এক ভুতুড়ে কান্ড

অলংকরণ: আসিফুর রহমান

ভূত বলে কিছু আছে? যদি থাকে তো তিনি আমাকে কখনো দেখা দেননি। তাঁর দয়া এবং আমার ধন্যবাদ। কৃপা করে দর্শন দিলে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁকে দেখতে পারতাম কি না সন্দেহ। ভূতদের রূপ-গুণে আমার কোনো মোহ নেই। তা ছাড়া আমার হার্ট খুব উইক। আর শুনেছি যে ওরা ভারি উইকেড—

তবে ভূত কি না ঠিক জানি না, কিন্তু অদ্ভুত একটা কিছু, একবার আমি দেখেছিলাম। দেখেছিলাম রাঁচিতে। না, পাগলা গারদে নয়, তার বাইরে—সরকারি রাস্তায়। রাঁচিতে রাজপথ না হলেও সেটা বেশ দরাজ পথ।

কী করে দেখলাম বলি।

একটা পরস্মৈপদী সাইকেল হাতে পেয়ে হনড্রুর দিকে পাড়ি জমিয়েছিলাম, কিন্তু মাইল সাতেক না যেতেই তার একটা টায়ার ফেঁসে গেল।

যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়—একটা কথা আছে না? আর যেখানে সন্ধে হয়, সেখানেই সাইকেলের টায়ার ফাঁসে।

জনমানবহীন পথ। জায়গাটাও জংলি। আরও মাইল পাঁচেক যেতে পারলে গাঁয়ের মতো একটা পাওয়া যেত—কিন্তু সাইকেল ঘাড়ে করে যেতে হলেই হয়েছে! এমনকি সাইকেল ফেলে, শুধু পায়ে হেঁটে যেতেও পারব কি না আমার সন্দেহ ছিল। হাঁটতে হবে আগে জানলে হাতে পেয়েও সাইকেলে আমি পা দিতাম না নিশ্চয়।

তখনো সন্ধে হয়নি। এই হব-হব। সামনে গেলে পাঁচ মাইল, ফিরতে হলে সাত—দুই দিকেই সমান পাল্লা। কোন দিকে হাঁটন দেব হাঁ করে ভাবছি।

শেষ পর্যন্ত কি হাঁটতেই হবে? এই একই প্রশ্ন প্রায় আধঘণ্টা ধরে পুনঃ পুনঃ আমার মানসপটে উদিত হয়েছে। আর এর একমাত্র উত্তর আমি দিয়েছি—না বাবা, প্রাণ থাকতে নয়!

অবশ্য এ রকম স্থানে আর এহেন অবস্থায় প্রাণ বেশিক্ষণ থাকবে কি না, সেটাও প্রশ্নের বিষয় ছিল। সন্ধে উতরে গিয়ে বাঁকা চাঁদের দিকে আলো দেখা দিয়েছে। সেদিন পর্যন্ত এ ধারে বাঘের উপদ্রব শোনা গিয়েছিল। কখন হালুম শুনব কে জানে!

তবু, চিরদিনই আমি আশাবাদী। সমস্যার সমাধান কিছু না কিছু একটা ঘটবেই। অচিরেই ঘটল বলে। দু-এক মিনিটের অপেক্ষা কেবল এবং সেই অভাবনীয়ের সুযোগ নিয়ে সহজেই আমি উদ্ধার লাভ করব।

এ রকমটা ঘটেই থাকে, এতে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। কত গল্পের বইয়েই এ রকম ঘটতে দেখা গেছে, আমার নিজেরই কত গল্পে এ রকম দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই। আর স্বয়ং লেখক হয়ে আমি নিজে আজ বিপদের মুখে পড়েছি বলে সেই অঘটনগুলো ঘটবে না? কোনো গল্পের নায়ক কি কখনো বাঘের পেটে গেছে? তবে একজন গল্প লেখকই বা কোন দুঃখে যাবে শুনি?

সেই অবশ্যম্ভাবী মুহূর্তের অপেক্ষায় আরও আধঘণ্টা কাটালাম। অবশেষে একটা ঘটনার মতো দেখা দিল বটে। একখানা লরি। খুব জোরেও নয়, আস্তেও নয়, আসতে দেখা গেল সেই পথে। রাঁচির দিকে যাচ্ছিল লরিটা।

আমার টর্চ বাতিটা জ্বালিয়ে নিয়ে প্রাণপণে ঘোরাতে লাগলাম। শীতের রাত, ফিকে চাঁদের আলো, তার ওপর কুয়াশার পর্দা পড়েছে—এই ঘোরালো আবহাওয়ার মধ্যে আমার আলোর ঘূর্ণিপাক লরির ড্রাইভার দেখতে পেলে হয়।

লরিটা এসে পৌঁছাল—এল একেবারে সামনাসামনি, মুহূর্তের জন্যই এল, কিন্তু মুহূর্তের জন্যও থামল না। যেমন এল, তেমনি চলে গেল নিজের আবেগে। রাস্তার বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। অনর্থক কেবল টর্চটাকে আর নিজেকে টর্চার করা। আলোর আন্দোলন করতে গিয়ে হাত ব্যথা হয়ে গিয়েছিল।

ছ্যা ছ্যা! লরিওয়ালারা কি কানা হয়ে লরি চালায় নাকি? (যে রকম তারা মানুষ চাপা দেয়, তাতে বিচিত্র নয়!)

শেষটা কি হাঁটাই আছে কপালে? এই ঝাপসা আলো আর কুয়াশার মধ্যে সাইকেল টেনে পাক্কা সাত মাইলের ধাক্কা। ভাবতেই আমার বুক দুরদুর এক ভুতুড়ে কাণ্ড করতে থাকে। তার চেয়ে বাঘের পেটের মধ্য দিয়ে স্বর্গে যাওয়া ঢের শর্টকাট।

না, না! কোথাও যেতে হবে না—বাঘের পেটেও নয়। কিছু না কিছু একটা হতে বাধ্য—অনতিবিলম্বেই হচ্ছে। আর এক মিনিটের অপেক্ষা কেবল।

এর মধ্যে কুয়াশা আরও জমেছে, চাঁদের আলো ফিকে হয়ে এসেছে আরও! আমি নিজেকে প্রাণপণে প্রবোধ দিচ্ছি, এমন সময়ে দুটো হলদে রঙের চোখ কুয়াশা ভেদ করে আসতে দেখা গেল।

বাঘ নাকি?...না, বাঘ নয়—দুই চোখের অতখানি ফারাক থেকেই বোঝা যায়। বাঘের দৃষ্টিভঙ্গি ওই রকম উদার হতে পারে না।

আবার আমি বাহুবলে টর্চ ঘোরাতে লাগলাম।

ছোট্ট একটা বেবি অস্টিন—তারই কটাক্ষ! আস্তে আস্তে আসছিল গাড়িটা—এত আস্তে যে মানুষ পা চালালে বোধ হয় ওর চেয়ে জোরে চলতে পারে।

আসতে আসতে গাড়িটা আমার সামনে এসে পড়ল।

আমি হাঁকলাম—এই।

কিন্তু গাড়িটার থামার কোনো লক্ষণ নেই! তেমনি মন্থরগতিতে গড়িয়ে চলতে লাগল গাড়িটা।

আমার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার দুর্লক্ষণ দেখে আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম।

না, আর দেরি করা চলে না, এক্ষুনি একটা কিছু করে ফেলা চাই। এসপার-ওসপার যা হোক! গাড়িমালিকের না হয় ভদ্রতা রক্ষা করার প্রয়োজন নেই, কিন্তু আমাকে তো আত্মরক্ষা করতে হবে।

অগত্যা আগুয়ান গাড়ির গায়ে পড়লাম। দরজার হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ঢুকে পড়লাম। ভেতরে। চলন্ত গাড়িতে ওঠা সহজ নয়, নিরাপদও না, কিন্তু কী করব, এক মিনিটও সময় নষ্ট করার ছিল না। কায়দা করে উঠতে হলো কোনো গতিকে। কে জানে, এ-ই হয়তো সশরীরে রাঁচি ফেরার শেষ সুযোগ!

সাইকেলটা রাস্তার ধারে ধরাশায়ী হয়ে থাকল। থাকগে, কী করা যাবে? নিতান্তই যদি রাতে বাঘের পেটে না যায়—(বাঘেরা কি সাইকেল খেতে ভালোবাসে?) কাল সকালে উদ্ধার করা যাবে। সাইকেলের মালিককে আগামীকাল একসময়ে জানালেই হবে—বেশি বলতে হবে না—খবর দেওয়ামাত্র আমার চৌদ্দপুরুষের শ্রাদ্ধ করে তিনি নিজেই এসে নিয়ে যাবেন।

ছোট্ট গাড়ির মধ্যে যতটা আরাম করে বসা যায়, বসেছি। বসে ড্রাইভারকে লক্ষ করে বলতে গেছি—

‘আমায় লালপুরার মোড়টায় নামিয়ে দেবেন, তাহলেই হবে। ডা. যদুগোপালের বাড়ির—’

বলতে বলতে আমার গলার স্বর উবে গেল, বক্তব্যের বাকিটা উচ্চারিত হলো না। আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম—আমার দুই চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইল।

আমার শার্টের কলারটা মনে হলো যেন আমার গলার চারধারে চেপে বসেছে। হাত তুলে যে গলার কাছটা আলগা করব, সে ক্ষমতাও নেই। আঙুলগুলো অবধি অবশ। সেই শীতের রাতেও সারা গায়ে আমার ঘাম দিয়েছে।

যেখানটায় ড্রাইভার থাকার কথা, সেখানে কেউ নেই।...একদম ফাঁকা, আমি তাকিয়ে দেখলাম।

জিভ আমার টাকরায় আটকে ছিল। কয়েক মিনিট বাদে সেখান থেকে নামলে বাক্শক্তি ফিরে পেলাম। ‘ভূত! ভূত ছাড়া কিছু না!’ আপনা থেকেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমার কথায় ভূত যে কর্ণপাত করল তা মনে হলো না। বে-ড্রাইভার গাড়ি যেমন চলছিল, তেমনি চলতে লাগল।

প্রথমে আমার মনে হলো, নেমে পড়ি গাড়ির থেকে। কিন্তু তারপর সমস্ত পথটা হেঁটে মরতে হবে এই কথা ভাবতেই, ভূতের মার-গুঁতার চেয়ে ঢের শ্রেয় বলে আমার জ্ঞান হলো। আমার নামের প্রথমার্ধ ভূতভাবন আর বাকি অর্ধেক ভূতধাবন; কাজেই ভূতের ভয় আমার থাকলেও, ভাবনা তেমন ছিল না। ভূতের হাতে মরলেও শিবলোক কিংবা রামরাজ্য একটা কিছু আমি পাবই। সেটা একেবারে নিশ্চিত।

কিন্তু তাহলেও এমন অভূতপূর্ব অবস্থায় আমায় পড়তে হবে কখনো ভাবিনি।

ড্রাইভার নেই এবং গাড়ির ইঞ্জিনও চলছিল না। তবু গাড়ি চলছিল এবং ঠিক পথ ধরেই চলছিল। এই কথা ভেবে এবং হেঁটে যাওয়ার চেয়ে বসে যাওয়ার আরাম বেশি বিবেচনা করে প্রাণের মায়া ছেড়ে দিয়ে সেই ভুতুড়ে গাড়িকেই আশ্রয় করে রইলাম। আলস্যের সঙ্গে আমি কোনো দিনই পারি না; চেষ্টা করলে হয়তো-বা কায়ক্লেশে পারা যায়; কিন্তু পেরে লাভ? লাভ তো ডিমের! চিরকালের মতো এবারও আমার আলস্যই জয়ী হলো শেষটায়।

ঘণ্টা দুয়েক পরে গাড়িটা একটা লেভেল ক্রসিংয়ের মুখে এসে পৌঁছেছে। ক্রসিংয়ের গেট পেরিয়ে যখন প্রায় লাইনের সম্মুখে এসে পড়েছি, তখন হুঁশ হলো আমার। হুস হুস করে তেড়ে আসছিল একটা আওয়াজ! রেলগাড়ির আগমনী কানে আসতেই আমি চমকে উঠলাম।

আপ কিংবা ডাউন—একটা গাড়ি এসে পড়ল বলে—অদূরে তার ইঞ্জিনের আলো দেখা দিয়েছে—কিন্তু আমার গাড়ির থামার কোনো উৎসাহ নেই!...

বিনে ভাড়ায় গাড়ি চেপে চলেছি বলে অদৃশ্য ভূত আমায় টেনে নিজের দল ভারী করতে চায় নাকি?

নিঃশব্দ রাত্রির শান্তিভঙ্গ করে গমগম করতে করতে ছুটে আসছিল ট্রেনটা। তার জ্বলন্ত চোখে মৃত্যুদূতের হাতছানি!

আমার গাড়ির হাতলটা কোথায়?—এক্ষুনি এই যমালয়ের রথ থেকে নেমে পড়া দরকার। আরেক মুহূর্ত দেরি হলেই হয়েছে।

কোনো রকমে দরজা খুলে তো বেরিয়েছি। আমিও নেমেছি আর আমার গাড়িও থেমেছে। আর সঙ্গে সঙ্গে সামনে দিয়ে রেলগাড়িটাও গর্জন করতে করতে বেরিয়ে গেছে।

কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার সংবিৎ ছিল না। হুস হুস করে ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর আমার হুঁশ হলো।

নাহ্, মারা যাইনি—হুঁশিয়ার হয়ে দেখলাম। জলজ্যান্ত রয়েছি এখনো এবং মোটরগাড়িটাও চুরমার হয়নি। আমার পাশেই ছবির মতো দাঁড়িয়ে—

আমার এবং মোটরটার টিকে থাকা একটা চূড়ান্ত রহস্য মনে হচ্ছে—এমন সময় চোখে চশমা লাগানো একটা লোক বেরিয়ে এল মোটরের পেছন থেকে।

‘আমাকে একটু সাহায্য করবেন?’ এগিয়ে এসে বললেন ভদ্রলোক, ‘দয়া করে যদি আমার গাড়িটা একটু ঠেলে দ্যান মশাই। আট মাইল দূরে গাড়িটার কল বিগড়েছে, সেখান থেকে একলাই এটাকে ঠেলতে ঠেলতে আসছি! সারা পথে একজনকেও পেলাম না যে আমার সঙ্গে হাত লাগায়। যদি একটু আমার সঙ্গে হাত লাগান। লাইনটা পেরিয়েই আমার বাড়ি, একটু গেলেই। ওই যে, দেখা যাচ্ছে—আর এক মিনিটের রাস্তা।’

শিবরাম চক্রবর্তী: জন্ম ১৯০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর। ছোটদের জন্য তিনি লিখেছেন বাড়ি থেকে পালিয়ে, হাতির সঙ্গে হাতাহাতি, হারাধনের দুঃখ, বাড়িওলার বাড়াবাড়ির মতো অসংখ্য বিখ্যাত গল্প ও কবিতা। ১৯৮০ সালের ২৮ আগস্ট এ পাঠকপ্রিয় লেখকের মৃত্যু হয়।