ঋভু

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

বাসা থেকে বেরোনোর দরজার কাছেই টিভিটা। টিভি থেকে ঠিক দশ কদম দূরে পদ্মাসনের মতো আসন পেতে মাটিতে বসে আছে ঋভু। মূর্তির মতো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে। ঘুমাতে যাওয়া আর টয়লেটে যাওয়া ছাড়া খুব কম কারণেই টিভির সামনে থেকে ওঠে সে।

ঋভুর বোন ঋতি নবম শ্রেণিতে পড়ে। সারা দিন ঘর বন্ধ করে লেখাপড়া করে ঋতি। ভাইয়ের সঙ্গে তার কথা হয় খুব কম। সাত বছর বয়সী ঋভুর সঙ্গে কী নিয়ে কথা বলবে, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না ঋতি। টিভি দেখার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই তার। তাই অন্যান্য বাড়ির মতো টিভির চ্যানেল বদলানো নিয়ে ভাইবোনের লড়াইয়ের আওয়াজ পাওয়া যায় না তাদের বাসায়।

সারা দিন দরজার কাছে টিভির সামনে বসে থাকে ঋভু। ফলে দরজা খোলার দায়িত্বটাও তার। অফিসে সারা দিন পরিশ্রম করেন ঋভুর আম্মু মিসেস নাহার। ছয়তলা সিঁড়ি বেয়ে দরজায় বেল বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই দরজাটা খোলা পান তিনি। দ্রুত দরজাটা খুলে দিয়েই আবার টিভির সামনে বসে পড়ে ঋভু।

কিন্তু আজ দুপুরবেলায় দরজা খুলল না ঋভু। আজও টিভি থেকে দশ কদম দূরে সে। মাটিতে না বসে আসন পেতেছে সোফায়। বেল বাজছে তো বাজছেই। দরজা খুলছে না কেউ। দরজা বন্ধ করে পড়ছে ঋতি। কলবেলের শব্দ সে শুনছে ঠিকই। কিন্তু ঋভু দরজা খুলবে ভেবে সে আর উঠছে না পড়া ছেড়ে। মিসেস নাহার ঋতিকে ল্যান্ডফোনে ফোন দিয়ে হালকা বকে দরজা খোলালেন। পড়ার সময় নষ্ট হবে ভেবে ঋভুকে বকা দিয়ে সময় নষ্ট করল না ঋতি। ঋতিকে বকে মিসেস নাহারও তাঁর বকার কোটা পূর্ণ করে ফেলেছেন। ফলে এই দফা কোনোরকম ঝামেলায় পড়ল না ঋভু। কিন্তু ঋভুকে সোফায় দেখে বেশ অবাক হলেন মা-মেয়ে দুজনই।

ঋভু, গোসল করেছিলে তুমি?

জি আম্মু।

যে জামা বের করে রেখে গিয়েছিলাম, সেটা তো তুমি পরোনি।

অনেকক্ষণ কোনো উত্তর না পেয়ে ঋভুর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন আবার।

ভুল করেছি। সরি, আম্মু!

আর যেন এমনটা না হয়!

ঘড়িতে এখন ছয়টা বাজে। ঋভুর প্রিয় কার্টুন ‘উই বেয়ার বিয়ার্স’ দেখাচ্ছে টিভিতে। আম্মু এসে চ্যানেল বদলে খবর দেখলেন। সাধারণত এই সময় কাউকে টিভির রিমোট ধরতে দেয় না ঋভু। কিন্তু আজ কিছুই বলল না। সেই কখন থেকে সোফা দখল করে বসে আছে সে! খবর দেখা সেরে সন্ধ্যার নাশতা বানাতে উঠলেন মিসেস নাহার। এরই মধ্যে এলেন ঋতির হোম টিউটর। দরজায় বেল বাজল। ঋভুর ওপর নির্ভরশীল বাড়ির বাকি দুই সদস্য সেদিকে কান দিলেন না। হোম টিউটর নিতান্তই ভদ্র বলে দ্বিতীয় বেলটা বাজালেন এক মিনিট পর। এবারও সবাই ভাবল ঋভু দরজা খুলবে। আরও তিন মিনিট পর বেলের আওয়াজ পেয়ে অবাক হলেন মিসেস নাহার। নিজেই গিয়ে দরজা খুললেন। দরজায় ঋভুর জায়গায় মিস নাহারকে পেয়ে অবাক হয়ে ঘরে ঢুকলেন টিউটর।

কী ঋভু? আজ দরজায় তুমি ছিলে না যে!

ঋভু অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘আমি একটু টায়ার্ড তো, তাই!’

এই দফা মিসেস নাহার একটু খেপে গেলেন। তবে কিছু বললেন না। শিক্ষকতা করতে গিয়ে ধৈর্য ধরে রাখতে শিখেছেন তিনি। রাগ হয়ে শুধু তাকালেন ঋভুর দিকে।

ঋভুর এমন একগুঁয়ে হয়ে বসে থাকা নতুন কিছু নয়। কিন্তু একেবারেই সোফা ছেড়ে না ওঠার ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন মিসেস নাহার। সকালবেলায় ঋভুকে যে অবস্থায় দেখে গিয়েছিলেন তিনি, এখনো ঠিক সেই অবস্থাতেই আছে সে। ওঠেনি। ঋতি বলল, সোফা থেকে উঠতে হবে বলে ঋভু নাকি দুপুরেও খায়নি।

রাতের খাবার বাড়া হলো। ঘড়িতে রাত বাজে দশটা। ঋভুকে সবাই টেবিলে ডাকল। কিন্তু কিছুতেই জায়গা ছেড়ে নড়ল না সে। মিসেস নাহার ঋভুর সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালেন এবার।

ঘড়িতে এখন ছয়টা বাজে। ঋভুর প্রিয় কার্টুন ‘উই বেয়ার বিয়ার্স’ দেখাচ্ছে টিভিতে। আম্মু এসে চ্যানেল বদলে খবর দেখলেন। সাধারণত এই সময় কাউকে টিভির রিমোট ধরতে দেয় না ঋভু।

তুমি কি উঠবে, নাকি উঠবে না?

একটু পরে উঠব।

তুমি কি টয়েলেট করে দিয়েছ প্যান্টে?

কোথায়? মা, এসব কী বলছ!

তাহলে উঠছ না কেন?

আম্মু, তুমি টেনশন কোরো না। আমি একটু পরেই উঠব।

আর কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে ঋভুকে হাত ধরে টেনে তুললেন মিসেস নাহার। সোফা ভেজা পেয়ে ছাদে সোফার ফোম শুকাতে দিয়ে আসার মানসিক প্রস্তুতি নিলেন তিনি। কিন্তু সোফার ফোম ভেজা ছিল না। শুকনা তকতকে সেই সোফার ফোমে বেশ বিশাল একটা গর্ত। অনেকক্ষণ বসে থাকলে যা হয় আরকি। অবাক করার বিষয়, গর্তের ভেতর একটা আস্ত মুরগির ডিম।

মিসেস নাহার কিছুক্ষণ শুধু তাকিয়ে রইলেন ডিমটার দিকে। ঋভু ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না শুরু করল। দুম করে ঘরে গিয়ে বিকট স্বরে কাঁদতে লাগল সে। মিসেস নাহার ভেবেছিলেন খুব করে বকে দেবে ঋভুকে। তা আর হলো কই! উল্টো ঋভুর কান্না থামাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। শেষমেশ কান্নার কাছে আত্মসমর্পণ করলেন মিসেস নাহার।

কী হয়েছে বাবা, বলবে তো!

ঋভুকে কোলে নিয়ে আদর করে কান্না থামানোর চেষ্টা করলেন তিনি। ঋতি ঘটনাটা একটু হালকা করতে আরেকটা ডিম নিয়ে এল ঋভুর কাছে। ঋভু কিছুতেই নেবে না সেই ডিম। অনেকক্ষণ পর ঋভু কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, ‘তুমি আমাকে এভাবে জোর করে ওঠালে কেন?’

কারণ তুমি খেতে আসছিলে না, তাই।

এখন আমার ডিমটার কী হবে?

কী হবে?

আমি সারা দিন এই ডিমের ওপর বসে ছিলাম। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতো। তোমার জন্য হলো না।

ঋভুর এই কথা শুনে কয়েক সেকেন্ড কেউ কোনো কথা বলল না। তার কথা সবাই প্রসেস করে ওঠার পর কেউ হাসি থামাতে পারল না। ঋভু ক্ষোভ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার কান্না শুরু করবে বুঝতে পেরে ঋভুকে কথা দিলেন আম্মু। কালই তার জন্য একটা মুরগির বাচ্চা কিনে আনা হবে। সেটার সঙ্গে খেলবে সে। ঋভু তো কিছুতেই মানবে না। তার নিজের তা দিয়ে ফোটানো মুরগির বাচ্চা চাই। কী মুসিবত!