামের টাকা বুদ্ধি কইরা খরচ করতে হয়।’

জরিনা বলল, ‘চালাকমামা, আপনের এত বুদ্ধি কেন? আপনের যদি এতই বুদ্ধি, আপনে রাস্তায় হাঁটেন কেন? আপনের তো মন্ত্রী হওন দরকার আছিল।’ চালাকমামা বললেন, ‘এইটাই তো পৃথিবীর ট্র্যাজেডি রে। যোগ্য মানুষের কদর নাই। বুদ্ধি নাই একেকটা লোক রাজা-বাদশাহ, ইন্ডাস্ট্রির মালিক হয়ে বসে আছে। আর আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। দে, এক কাপ চা দে।’

জরিনা চা বানিয়ে চায়ের কাপে একটা টি-ব্যাগ ভাসিয়ে আনল, ‘লন আপনার চা।’

চালাকমামা বললেন, ‘আরে কী করেছিস! নতুন টি-ব্যাগ কেন দিয়েছিস? টাকাপয়সা নষ্ট করার কোনো মানে হয়? আচ্ছা দিয়েছিস দিয়েছিস। নে, টি-ব্যাগটা তুলে নে। চুলার পাশে রেখে দে। শুকিয়ে গেলে আবার কোনো গেস্ট এলে তাকে দিস। শোন, দ্বিতীয়বার আমাকে দেওয়ার দরকার নেই। অন্য কাউকে দিস।’

এই সময় বিদ্যুৎ চলে গেল। বেশ কিছুদিন বিদ্যুৎ সরবরাহ ভালো ছিল। আবার কোথায় কী ঘটেছে কে জানে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে।

জরিনা বলল, ‘মামা, কারেন্ট গেছে গা। এখন জেনারেটরের লাইন আইব।’

মামা বললেন, ‘তাইলে আমার কাপড় ইস্তিরি এখনই হবে।’

নিচতলায় জেনারেটর চালু হয়েছে। ভটর ভটর শব্দ আসছে।

বিদ্যুৎ এসে গেল জেনারেটরের লাইনে।

মামা একটা মাল্টিপ্লাগের লাইন টেনে আনলেন পাশের ঘর থেকে। ‘নে, এই লাইন থেকে ইস্তিরির লাইন নে।’ জরিনা তা-ই করতে গেল। পাশের ঘর থেকে জেনারেটরের লাইনওয়ালা সকেটে প্লাগ ঢুকিয়ে চালাকমামা লাইন এনেছেন। গোল মাল্টিপ্লাগ। অনেকগুলো সকেট আছে। একটা হলুদ বাতি জ্বলছে। জরিনা ইস্তিরির গ্লাগ ঢুকিয়ে দিল। ইস্তিরির টেবিলে মামার কাপড়গুলো রাখল। একটা একটা করে ইস্তিরি করতে হবে। ইস্তিরি গরম হচ্ছে। সে কাপড়ে পানি ছিটিয়ে নিল।

চালাকমামা বললেন, ‘তুই ইস্তিরি করতে থাক। আমি একটু নিচে থেকে পান খেয়ে আসি। তোদের বাড়িতে পান থাকে না। চায়ের পরে আবার আমার পান খাওয়ার অভ্যাস হয়েছে।’

তিনি দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। সামনে লিফট। তিনি লিফটের বোতাম টিপলেন। লিফট এল। দরজা খুলে গেল।

চালাকমামা লিফটে উঠলেন।

লিফটের দরজা বন্ধ হলো।

জরিনার ইস্তিরি গরম হচ্ছে। কিন্তু জেনারেটরের লাইন তো কাপড় ইস্তিরি করার জন্য নয়। এই অতিরিক্ত চাপটা নিতে পারল না জেনারেটর। বিদ্যুৎ চলে গেল।

চালাকমামা তখন লিফটের ভেতরে। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে লিফট গেল থেমে। আলো গেল নিভে।

চালাকমামা লিফটে এমনিতেই ভয় পান। তিনি বিড়বিড় করতে লাগলেন, ‘হায় হায় কারেন্ট গেল। মানে কী? তার মানে তো জেনারেটর ফেইল করল। এখন উপায়? আমি তো আটকা খাইলাম।’

তিনি মোবাইল ফোন হাতে নিলেন। তাকিয়ে দেখলেন, লিফটের মধ্যে মোবাইল ফোনে কোনো নেটওয়ার্কও নেই। ‘হায় হায়, নেটওয়ার্কও তো নাই। এখন কী করি’—তিনি বিলাপ করতে লাগলেন।

মোবাইলের আলোয় তিনি লিফটের সুইচ খুঁজলেন। ইমার্জেন্সি সুইচ বোধ হয় লালটা। তিনি চাপ দিলেন। অ্যালার্ম বাজল বলে মনে হচ্ছে না।

তিনি ঘামতে লাগলেন। তারপর শুরু করলেন চেঁচাতে, ‘আমি লিফটে আটকা পড়ছি। আমি লিফটে আটকা পড়ছি।’ তাঁর সেই চিৎকার লিফটের ধাতব দেয়ালে আঘাত করে ফিরে আসতে লাগল। বাইরে বেরোনোর ফুরসত পেল না। তিনি লিফটের বদ্ধ দরজায় ধাক্কা দিতে আরম্ভ করলেন।

কেউ তাঁর কথা শুনছে না। প্রচণ্ড গরম। আর অন্ধকার। তাঁর মনে হলো, তাঁর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এই দরজা আর খুলবে না। এই লিফটেই তিনি প্রাণত্যাগ করবেন। তিনি তাঁর মোবাইলের দিকে তাকালেন। একটুখানি নেটওয়ার্ক দেখা যাচ্ছে। তিনি তাড়াতাড়ি কল করলেন তাঁর আপাকে, ‘হ্যালো আপা, আপা, আমি লিফটে, হ্যালো, হ্যালো... দুরো, লাইন তো কেটে গেছে। হ্যালো...’ তিনি আবার ডায়াল করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু নেটওয়ার্কই নেই। কল যাবে কীভাবে?

চালাকমামা লিফটের মেঝেতে বসে পড়লেন। তাঁর কান্না পাচ্ছে। তিনি বোধ হয় জ্ঞান হারাবেন। তাঁর পেট ফেটে যাচ্ছে জলভারে। কী মুশকিল। কী মুশকিল।

স্বাতী আর শান্তার মা অন্ধকারে হাতড়ে খুঁজে বের করলেন একটা রিচার্জেবল লাইট। সেটা জ্বালালেন। তারপর সেটা নিয়ে এগিয়ে গেলেন তাঁর বাসার ডাইনিং এলাকার দিকে। উষ্মামিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, ‘কী ব্যাপার, জেনারেটর কাজ করছে না কেন? এই গরমে ফ্যান ছাড়া থাকা যায়?’

‘জরিনা, জরিনা।’

‘জি খালাম্মা।’

‘নিচে গেটে ফোন কর। জেনারেটর আসে না কেন?’

‘খালাম্মা কল তো যায় না।’

‘আচ্ছা, আমি দেখছি।’

স্বাতীর মা মোবাইল ফোন তুলে কল করেন ফ্ল্যাটবাড়ির কেয়ারটেকারকে।

‘এই রতন। জেনারেটর কাজ করছে না?’

রতন নামের কেয়ারটেকার বলে, ‘না ম্যাডাম। জেনারেটর চালু করছিলাম। কোনো একটা বাড়িতে কেউ অতিরিক্ত লোড দিছে। জেনারেটর ফেইল করছে।’

স্বাতীর মা বললেন, ‘কে যে কী করে এই বাড়িতে! জেনারেটরের লাইনে বেশি লোড ইউজ করে কেন?’

জরিনা লজ্জা পাচ্ছে। তার হাতে একটা প্রজ্বলিত মোমবাতি। সেই আলোয় তার মুখখানা আরও লাজরাঙা দেখাচ্ছে। আসলে সেই তো ইস্তিরি গরম করছিল। আর সেটা সে করছিল চালাকমামার পীড়াপীড়িতে।

মোমবাতি নিয়ে জরিনা এগিয়ে গেল ইস্তিরির টেবিলের দিকে।

স্বাতীর মা দেখলেন। বললেন, ‘কিরে জরিনা, মোমবাতি নিয়ে কই যাস?’

জরিনা বলল, ‘মামার কাপড় ইস্তিরি করতে আছিলাম।’

তার হাতে মোমবাতির শিখা কাঁপছে। সেই আলোতে ছায়া পড়েছে পেছনের দেয়ালে।

স্বাতীর মা হাসতে হাসতে বললেন, ‘এখন কি মোমবাতি দিয়ে ইস্তিরি করবি?’

জরিনা বলল, ‘করন গেলে তো ভালাই হইত।’

স্বাতীর মা তাকিয়ে দেখলেন এক্সটেনশন লাইনে মাল্টিপ্লাগ এনে ইস্তিরি করা হচ্ছিল।

তিনি বললেন, ‘এর মানে কী? তুই জেনারেটরের লাইনে ইস্তিরি করছিলি!’

জরিনা মাথা নিচু করে বলল, ‘জে।’

‘আমি এখনই কেয়ারটেকারের সঙ্গে গজর গজর করলাম যে কারা জেনারেটরের লাইনে হেভি জিনিস চালায়। আর সেইটা কি না আমরা। আমাদের বাসায়?’

‘আরে আমার কী দোষ, চালাকমামা তো এই বুদ্ধি দিল!’

স্বাতীর মা বললেন, চালাক কই?

‘পান খাইতে নিচে গেল।’

‘আসুক। আজকে ওকে আচ্ছা করে শিক্ষা দিতে হবে।’

শিক্ষা চালাকমামা প্রকৃতির কাছ থেকেই পাচ্ছেন। তাঁর দমবন্ধ অবস্থা। তিনি লিফটের মেঝেতে বসে আছেন। গরমে সেদ্ধ, ঘামে জবজবে। তাঁর নিশ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি ধরেই নিয়েছেন, এই দরজা আর কোনো দিনও খুলবে না। তিনি মারা যাচ্ছেন। তিনি এখানে মরে পড়ে থাকবেন। তারপর তাঁর লাশ বের করা হবে। তখন দুলাভাই নিশ্চয়ই লিফট কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করে দেবেন। বেশ কিছু টাকা দুলাভাই পাবেন। তাতে তাঁর নিজের কী লাভ? তিনি তো তখন মৃত। টাকার ভাগ তো পাবেন না।

তবে মামলা কার বিরুদ্ধে হবে? জেনারেটর ফেইল করেছে। কারণ, জরিনা ইস্তিরি চালাচ্ছিল। আর কাপড়গুলো ছিল তাঁর নিজের।

স্বাতীর মা বলছেন, ‘কই চালাক আসে না তো। কী হলো?’

জরিনা বলল, ‘আন্দারে কেমনে আইব। কারেন্ট আহুক। আয়া পড়ব।’

স্বাতী আর শান্তা বাইরে গিয়েছিল। তারা এল অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে। এসে দেখতে পেল নিগূঢ় অন্ধকার। বিদ্যুৎ নেই, আবার জেনারেটরও কাজ করছে না। তারা গেটের প্রহরীদের জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে? কারেন্ট নাই কেন?’

‘জেনারেটর নষ্ট হইয়া গেছে আপা।’

‘এখন কী হবে? কালকে আমার সাবমিশন আছে। এখন স্টাডি করতে হবে’—ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ছাত্রী স্বাতী বলল।

শান্তা সদ্য মাধ্যমিক পাস করেছে, বলল, ‘তোমার ল্যাপটপে চার্জ আছে না?’

স্বাতী বলল, ‘কে জানে।’

‘চার্জ থাকলে তো মোমবাতি দিয়েই কাজ করতে পারতে।’

স্বাতী বলল, ‘যা গরম পড়েছে।’

তারা দুজন সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। স্বাতী উঠছে ধীরে ধীরে। শান্তা উঠছে দুই সিঁড়ি একবারে পার হয়ে, লাফিয়ে লাফিয়ে। সিঁড়িতে শব্দ হচ্ছে।

লিফটের মধ্যে আটকা পড়া চালাকমামার মনে হলো, সিঁড়ি দিয়ে কে যেন যাচ্ছে। তিনি লিফটের দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলেন, ‘বাঁচান, আমারে বাঁচান। আমি লিফটের মধ্যে আটকায়া আছি। আমারে বাইর করেন।’

শান্তাই লিফটের দরজার শব্দ শুনতে পেল আগে। সে বলল, লিফটে শব্দ হয় কিসের। ‘হ্যালো, কেউ কি লিফটে আটকে আছেন?’

চালাকমামার ধড়ে পানি ফিরে এল। তিনি বললেন, ‘জি, আমি আটকে আছি।’

শান্তা চেঁচিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, আমি বলছি গেটে। ওরা আসছে। দরজা খুলে দিতে আসছে। আপনি থাকুন। ভয় পাবেন না।’

চালাকমামা বললেন, ‘আপনার দুইটা পায়ে পড়ি। আপনি ওইখানে খাড়ান। বাইরায়া আপনেরে ৫০০ টাকা দিতাম।’

শান্তা বিস্মিত, ‘কী বলছেন?’ স্বাতীও তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার মোবাইল ফোন দিয়ে আলো জ্বালিয়েছে।

চালাকমামা বললেন, ‘বাইরায়া আপনেরে ৫০০ টাকা দিমু। আপনি যাইয়েন না। আমার সামনে খাড়ায়া থাকেন। আমি ভয় পাইতেছি। আমার কাপড়চোপড় নষ্ট হইয়া গেছে।’

শান্তা বলল, ‘আপনি আমাকে টাকা অফার করছেন কেন? আপনি থাকেন লিফটে আটকা। আপনার এইটাই শাস্তি হওয়া উচিত।’

চালাকমামা বললেন, ‘মা রে। আপনে আমার মা হন। বাপ হন। আপনে লিফট খুইলা দেন। নাইলে স্বাতী-শান্তার মায়েরে খবর দেন।’

স্বাতী চিৎকার করে উঠল, ‘চালাকমামা নাকি?

চালাকমামা বললেন, ‘কে স্বাতী? মা রে, আমারে বাঁচা রে মা।’

শান্তা বলল, ‘আপনার ভয়েস চেঞ্জ হয়ে গেছে নাকি?’

চালাকমামা বললেন, ‘মারে, আগে উদ্ধার কর।’

স্বাতী আর শান্তা দুজনেই দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল। কেয়ারটেকারকে বলল, ‘আংকেল, দেখেন তো, লিফটে আমাদের মামা আটকা পড়েছেন। তাঁকে উদ্ধার করতে হবে।’

কেয়ারটেকার লোকটা বৃদ্ধমতো। তার গালে দাড়ি। সঙ্গে একজন দারোয়ান। অতি তরুণ। তারা এল। সিঁড়ি বেয়ে উঠল তিনতলায়। একজন গেল ছাদে। কায়দা করে খুলল লিফটের দরজা।

চালাকমামা বের হলেন।

আর তখনই ইলেকট্রিসিটি চলে এল। আলোয় ঝকমক করে উঠল জায়গাটা।

চালাকমামা পুরোটা ভেজা। মাথা বেয়ে ঘাম ঝরছে। শার্ট ভেজা। প্যান্টও ভেজা। ব্যাপার কী, তিনিই জানেন।

চালাকমামা বের হয়েই চিৎকার করতে লাগলেন, ‘এই তোমরা কই থাকো? লিফটে আমি আটকা পড়ছি। তোমরা দেখবা না? আমি সবার চাকরি খাব। খেতেই হবে।’

শান্তা বলল, ‘মামা, ওরা আপনাকে উদ্ধার করেছে। আপনি ওদের ধন্যবাদ দিন।’

স্বাতী বলল, ‘জি মামা, ওনাদের ধন্যবাদ দিন। আর আপনি তো আমাদের ৫০০ টাকা দিতে চেয়েছিলেন। আমাদের সেই টাকা দিন। আমি ওনাদের সেটা দিয়ে দেব।’

চালাকমামা বললেন, ‘কিসের টাকা? আমি আগে এদের চাকরি খাই। তারপর কথা।’

****

আরেক দিনের কথা।

চালাকমামা এসেছেন এই বাসায়। ‘জরিনা। এক কাপ চা দিস তো।’

জরিনা বলল, ‘জি আচ্ছা।’

‘এক মিনিটের মধ্যে চা দিবি।’

‘মামা। পানি ফুটাইতে তো হইব। পানি না ফুটায়াও দিতে পারি। ঠান্ডা পানির মধ্যে একটা টি-ব্যাগ ছাইড়া দিতে পারি।’

‘পানি ফুটতে কতক্ষণ লাগে? চুলা ধরানো আছে না?’

‘না। চুলা ধরাইতে হইব।’

‘চুলা ধরাইতে হইব কেন? সব সময় চুলা ধরায়া রাখবি। ম্যাচের কাঠি বাঁচব। ম্যাচের কাঠি মূল্যবান জাতীয় সম্পদ। এইটা রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।’

‘আমাগো চুলা অটোমেটিক। ম্যাচের কাঠি লাগে না।’

‘তাইলেও চুলা জ্বালায়া রাখা নিরাপদ। ঘরে গ্যাস জমতে পারব না। চুলা নিভায়া রাখলি আর গ্যাসে ঘর ভইরা গেল। তখন চুলা জ্বালাইলেই ধম। পুরা বাড়ি দাউ দাউ কইরা জ্বলব। এই জন্য চুলা জ্বালায়া সব সময় ওপরে পানি দিয়া রাখবি এক হাঁড়ি।’

জরিনা ছাড়বার পাত্রী নয়, সে বলল, ‘মামা। উল্টা। চুলা জ্বালায়া রাইখা পানি চড়াইলেন। পানি ফুইটা ফুইলা চুলা গেল নিভা। তখন পুরা ঘরে গ্যাস ভইরা থাকব। এই জন্য চুলা নিভায়া রাখনই ভালা।’

চালাকমামা বললেন, ‘এই তুই এত কথা কস কেন? আমার চায়া বেশি বুঝস?’

জরিনা হেসে বলল, ‘মামা যে কী কন! এই দুইনায় আপনার চায়া বেশি কেউ জানতে পারে?’

জরিনা চা বানাতে চলে গেল।

এই সময় চালাকমামার ফোন বেজে উঠল।

চালাকমামা ফোন কানে লাগিয়ে বললেন, ‘হ্যালো...’

‘বাবা, চালাক।’

‘জি বলছি।’

‘বাবা। আমি তোমার আজিজার স্যার। তোমার জ্ঞানদীপ উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আজিজার রহমান।’

‘আসসালামু আলাইকুম স্যার। কেমন আছেন?’

‘কেমন আছি, সেইটা বলতে বাবা তোমার সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। আমি ঢাকায় আছি। তুমি কি বাবা আমার সঙ্গে একটু দেখা করতে পারবা?’

‘আপনি স্যার এক কাজ করেন। চলে আসেন।’

‘চলে আসব, কোথায়?’

‘এই তো আমার বোনের বাসায়। আমি স্যার ঠিকানাটা আপনাকে এসএমএস করে দিচ্ছি।’

‘আচ্ছা বাবা দাও।’

চালাকমামা এমএমএস করছেন। এর মধ্যে চা নিয়ে আসে জরিনা, ‘এই যে আপনের চা।’

‘এই টি-ব্যাগটা নিয়ে যাও। এটা ফ্রিজে তুলে রাখো। এরপরে আমার স্যার আসবেন। তাঁকে এই টি-ব্যাগ দিয়েই চা দেবে।’

‘ক্যান? পুরানা টি-ব্যাগ ক্যান দিমু? নতুন টি-ব্যাগ দিমু!’ জরিনা বিস্মিত।

চালাকমামা বললেন, ‘অপচয় করতে হয় না। যা বলি তাই শুনো।’

জরিনা বলল, ‘এইটা যদি আমি ফ্রিজে রাখি তাইলে আপনে যখন আবার চা চাইবেন তখন দিমু। আর কে আইব কইলেন?’

‘আমার স্যার। আমার শিক্ষক। মাস্টার মশাই। জনাব মো. আজিজার রহমান।’

‘ওনারে আমি ভালা কইরা চা-নাশতা দিমু। মাস্টার মশাইকে সম্মান করা ভালা।’

‘মাস্টারগো সম্মান করাই উচিত। কিন্তু সেইটা নতুন টি-ব্যাগ দিয়া না। তাগো সম্মান দিতে হইব সালাম কইরা।’

চালাকমামা নিচে গিয়ে তাঁর শিক্ষক আজিজার রহমানকে এগিয়ে নিয়ে এলেন। এসেই হাঁক পাড়তে লাগলেন, ‘এই জরিনা। চা দে। আমার স্যার এসেছেন। আমার স্কুলের স্যার। স্যার আর কিছু খাবেন? খান। আমার বোনের বাড়ি। দুলাভাই বড়লোক আছে। তারটা খাইতে কোনো অসুবিধা নাই। এই জরিনা, স্যার রে চা দে। শরবতও দে। শোন। শরবতে চিনি দিস না। স্যারের ডায়াবেটিস। চিনি ছাড়া শরবত দে।’

বলেন স্যার, ‘আপনার কী উপকার করতে পারি।’

আজিজার স্যারের পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি। তাঁর চক্ষু কোটরাগত। তবে চোখ দুটো উজ্জ্বল। তাঁর চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। তিনি বললেন, ‘বাবা আজিজার, তুমি ভালো আছো তো, না। বাবা, আমি আসছি আমার পেনশনের টাকা তুলতে। আমার কাছে বাবা তিন হাজার টাকা ঘুষ চায়।’

চালাকমামা বললেন, ‘ও হো স্যার, আমার কাছে তো তিন হাজার টাকা নাই।’

আজিজার স্যার বৈঠকখানা ঘরটার চারদিকে চোখ বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘বাবা। তোমার কাছে টাকা থাকলেই আমি নেব কেন? আমি তো মাস্টার মানুষ। চিরকাল পড়িয়ে এসেছি অনেস্টি ইজ দ্য বেস্ট পলিসি। আমি কেন ঘুষ দিয়ে আমার পাওনা পেনশন তুলব? এইটা আমার ন্যায্য পাওনা।’

চালাকমামা বললেন, ‘কত টাকা পাবেন।’

‘১ লাখ ৬৩ হাজার।’

চালাকমামা বললেন, ‘আরে ১ লাখ ৬৩ হাজারে ৩ হাজার। কমই তো চাইছে। দিয়ে দেন।’

আজিজার স্যার বললেন, ‘বাবা, তুমি আমার ছাত্র হয়ে এটা কী বলছ! আমি ঘুষ দেব। তুমি জানো—ঘুষদাতা ও ঘুষখোর উভয়েই দোজখের আগুনে জ্বলিবে।’

চালাকমামা বললেন, ‘সেটা তো দোজখে যাওয়ার পর। এখন আপনার টাকাটা তুলতে হলে কিছু দেবেন না? এইটাকে ঘুষ ভাববেন না। ভাববেন স্পিড মানি।’

‘না বাবা। যে নামেই বলো না কেন, এটা ঘুষ। এটা আমি দেব না।’

‘না দিলে তো ওরা আপনাকে টাকা দেবে না।’

‘সেই জন্যই তো আমি তোমার কাছে আসলাম। তুমি ব্যবস্থা নাও। এত বড় সাহস! একজন শিক্ষকের কাছে ঘুষ চায়।’

‘আপনি তো আর ওদের শিক্ষক না। আমি নাহয় আপনার ছাত্র। দুনিয়াতে তো আর সবাই আপনার ছাত্র না।’

‘কিন্তু তুমি আমার ছাত্র হয়ে ঘুষ দিতে বলছ?’

‘এইটাই এই যুগের নিয়ম স্যার। কী করবেন?’

‘বাবা চালাক, আমি তোমার শিক্ষক।’

‘স্যার আপনি শিক্ষক, আপনি জ্ঞানী। কিন্তু চালাক না। আমি ছাত্র, আমি চালাক। তিন হাজার টাকা থাকলে দিয়ে দেন।’

‘না, আমি দেব না। কেন দেব? সারা জীবন ছাত্রদের পড়িয়েছি। আদর্শ প্রচার করেছি। বলেছি, সততাই সর্বোৎ্কৃষ্ট পন্থা। নিজের পাওনা টাকা। যাঁরা আমাকে টাকাটা দেবেন, তাঁদের নিজেদের পকেটের টাকা না। আমাকে সেটা দেওয়া তাঁদের কাজ। সেই কাজ করার জন্য তাঁরা বেতন পান। সেই টাকা তুলতে আমাকে ঘুষ দিতে হবে? আমি ঘুষ দিলে বাংলাদেশ টিকবে? শেষ হয়ে যাবে। আর তুমি আমার ছাত্র, আমাকে বলতে পারলে ঘুষ দেন? এটা তুমি বলতে পারলে?’

আজিজার স্যার কাঁদতে লাগলেন।

এই সময় বাসায় ঢুকল স্বাতী। দেখল, একজন সৌম্যকান্তি বৃদ্ধ কাঁদছেন। সে তাঁর কথার কিছুটা শুনতেও পেল, ‘আমার ছাত্রও আমাকে বলে ঘুষ দিতে। আমার ছাত্রকে আমি এই শিক্ষা দিয়েছি!’

স্বাতী বলল, ‘কী হয়েছে?’

অলংকরণ: তুলি

চালাকমামা বললেন, ‘আরে বাদ দে। আমার স্কুলের স্যার। আগের কালের মানুষ। পেনশন তুলতে আসছেন। ১ লাখ ৬৩ হাজার টাকা পাবেন। মাত্র তিন হাজার টাকা ঘুষ দেবেন না।’

আজিজার স্যার বললেন, ‘দেখো মা। দেখো। কী বলে আমার ছাত্র!’

স্বাতী আগ্রহ নিয়ে শুনতে লাগল আজিজার স্যারের সমস্যাটা।

জরিনা কিছু বিস্কুট আর মিষ্টি ট্রেতে সাজিয়ে এনেছে। দুই কাপ চা। একটা চালাকমামার জন্য, একটা মেহমানের জন্য।

দুই চায়ের কাপে দুটো টি-ব্যাগ। মেহমানের জন্য সে নতুন টি-ব্যাগ দিয়েছে। চালাকমামাকে দিয়েছে ফেলে দেওয়া টি-ব্যাগ।

মামা চায়ের কাপে চুমুক দিলেন, বললেন, ‘চায়ে রংটা ঠিক খুলছে না।’

জরিনা বলল, ‘মামা। ড্রেনের মধ্যে ফেলছিলাম টি-ব্যাগটা। আপনার লাইগা ড্রেন থেইকা তুইলা আনলাম। আপনে ঘুষ দিতে চান। আপনের এই শাস্তি।’

মামা মুখের চা থু তু করে ফেলে দিলেন।

**

স্বাতী ঘরে ঢুকে ফোন করল ইটিকে। ‘হ্যালো, ইটি, একটা ছোট্ট সমস্যা নিয়ে তোমাকে ফোন করেছি।’

অপরাহ্ন। ইটির চিলেকোঠার ছাদে গনগন করছে রোদ। তার ঘরের জানালা খোলা। বাতাস নেই। গাছের পাতারা সব স্থির। ইটি ফোন ধরে বলল, ‘হ্যাঁ স্বাতী, বলো তোমার কী ছোট্ট সমস্যা।’

স্বাতী বলল, ‘একজন শিক্ষক। অবসর নিয়েছেন। তাঁর পেনশনের টাকা তুলতে ঢাকায় এসেছেন। এখন কর্মচারীরা তাঁর কাছে ঘুষ চাচ্ছে।’

ইটি মানে ইশতিয়াক টিপু। সে মোবাইল ফোন নিয়ে তার ছাদে এসে দাঁড়াল। কাকদের নিয়মিত খাবার দেয় সে। তাকে দেখে দুটো কাক এসে ছাদের রেলিংয়ে বসল।

ইটি বলল, ‘ঘুষ চাচ্ছে, না? এটা ছোট সমস্যা না। এটা অনেক বড় সমস্যা। কার স্যার?’

স্বাতী বলল, ‘চালাকমামার শিক্ষক।’

ইটি বলল, ‘চালাকমামা এর মধ্যে এসে গেলে মুশকিল। তুমি একটা কাজ করো। স্যারের ফোন নম্বরটা একটু আমাকে দাও।’

স্বাতী বলল, ‘তোমাকে এসএমএস করে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

ইটি আর আজিজার স্যার স্বাতীদের বাসাতেই বসল। স্যার সব খুলে বললেন ইটিকে।

ইটি বলল, ‘স্যার, কালকে আমরা একসঙ্গে পেনশনের অফিসে যাব। কে কে ঘুষ চেয়েছিল আপনি একটু আমাকে দেখিয়ে দেবেন।’

আজিজার স্যার বললেন, ‘জি বাবা।’

‘আমরা একসঙ্গে যাব।’

‘ঠিক আছে বাবা। বাবা, কোনো ঝামেলা হবে না তো? তোমার কোনো ক্ষতি হবে না তো?’

ইটি বলল, ‘আমার ক্ষতি নিয়ে ভাববেন না স্যার।’

সরকারি অফিস। মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে। দেয়ালজোড়া আলমারিতে ফাইল আর ফাইল। টেবিলের ওপরেও ফাইলের স্তূপ। ঘরটা দিনের বেলায়ও অন্ধকার। তিনটা হলুদ বৈদ্যুতিক লাইটও সেই অন্ধকার যেন দূর করতে পারছে না।

আজিজার মাস্টার ইটিকে নিয়ে গেলেন অফিসারের সামনে। ইটির পরনে থ্রিকোয়ার্টার ট্রাউজার, গায়ে একটা টি-শার্ট। শার্টে লেখা, আমার পৃথিবী অনেক বড়। তার পায়ে একজোড়া চপ্পল।

তারা গিয়ে দাঁড়াল একটা টেবিলের সামনে। টেবিলের অপর পারে একটা উজ্জ্বল টাক। মাথার ওপরের লাইট সেখান থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে। তাঁর গায়ে একটা কোট। এই প্রচণ্ড গরমের মধ্যে তিনি কোট পরে আছেন, বলা মুশকিল। ইটির টি-শার্টে আবার পকেট আছে। সেই পকেটে আছে একটা হিডেন ক্যামেরা। কলমের আকার। ইটি কলমটা হাতে নিয়ে একটা টিপ দিল। নিব বের হলো। যেন সে এখন লিখবে। ক্যামেরা চালু হয়ে গেল। ইটির কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ ঝুলছে।

ইটির একজন বন্ধু থাকে সান ফ্রান্সিসকোতে। সিলিকন ভ্যালিতে। আইটি এক্সপার্ট। কম্পিউটার জিনিয়াস। সে-ই তাকে এই ক্যামেরা পাঠিয়েছে আমেরিকা থেকে। আর ইটির অনলাইন ব্যাপারগুলোর ব্যাপারেও তার এই আইটি এক্সপার্ট বন্ধুই প্রধান পরামর্শক।

আজিজার স্যার বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম। আমার ফাইলটা যদি ছাড়তেন।’

অফিসার মুখ না তুলে বললেন, ‘আনছেন টাকা?’

‘আমার সঙ্গী উনি এনেছেন।’

ইটি বলল, ‘কত টাকা ঘুষ দিতে হবে?’

অফিসার বললেন, ‘ঘুষ বলবেন না। এটাকে বলবেন কমিশন। স্যার, এত টাকা পাবেন। আমরা তো কিছুই পাব না। কাজেই একটু খুশি হয়ে যদি কিছু দেন আরকি। আমরা তো অনেকের কাছে অনেক বেশি নিই। স্যারের জন্য মাত্র তিন হাজার টাকা।’

ইটি তার কাঁধের থলেটা টেবিলের ওপরে রাখল। বলল, ‘নেন। গুনে নেন। এই ব্যাগে আছে। দশ হাজার আছে।’

অফিসার বলল, ‘দশ কেন?’

ইটি বলল, ‘বললেন না অনেকের কাছে বেশি নেন। আমি চাই কাজটা তাড়াতাড়ি হোক।’

অফিসার এবার টাকার থলেতে হাত দিলেন। থলের মুখ খুললেন। ভেতরে হাত দিতেই চিৎকার করে উঠলেন। হাত থেকে কী যেন ছুড়ে ফেললেন।

একটা সাপ অফিসের মেঝেতে ফণা তুলে আছে।

অফিসার অফিসের টেবিলে উঠলেন। ওরে বাবা রে, ওরে মা রে...ওই রুমের অন্য কর্মচারীরাও সবাই চেয়ারের ওপরে উঠেছেন।

সাপটা ঘরের মধ্যে ঘুরতে লাগল।

সবাই কেউ টেবিলের ওপরে, কেউবা চেয়ারের ওপরে দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করছেন।

অফিসার বলছেন, ‘এসব কী? এই সবের মানে কী? ও রে বাবা রে। আমার হাতে ঠান্ডা লেগে আছে।’

ইটি বলল, ‘এইটা ঘুষ। এই সাপের দাম দশ হাজার টাকা। খাঁটি গোখরো। একবারে ত্রিশজনকে মারতে পারবে।’

অফিসার বললেন, ‘ত্রিশজনকে মারতে পারবে?’

ইটি বলল, ‘ভয়ানক সাপ। থুতু দিয়ে বিষ ছিটাতে পারে। সর্পমণি, এই সাহেবরে একটু থুতু মেরে দেখাও তো।’

অফিসার বললেন, ‘আপনের পায়ে পড়ি। আমি সাপ খুব ভয় পাই।’

‘সাপ ভয় পান। কিন্তু ঘুষ খুব আরাম করে খেতে পারেন। তাই তো?’

‘ভাই ভুল হয়ে গেছে। আর কোনো দিন কারও কাছে ঘুষ চাইব না।’

ইটি সাপটাকে ধরে থলেয় পুরল। তারপর অফিসারের কাছে গিয়ে বলল, ‘ব্যাগে আরও সাপ আছে। দেব ধরিয়ে...’

‘ও রে বাবা রে...’

‘আর কোনো দিন কোনো অসহায় মানুষের কাছে ঘুষ চাইবেন?’ ইটি বলল।

‘না, আর কোনো দিনও চাইব না।’

‘মনে থাকে যেন। আর স্যারের বিল আজকের মধ্যে ক্লিয়ার করে দেবেন।’

‘জি আচ্ছা। আপনি সাপটাকে নিয়ে বাইরে যান। আমি বিল করে দিচ্ছি।’

আমার সঙ্গে বলুন, ‘ঘুষ খাব না, ঘুষ দেব না।’

অফিসারটা তোতাপাখির মতো বললেন, ‘ঘুষ খাব না, ঘুষ দেব না।’

ইটি সবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনারা সবাই হাত তুলে শপথ নিন। আমার সঙ্গে বলুন, ঘুষ নেব না, ঘুষ দেব না।’

সবাই—কেউ টেবিলে, কেউ চেয়ারে দাঁড়ানো। বললেন, ‘ঘুষ নেব না, ঘুষ দেব না।’

***

ইটি তার ঘরে বসে ভিডিওটা এডিট করল। তাতে ভয়েস ঢোকাল। সে বলল, ‘আমাদের দেশটা সুন্দর। এর বেশির ভাগ মানুষ সুন্দর। গরিব কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শস্য ফলায়, আমাদের মুখে অন্ন জোগায়। গরিব শ্রমিক কারখানার চাকা ঘোরায়। বিদেশে গিয়ে কত কষ্ট করে মানুষ দেশে টাকা পাঠায়। কিন্তু এই দেশের তবু দুর্নাম। গরিব মানুষ দুর্নীতি করে না। শ্রমজীবী মানুষ দুর্নীতি করে না। কিন্তু কতিপয় ভদ্রপোশাক পরা ভদ্রলোক আমাদের দেশের দুর্নামের জন্য দায়ী। বাংলাদেশকে বলা হয় পৃথিবীর অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। এ দেশের সরকারি কর্মকর্তারা ঘুষ খান। দেখুন, এই লোকের কাণ্ড দেখুন। একজন অসহায় শিক্ষকের কাছ থেকে তিনি ঘুষ আদায় করার চেষ্টা করছেন। যে শিক্ষক সারা জীবন ছাত্রদের পড়িয়েছেন সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। তাঁর কাছে কেউ ঘুষ চাইতে পারে? এই পাষণ্ড মানুষটি পারে। তাই তাকে শায়েস্তা করার জন্য আমাদের বিশেষ সর্প অভিযান। দেখুন।’

ইটি তার এই ভিডিওটা পোস্ট করে দিল তার ফেসবুক পেজ ‘নাগরিকের চোখে’। সঙ্গে সঙ্গে তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে যেতে লাগল দেশের আনাচকানাচে। মানুষ দেখে আর হাসে। ঘুষখোর অফিসারের ভয়ার্ত মুখখানা দেখে মানুষ আমোদ পায়। তাঁকে একবার চেয়ারের ওপরে একবার টেবিলের ওপরে উঠতে দেখে মানুষ হেসে গড়িয়ে পড়ে। আবার এই শিক্ষকের দুঃখ দেখে কষ্টও পায়। একটা মানুষ সারাটা জীবন নিঃস্বার্থভাবে পরোপকার করে গেলেন। মানুষকে মানুষ করার জন্য খেটে মরলেন। শেষ জীবনে এসে তিনি তাঁর পাওনা টাকা পাবেন না! তাঁকে ঘুষ দিতে হবে?

ইটি তার ফেসবুক পেজটায় বারবার ঢোকে। দেখে, তার পোস্টটা কতটা লাইক পেল। বন্যার পানির মতো তার এই ভিডিওতে লাইক পড়ছে। হাজার হাজার শেয়ার হচ্ছে। মানুষের ক্ষুব্ধ কমেন্টসে তার পেজ ভরে যাচ্ছে। ইটির চোখের কোণে জল। বাংলাদেশের মানুষ আসলে ভালো। সে তার ঘরের বাইরে এল। ছাদে পায়চারি করতে লাগল। তাকে দেখে কাকেরা এসে গেল। আজকে দুপুরে কাকদের কি সে একটু উন্নত মানের খাবার দেবে? কাকেরা কি বিরিয়ানি পছন্দ করে? পচা বিরিয়ানি নাকি গরম বিরিয়ানি? সে হেঁটে হেঁটে গেল মোড়ের সাগর হোটেলে। তিন প্যাকেট বিরিয়ানি কিনল। তারপর সেই বিরিয়ানি নিয়ে চলে এল ছাদে।

কাকদের খাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। তারা ছাদের রেলিংয়ে বসে পড়েছে। কা কা রবে মাতিয়ে তুলেছে পুরো এলাকা।

ইটি বিরিয়ানির প্যাকেট খুলে খাবার ছিটাতে লাগল। কাকদের ফুর্তি দেখার মতো। কী যে আনন্দ করে কাকগুলো বিরিয়ানি খাচ্ছে!

এদিকে ইটি তথা ইশতিয়াক টিপুর ভিডিও পোস্টটা সাড়া ফেলেছে সাপুড়েসমাজেও। ঢাকা সাপুড়ে সমিতির সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদক জরুরি সভা ডেকেছেন। তাঁরা বললেন, ‘আমরা যাব ওই অফিসে। আরও সাপ ছেড়ে দেব।’

যা কথা, তা-ই কাজ। সাতজন সাপুড়ে তাদের সাপের ঝুড়ি নিয়ে হাজির হলো ওই অফিসে। তারা ওই অফিসারের সামনে গিয়ে ১৪টা ঝাঁপি খুলে ছেড়ে দিল ৭২টা সাপ। সাপ কিলবিল করছে পুরো অফিসে।

কর্মকর্তা আর কর্মচারীরা পালাল সবাই ওই ঘর থেকে। শুধু ঘুষ দাবি করা অফিসারটা বের হতে পারলেন না। তাঁর সামনে সাপ। পেছনে সাপ। তিনি টেবিলের ওপরে উঠে ‘ও রে বাবা রে, ওরে মা রে, খেয়ে ফেলল রে’ বলে চিৎকার করে চললেন।

পলায়নপর কর্মকর্তারা ফোন করলেন পুলিশ স্টেশনে। আমাদের বাঁচান। সাপুড়েরা অফিসে সাপ ছেড়ে দিয়েছে। পুরো অফিসে কিলবিল করছে সাপ আর সাপ।

পুলিশ ছুটে আসছে। কিন্তু সে খবর চাউর হয়ে গেল। টেলিভিশনের সাংবাদিকেরা, সংবাদপত্রের সাংবাদিকেরা জেনে গেলেন ওই অফিসে কিছু একটা হয়েছে। তাঁরা ক্যামেরা নিয়ে ছুটলেন পেনশন শাখায়। দেখতে পেলেন আজব কাণ্ড। সাপুড়েরা বাঁশি বাজাচ্ছে। পেনশন শাখার অফিস ঘরে নৃত্য করছে কতগুলো সাপ। আর ঘুষখোর অফিসার টেবিলের ওপরে চড়ে ভয়ের নাচ নাচছেন।

পুলিশ এল। তারা গ্রেপ্তার করল সাপুড়েদের।

তখন অফিসাররা বলতে লাগলেন, ‘আরে ওদের গ্রেপ্তার করলে কী লাভ? ওদের বলেন, সাপগুলোকে আগে ঝুড়ির মধ্যে পুরুক। সব সাপ।’

‘তাই তো। তাই তো।’ পুলিশকর্তা বললেন, ‘এই তোরা সবগুলো সাপ গুনে গুনে ঝুড়িতে ভর। ’

টেলিভিশনগুলোয় লাইভ প্রচার করা হচ্ছে এই দৃশ্য। ভিড় জমে গেছে পেনশন শাখার সামনে। সংবাদপত্রগুলোও তাদের ওয়েবপেজে ভিডিও ছবি প্রকাশ করছে।

ইটি তার ছাদের ঘরে বসে টেলিভিশন চ্যানেলের লাইভটাকে নিজে শেয়ার দিল তার নাগরিকের চোখ পাতা থেকে।

আজিজার স্যার বসে আছেন স্বাতীদের বৈঠকখানায়। টেলিভিশনে লাইভ দেখাচ্ছে পেনশন শাখার কর্মকারখানা।

তারপর টেলিভিশনে দেখাতে লাগল মন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন।

মন্ত্রী বলছেন, ‘আমরা এই অসৎ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আর আজিজার রহমান স্যারের সব পাওনা তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে।’

সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ‘হবে মানে কবে হবে?’

‘আজকেই হবে। অবিলম্বে। ধন্যবাদ।’

‘সাপুড়েদের কি ছেড়ে দেওয়া হবে?’

‘এটা আইনের ব্যাপার।’

সাপুড়েরা খবর পেয়ে বলল, ‘আমাদেরকে গ্রেপ্তার করলে করুন। আমরা কিন্তু তাহলে সাপ ধরব না।’

পুলিশ বলল, ‘আচ্ছা, তোমাদের গ্রেপ্তার করা হবে না। সাপ ধরো আগে।’

সাপুড়েরা সাপ ধরে ধরে আবার ঝুড়িতে রাখল।

আজিজার স্যার টেলিভিশন দেখছেন। খুব আবেগপ্রবণ হলেন তিনি। তাঁকে ঘিরে এত কাণ্ড। তাঁর চোখ ফেটে জল আসছে। মন্ত্রী বলেছেন, তাঁর পেনশনের টাকা তাঁকে পৌঁছে দেওয়া হবে। আলহামদুলিল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ।

ওই ড্রয়িংরুমে এসে গেলেন চালাকমামা। তিনিও বসে বসে খানিকক্ষণ টেলিভিশন দেখলেন। তারপর বললেন, দুনিয়াটা হইল শক্তের ভক্ত নরমের যম। দেখেন দেখেন, এখন সব কেমন সোজা হয়ে গেছে।

চালাকমামা হাঁক ছাড়লেন, ‘জরিনা জরিনা। তরমুজ কেটে দাও তো।’

জরিনাও এতক্ষণ টেলিভিশন দেখছিল। সাপ নিয়ে এত কাণ্ড তার খুবই পছন্দ হয়েছে। তার মাথায় একটা দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল।

ফ্রিজে তরমুজ কাটাই আছে। সে একটা বড় বাটিতে তরমুজ নিল। তারপর খাটাল তার দুষ্টুবুদ্ধি। তরমুজ ঢেকে নিয়ে সে এল চালাকমামার সামনে।

মামা বাটির ঢাকনা খুললেন।

ঢাকনা খুলতেই বেরিয়ে এল একটা সাপ।

চালাকমামা ‘ও রে বাবা রে, ও রে মা রে’ বলে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

জরিনা বলল, ‘হায় হায় মামা, এইটা তো প্লাস্টিকের সাপ। ও মামা...’

শারা জুডো ফেডারেশনের অফিস থেকে বের হচ্ছিল। একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। ফুটপাতে এখানে-ওখানে পানি জমে আছে। তবে আকাশটা বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। ঝকঝক করছে। গাছের পাতাগুলোও পরিষ্কার। ঢাকা শহরের গাছের পাতার ওপরে এত ধুলোবালু পড়ে থাকে যে পাতার রং হয়ে যায় ধূসর। বৃষ্টির পরে গাছের পাতাগুলো সবুজ হয়ে ওঠে।

শারা তার ড্রাইভারকে ফোন করল, ‘মিঠু আংকেল, আপনি কই?’

মিঠু বলল, ‘পার্কিংয়ে গাড়ি রাখছি। আইতাছি।’

কল কেটে দিয়ে শারা তাকাল ফুটপাতে। বেশ জটলা। একজন বৃদ্ধ হাউমাউ করে কাঁদছেন। শারা কৌতূহলবশত তাঁর কাছে গেল।

শারা বলল, ‘কী হয়েছে?’

একজন লোক বলল, ‘ওনার জমি বিক্রির টাকা নিয়ে উনি ব্যাংকে যাচ্ছিলেন। ওনার হাতের ব্যাগে পাঁচ লাখ টাকা ছিল। রাস্তায় কারা যেন ওনার শার্টে ময়লা লাগিয়ে দেন। উনি ময়লা পরিষ্কার করার জন্য বাথরুমে ঢোকেন। ব্যাগ রেখে শার্ট পরিষ্কার করছিলেন। হঠাৎ দেখেন টাকা নাই।’

বৃদ্ধ বললেন, ‘আমার শেষ সম্বল। বিক্রি করেছিলাম ছেলেকে বিদেশে পাঠাব বলে।’ তিনি আর কথা বলতে পারছেন না। কান্নার তোড়ে তাঁর কথা বুজে আসছে।

শারা বলল, ‘আপনি কোন বাথরুমে গিয়েছিলেন?’

শারাও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সে জুডো ফেডারেশনের সদস্য। জুডো জানে। ব্ল্যাকবেল্ট। স্বাতী তার ক্লাসমেট। রাস্তাঘাটে বখাটেদের পিটিয়ে সে এরই মধ্যে তারকাখ্যাতি অর্জন করেছে। ইটির নাগরিকের চোখ পেজে তার বখাটে-ধোলাইয়ের ভিডিও পোস্ট করা আছে।

‘ওই বিল্ডিংয়ে...’, বৃদ্ধ বললেন।

শারা বলল, আপনি আমার সঙ্গে আসুন তো। একজন-দুজন পথচারী চিনতে পেরেছে শারাকে। তারা বলাবলি করল, এইটা তো সেই কারাতে কন্যা। ডেঞ্জারাস লেডি।

পাশেই একটা দোতলা মার্কেট। মার্কেটের দেয়ালে শত শত পোস্টার। দেয়ালটা ক্ষতবিক্ষত। ঢাকা শহরে পোস্টার লাগানো নিষিদ্ধ করা উচিত। কে পড়ে এসব পোস্টার? কী লাভ হয় এসব পোস্টারে?

বৃদ্ধ তাকে মার্কেটের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। ওই ওখানে বাথরুম। বাথরুমের পাশেই একটা জুয়েলারির দোকানও দেখা যাচ্ছে।

বৃদ্ধ রোদন করে করে শারাকে ঘটনার বিবরণ দিলেন।

শারা চারপাশটা ভালো করে লক্ষ করছে। তার প্রথম অন্বেষণ, আশপাশে কোথাও সিসিটিভি ক্যামেরা আছে কি না। জুয়েলারিতে অবশ্যই সিসি ক্যামেরা থাকার কথা। সে বলল, এখানে তো সিসিটিভি আছে। আচ্ছা দেখছি ফুটেজ আছে কি না।

সারা জুয়েলারির দোকানে গেল। বলল, ‘আপনাদের এই সিসিটিভিটা তো দেখছি বেশ শক্তিশালী। আপনারা কত দিনের রেকর্ড রাখেন।’

একজন দোকানি বলল, ‘তিন দিনের রাখি ম্যাডাম।’

‘গুড। রাখবেন। আপনারা অন্তত আজকের ফুটেজটা নষ্ট করবেন না। বুঝলেন?’

‘জি ম্যাডাম।’

‘কথার যেন নড়চড় না হয়।’

দোকানের দুজন কর্মচারী সারাকে চিনতে পেরেছে। তারা বলল, ‘জি ম্যাডাম, জি ম্যাডাম। আপনাকে আমরা চিনতে পেরেছি। ম্যাডাম, আপনার সঙ্গে কি একটা সেলফি তুলতে পারি?’

শারা বলল, ‘জি নিশ্চয়ই। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনাদের সিসিটিভির ফুটেজ কিন্তু আমার লাগবে।’

‘জি ম্যাডাম, জি ম্যাডাম।’

শারা ফোন করল ইটিকে।

‘হ্যালো, ইটি!’

ইটি বলল, ‘বলো।’

‘একটু আসতে পারবেন?’

‘কোথায়?’

‘উত্তর গেটের জুয়েলারি মার্কেটে। রূপসী জুয়েলার্সে। আসার সময় একটা পেনড্রাইভ নিয়ে আসবেন। সিসিটিভির ফুটেজ নিতে হবে।’

ইটি বলল, ‘আচ্ছা, আমি আসছি।’

ইটির আসতে সময় লাগল। বুদ্ধি করে ফোন দিয়েছে জিয়াকে। জিয়া একটা দৈনিক পত্রিকার ফটোসাংবাদিক। তাঁর মোটরসাইকেল আছে। জিয়া সাহেব তাঁর মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে ইটিকে নিয়ে চলে এলেন রূপসী জুয়েলার্সে।

ইটি আর জিয়া সাহেব আসার পরে তারা সবাই মিলে সিসিটিভির ফুটেজ পরীক্ষা করা শুরু করল।

দেখা গেল, বৃদ্ধ ভদ্রলোক বাথরুমে ঢুকলেন। বাইরে কয়েকজন দাঁড়াল। তারাও ভেতরে ঢুকল। তারপর ভদ্রলোকের ব্যাগ নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল।

শারা বুঝিয়ে বলল, ‘এনার ব্যাগে পাঁচ লাখ টাকা ছিল। এই লোকগুলো এভাবে নিয়ে চলে গেছে।’

ইটি বলল, ‘আপনারা চেনেন এই লোকগুলোকে?’

দোকানিরা বলল, ‘জি না। আমরা এনাদের এর আগে কোনো দিনও দেখি নাই।’

ইটি বলল, ‘ঠিক আছে। পেনড্রাইভে ফুটেজটা ভরে নিয়ে যাচ্ছি। ধন্যবাদ। আপনারা এই ফুটেজ নষ্ট করবেন না। বুঝলেন?’

দোকানিরা বলল, ‘জি বুঝেছি।’

ওরা চারজন, ইটি, শারা আর জিয়া সাহেব আর বৃদ্ধ গেলেন নিকটবর্তী থানায়। বৃদ্ধ উঠলেন শারার গাড়িতে। ইটি আর জিয়া মোটরসাইকেলে।

জিয়াকে দেখেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে পড়লেন। ‘আসুন আসুন, জিয়া সাহেব।’

আর ইটিকে দেখে তো পায়ে ঠুকে স্যালুট করে ফেললেন।

কর্মকর্তা বললেন, ‘এই চেয়ার দাও। কী খাবেন, চা না কফি? বলেন, আপনাদের কী সেবা করতে পারি?’

শারা বলল, ‘আমার ল্যাপটপে একটা সিন আগে দেখে নিন।’

তারা পেনড্রাইভের ভিডিওটা চালাল। পুলিশ অফিসার দেখলেন।

শারা বলল, ‘এই ভদ্রলোকের হাতে ব্যাগটা ছিল। টাকার ব্যাগ। এই লোকগুলো তাঁর শার্টে ময়লা লাগিয়ে ধোয়ার কথা বলে ব্যাগটা নিয়ে চম্পট দিয়েছে।’

পুলিশ অফিসার বললেন, ‘এই লোকগুলো কারা? এদের নাম-ঠিকানা কী?’

শারা বলল, ‘তা তো জানি না।’

বৃদ্ধ বললেন, ‘আমি তো এদের চিনি না।’

পুলিশ কর্তা বললেন, ‘তাহলে কীভাবে মামলা হবে। নাম-ঠিকানা তো লাগবে।’

শারা বলল, ‘আপনারা ছবি দেখে বের করে ফেলেন।’

পুলিশ বলল, ‘এটা কীভাবে সম্ভব। আমরা আইনের লোক। আইনের বাইরে কীভাবে যাব। এই লোকগুলোকে তো আমরা চিনি না, জানি না। কীভাবে সম্ভব?’

শারা বলল, ‘কেন সম্ভব না?’

ইটি সব দেখছে। সে কিছু বলছে না।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তবু পুলিশের দয়া হয় না।

বৃদ্ধ বলতে লাগলেন, ‘আমার একমাত্র পুত্র। আমার বেশি বয়সের সন্তান। পোলাটাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য আমি এত কষ্ট করেছি। আমার শেষ সম্বলই জমি বিক্রি করেছি। জমি বেচা টাকাও হাতছাড়া হলো। এখন আমি কী করব। আল্লাহ গো, আমাকে তুলে নাও গো।’

ইটি বলল, ‘পুলিশ জানে না, এটা হয়? আপনারা অবশ্যই ক্রিমিনালগুলোকে ধরে ফেলতে পারবেন।’

পুলিশ বলল, ‘ভাই, আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। আমরা এই লোকগুলোকে কোথায় পাব? ১৬ কোটি লোক। কোনো ক্লু থাকলে দেন। নাম-ঠিকানা।’

ইটি বলল, ‘আচ্ছা, আমরা জিডি করি। এরপর আসামিদের নাম, পরিচয়, ঠিকানাসমেতই আপনাদের কাছে আসব।’

ওরা বেরিয়ে গেল। শারার মন খারাপ। জিয়া ক্ষিপ্ত। ইটি ঠান্ডা। বলল, ‘আমাকে কিছুটা সময় দাও।’

বৃদ্ধ ভদ্রলোককে ইটি বলল, ‘আপনি বাড়ি যান। আপনার নাম-ঠিকানা আমাদের কাছে থাকল। আমাদের নম্বরও আপনি রাখুন। আপনার এই টাকা অবশ্যই উদ্ধার হবে। অবশ্যই।’

এই পুরো কথোপকথনটাও ইটি রেকর্ড করে ফেলল তার গোপন ক্যামেরায়।

তারপর সে এই ভিডিওটা প্রকাশ করল তার ফেসবুক পেজ ‘নাগরিকের চোখ’-এ।

প্রথমে সিসিটিভির ফুটেজ। তারপর বৃদ্ধের কান্না। তারপর পুলিশের নিস্পৃহ কথাবার্তা। এরপর ইটির কথা—আপনারা কি কেউ এই ক্রিমিনালগুলোকে চেনেন? তাহলে এদের নাম-ঠিকানা ইনবক্সে কিংবা কমেন্টসে লিখুন।

দিকে দিকে লোকে এই ভিডিও দেখছে। থানায় ফোন আসছে। আপনারা মিজান সাহেবের কেসটা দেখছেন না কেন? এটা হাতে নিচ্ছেন না কেন? ফোন বেজেই চলেছে। একটার পর একটা। ব্যাপার কী? এত ফোন আসছে কেন? পুলিশ ঘটনাটা তদন্ত করে দেখছে। এত কেন ফোন আসে? এত কেন ফোন আসে? তদন্ত বড়ই কঠিন। কিছুতেই কিনারা করা যাচ্ছে না। বড় কঠিন সমস্যা। কঠিন সমস্যারও সহজ সমাধান আছে। পুলিশ একজন ফোন কলারকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই ঘটনা কী, আপনারা ফোন নম্বর কই পাচ্ছেন?’

ফোন নম্বর? ‘নাগরিকের চোখ’ নামের ফেসবুক পাতায়।

আশ্চর্য। এই কঠিন সমস্যার এত সহজ সমাধান। নাগরিকের চোখ পেজটা কাটাছেঁড়া করে দেখতে হয়। পুলিশ মুশকিলে পড়ল। এই পেজ কাদের। এই সমস্যারও সোজা সমাধান আছে। এর আগেও এই পেজ তাদের যন্ত্রণা করেছে। একজন দাগি আসামি আছে এই পেজের নেপথ্যে। তার নাম ইটি।

‘অ্যারেস্ট হিম। অ্যারেস্ট হিম।’

পুলিশ এসে ঘিরে ফেলল ইটির আস্তানা। তারা উঠে পড়ল চিলেকোঠায়। ঠক ঠক।

ইটি তাকিয়ে দেখল, পুলিশ এসে গেছে।

‘কী ব্যাপার, আপনারা? আবার পুরস্কার দেবেন নাকি?’

‘পুরস্কার বাইর কইরা দেওয়া হবে। আসো মিয়া।’

‘আপনারা আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছেন কেন? আমাকে খবর দিলেই তো আমি নিজে হাজির হয়ে যেতাম।’

ইটি বসে আছে থানায়।

‘তুমি এই পোস্ট কেন দিয়েছ?’

‘আপনারা এই ক্রিমিনালগুলোকে ধরছেন না কেন? কেন বের করছেন না এরা কারা?’

‘ফাজলামো করো? এইটা তুমি পোস্ট করছ। তুমিই বলো এরা কারা।’

‘আপনারা পুলিশ। আপনাদের কাজ অপরাধীকে শনাক্ত করা। তাদের আইনের আওতায় আনা। আমাকে বলছেন কেন? এত বড় একটা অপরাধী চক্র! তাদের চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেই ভিডিও আপনাদের দেওয়া হয়েছে। এরপরও আপনারা ব্যবস্থা নেবেন না কেন?’

ইটির পকেটের কলম এসব কথাও রেকর্ড করে ফেলল।

স্বাতী এসেছে থানায়। ইটির সঙ্গে দেখা হলো তার।

ইটি তাকে প্রথম সুযোগেই দিয়ে দিল তার কলমটা। সেটা তো আসলে কলম নয়। হিডেন ক্যামেরা।

স্বাতী বলল, ‘খেতে দিয়েছে?’

‘হ্যাঁ। খেতে দিয়েছে।’ ইটি বলল, ‘তবে আমি আমার খাওয়া নিয়ে চিন্তিত না। আমি চিন্তিত কাকদের নিয়ে। তুমি প্লিজ একটু বাসায় যাও। কাকদের একটু খেতে দাও।’

স্বাতী চোখ মুছছে। এই লোকটা এমন কেন? নিজের খাওয়া নিয়ে কথা বলে না। কাক নিয়ে দুশ্চিন্তা করে।

এবার নাগরিকের চোখ পেজটিতে ভিডিও পোস্ট করছে স্বাতী। পেজটার সেও একজন অ্যাডমিন। ইটি তাকে অ্যাডমিন বানিয়ে দিয়েছে। এবারের ভিডিওটা ইটির গ্রেপ্তার হওয়া আর তার সঙ্গে পুলিশের প্রাথমিক কথাবার্তা নিয়ে। নিজের ঘরে বসে স্বাতী ভিডিও পোস্ট করছে। জানালার পর্দা সরানো। দক্ষিণ দিকের জানালা। চারতলা ভবন। দুটো নারকেলগাছ আর একটা আমগাছ ঠিক তার জানালা বরাবর। আমগাছে আম ধরে পেকে আছে। বাইরে বোধ হয় বৃষ্টি হবে। আকাশ কালো হয়ে আসছে।

ভিডিওটা এডিট করে সে পাবলিশের ঘরে চাপ দিল।

হ্যাঁ। পোস্ট হয়েছে। লাইক পড়তে শুরু করেছে।

দুই শ তিনটা লাইক। পাঁচ শ লাইক। ২৫ শেয়ার।

আবারও ঘরে ঘরে লোকে এই ভিডিও দেখতে শুরু করল। এক লাখ লাইক, সাড়ে তিন হাজার শেয়ার। পাঁচ হাজার কমেন্টস।

‘ইটিকে ছেড়ে দাও।’

‘রিলিজ ইটি।’

ইভেন্ট খোলা হয়েছে। পেজ খোলা হয়েছে। সারা দেশে হইচই।

মিজান সাহেবের টাকা উদ্ধার করুন। দোষী ব্যক্তিদের ধরুন। মোশাকে ছেড়ে দিন। থানার সামনে লোকের ভিড়। তারা ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছে।

বৃদ্ধ ভদ্রলোকের নাম মিজান সাহেব। চারদিকে এক আওয়াজ, ‘মিজান সাহেবের টাকা উদ্ধার করো। প্রতারক চক্রকে গ্রেপ্তার করো। সাজা দাও। ইটির মুক্তি চাই।’

থানার সামনে লোক সমাবেশ হচ্ছে।

শাহবাগে একদল ছেলেমেয়ে মাইক লাগিয়ে গণসংগীত গাইতে শুরু করেছে—‘কারার ঐ লৌহকবাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট।’

থানার জেরাকারীরা ইটির সঙ্গে কথা বলছে, জেরা চলছে—

‘তুমি কি ঘুঘু দেখেছ?’

‘জি?’

‘তুমি কি ঘুঘু দেখেছ?’

‘জি না।’

‘এত বড় হইছ, ঘুঘু দেখো নাই?’

‘জি না।’

‘ফাঁদ দেখেছ?’

‘ফাঁদ? ইঁদুর মারা ফাঁদ ছোটবেলায় দেখেছিলাম।’

‘বড় হয়ে দেখো নাই?’

‘জি না।’

‘তোমাকে ঘুঘু আর ফাঁদ দুটোই দেখানোর ব্যবস্থা হবে। তোমাকে সিএমএম কোর্টে তোলা হবে। তারপর তোমাকে রিমান্ডে নেওয়া হবে। রিমান্ড বোঝো?’

‘জি না।’

‘এবার বুঝবে।’

‘কী বুঝব?’

‘হাউ মেনি প্যাডি হাউ মেনি রাইস। কত ধানে কত চাল।’

‘ভালো তো। কৃষিবিষয়ক জ্ঞান। মাটি ও মানুষ।’

‘নিজেকে চালাক ভাবছ। চালাকি বের কমর ‘নিজেকে চালাক ভাবছ। চালাকি বের করে দেওয়া হবে। তুমি যে একটা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্রের হোতা, এটা আমরা ধরে ফেলেছি। তোমার সমস্ত কানেকশন বিদেশে। তুমি আন্তর্জাতিক আইটি সন্ত্রাসী।’

‘ধরে ফেলেছেন?’

‘হুঁ।’

থানায় ফোন করেছেন আইজি। ‘এই তোমরা কী করেছ? কাকে আটকেছ। ছেড়ে দাও ওকে।’

‘স্যার। কাকে ছাড়ব স্যার?’

‘ওই যে ইটি না ফিটি, ওইটাকে।’

‘জি আচ্ছা স্যার। সালাম স্যার।’

‘আর ওই ছিনতাইকারীকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ধরে টাকা উদ্ধার করো। কোনো নড়চড় যেন না হয়।’

‘ইয়েস স্যার।’

পুলিশ ইটিকে বলল, ‘স্যার, আপনি সামনে আসুন। এই মেঝেতে আর আপনাকে বসে থাকতে হবে না। আসুন। চেয়ারে বসুন। স্যার বেশি করে গরুর দুধ দিয়ে এক কাপ চা দিই। ওপরে দুধের সর ভাসবে। দিই স্যার এক কাপ।’

ইটি চেয়ারে বসল।

‘স্যার, এখানে সাইন করেন স্যার। আপনি মুক্ত।’

ইটি বলল, ‘আমি তো যাব না। ওনার টাকা উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আমি যাব না।’

‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে টাকা উদ্ধার করার হুকুম হয়েছে। কোনো ক্লু তো পাই না।’

‘আমি দিচ্ছি। দাঁড়ান। আমার মোবাইল ফোনটা দিন।’

‘জি স্যার। এই যে আপনার মোবাইল স্যার।’

‘একদম চার্জ কম। আপনারা চার্জ দিয়ে রাখবেন না?’ মোবাইল অন করতে করতে ইটি বলল। সে ফেসবুক চেক করে বলল, ‘এই ছিনতাইকারীদের নাম পাওয়া যাচ্ছে কালা বাদল, মিচকা বাবু, ছাগল মিলন। এদের ঠিকানা হলো...’

থানাতেই অফিসার ইনচার্জের রুমের পেছনের একটা রুমে আরাম করে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে ইটি। মোবাইল ফোন চার্জে দেওয়া। সে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছে। তার চিলেকোঠার ঘরে প্রচণ্ড গরম। এই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে খানিকক্ষণ আরাম করবে সে। কিন্তু নিজের মনের গহিনে ডুবে থাকতে পারছে না সে। একটু পরপর পুলিশের লোক আসছে। এক ঝুড়ি আঙুর-কমলা এল। খানিক পরে এল ফিঙ্গার ফিশ। উফ। এরা কত খেতে পারে?

ঘণ্টা তিনেক পরে পুলিশ এল ইটির কাছে। বলল, ‘স্যার, আমরা ছিনতাইকারী সবাইকে ধরে ফেলেছি স্যার। টাকাটাও উদ্ধার করা হয়েছে। এখন মিজান সাহেবকে আনা হচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে টাকাটা তাঁর কাছে হস্তান্তর করা হবে স্যার।’

ইটি সেই কথাগুলো রেকর্ড করল তার মোবাইল ফোনে।

‘স্যার, আপনি কি এখন আপনার বাড়িতে ফিরে যাবেন স্যার?’

ইটি বলল, ‘আমার তো কোনো বাড়ি নেই ভাই। আমি চিলেকোঠার একটা ঘরে থাকি।’

‘সেখানেই কি আপনাকে আমরা এখন পৌঁছে দেব?’

‘না না। মিজান সাহেব আসুন। তাঁকে টাকাটা তুলে দিন। আমি দেখি।’

‘ওকে স্যার। যা বলবেন স্যার।’

মিজান সাহেব এসেছেন। তাঁর হাতে পুরো টাকা গুনে তুলে দেওয়া হলো। ইটি বলল, ‘মুরব্বি, ভালো করে গুনে নিন।’

তিনি আনন্দে কেঁদে ফেললেন।

স্বাতী আর শারাও এসেছে। তাদের হাতে সেই কলম অর্থাৎ হিডেন ক্যামেরাটাও আছে।

পুলিশ ইটিকে বলল, ‘আপনাকে এখন আমরা গাড়িতে করে পৌঁছে দেব। পাজেরো গাড়ি। কিন্তু স্যার আপনি বললে আমরা ছোট গাড়ি নেব। কারণ, আপনার গলিতে বড় গাড়ি ঢোকানো বড় যন্ত্রণা স্যার।’

‘আমাকে পৌঁছে দিতে হবে না। আপনারা মিজান সাহেবকে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দিন, অনুগ্রহ করে।’

এই দৃশ্যও রেকর্ড করা হলো।

ইটি ঘরে ফিরে মিজান সাহেবের টাকা ফিরে পাওয়ার ভিডিও ছবি প্রকাশ করল নাগরিকের চোখ ফেসবুক পেজে।

সবাই ফেসবুকে দেখছে সেই দৃশ্য। সবচেয়ে খুশি মিজান সাহেব। টাকাটা পেয়ে তিনি হাসছেন ফোকলা দাঁত বের করে, সেটা দেখে সবাই চোখ মুছতে লাগল।

বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। স্বাতী ঘরের জানালা খুলে দিয়েছে। নারকেলগাছগুলো মাথা দোলাচ্ছে। ঝাঁকড়া চুলের মতো নারকেলের পাতা আছাড় খাচ্ছে। আমের ডালে বৃষ্টি। স্বাতী জানালা দিয়ে হাত বাড়াল। বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ছে তার হাতে। সে বৃষ্টির পানি হাতে নিয়ে চোখ মুছছে। অকারণেই আজ তার চোখ বারবার ভিজে উঠছে। তার এখন বৃষ্টিতে ভেজা দরকার। সে ছাদে যাবে। শান্তা কি যাবে তার সঙ্গে? ‘শান্তা শান্তা। চল ছাদে যাই। বৃষ্টিতে ভিজি।’

শান্তা বলল, ‘চলো।’

মা বললেন, ‘কই যাচ্ছ?’

শান্তা বলল, ‘ছাদে যাই মা। বৃষ্টিতে ভিজব।’

মা বললেন, ‘না, যেয়ো না। বৃষ্টিতে ভিজলে সর্দি লাগবে।’

শান্তা বলল, ‘মা, আমি একটা ব্যাঙ। ব্যাঙের আবার সর্দি!’

স্বাতী বলল, ‘মা ঘামাচি হয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজলে সেরে যাবে মা।’

বৃষ্টির প্রচণ্ড ধারার নিচে শান্তা আর স্বাতী। স্বাতী কাঁদছে। বৃষ্টির জল তা ধুয়ে দিচ্ছে। স্বাতীর কান্না তাই ধরতে পারছে না শান্তা।

কাঁদতে কাঁদতে স্বাতী বলতে লাগল, ‘ইটি, তুমি কেমন আছো?’

হঠাৎ চালাকমামা ছাদের দরজার কাছে এসে বলললেন. ‘ওই! তোরা ছাদে কী করিস?’

শান্তা বলল, ‘বৃষ্টির জলে স্নান করছি মামা। কবি বলেছেন, এসো করো স্নান নবধারা জলে...।’

চালাকমামা অবাক হয়ে বললেন, ‘বৃষ্টিতে স্নান করার কী আছে? বাথরুমের শাওয়ার ছাড়লেই তো পানি পড়ে, স্নানও করা যায়।’

স্বাতী বলল, ‘উফ! আপনি এসে ভিজে দেখেন মজাটা কী।’

একটু পর চালাকমামাও ছাদে এলেন। যোগ দিলেন শান্তা আর স্বাতীর সঙ্গে। শান্তা-স্বাতী বিস্মিত হয়ে দেখল চালাকমামা রেইনকোট পরে এসেছেন। আর অবাক হয়ে বলছেন, ‘কই? মজা কই?’