একটা প্যাঁচার গল্প

এক.

অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেল আনিকার। কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। অন্য কেউ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে যেমন অস্বস্তি বোধ হয় তেমন একটা অনুভূতি। কিন্তু ঘরটাতে আনিকা একাই থাকে। ওর দিকে তাকিয়ে থাকার মতো কেউ এই রাত দুটোয় এই ঘরে থাকবার কথা নয়। নীল মৃদু আলোয় অস্পষ্ট ঘরটার চারদিকে ভয়ে ভয়ে চোখ বুলায় আনিকা। না, সবকিছু ঠিকঠাকই তো আছে। দরজাটা ভেজানো, তার পাশে ওর আলমারি, আলমারির পাশে পড়ার টেবিল, দেয়ালে ওর একটা ছবি, ওপাশে মেঝেতে কার্পেটের ওপর পড়ে থাকা টেডি বিয়ার-ঘুমানোর আগে যেটা যেখানে ছিল ঠিক তেমনটাই আছে। তবু অদ্ভুত একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে ওর। কেউ যেন গভীরভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। অনেকক্ষণ ধরেই তাকিয়ে আছে। আর সে জন্যই ঘুমটা ভেঙে গেল। এখন সে কী করবে? উঠে গিয়ে মাকে ডেকে আনবে? ১৪ বছর বয়সে এমন ভয় পেয়ে মা-বাবাকে রাতদুপুরে ডাকাডাকি করলে সবাই কাল হাসাহাসি করবে ওকে নিয়ে। কিন্তু...কেউ একজন এখানে অবশ্যই আছে। সব মানুষেরই একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে। সেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে এই ঘরে অন্য কেউ আছে। ভাবতে ভাবতে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে আনিকার। হ্যাঁ, একটা জায়গা, জানালা-জানালাটা দেখা হয়নি এখনো। মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে নিয়ে প্রায় জোর করেই জানালার দিকে তাকায় আনিকা। জানালায় ভারি পর্দা, কিন্তু একটা জায়গায় পর্দাটা ফাঁক হয়ে আছে একটু। সেদিকে তাকিয়ে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে আনিকা।

দুই.

 ‘ঢাকা শহরে প্যাঁচা?’ হাসি হাসি মুখে আনিকার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন জাহেদ চাচা। তারপর হাসিটা বিস্তৃত করে বললেন-শুনে বেশ ভালো লাগল। বেশ পরিবেশবান্ধব তো তোদের এলাকাটা। প্যাঁচা তো দূরের কথা, ঢাকা শহরে কাক ছাড়া আর কোনো পাখি আছে বলে আমার মনেই হয় না। আমাদের ছোটবেলায় ঢাকায় অনেক চিল দেখা যেত, আরে চিলের জ্বালায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছু খাওয়াই যেত না। কোথায় যে হারিয়ে গেল এত চিল! আর প্যাঁচা? শেষ কবে দেখেছি মনেই করতে পারছি না।

জাহেদ চাচার এই সমস্যা। মূল বিষয় থেকে সব সময়ই অনেক দূরে চলে যান। ভাগ্যিস যে বাবা তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন। ‘বিষয়টা একটু গোলমেলে বলেই তোকে ডেকেছি জাহেদ’—বললেন তিনি। আনিকা প্রায় প্রতিরাতেই ঘুম ভেঙে চেঁচামেচি করছে ভয়ে। জানালা দিয়ে একটা প্যাঁচা নাকি ওর দিকে প্রতিদিন গভীর রাতে তাকিয়ে থাকে। শি ইজ বিকামিং সিক। কী করা যায় বল তো?  

জাহেদ চাচা বাবার ছোটবেলার বন্ধু। ডাক্তার। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জন। বেশ হাসিখুশি মানুষ। এ মুহূর্তে হাসতে হাসতেই চায়ের কাপে মুখ দিয়ে বললেন—তুই দেখেছিস প্যাঁচাটাকে? বাড়ির আর কেউ দেখেছে?

বাবা বলতে বাধ্য হলেন যে আর কেউ দেখেনি। চিৎকার শুনে সবাই ছুটে আসতে আসতে প্যাঁচাটা পালিয়েছে।

তাহলেই বোঝ, জাহেদ চাচা সমস্যার সমাধান করে ফেলেন সহজেই—এটা ওর মস্তিষ্ক বানিয়েছে। বানোয়াট ভাবনা। হয়তো ওর খুব পড়ালেখার চাপ যাচ্ছে। স্ট্রেস কমানোর জন্য কাল্পনিক ঘটনার অবতারণা করছে সে। আজকাল তো বাচ্চাদের এত লেখাপড়ার চাপ! কিংবা কোনো কারণে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে, অ্যাটেনশন সিকিং বিহেভিয়ার, অনেক সময় বাচ্চারা এটা করে। তোরা মনে হয় বেশি সময় দিস না ওকে। এগুলো হচ্ছে মডার্ন লাইফের সমস্যা। আর কিছু না।

আনিকার রাগ হতে থাকে। প্রথমত সে মোটেও আর বাচ্চা নয়, যথেষ্ট বড় হয়েছে। ক্লাস এইটে পড়ে। দ্বিতীয়ত সেÊফ অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলার মতো মেয়েও সে নয়। প্রথম দু-তিন দিন সমস্যাটার কথা সে কাউকে বলেইনি। নিজেই ভেবে নিয়েছে এটা গভীর ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্ন বা হিপনাগোগিক হ্যালুসিনেশন। জাহেদ চাচা হয়তো জানেন না যে আজকালকার ছেলেমেয়েরা বইপত্র পড়ে ও ইন্টারনেট ঘেঁটে অনেক বিষয়েই যথেষ্ট জ্ঞান রাখে। ভূত-প্রেত বা অবাস্তব কিছুতে চট করে ভয় পেয়ে যাবে—ছেলেমেয়েরা এখন আর এমন নেই। কিন্তু রাতের পর রাত প্যাঁচাটা ঘোরতর বাস্তব হয়ে দেখা দিতে থাকায় তার আত্মবিশ্বাসে একসময় চিড় ধরে। বিষয়টা বোঝার জন্য মা এক রাত তার ঘরে থাকলেন। সেদিন গভীর রাতে আনিকার ঘুম ভেঙে গেলে মাকে ডেকে ওঠানোর আগেই প্যাঁচাটা পালিয়ে গেল। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত, অবিশ্বাস্যও বটে, মানছে আনিকা, কিন্তু ঘটনাটা তো সত্য। সত্যি তো সে প্রতিদিন প্যাঁচার আশ্চর্য উজ্জ্বল গোল গোল হলদে চোখ দেখতে পাচ্ছে। এরপর জাহেদ চাচা গলা নামিয়ে বাবাকে যা বললেন, তাতে রীতিমতো কান্না পেয়ে গেল ওর। জাহেদ চাচা ভেবেছেন সে শুনতে পায়নি, কিন্তু সে ঠিকই বুঝেছে যে তিনি বাবাকে বলছেন আনিকা কোনো নেশা-টেশা করে কি না, তার খোঁজ নিতে। আনিকার চোখ পানিতে ভরে গেল। আজকালকার ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে বড়রা কেবল নেতিবাচক চিন্তাই প্রথমে মনে আনে। ব্যাপারটা ঠিক নয়।

তিন.

 আইসোলেটেড ভিসুয়াল হ্যালুসিনেশন সাধারণত মস্তিষ্কের টেমপোরাল লোবের কোনো সমস্যাকে নির্দেশ করে, টেবিলে কলম ঠুকতে ঠুকতে কথাগুলো বললেন নিউরোলজিস্ট ডা. আমিন, জাহেদ চাচার বন্ধু। প্রথম প্রথম পাত্তা না দিলেও সমস্যা ক্রমেই জটিল হয়ে পড়তে থাকায় জাহেদ চাচাই আনিকাকে তার এই বন্ধুর কাছে নিয়ে এসেছেন।

ড. আমিন বিষয়টা আনিকার বাবাকে ব্যাখ্যা করতে থাকেন, হঠাৎ গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলেও একধরনের হ্যালুসিনেশন হয়, যাকে বলে হিপনোপমপিক হ্যালুসিনেশন। কিন্তু আপনার মেয়ের এটা রিপিটেডলি হচ্ছে এটাই আশ্চর্য। আর প্রতিদিন একই দৃশ্য। স্ট্রেনজ! ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং।

আনিকার বাবাকে একটু বিধ্বস্ত দেখায়। সত্যি বলতে কী, প্যাঁচাটার কারণে এখন আনিকার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। রাতে ঘুম না হওয়ার কারণে চোখের নিচে কালি পড়েছে ওর। খাবার রুচি কমে গিয়েছে ভীষণ, শুকিয়ে কাঁটা হয়ে যাচ্ছে সে। আনিকার মা পুরান ঢাকার কোনো পীর সাহেবের কাছ থেকে কিশমিশ পড়া নিয়ে এসেছেন, রোজ সকালে খালি পেটে গুণে গুণে সাতটা কিশমিশ খেতে হবে, তাতে কেউ আর ওকে নাকি ভয় দেখাতে পারবে না। আনিকা অবশ্য কিশমিশ খায়নি, তার স্বাভাবিক বোধ-বুদ্ধি লোপ পায়নি যে অসুখ সারানোর জন্য কিশমিশ খেতে হবে। অবশেষে জাহেদ চাচা তার নিউরোলজিস্ট বন্ধুর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছেন। এই ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে নাকি এক মাস লেগে যায়, জাহেদ চাচার কারণে তা এক দিনেই ম্যানেজ করা গেছে।

এখন ড. আমিন আর জাহেদ চাচা মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন যে আনিকার ব্রেনে ইইজি করা হবে। এতে টেমপোরাল লোব এপিলেপসি নির্ণয় করা যাবে ও চিকিৎসা শুরু করা হবে। ‘ বিষয়টা খুবই সহজ’—যেন সমাধান প্রায় হয়েই গেছে এমন একটা ভঙ্গিতে বললেন ডা. আমিন—এটা একটা রুটিন প্রসিডিউর। এ রকম বয়সেই সাধারণত টিএলই হয়ে থাকে। বেশ কিছুদিন ওষুধ খেতে হবে ওকে। ভয় নেই, ঠিকঠাক চিকিৎসা নিলে একদম ভালো হয়ে যাবে আপনার মেয়ে।’

আনিকাকে অতঃপর একটা হিম ঠান্ডা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ঘরটাতে ঠান্ডা নীল একটা আলো জ্বলছে। আনিকার মাথায় অনেকগুলো ইলেকট্রোড লাগানো হলো। চোখের নড়াচড়া বোঝার জন্য মনিটর চালু করা হলো। আনিকার ভীষণ ভয় পেতে থাকলেও সে প্রাণপণে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করল। নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করল যে এটা একটা পরীক্ষা মাত্র, আর কিছু নয়। তা ছাড়া এটা তার ভালোর জন্যই করা হচ্ছে। তারপর কী কী হতে থাকল তা আর ওর মনে নেই। আবার যখন নিজেকে সে ফিরে পেল দেখল একটা বিছানায় শুয়ে আছে। পাশেই একটা টুলে বসে মা উদ্বিগ্ন মুখে চেয়ে আছেন। চোখ খুলে প্রথমেই আনিকা বলল—মা, আমার কি সত্যি টিএলই হয়েছে?

ওর কথা শুনে জাহেদ চাচা আর বাবা গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। আনিকা সব সময়ই খুব সাহসী আর আধুনিক মেয়ে, তা নাহলে জ্ঞান ফিরেই নিজের রোগের ব্যাপারে জানতে চাইত না। আর যে মেয়ের ইনসাইট এত ভালো, মানে নিজের অন্তর্গত চিন্তার জগৎ যার এত পরিষ্কার, তাতে ওর কোনো ধরনের মানসিক রোগ আছে সেটা বিশ্বাসই করা যায় না। অথচ ড. আমিন ইইজি রিপোর্ট দেখতে দেখতে ব্যথিত মুখে সে কথাই বললেন একটু আগে—ওর কোনো এপিলেপসি নেই মনে হচ্ছে। ইইজি তো একদম নরমাল। আমার মনে হয় ও কোনো জটিল মানসিক রোগে ভুগছে। আপনারা একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে আলাপ করতে পারেন। তবে...তার আগে একটা এমআরআই করে নিলে বোধ হয় ভালো হতো। মানে ব্রেনের ভেতর কোনো অরগানিক প্রবলেম আছে কি না...

ডাক্তার যা বলেন তা-ই সই। আনিকাকে এবার একটা বিশাল কফিনের মতো এমআরআই যন্ত্রের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। তার আগে যন্ত্রের বেডের সঙ্গে শক্ত বেল্ট দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা হলো ওকে। আনিকার মনে হতে লাগল যেন তাকে বেঁধে একটা চুল্লির ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হবে এখন। যেন সে একটা ভয়ংকর থ্রিলার ছবির শেষ ভাগে অভিনয় করছে। অদ্ভুত ও ভয়াল যন্ত্রটা ওকে ভেতরে টেনে নিলে ভয়ে সে চোখ বন্ধ করে ফেলল। প্রায় আধা ঘণ্টা পর কফিনটা থেকে বের করে আনা হলো ওকে। রেস্টরুমে খানেক ধাতস্থ হয়ে ডাক্তারের রুমে ফিরে এসে সে দেখল বাবা, জাহেদ চাচা ও ড. আমিন এখন আগের চেয়েও বেশি গম্ভীর। ব্যাপারটা হলো যে আনিকার মস্তিষ্কের ভেতর-বাহির কোথাও কোনো সমস্যা নেই। তার মানে সমস্যাটা বোধ হয় তার মনে, বা চেতনায়। ড. আমিন এবার মোটামুটি নিশ্চিত যে আনিকার কোনো মানসিক রোগ আছে। বাবা, মা, জাহেদ চাচা সবাই মন খারাপ করে রইলেন। কিন্তু আনিকা জানে, এটা কোনো মানসিক সমস্যা নয়। হয়তো সমস্যাটা অনেক বেশি জটিল। সেটা যে কী হতে পারে, সে বিষয়ে তার নিজেরও কোনো ধারণা নেই। তার এবার একটু অসহায় লাগতে থাকে। হঠাৎ করে মনে হয় যে কেউ তাকে কেন যেন আর বিশ্বাস করছে না।

 এত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও সমস্যার মূল কারণ ধরতে না পারায় আনিকার বাবা-মা একসময় হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলেন। এর মধ্যে আনিকাকে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞও দেখানো হয়েছে। আনিকার সঙ্গে কথা বলে তিনি রায় দিয়েছেন যে এই মেয়ের বুদ্ধিমত্তা ও চেতনা প্রখর, সে অত্যন্ত সাহসীও, তার মনে হয় না যে আনিকার কোনো মানসিক রোগ আছে। তিনি তাদের অপেক্ষা করতে পরামর্শ দিলেন, দেখা যাক মনের প্যাঁচাটা এমনি এমনি চলে যায় কি না। আনিকার মা এবার নতুন একজন পীরের কাছ থেকে চিরুনি পড়া নিয়ে এসেছেন। এই চিরুনি ঘরের দরজার কাছে রেখে দিলে অশুভ কিছু আর এ ঘরে ঢুকতে পারবে না। কিন্তু প্যাঁচাটা এতকিছুর পরও রয়েই গেল। আনিকা তাই শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা মেনে নিতেই চেষ্টা করছে। প্যাঁচাটা বেশ নিরীহ গোছের, রোজ রাতে জানালায় বসে জ্বলজ্বলে হলুদ চোখে চেয়েই তো থাকে শুধু, কোনো ক্ষতি তো করে না। তাহলে ওকে এত ভয় পেয়ে আর কী হবে! তবে আনিকার স্কুলে যাওয়া এখনো শুরু হয়নি। এমনকি তার বন্ধুদের সঙ্গেও তার আর যোগাযোগ নেই, হয়তো ওদের বাবা-মায়েরা তাদেরকে ওর কাছে আসতে নিষেধ করে দিয়েছেন। হয়তো স্কুলেও সবাই ভাবছে যে আনিকা একজন জটিল মানসিক রোগী, কাছে গেলে কামড়ে দিতে পারে। একটা প্যাঁচার জন্য ওর জীবনটাই পালটে গেল পুরোপুরি। আর এই নতুন জীবনে তারা কিছুটা মানিয়ে নিতেও শুরু করেছিল। এই রকম সময়ে একদিন ওদের বাড়ির কলবেল অনেক দিন পর বেজে উঠল। আনিকার বাবা দরজা খুলতেই একজন চশমা পরা উসকোখুসকো কাচা-পাকা চুলের লোক উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে বলল, এটা কি আনিকাদের বাসা? যে মেয়েটা রাতে তার জানালায় রোজ একটা প্যাঁচাকে দেখে?

চার.

ডা. আমিন অনেকক্ষণ ১৩ বছর বয়সী ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেটা তার স্কুলের একজন চৌকস ছাত্র, জাতীয় দাবা প্রতিযোগিতায় দুবার রানারআপ হয়েছে, গণিত অলিম্পিয়াডেও পুরস্কার পেয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার ভয়ার্ত চোখ দুটো এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছে, নার্ভাস ভঙ্গিতে পা দোলাচ্ছে সে। জিব দিয়ে ঠোঁট চেটে সে এবার বলে, আমি জানি কথাটা খুব অস্বাভাবিক শোনাচ্ছে, কিন্তু আংকেল, বিশ্বাস করুন, এটা সত্যি।

ড. আমিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, না রনি, আমি খুব একটা আশ্চর্য হচ্ছি না। প্রথমবার হয়েছিলাম। তুমি কি বাই অ্যানি চান্স, আনিকা নামের কাউকে চেনো? ক্লাস এইটে পড়ে, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলে।

রনি নামের ছেলেটা অনেকক্ষণ চিন্তা করে বলে, না আংকেল, চিনি না। কেন বলেন তো?

ড. আমিন বলেন, ভালো করে চিন্তা করো। চেনো কি না।

না আংকেল, আমি শিওর যে চিনি না। রনি বলল। তার মা বসে আছেন পাশে, তাকেও খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে। দেখাবেই তো, ড. আমিন ভাবেন, তার ছেলে গত সাত দিন তার জানালায় একটা প্যাঁচাকে বসে থাকতে দেখছে। এ রকম অদ্ভুত ঘটনা কে কবে শুনেছে?

ড. আমিন রনির মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, খুবই উইয়ার্ড ব্যাপারটা। রনি একা নয়, এই দৃশ্যটা আরও একটি মেয়ে দেখে। সে-ও আমার কাছে এসেছিল। আমরা তার রোগটা ধরতে পারিনি।

রনির মাকে এবার আরও চিন্তিত দেখায়, তাহলে কী হবে স্যার? এ রকম কি চলতেই থাকবে?

ড. আমিন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। একসঙ্গে কয়েকজন এমনকি অনেকের একই ধরনের হ্যালুসিনেশন কখনো কখনো হতে পারে। ধরুন এক বোন রাতে একটা জোব্বা পরা ভূত দেখতে পেল, সে গল্প করল অন্য বোনকে, অন্য বোনও পরদিন রাতে সেই একই ভূত দেখতে পেল। কিংবা এক ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে একই কাল্পনিক মাকড়সার ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ল। একে বলা হয় শেয়ারড হ্যালুসিনেশন। কিন্তু রনি আর আনিকা, ওরা কেউ পরস্পরকে চেনে না। ওরা পরস্পরের সঙ্গে নিজেদের সমস্যা শেয়ারও করেনি। তার মানে এটা কোনো শেয়ারড হ্যালুসিনেশন নয়।

প্লিজ ডক্টর, রনির মাকে এবার বিধ্বস্ত দেখায়, কিছু একটা করুন। কোনো ওষুধ দিন বা কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা। যা দরকার সব করুন।

ড. আমিন ফিরে এসে তার চেয়ারে বসেন, আনিকার সব ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট নরমাল পাওয়া গেছে। আমি জানি রনিরও তাই হবে। তবে, ফর আ কিউরিওসিটি, আমি কি ওর একটা ইমেজিং করতে পারি? এইচ টু ফিফটিন পজিট্রন ইমিশন টমোগ্রাফি। এটা একধরনের হাই টেক ইমেজিং যাতে মস্তিষ্কের সবকিছুর নিখুঁত পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখা যায়। ইফ ইউ পারমিট।

দুই ঘণ্টা পর ড. আমিনকে দেখা গেল নিজের চেম্বারে বসে ভ্রু কুঁচকে ভিউবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতে। খুবই সামান্য, সামান্য হলেও জিনিসটা গুরুত্বপূর্ণ, রনির হিপোক্যামপাস এলাকায় নিউরন স্ক্লেরসিস হয়ে আছে। রাত ১০টা বাজে, ড. আমিনের সহকারী দুবার এসে বলে গেছেন যে আর কোনো রোগী অবশিষ্ট নেই। স্যার এবার যেতে পারেন। কিন্তু তিনি তাঁর ল্যাপটপে তন্ময় হয়ে নানা কিছু সার্চ করছেন। সামথিং ইজ দেয়ার টু বি ফাউন্ড। তাঁকে খুঁজে বের করতেই হবে। রনি আর আনিকা, এই দুটো ছেলেমেয়ের এই অদ্ভুত সমস্যার মধ্যে যোগাযোগটা কোথায়?

পাঁচ.

আমাদের মস্তিষ্কের অনেক কিছুই এখনো প্রায় পুরোপুরি অজানা রহস্যে ভরা। আনিকাদের ড্রইংরুমে বসে বলে চলেছেন লিকলিকে চশমা পরা লোকটা, যিনি নাকি একজন নিউরোসায়েন্টিস্ট। দীর্ঘদিন ছিলেন দেশের বাইরে। এখন দেশে ফিরে অ্যাবনরমাল নিউরনাল ডিসচার্জ নিয়ে গবেষণা করছেন। যেমন: হিপোক্যামপাস। বললেন লোকটা, মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীর এই জায়গাটা এত উন্নত নয়। দেখতে অনেকটা ঘোড়া মাছের মতো, সেরিব্রাল কর্টেক্সের ঠিক নিচে থাকে। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় হিপোক্যামপাস শব্দটির অর্থ সি মনস্টার বা সমুদ্রের দৈত্য। লিম্বিক সিস্টেমের একটা অংশ হলেও এর কাজকর্ম সম্পর্কে এখনো সঠিক জানা যায়নি। কিন্তু গবেষণায়  প্রমাণিত হয়েছে যে এই এলাকার নিউরনগুলোকে যথাযথভাবে উদ্দীপ্ত করা হলে অতিপ্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা বা শোনাটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এর চেয়ে বড় ব্যাপার, মস্তিষ্কের এই জায়গার নিউরনই বৈদ্যুতিক তরঙ্গে সবচেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত হয়। খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, তাই না?

আনিকার বাবা-মা ভাবলেশহীন থাকেন। ব্যাপারটার মধ্যে ইন্টারেস্টিং কী আছে, তা তাঁরা বুঝতে পারছেন না। আর এসব সামুদ্রিক দৈত্য-ফৈত্যের সঙ্গেই বা তাঁদের মেয়ের কী সম্পর্ক?

কিন্তু বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষেত্রে লোকটার আগ্রহ যেন বেড়ে যায় আরও, এর চেয়েও দারুণ একটা বিষয় আছে। মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতা আসলে আমাদের ধারণার চেয়েও বেশি। আর এর অনেকটাই এখনো অনাবাদিই পড়ে রয়েছে, মানে এর ব্যবহারটা মানবজাতি ঠিকঠাক শিখেই উঠতে পারেনি। এই যেমন এই ছোট্ট সি মনস্টার হিপোক্যামপাস-প্রপারলি এর ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারলে তুমি অন্যের মস্তিষ্কে অপটিক্যাল ইলিউশন তৈরি করতে পারবে। ধরো, তুমি যে প্যাঁচাটাকে দেখতে পাচ্ছ আসলে হয়তো সেটা কোনো প্যাঁচা নয়। হয়তো সে একটা মানুষ, বা তোমার কোনো চেনা লোক, যে প্যাঁচা হয়ে তোমাকে দেখা দিচ্ছে। চাইলে তুমিও তাকে অন্য কিছু হয়ে ঘাবড়ে দিতে পারো।

আনিকার বাবা এবার চরম বিরক্ত হলেন। এই লোককে ঘরে ঢোকানোই ভুল হয়েছে। পুরোপুরি মাথা খারাপ এই লোকের। কিন্তু আনিকা গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ে। বেশ, সবই বোঝা গেল, কিন্তু আর সবাইকে বাদ দিয়ে ওরই মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসে অস্বাভাবিক নিউরন ডিসচার্জ হতে যাবে কেন? ওর কী দোষ? ওর তো কোনো অসুখ বিসুখও হয়নি।

আনিকার হয়ে প্রশ্নটা করে ফেলেন ওর মা। আর জবাবে লোকটা অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে শেষে বলে—এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আনিকাকে আমার ল্যাবরেটরিতে যেতে হবে। আমি ওর কয়েকটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করব। ভয়ের কিছু নেই, দুটো ছোট্ট ইলেকট্রোড ব্যবহার করে কেবল হিমোক্যামপাল এরিয়াটাকে সামান্য উদ্দীপনা দেওয়া হবে। আমি দেখতে চাই, সে তখন প্যাঁচাটাকে দেখতে পায় কি না। ইচ্ছে করলে সে তার নিজস্ব শক্তি বা ইচ্ছে দিয়ে তখন প্যাঁচাটার মোকাবিলা করতে পারবে, বিদায় করে দিতে পারবে মাথা থেকে। আই হোপ সো। ব্যস। এটুকুই।

শুনে আনিকার বাবা খেপে গেলেন। আমরা আনিকার আর কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেব না। অনেক হয়েছে। আপনার কাছে যদি কোনো সমাধান থাকে তো বলেন, নয়তো আপনি এবার যেতে পারেন।

বাবার তিরিক্ষি কথা শুনে একটু খারাপই লাগে আনিকার, বাবা ইদানীং বেশ মেজাজি হয়ে উঠেছেন। ওর তো ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিংই মনে হচ্ছে। সে জানতে চায়, ব্যথা লাগবে না তো?

রাজিব একটু হাসেন। একটু অস্বস্তি লাগতে পারে। এগুলো টেকনিক্যাল ব্যাপার। আর বিশ্বাস করো, আমার সহকারী সুমন এ বিষয়ে একজন সত্যিকারের এক্সপার্ট। তুমি কিছু টেরই পাবে না।

বাবা-মার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও আনিকা রাজিবের ল্যাবে যেতে রাজি হয়ে গেল।

রাজিবের ল্যাবরেটরিতে সার ধরে রাখা অনেকগুলো বিছানা। প্রত্যেক বিছানার পাশে একটি করে বাক্সের মতো যন্ত্র, তার সঙ্গে অনেকগুলো তার। আনিকাকে একটা বিছানায় শুইয়ে মাথার দুই পাশে একটি করে ইলেকট্রোড লাগানো হলো। এই জিনিসটি ওর চেনা, ইইজি করার সময় ব্যবহার করা হয়েছিল। তাই সে খুব একটা ভয় পেল না এবার।

রাজিবের সহকারী সুমন একে একে যন্ত্রগুলো অন করে দিতেই মাথার ভেতর কেমন যেন একটা ঝিঁঝি অনুভূতি হতে থাকে আনিকার। তার চারপাশের পৃথিবীটা যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এদিক-ওদিক থেকে ঢুকে পড়ছে নানা অচেনা দৃশ্য। চারপাশটা পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে হঠাৎই সামনের সাদা দেয়ালে ঝোলানো একটা পোস্টারের দিকে দৃষ্টি পড়ে আনিকার। পোস্টারটি কোনো এক ওষুধ কোম্পানির, বেশির ভাগ হাসপাতালেই যেমনটি থাকে। এর ছবিতে একটা ফুটফুটে শিশু দুই হাত বাড়িয়ে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আনিকা চমকে ওঠে। এই পোস্টার, এই ছবি, এই ঘর সে আগেও দেখেছে। এসব কিছু তার খুব চেনা। কিন্তু কোথায় দেখেছে? কবে দেখেছে? তাহলে কী তার দ্য জা ভু হচ্ছে? ভাবতে ভাবতেই অন্ধকারে হারিয়ে গেল আনিকা।

প্রথমে সে দেখল একটা বিশাল সমুদ্র। সমুদ্রের বিরাট বিরাট ঢেউ বিকট গর্জন করে আছড়ে পড়ছে তীরে। আর সে একা বালুতে দাঁড়িয়ে আছে, পা দুটো ভিজে যাচ্ছে বারবার। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সে টের পায় যে সে একা নয়। তার পাশে আরও অনেকেই আছে যাদের সে অনুভব করতে পারছে কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না। তার কানের কাছে একটি পরিচিত কণ্ঠ বলে ওঠে, এই দৃশ্যটা আমি আগে দেখেছি। এখন মনে করতে পারছি না।

এই কথা শেষ না হতেই একটা গির্জার ছবি ফুটে উঠল চোখের সামনে। সবুজ মাঠের মাঝখানে ভারি পবিত্র দেখাচ্ছে ধবধবে সাদা গির্জাটাকে। গির্জার ঘণ্টাটা ঢং ঢং করে বেজে উঠলে ওরা সবাই একসঙ্গে ওর ভেতরে ঢোকে। দূরে যিশু ক্রুশবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার পাশে মা মেরি। ওদের দলের একটা লম্বা চুলের মেয়ে ভারি অবাক হয়ে বলে, ‘এখন কী হবে আমি জানি। ফাদার পাঠ করবেন পবিত্র বাইবেল-জগৎ যদি তোমাদিগকে দ্বেষ করে, তোমরা তো জানো, সে তোমাদের অগ্রে আমাকে দ্বেষ করিয়াছে। তোমরা যদি জগতের হইতে, তবে জগৎ আপনার নিজস্ব ভালোবাসিত; কিন্তু তোমরা তো জগতের নহ, বরং আমি তোমাদিগকে জগতের মধ্য হইতে মনোনীত করিয়াছি, এই জন্য জগৎ তোমাদিগকে দ্বেষ করে।’...আশ্চর্যের ব্যাপার, ফাদার যেন তার কথাগুলোরই প্রতিধ্বনি করলেন।

আনিকা বুঝতে পারে যা যা ঘটছে তা ঘটবে এমনটা যেন তারা সবাই জানত। কিন্তু সবাই মানে কী? তার আশপাশের ছেলেমেয়েগুলোকে সে কেবল অনুভব করতে পারছে, কথা শুনতে পাচ্ছে কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না। ওরা কারা? ওরা কীভাবে ওর সঙ্গে কথা বলছে? ভাবতে ভাবতে তার খুব ক্লান্ত লাগতে থাকে। সে ঘুম ঘুম চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে তার বিছানার পাশে যে চেয়ারে রাজিব নামের লোকটা বসেছিল, সেখানে চুপচাপ বসে আছে একটা হলুদ বড় চোখের প্যাঁচা। সে ভয়ে চিৎকার করে উঠতে গিয়েও চিৎকার করতে পারে না, গভীর ঘুম এসে তাকে ভাসিয়ে নিতে চায়। সে প্রাণপণে নিজেকে সংবরণ করতে চেষ্টা করে। প্যাঁচাটার সঙ্গে তার কথা বলতেই হবে।

ছয়.

আনিকা বাড়ির সবগুলো ড্রয়ার তোলপাড় করতে থাকল। মা জিজ্ঞেস করলেন, কী খুঁজছ তুমি? আমাকে বলো। কোনো সাহায্য করতে পারি। আনিকা উত্তর দিল না। কবে, কোথায় সে দেখেছিল ওই পোস্টারের ছবিটা? কেন কিছুতেই মনে পড়ছে না? রাগে সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিতে গিয়ে হঠাৎ ড্রয়ারের একেবারে নিচে সে খুঁজে পায় ওটা। হসপিটালের ডিসচার্জ লেটার। হ্যাঁ, ১০ বছর বয়সে ওর একবার খুব জ্বর হয়েছিল। অনেক জ্বর ওঠার পর সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। খিঁচুনিও হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন এনকাফালাইটিস। মস্তিষ্কে একধরনের ভাইরাস সংক্রমণ। ১০ দিন হাসপাতালে থেকে ছাড়া পেয়েছিল সে। আর হাসপাতালে তার বেডের সামনের দেয়ালেই লাগানো ছিল পোস্টারটা। ওটা একটা ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইনজেকশনের বিজ্ঞাপন, যা সাধারণত মস্তিষ্কের সংক্রমণে ব্যবহার করা হয়। আনিকা একটা কাগজে ওষুধটার নাম লিখে নেয়। তারপর বেরিয়ে সোজা আমিন আংকেলের চেম্বারে। আজ নাকি আংকেল জাহেদ চাচাকে ফোন করে জরুরি ভিত্তিতে ওকে দেখা করতে বলেছেন।

ড. আমিন কাগজটার দিকে তাকিয়ে একটু গম্ভীর হয়ে পড়লেন। ওয়েল, বলেন তিনি—ইমিউনোগ্লোবিউলিন জি সাধারণত গুলেন বেরি সিনড্রোমে ব্যবহার করা হয়। কয়েক ধরনের অটোইমিউন ডিজিজেও এর ব্যবহার আছে। গত দশকে আইজি বা ইমিউনোগ্লোবিউলিন থেরাপি নিয়ে গবেষণার হিড়িক পড়েছিল। তারপর বেশ কিছু কারণে এতে ভাটা পড়ে। বিশেষ করে দেখা যায় যে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি আইজি নিজেই অটোইমিউন রি-অ্যাকশন করতে পারে। তার মানে আমাদের শ্বেতকণিকা নিজের দেহের কোনো কোষের বিপরীতেই কাজ শুরু করে দিতে পারে। ভেরি ইন্টারেস্টিং, দেখা যাচ্ছে এই গবেষণায় কিছু কিছু আইজি থেরাপি নিউরনে তথ্য আদান-প্রদান করে যে সিনাপস সেখানে সিনাপটিক রি-অরগানাইজেশন করেছে। পতু‌র্গালে এ নিয়ে এক ভদ্রলোক একটা ডিটেইল স্টাডি করেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে কয়েকজন ভলান্টিয়ারের দেহে একধরনের আইজি জি ফোর ইনজেকশন প্রয়োগের কারণে মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু জায়গায় সিনাপটিক রি-অরগানাইজেশন হয়েছে। আর ভেরি ইমপর্টেন্টলি, এটা হয়েছে কেবল মস্তিষ্কের একটা নির্দিষ্ট জায়গায়। হিপোক্যামপাসে। এই গবেষণার পরই এই আইজিজি ফোর নিয়ে ফেজ থ্রি ট্রায়াল নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

লিংকটা কি আমাকে দেখাবেন আংকেল?-আনিকা আমিন আংকেলের ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রাখে। এই গবেষণা নিয়ে অরিজিনাল আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছিল বিশ্বখ্যাত এক সাময়িকীতে, প্রধান গবেষক ছিলেন পতু‌র্গালের লুই স্টিভেনসন, আর গবেষণা সহকারী...গবেষণা সহকারীর নামটা দেখে প্রায় আঁতকে ওঠে আনিকা—চৌধুরী আর। এর মানে কী? রাজিব চৌধুরী?

ড. আমিন ঠোঁট কামড়াতে থাকেন। বিষয়টা খুবই গোলমেলে। আনিকাকে এনকাফালাইটিসে ভোগার সময় নানা ধরনের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল। সবগুলো কি এন্টিবায়োটিক বা এন্টিভাইরাল জাতীয় ইনজেকশন? না অন্য কিছু? সাত বছর বয়সে রনি নামের ছেলেটির ফেব্রাইল কনভালশন হয়। সেও একটি হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং নানা রকম ইনজেকশন নেয়। তৃতীয় যে কিশোরটি তার জানালায় ইদানীং প্যাঁচা দেখতে শুরু করেছে তার নাম অরুন। তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন যে অরুনও হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ইনজেকশন নিয়েছে আট বছর বয়সে। তার হয়েছিল ম্যালেরিয়া। এই শিশুগুলো কি কোন এক্সপেরিমেন্টে ব্যবহৃত হয়েছে? উন্নত দেশের মাল্টি বিলিয়ন প্রজেক্টের কোম্পানিগুলো খুব সস্তায় ও খুব সহজে দরিদ্র দেশের মানুষের ওপর বিভিন্ন ট্রায়াল করতে পারে। কিন্তু সব ফেজের ট্রায়ালেরই একটা সুনির্দিষ্ট ও পরিকল্পিত পদ্ধতি ও নীতিমালা আছে। বিশেষ করে এ ধরনের ট্রায়ালে ভলান্টিয়ারের অনুমতি বা কনসেন্ট নেওয়াটা বাধ্যতামূলক। যদি তা না করা হয় তবে সেটা নিশ্চয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

ড. আমিন আনিকা ও জাহেদ চাচার দিকে ফিরে বলেন, কোথাও একটা বিরাট গোলমাল আছে। আনিকা, রনি ও অরুন—এদের মধ্যে এটা যোগাযোগ নিশ্চয় আছে। কিন্তু যোগাযোগটা কোথায় সেটাই সবচেয়ে বড় রহস্য। হতে পারে যে এই রহস্যের উত্তর ওই পাগলা গবেষক রাজিব চৌধুরী জানেন। আমাদের তাঁর কাছেই যেতে হবে।  তার আগে লোকটা সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া দরকার। আমি পতু‌র্গালে লুই স্টিভেনসনের কাছে একটা মেইল করেছি। দেখি কী উত্তর আসে।

সাত.

‘মানব মস্তিষ্কের অপাররহস্য আমাকে অভিভূত করে। যা এই পৃথিবীতে নেই, অপার্থিব, কিংবা যা সত্য নয়—তাও আমাকে দেখাতে পারে এই মস্তিষ্ক। আমি যা নই, তাও হতে পারি এই মস্তিষ্ককে ব্যবহার করেই। তাই আমাকে আর কেউ খুঁজে পাবে না কোনোদিন। আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দের মতোই আমি হয়তো শঙ্খচিল কি কাক বা প্যাঁচা হয়ে জন্ম নেব একদিন।’

রাজিব চৌধুরী নামের অদ্ভুত লোকটাকে পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে এই ছোট্ট নোটবইটা, যাতে এসব হাবিজাবি জিনিস লেখা। রাজিবের ল্যাবরেটরিটি তালাবদ্ধ দেখে জাহেদ চাচা থানায় জিডি করে পুলিশ ডেকে তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা করেছিলেন। ভেতরে ঢুকে আনিকার চোখ ছানাবড়া। পুরো হলঘর সুনসান। ধবধবে সাদা বিছানা, সেসব বিদ্ঘুটে যন্ত্রপাতি, তার, ইলেকট্রোড কিচ্ছু নেই ওখানে। খাঁ খাঁ ঘরের দেয়ালে কেবল ঝুলছে সেই পোস্টারটা। আর মেঝেতে পড়ে রয়েছে একটা নোটবই।

আনিকার আগে রনি, অরুন ও আরও তিনজন কিশোর-কিশোরীকেও আনা হয়েছিল এই ল্যাবে। বিদ্যুৎতরঙ্গের সাহাযে্য তাদের মস্তিষ্কের বিশেষ অংশে উদ্দীপনা দিয়ে দেখা হয়েছিল যে কী হয়। তারা প্রত্যেকেই এই উদ্দীপনার সময় প্যাঁচাটার আসল রূপ দেখতে পেয়েছিল এবং এতে করে তাদের ভয়-আশঙ্কা-সন্দেহ টুটে গিয়েছিল। এর পর থেকে কোনো রাতেই আর প্যাঁচাটার সঙ্গে দেখা হয়নি কারও। কিন্তু প্যাঁচাটা আসলে কী, কী কথা হয়েছিল ওটার সঙ্গে, কিংবা কীভাবেই তারা ওটাকে দূর করল—সে বিষয়ে ওরা কেউ মুখ খোলেনি। এমনকি নিজেদের মধ্যেও না। আমিন আংকেল মোটামুটি নিশ্চিত যে এই ছেলেমেয়েগুলো কোনো গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। এটা খুবই অনৈতিক ব্যাপার। লোকটাকে আইনের আওতায় আনা উচিত।

জাহেদ চাচা চেঁচামেচি করতে থাকলেন। পালিয়ে যাবে কোথায় বদমাশগুলো? ঠিক ওদের ধরে ফেলা হবে। পুলিশের আইজি আমার বন্ধু, আমি এক্ষুনি তাঁকে ফোন করছি...

পতু‌র্গাল থেকে বিশ্বখ্যাত নিউরো গবেষক ড. লুই স্টিভেনসন ওই রাতেই মেইলটার জবাব দিয়েছিলেন।

 প্রিয় ড. আমিন, আপনার চিঠির জন্য অনেক ধন্যবাদ। আমি শুনে আশ্চর্য হচ্ছি যে আমার প্রাক্তন সহকারী রাজিব চৌধুরী এখনো বে‌েঁচ বর্তে আছে। সে একজন অত্যন্ত মেধাবী গবেষক ছিল সন্দেহ নেই। আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন ছাত্রও ছিল সে। কিন্তু আইজিজিফোর নিয়ে ট্রায়াল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ার কারণে আমরা যখন এই ট্রায়াল বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিই সে তখন এর ঘোর বিরোধিতা শুরু করে। এ নিয়ে তার সঙ্গে আমার মতান্তর হয় এবং আমি তাকে গবেষণা সহকারীর পদ থেকে ছাঁটাই করি। ফলে পতু‌র্গালে থাকার জন্য তার ভিসা-সংক্রান্ত সমস্যা হয় এবং সে সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধভাবে জার্মানি চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। খুবই দুঃখের কথা, যাওয়ার সময় সে একটা মারাত্মক পাগলামি করে বসে। সে আমার ল্যাবরেটরি থেকে বাতিল হয়ে যাওয়া স্যাম্পল আইজিজি ফোরের সবগুলো ইনজেকশন চুরি করে নিয়ে যায়। পত্রিকা মারফত আমি জানতে পারি যে সীমান্ত পথে অবৈধভাবে ওষুধ পাচারের দায়ে সে ধরা পড়ে ও তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। বেশ কয়েক বছরের সাজা হয়েছিল তার। রাজিব সম্পর্কে আমার কাছে এটাই হচ্ছে সর্বশেষ খবর। ছেলেটির হঠকারিতা ও দায়িত্বহীনতাই তাকে একজন সম্ভাবনাময় বিজ্ঞানী থেকে একজন অপরাধীতে পরিণত করেছিল। কিন্তু শেষ অবধি সে অত্যন্ত উচ্চকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অপটিক্যাল ইলিউশন সৃষ্টির ক্ষমতা নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছিল বলে আমি শুনেছি। আপনাকে অনেক শুভেচ্ছা—ড. লুই স্টিভেনসন।

 রাজিবের ঢাকার ল্যাবরেটরিটি সিলগালা করে দেওয়া  হয়েছে। লোকটাকে ধরতে প্রয়োজনে ইন্টারপোলের সাহায্য নেওয়া হবে বলে চেঁচাতে লাগলেন জাহেদ চাচা, কত বড় বদমাশ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে প্যাঁচা দেখায়! ওকে পেলে আমি...ওকে পেলে তিনি কী করবেন সেটা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয় বলে আনিকাদের সামনে আর উচ্চারণ করলেন না তিনি।

সবাই মিলে বেরিয়ে আসার সময় কী মনে করে ছোট্ট কালো নোটবইটা হাতে নিয়ে ল্যাবের জানালার কাছে এগিয়ে গেল আনিকা। সে নিশ্চিত যে জানালার ওপাশে কিছু আছে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে জানালার পর্দাটা সরানো উচিত। কিন্তু সে সাহস পাচ্ছে না। পেছন থেকে জাহেদ চাচা ডাকলেন, চলে এসো আনিকা, আমরা এবার যাব।

আনিকা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে রইল। তারপর সাহস করে জানালার পর্দাটা সরিয়েই গম্ভীর হয়ে গেল সে। জানালার ওপাশে ঘাসের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে একটা প্যাঁচার মৃতদেহ। প্যাঁচাটার হলুদ গোল বড় বড় চোখ দুটো নির্জীব হয়ে চেয়ে রয়েছে আকাশের দিকে। কেউ দেখার আগেই পর্দাটা টেনে দিয়ে দ্রুত ফিরে এল সে।    

অলংকরণঃ মাসুক হেলাল