নির্জন রাস্তায় প্রায় মাঝরাতে বাস থেমেছিল আধা ঘণ্টার জন্য। কারণ, বাসের এক যাত্রীর কবুতর জানালা দিয়ে উড়ে গেছে। ওই যাত্রী রাশেদের পাশেই বসা। লোকটার কবুতর নাকি কথা বলা কবুতর। ময়না পাখির চেয়েও স্পষ্ট কথা বলে। সেই কবুতর ফেরত আসবে বলে অপেক্ষা করছে বাস। এই সুযোগে বাস থেকে নেমে খানিকক্ষণ হাওয়া–বাতাস খেলো রাশেদ, সঙ্গে নামল অনেকেই। কিন্তু কবুতর আর ফিরে এল না। শেষমেশ তার ফেরার আশা বাদ দিয়ে বাস রওনা দিল। গন্তব্য সিলেট। তুমুল বেগে নাইট কোচ এগিয়ে যাচ্ছে গাছগাছালিতে ঘেরা পথে। কবুতর হারিয়ে বিমর্ষ ভদ্রলোক বলে উঠল,
‘না বইলা চইলা গেল?’
লোকটাকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করল রাশেদ, ‘চিন্তা করবেন না। আপনার কবুতর তো কথা বলে। জিজ্ঞেস করে করে ঠিক চলে আসবে।’ একবার চোখ রাঙিয়ে আবার বিমর্ষ অবস্থায় ফেরত গেল ভদ্রলোক। রাশেদও ঘুমানোর চেষ্টা করল। ঠিকঠাক না ঘুমালে কালকের দিনটা মাটি হবে। অফিসের ছুটির সদ্ব্যবহার করতে সিলেট ঘুরতে আসা। সময় মোটে দুই দিন। তাই ঘুরে বেড়ানোর তাড়াটা সকালে অফিসে যাওয়ার মতোই।
চোখটা একটু লেগে আসতেই বাসে শুরু হলো চেঁচামেচি। কে যেন কাঁদছে। ধড়মড় করে উঠে বসল রাশেদ। ব্যাপারটা কী? কবুতর ভদ্রলোকও উৎসুক চোখে তাকালেন। ওনার নাম ফরিদ, কথা বলা কবুতরকে সিলেট ঘোরাতে নিয়ে যাচ্ছেন। ভ্রমণসঙ্গী উড়ে যাওয়ায় বিমর্ষ হলেও উনি চিন্তিত নন। বোঝা যাচ্ছে, এ ঘটনা অতীতেও ঘটেছে।
‘কী হইসে? বিষয়টা কী?’ ফরিদ সাহেবের কথার উত্তর না দিয়ে সিট ছেড়ে উঠল রাশেদ। আবার কী ঝামেলা হলো কে জানে। সামনে এগিয়ে দেখা গেল, কাঁদছেন বেশ বয়স্ক একজন মহিলা। তাঁর আশপাশে কয়েক সিটজুড়ে জটলা। মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে হাত–পা নেড়ে কথা বলছেন বাসের সুপারভাইজার, ‘এমন হয় ভাই, বিশ্বাস করেন। বাসের জানালা খোলা পাইলেই পরিরা টাইনা নিয়া যায়। আমার নিজ চোখে দেখা। সেইবার গুলিস্তান যাইতাসি…ফার্মগেটের সামনে ঘটনা ঘটল। পরি আমারে দিল টান…’
রাশেদ নিচু গলায় সুপারভাইজারের কথায় মগ্ন একজনকে জিজ্ঞেস করল, ‘দাদির কী হয়েছে? কাঁদছেন কেন?’
লোকটা কিছু বলার আগেই চেঁচিয়ে বলে উঠলেন দাদি, ‘আমার নাতি হাওয়া হইয়া গেসে গো।’
২
ছেলেটা ভার্সিটিতে পড়ে। নাম সোহেল। মাজার দেখাতে দাদিকে নিয়ে যাচ্ছে সিলেটে। দাদির পাশের সিটেই বসে ছিল। ঘুমিয়ে পড়া দাদি ঘুম ভাঙতেই দেখেন পাশে নাতি নেই। ফলে বলতেও পারছেন না কখন থেকে সোহেল হাওয়া হলো।
রাশেদ অবশ্য হাওয়া হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ধরতে পারছে না। জলজ্যান্ত মানুষ হাওয়া হয়ে যায় কীভাবে? নিশ্চয়ই কোনো বিষয় আছে। কিন্তু বাসের অর্ধেক লোক সুপারভাইজারের গল্প বিশ্বাস করে ফেলেছে। শত কিচিরমিচিরের মাঝে গলাখাঁকারি দিয়ে বলে উঠল রাশেদ, ‘সুপারভাইজার সাহেব, কবুতরের জন্য নামার সময় সবাই উঠেছে কি না, দেখেছিলেন?’
সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল সব গুঞ্জন। দাদি ফুঁপিয়ে উঠলেন আরও একবার। কয়েকজন মিলে তাঁকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছেন। বেচারি জানেনও না কোথায় নামবেন। না জানেন কোনো ফোন নম্বর। সীমাহীন বিপদ!
রাশেদের কথার জবাব এল, ‘রাইতের বেলা আমি দিশা পাই না বুঝলেন। রাতকানা আছে, আমি গুনলেও ফয়দা নাই জনাব। একজনরে দু–তিনবারও গুনতে পারি।’
দম বন্ধ হয়ে এল রাশেদের। এত রাতে নির্জন রাস্তায় একটা ছেলেকে একলা ফেলে এসেছে সবাই? কী ভয়ানক ব্যাপার।
এতক্ষণে ঘটনার গুরুত্ব ধরতে পেরেছে বাসের যাত্রীরা। বলতে গেলে বাসের কেউই আর নিজের সিটে নেই। জড়ো হয়েছে এক জায়গায়। শক্ত–সমর্থ একজন বলে উঠল, ‘ড্রাইভার, গাড়ি ঘোরাও। ফালতু কবুতরের জন্য থাইমা উল্টা একজন মানুষ রেখে আসছি আমরা।’
‘পরিচয় দিলে সময় নষ্ট, তা–ও নামখানা বলি। আমি মঞ্জু ডাকাত আর এরা আমার শাগরেদ। আমি মানবিক লোক, আপনারা যা দেবেন, তা–ই নেব। যারা ঘুরতে যাইতেসেন, হোটেলভাড়া মাফ পাবেন। শুক্রবারের অফার।
কবুতর ভদ্রলোক ফরিদ চুপ থাকলেন না।
‘আমার কবুতর কথা বলা কবুতর। বিবেচনা করে কথা বলেন।’
খেঁকিয়ে উঠলেন দাদি, ‘এই পোলা, আমার নাতির কি জবান নাই? আমার নাতি কথা বলতে পারে না?’
রাশেদ জটলা পেরিয়ে চলে গেল ড্রাইভারের কাছে। গাড়ি ঘোরাতে হবে বলতেই মুখ অন্ধকার হয়ে গেল ড্রাইভারের। মিনমিন করে বললেন, ‘কিন্তু…কিন্তু…এই রাস্তায় তো…’
‘কোনো কথা না, ছেলেটা একা। দ্রুত চলো।’
ফলে খানিক পরেই বাস চলে এল সেই জায়গায়, যেখানে কবুতর হারিয়ে গিয়েছিল। ফরিদ সাহেব বিমর্ষ ভাব ছেড়ে বাস থেকে নামলেন, আরেকবার আশার আলো দেখতে পেয়েছেন তিনি।
৩
দাদিসহ প্রায় পুরো বাসের মানুষ নিয়ে আধা ঘণ্টা ডাকাডাকির পরও যখন সোহেলকে পাওয়া গেল না, তখন রাশেদও প্রায় ভেঙে পড়েছে হতাশায়। বয়স্ক মানুষ, জানা নেই, শোনা নেই, বিপদে পড়েছেন। তার ওপর ছেলেটা এই রাতে গেলই–বা কোথায়। কোনো উপায় না পাওয়া বাসের মানুষদের তখন দাদির কান্না শোনা ছাড়া কিছু করার নেই। ড্রাইভারও বসে আছে হতাশ হয়ে। এমন সময় শব্দটা এল। তিন–চারজনের দুদ্দাড় দৌড়। বাসের গায়ে প্রচণ্ড জোরে হাত দিয়ে চাপড়। হঠাৎ এসব দেখে চিৎকার করে উঠল সবাই। সেই চিৎকার ছাপিয়েও শোনা গেল ড্রাইভারের গলা, ‘ইয়া মাবুদ, ডাকাইত, ডাকাইত।’
৪
সিলেটের শেষ বাসকেও যখন আটকানো গেল না, তখন মঞ্জু ডাকাত রাগে ফুঁসছে।
‘তিন–তিনটা দামড়া মিলাও একটা গাছ ফালাইয়া রাস্তা আটকাইতে পারোস না? এই সব লইয়া ডাকাতি করবি? এদ্দুর নলেজ দিয়া মার্কেটে কেমনে টিকবি?’
মাথা নিচু করে ওস্তাদের কথা শুনছিল পাঁচজন। ঠিক তখনই দেখা গেল সিলেটের একটা বাস উল্টো দিকে ফেরত আসছে। ওরা ভাবল, আগেরবার মিস হয়ে যাওয়ায় বাসটা নিজেই আবার ওদের কাছে ফিরে এসেছে। ডাকাতদের আড়ালের সামনে গিয়েই থামল বাসটা।
‘যদি থাকে নসিবে, আপনি আপনি আসিবে…আজকে নসিব খুলসে ওস্তাদ।’ বলল কেউ একজন।
মঞ্জু ডাকাত গতিবিধি বুঝতে অপেক্ষা করল কিছু সময়। তারপরই রওনা দিল দলবলসহ। ‘গাধাগুলা উল্টা দিকে কেন চলে এল?’ ব্যাপারটা এখনো বুঝে উঠতে পারছে না সে।
৫
‘পরিচয় দিলে সময় নষ্ট, তা–ও নামখানা বলি। আমি মঞ্জু ডাকাত আর এরা আমার শাগরেদ। আমি মানবিক লোক, আপনারা যা দেবেন, তা–ই নেব। যারা ঘুরতে যাইতেসেন, হোটেলভাড়া মাফ পাবেন। শুক্রবারের অফার। আপনাদের নাখোশ করে বিদায় দিতে চাই না। বুঝতে পারসেন?’
বাসের কেউই তখন বোঝার মতো অবস্থায় নেই।
মঞ্জু ডাকাত আবার মুখ খোলার আগে ফুঁপিয়ে বলে উঠলেন দাদি, ‘আমার নাতি হাওয়া হইয়া গেসে গো।’
কিছুক্ষণের জন্য বিভ্রান্ত মনে হলো ডাকাতদের। কিন্তু সাহায্য করতে এগোল রাশেদ, ‘ব্যাপারটা হচ্ছে মঞ্জু ভাই…’
বিড়বিড় করে উঠল সুপারভাইজার, ‘জনাব, বুঝলাম না, ডাকাইতের লগে ভাই–ব্রাদার পাতাইতাসেন…’
৬
ছোটবেলা থেকেই মনটা খুব নরম মঞ্জু ডাকাতের। শাগরেদরাও এই তথ্য জানে, কিন্তু প্রকাশ করে না। ডাকাতিতে নরম মনের লোকের ভাত নেই। তবে নরম মন নিয়েও ডাকাতি করে মঞ্জু ডাকাত পোলাও–কোরমা খায়। দুই ফোঁটা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মঞ্জু বলল, ‘দাদি, আমি আপনার পোলা। আপনে আমার বাড়িতে থাকবেন দরকার হইলে। ভাইস্তারে খুঁইজা বাইর করবই আমি।’
মঞ্জু ডাকাতের আচরণ কারও মাথায় ঢুকছে না। সবাই ভয়ে তটস্থ। অনেকেই ভাবছে পুলিশকে ফোন দেওয়া উচিত। আবার সাহসও পাচ্ছে না। সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া ছেলেটা। কবুতর ফরিদ বাদে সবারই বিধ্বস্ত অবস্থা। তার কবুতর ফেরত এসেছে। বিরক্ত কণ্ঠে বলছে, ‘এত লোক ক্যান?’ দুজন শাগরেদ অবাক হয়ে দেখছে কথা বলা কবুতর। একটু পরপর বলে উঠছে, ‘আচ্ছা ময়না, বলো দেখি…ডাকাইত, ডাআকাআইত…’
বিরক্ত হচ্ছেন ফরিদ। কবুতরকে ময়না ডাকলে আত্মসম্মানের জায়গাটা ডাকাতদের বোঝাতে পারছেন না।
৭
‘আনোয়ার, মিথ্যা বলিস না। তুই আমি দীর্ঘদিনের বন্ধু। গত মাসেও তোরে দুইটা লুটের আইফোন দিসি। আমার ভাইস্তারে তোর মলম পার্টি ধরসে না?’
মঞ্জু ডাকাত নিজের এলাকার সবাইকে একে একে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। উৎসুক জনতা আগ্রহ নিয়ে শুনছে সেই কথোপকথন। মঞ্জু ডাকাতের নরম মনের খবর এখন সবারই জানা, তাই ভয়ডর বাসের নিচে চাপা পড়েছে। এই অবস্থাতেও দুবার হাই তুলল রাশেদ। আজকের ঘুমটা পুরো মাটি। আসল সমস্যা হলো, ঘটনা কোথায় যাবে, তা বোঝা যাচ্ছে না।
শক্ত–সমর্থ লোকটা বলে উঠল, ‘আমাদের উচিত পুলিশে খবর দেওয়া।’
কান থেকে ফোন সরিয়ে গর্জে উঠল মঞ্জু ডাকাত, ‘আমার লাইনে একটু ট্রাই মারতে দেন, আমি গেলে পুলিশ সাংবাদিক সব ডাকবেন।’
দাদি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন মঞ্জু ডাকাতের পাশে। কবুতর ছেড়ে দুই শাগরেদ এখন দাদিকে বাতাস করছে।
৮
বাসে উৎকণ্ঠা তখন চরমে। ফরিদ সাহেবও কবুতরসহ ঘটনায় যোগ দিয়েছেন। শত শত মতামত আসা শুরু হয়েছে।
‘পোলাটা হাওয়া হইয়া গেসে। এই এলাকায় ও নাই।’ মিনিট দশেক পর ঘোষণা দিল মঞ্জু ডাকাত।
কথা শুনে থেমে গেল সবাই। শুধু সুপারভাইজার বলল, ‘কইসিলাম না পরি নিসে?’
একই সময়ে বলে উঠল এক শাগরেদ, ‘ওস্তাদ, আজকে ডাকাতি হইব না?’
মঞ্জু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, ‘তোগো কোনে সেন্সটেন্স নাই।’
রাশেদ ততক্ষণে আরও কয়েকটা জিনিস ভেবে ফেলেছে। মনে হচ্ছে এতে কাজ হবে।
গলাখাঁকারি দিয়ে শুরু করল সে, ‘আমরা একটা কাজ করতে পারি, মনে হচ্ছে সোহেলকে পেয়ে যাব…’
এমন সময় জটলা ঠেলে রাশেদের সামনে এল অল্প বয়সী একটা ছেলে। চোখে কাঁচা ঘুম, ‘কী চেঁচামেচি করতেসেন আপনারা, দেখতেসেন না আমার দাদি ঘুমাইতেসে? আর বাস চলতেসে না কেন? তেল নাই?’
মঞ্জু ডাকাত তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘তুমি সোহেল?’
মাথা নাড়ল ছেলেটা।
‘এতক্ষণ কই ছিলা?’
‘পেছনের সিটে ঘুমাচ্ছিলাম।’
পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কে ফোন করেছে কে জানে। সঙ্গে কানে আসছে দাদির নাক ডাকার আওয়াজ। বাসের হতভম্ব যাত্রীরা কোনো কথা বলতে পারছে না। ডাকাতরা ভুলে গেছে পালানোর কথা।
রাশেদ স্পষ্ট শুনতে পেল, ফরিদ সাহেবের কবুতর বলে উঠল, ‘এইটা কোনো কথা?’