ইতালি থেকে বাংলাদেশ

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

আমি ফেরারি। খুবই ভদ্র একটা চশমা। সুদূর ইতালির এক প্রত্যন্ত গ্রামের কারখানায় লাল প্লাস্টিক থেকে আমার জন্ম। জন্মের পর আমাকে পাঠানো হলো পৃথিবীর আরেক প্রান্তে; বাংলাদেশ নামক ছোট্ট একটি দেশে। শিপইয়ার্ড থেকে কিছু লোক আমার বন্ধুদের সঙ্গে একটি ট্রাকে তুলে দিল আমাকে। অনেক ঝাঁকি খাওয়ার পর যখন আমাকে বের করল, তখন দেখি আমার মতো অনেকেই একটি দোকানে কাচের জেলখানায় বন্দী। একটু পরে একই পরিণতি হলো আমারও। বন্দী হয়েই কেটে গেল একটি মাস।

হঠাৎ এক বৃষ্টিভেজা দিনে একটি ছেলে এল দোকানটায়। কী ভেবে যেন আমাকেই পছন্দ করে বসল সে। কী যে ভালো লাগছিল সেদিন! অবশেষে আমার বন্দী জীবনের সমাপ্তি ঘটল। ঘুম আর গোসলের সময়টুকু ছাড়া সব সময় আমাকে পরতে শুরু করল ছেলেটি। তখনো জানতাম না যে ছেলেটি ক্যাডেট কলেজে পড়ে। ছুটিতে বাড়িতে এসেছে সে। আমাকে চোখে রাখলেই ছেলেটির পৃথিবীটা পরিষ্কার হয়ে যেত। খুব গর্ব হতো আমার। মাঝেমধ্যে নরম তোয়ালে দিয়ে আমার গা মুছে দিত ছেলেটি। কখনো আবার আমাকে খুঁজে না পেয়ে অস্থির করে তুলত বাড়ির সবাইকে। কিন্তু ছেলেটি যখন তার চোখ ভালো হওয়ার জন্য প্রার্থনা করত, তখন ভয়ে ফ্রেম লুকানোর জায়গাটাও পেতাম না আমি। চোখ ভালো হয়ে গেলে আমি তো আর কারও কাজে আসব না!

কিন্তু সময় তো থেমে থাকে না। ছুটি শেষ হয়ে গেল ছেলেটির। যাওয়ার আগ মুহূর্তে চোখের লোনা পানিতে আমাকে ভাসিয়ে বাসে উঠল সে। শেষ পর্যন্ত আমাকে নিয়েই কলেজে পৌঁছাল ছেলেটি। শুরু হলো তার ব্যস্ত জীবন। পিটি, ড্রিল, প্যারেড, একাডেমি, গেমস এসব করে কাটতে লাগল দিন।

এক শুক্রবারের কথা। দুপুরের খাবারের পর কিছুক্ষণ গিটার বাজিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ছেলেটি। কিন্তু সে ঘুম থেকে উঠলেই যে আমার এত বড় বিপদ হবে তা কে জানত! সেদিন ছিল বাংলাদেশ-ইংল্যান্ডের খেলা। আমাকে হাতে নিয়েই খেলা দেখতে টিভি রুমে গিয়েছিল ছেলেটি। হঠাৎ ক্রিস ওকসের ক্যাচ মিস করল ইমরুল কায়েস। উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠল ছেলেটি। প্রচণ্ড রাগে মাটিতে ছুড়ে মারল আমাকে। কয়েক ফিট ওপর থেকে শক্ত মেঝেতে আছড়ে পড়লাম আমি। কী যে ব্যথা! হ্যান্ডেল আর কাচ আলাদা হয়ে গেল আমার। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে আবার একটি প্লাস্টিক হিসেবে আবিষ্কার করলাম আমি। এখন আর কেউ ফিরেও তাকায় না আমার দিকে। এমনকি সেই ছেলেটিও না। বসে বসে পুরোনো দিনের কথা মনে করা ছাড়া কী বা করার আছে আমার? তোমরা আমার জন্য একটু হলেও চোখের পানি ফেলো।