ওয়াটসনের হাড্ডিগুড্ডি

অলংকরণ: তীর্থ

‘এমা আমাদের রাজশাহীর কালাইয়ের রুটি আর বেগুনভর্তা খেতে খুব পছন্দ করে। জানিস?’

অর্ণব ভাইয়া নাশতার টেবিলে এক টুকরো রুটি আলুভাজি দিয়ে পেঁচিয়ে মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল।

‘এমা? কোন এমা? আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ের এমির কথা বলছ নাকি? ওকে চেনো তুমি?’

‘আরে না, এমি–টেমি না, বলছি এমা ওয়াটসনের কথা। ওই যে বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট–এর নায়িকা, দেখিসনি ছবিটা?’

‘এমা ওয়াটসন? ব্রিটিশ অভিনেত্রী? হ্যারি পটারের হারমাইওনি? তার কথা বলছ?’

‘নইলে কার কথা আর?’ অর্ণব ভাইয়া উদাস গলায় বলে। আমরা এবার নড়েচড়ে বসি।

‘চাপা মারার আর জায়গা পাও না, ভাইয়া? ব্রিটিশরা ওসব খায়?’

‘সচরাচর খায় না। কিন্তু যদি কোনো ব্রিটিশ রাজশাহীতে আসে, আর তখন হঠাৎ তার খুব ক্ষুধা পায় আর হাতের কাছে যদি ওসব ছাড়া আর কোনো খাবার না থাকে, তখন?’

‘বলো কী, এমা ওয়াটসন কবে রাজশাহী গেল, আর কবেই–বা কালাই–রুটি খেল?’

অর্ণব ভাইয়া নাশতা শেষ করে ঢক ঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে বলল, ‘খবর তো রাখিস না কিছু । ২০১০ সালে কাউকে কিছু না জানিয়ে এমা ওয়াটসন যে বাংলাদেশ ঘুরে গিয়েছিল, সে খবর শুনেছিস?’

আমাদের মধ্যে যৌথ আবার অনেক খোঁজখবর রাখে। সে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘হ্যাঁ। শুনেছিলাম। বাংলাদেশের পোশাককর্মীদের অবস্থা দেখতে এসেছিল। কিন্তু সেটা তো ঢাকায়, রাজশাহী যাওয়ার কথা তো শুনিনি।’

ততক্ষণে অর্ণব ভাইয়ার খাওয়া শেষ। ডাইনিং টেবিল ছেড়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় এসে এবার জাঁকিয়ে বসল সে। গল্পের গন্ধ পেয়ে আমরা তার পিছু ছাড়লাম না। সুরমা আদুরে গলায় বলল, ‘বলো না ভাইয়া, এমা ওয়াটসন কি সত্যি রাজশাহী গিয়েছিল? তোমার সাথে দেখা হয়েছিল? কেমন দেখতে লাগল? বলো না...’

ভাইয়া বলল, ‘যৌথ তুই যদি আমাকে এক কাপ চমত্কার কফি বানিয়ে খাওয়াস, তাহলে পুরা ঘটনাটা বলতে পারি।’

আমাদের সবার চাপাচাপিতে যৌথ কফি বানিয়ে আনল। ভাইয়া কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘শোন তবে, তোরা তো জানিস আমার একটা ভাঙা মোটরসাইকেল আছে, আর সেটা নিয়ে সারা রাজশাহী জেলা ঘুরে বেড়াই আমি, তো একদিন ভোরে বেরিয়েছি, নাটোরের দিকে যাব, দেখি চাকায় হাওয়া নাই, রাস্তার পাশে রকিবের গ্যারেজে নিয়ে গেছি হাওয়া দিতে, রকিব চাকায় পাম্প করছে, সেই ফাঁকে আমি রাস্তার পাশের টং দোকান থেকে এক কাপ খাঁটি গরুর দুধের চা নিয়ে আরাম করে চুমুক দিয়েছি...’

অর্ণব ভাইয়ার ধান ভানতে শিবের গীত শুনে সুরভি তো মহা খাপ্পা হয়ে বলল, ‘আচ্ছা, ভাইয়া আমরা কি তোমার ভাঙা মোটরসাইকেলের গল্প শুনতে বসছি?’

যুক্ত বলল, ‘কাম অন ভাইয়া, আসল গল্পে আসো…’

‘আহা, একটুও ধৈর্য নেই তোদের? বলছি, বাবা শোন, চায়ে শুধু চুমুক দিয়েছি, হঠাৎ দেখি সামনের রাস্তা ধরে হনহন করে একটা মেয়ে লম্বা পা ফেলে হেঁটে আসছে, চোখে বড় কালো চশমা, মাথায় স্কার্ফ বাঁধা, পরনে কালো শার্ট কালো প্যান্ট, পায়ে কালো কেডস মেয়েটা সটান এসে দাঁড়িয়ে পড়ল আমার সামনে, তারপর এক টুকরা কাগজ সামনে বাড়িয়ে বলল, ‘ক্যান ইউ টেল মি হয়ার ইজ দিস লোকেশন?’ আমি তো বুঝতেই পারছিস একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম, হাত থেকে গরম চায়ের কাপ ছলকে পড়ে শার্ট–প্যান্ট প্রায় ভিজে একাকার, মেয়েটা বুঝল ওর আচমকা প্রশ্নেই আমার এই অবস্থা, সে সরি সরি বলে অস্থির…।’

ভাইয়ার তখনকার বেচারা মার্কা অবস্থাটা কল্পনা করে আমাদের খুব হাসি পেল। কিন্তু হাসলাম না। জানতে চাইলাম, ‘তারপর?’

‘না, ইয়ে...তারপর আর কী? আমি বললাম, নো প্রবলেম, ওকে, ওকে। এরপর ওর হাত থেকে ওই কাগজটা নিলাম। পুরোনো লালচে একটা কাগজ। তাতে ইংরেজিতে লেখা আছে, রামচন্দ্রপুর কুঠি, রাজশাহী।

‘সে তো বহুদূর, ভেরি ভেরি ফার অ্যাওয়ে, আমার ইংরেজির দৌড় তো জানিস, সেই ভাঙা ইংরেজিতেই বললাম। বিদেশিনী বলল, ‘যত দূরেই হোক, আমি একবার সেখানে যেতে চাই। নিয়ে যেতে পারবে?’

হাত থেকে গরম চায়ের কাপ ছলকে পড়ে শার্ট–প্যান্ট প্রায় ভিজে একাকার, মেয়েটা বুঝল ওর আচমকা প্রশ্নেই আমার এই অবস্থা

‘কেন পারব না? তবে কিনা, আমার মোটরসাইকেলে চড়তে হবে তোমাকে, তাহলে ধরো আধা ঘণ্টায় নিয়ে যেতে পারব। যদি রাজি হও।’

রাজি, বিদেশিনী মাথা ঝাঁকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল হ্যান্ডশেকের জন্য, ‘আই অ্যাম এমা…’

ততক্ষণে চাকায় হাওয়া দেওয়া শেষ। এমাকে নিজের পরিচয় দিলাম। তারপর মোটরসাইকেলের পেছনে তুলে নিয়ে রওনা দিলাম রামচন্দ্রপুর কুঠিবাড়ির পথে, তখনো কিন্তু চিনি নাই এমাকে, মানে ও যে সেই বিখ্যাত অভিনেত্রী এমা, তা বুঝি নাই। ভাঙাচোরা রাস্তার দিকে সতর্ক চোখ রেখে চিত্কার করে জানতে চাইলাম, ‘হোয়াই আর ইউ গোয়িং, কেন যেতে চাচ্ছ ওখানে?’

ও ইংরেজিতে হড়বড় করে অনেক কিছু বলল, আমি শুধু বুঝলাম, টু ফাইন্ড দ্য বোন অব মাই অ্যানসেস্টর, মানে আমার পূর্বপুরুষের হাড্ডিগুড্ডি খুঁজতে…

মানে কী? আমি ওর কথার অর্থ বুঝি না, এমা তখন যা বলে তা থেকে আমি বুঝলাম যে, ওর দাদার বাবা জন ডুরহাম ওয়াটসন ১৮৯০ সালে ব্রিটেন থেকে রাজশাহীর রামচন্দ্রপুর এসেছিল চাকরি করতে, তারপর এ দেশেই মারা যান। মৃত্যুর আগে নিজের ছেলে মানে এমার দাদাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন জন ডুরহাম ওয়াটসন। সেই চিঠিতে রামচন্দ্রপুর কুঠিতে একটা গুপ্তঘরের কথা বলেছিলেন তিনি, সেই গুপ্তঘরে তাঁর কফিনে ছেলের জন্য একটা উপহার রেখে যাচ্ছেন, সে কথাও লিখেছিলেন ওয়াটসন। জনের ছেলে শেন বা শেনের ছেলে মানে এমার বাবা ক্রিস ওয়াটসন কেউই আসতে পারেননি বাংলাদেশে। বাবার মুখে গল্প শুনে ১২০ বছর পরে এমা ঠিকই এসেছে তার পূর্বপুরুষের খোঁজে।

ফাঁকা রাস্তায় মোটরসাইকেল এগিয়ে যাচ্ছে সাঁই সাঁই করে। কুঠিবাড়ির সড়ক ধরে ডানে মোড় নিয়ে রামচন্দ্রপুরের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।

এমা তখন বলল, বুড়া ওয়াটসন একটা দেশি কুকুর পুষত, নাম ব্যাগা, সেটাও নাকি চিঠিতে লেখা ছিল। আমি বুঝলাম বাঘা নামটাই ব্রিটিশ উচ্চারণে ব্যাগা হয়ে গেছে। কিন্তু আমার মনে তখন চিন্তা, রামচন্দ্রপুর কুঠির সেই গুপ্তঘর আদৌ খুঁজে পাব কি না। এত পুরোনো দালান, তার কতটুকুই বা অবশিষ্ট আছে কে জানে?

তবে সেই চিন্তার কথা আর এমাকে জানালাম না। বেচারা এত দূরের দেশ থেকে আশা নিয়ে এসেছে। রামচন্দ্রপুর বাজারে মোটরসাইকেল থামিয়ে এক দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম, কুঠিবাড়িটা কত দূর? কীভাবে যাব?’

দোকানি কিছুক্ষণ চোখ বড় বড় করে এমার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, ‘এই মাটির রাস্তা ধরে কিছুক্ষণ গিয়ে একটা ব্রিজ পাবেন, তারপর বাঁয়ে আলপথ ধরে কিছুটা এগোলে পথে পড়বে জোড়া তালগাছ, সেই তালগাছ পার হয়ে পাবেন একটা মজা পুকুর, সেই পুকুরের পাশে একটা জংলামতো জায়গা, তার পেছনে ভাঙাচোরা কুঠিবাড়ি। তবে কিছু তো পাবেন না সেখানে, শুধু কখানা আধভাঙা ইটের দেয়াল পড়ে আছে…’

আমি আর কিছুই শুনলাম না, এমাকে নিয়ে মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিলাম। লোকটা যেমন যেমন বলেছিল, তেমন তেমন করেই ব্রিজ, জোড়া তালগাছ আর মজা পুকুর পার হয়ে সামনে এগোতেই চোখে পড়ল রামচন্দ্রপুর কুঠিবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। লাল ইটের কয়েকটা ভাঙা দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। ভাঙা দেয়ালের ফাঁকফোকরে বটের চারা গজিয়ে উঠেছে। এই ভাঙা বাড়িতে কী আর পাওয়া যাবে, ভেবে হতাশ লাগে আমার। এমা দেখলাম দেয়ালের ইটগুলোকে ধরে ধরে দেখছে। হয়তো ভাবছে, সিনেমায় যেমন হয়, কোনো একটা বিশেষ ইটে চাপ দিলে গুপ্ত কুঠুরির দরজা খুলে যায়, তেমন কিছু ঘটবে। কিন্তু কোথায় কী? আমিও ভেবে পাচ্ছিলাম না কী করব? এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে যেন ছুটে এল একটা লাল–সাদা রঙের দেশি কুকুর। এসেই এমার পায়ের কাছে ঘেউ ঘেউ করা শুরু করল। আমি একটু চমকে গিয়ে ‘হ্যাট হ্যাট’ করে কুকুরটা তাড়াতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু এমা দিব্যি হাসিমুখে নিচু হয়ে কুকুরটার মাথায়–গলায় হাত বোলাতে শুরু করল। আর কী আশ্চর্য, কুকুরটাও ঘেউ ঘেউয়ের বদলে নরম গলায় কেঁউ কেঁউ করতে শুরু করল। আমি একটু ভয় পেয়ে বললাম, ‘হেই এমা, বি কেয়ারফুল, তোমাকে কামড়ে দিতে পারে।’ এমা আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল, বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে, আমি যেমন ওয়াটসন বংশের মানুষ, তেমনি ও হচ্ছে ব্যাগার বংশের কুকুর…’

‘ব্যাগা নয়, ওটা বাঘা।’ আমি ঠিক করে দিই। কিন্তু কিসের কী? এমা আগের মতোই ‘ব্যাগা’ ‘কিউট ব্যাগা’ বলে কুকুরটাকে আদর করতে থাকে। কুকুরটাও দেখি একদম কেঁউ কেঁউ করে চোখ বুজে লেজ নাড়াতে শুরু করল। আমি এবার বললাম, ‘গুপ্তঘরটা খুঁজে বের করা দরকার, কিন্তু কীভাবে? কিছুই তো বুঝতে পারছি না...’

এমা কুকুরটার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘ব্যাগা ডু ইউ নো হয়ার ইজ মিস্টার ওয়াটসনস সিক্রেট কেবিন?’

কুকুরটা এমার মুখের দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। এমা বলল, ‘প্লিজ শো মি সুইট হার্ট, প্লিজ কাম অন…’

এমার পাগলামি দেখে আমার তো আক্কেলগুড়ুম। এ বলে কী? কুকুর কি আর ওর ভাষা বুঝবে? নাকি কুকুর জানে কোথায় সেই গুপ্তঘর? এমা কিন্তু আগের মতোই কুকুরটাকে অনুরোধ করতে থাকে, ‘হেল্প মি ডিয়ার, প্লিজ শো মি…’

বুঝলাম ভালো পাগলের পাল্লাতেই পড়েছি। এমা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ধৈর্য ধরো, ব্যাগা ঠিকই আমাকে পথ দেখাবে।’

কোথায় কী? খানিকক্ষণ পরে দেখি কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে দুবার চিত্কার করে ছুটে পালাল ভাঙা দেয়ালের পেছনে। এমা বলল, ‘লেটস ফলো হিম…’

কী আর করা, পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে। এমার কথামতো কুকুরটাকে ফলো করলাম। দু–তিনবার কুঠিবাড়ি চক্কর দিল ‘ব্যাগা’। তারপর কুঠিবাড়ির পেছন দিকে, যেখানটায় একটা আশশেওড়া গাছের ছায়া পড়ে প্রায় অন্ধকার হয়ে আছে, বোঝাই যাচ্ছে কেউ ওদিকটায় পা মাড়ায় না, ঝরাপাতা আর ময়লা–আবর্জনা জমে আছে, সেখানটায় গিয়ে ব্যাগা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করল, তারপর সামনের দুই পা এক সাথে করে সমানে মাটি খামচে একটা গর্ত বানিয়ে ফেলল। এমা বলল, ‘প্লিজ হেল্প হিম, এখানেই আছে…’ পাশেই পড়ে থাকা একটা গাছের শুকনো ডাল তুলে নিল ও। তারপর ব্যাগার সাথে মাটি খুঁড়তে শুরু করল। আমি আর বসে থাকি কীভাবে? আশপাশে ঘুরে একটা ভাঙা লোহার ফলা পেয়ে গেলাম। তারপর চলল আমাদের অক্লান্ত খোঁড়াখুঁড়ি। বেশ অনেকটা খুঁড়েও যখন কিছুই পেলাম না, তখন হাল ছেড়ে দিলাম আমি। এমাকে বললাম, ‘অনেক হয়েছে, চলো ফিরে যাই। তুমি একটা মিথ্যা গল্পের পেছনে ঘুরছ।’

এমার ঠোঁটের ওপর ঘাম জমেছে। চোখে কালো সানগ্লাস নেই। মাথা থেকে স্কার্ফ সরে সোনালি চুল বেরিয়ে পড়েছে।

এমার ঠোঁটের ওপর ঘাম জমেছে। চোখে কালো সানগ্লাস নেই। মাথা থেকে স্কার্ফ সরে সোনালি চুল বেরিয়ে পড়েছে। তবু সে খোঁড়া বন্ধ করল না।

আমি বললাম, ‘বাই দ্য ওয়ে তুমি দেখতে কিন্তু একদম হ্যারি পটারের হারমাইওনের মতো।’

এমা একটু হেসে বলল, ‘ওই চরিত্রটা ছোটবেলায় আমিই করতাম।’

এবার তো আমার আক্কেলগুড়ুম। বলে কী মেয়েটা। এ কি সত্যিই এমা ওয়াটসন? আমি কি স্বপ্ন দেখছি? নাকি ও মজা করছে?

কী বলব বুঝতে না পেরে আমার যখন বোবা হওয়ার অবস্থা, তখনই শুনি এমার কণ্ঠ, ‘লুক, সামথিং ইজ দেয়ার।’

এমার কথা শুনে এগিয়ে এলাম আমি। আবার কাজে হাত লাগালাম। ওপরের আলগা মাটিগুলো সরানোর পর দেখি সেখানে একটা ধাতব আংটা। তাড়াতাড়ি লোহার ফলাটা দিয়ে খুঁচিয়ে আরও মাটি সরালাম। ব্যাগা পাশে চুপচাপ বসে আছে। আংটাটা টানলাম, কিন্তু খুলল না। এমা বলল, আরও জোরে টানো…’

এবার দুজন মিলে সব শক্তি এক সাথে করে টান দিতেই একটা গর্তের মুখ খুলে গেল। গর্তের ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমি পকেট থেকে মোবাইল বের করে আলো ফেললাম, দেখি কী একটা সরু এবড়োখেবড়ো সিঁড়ি নেমে গেছে গর্তের ভেতরে। এমা চিত্কার করে উঠল, ‘ইয়েস, হেয়ার ইজ দ্য সিক্রেট কেবিন। লেটস গো...’

গো তো করতেই চাই কিন্তু করা তো সম্ভব নয়। এমাকে থামিয়ে বললাম, ‘এত তাড়াহুড়ো করো না, এত দিনের বন্ধ গর্ত, বিষাক্ত গ্যাস জমা হতে পারে। তা ছাড়া কেমন সরু পথ দেখেছ, এর মধ্যে তো একটা বাচ্চা শিশুরও নামতে কষ্ট হবে, তুমি বা আমি নামব কীভাবে?’

আমার কথায় হুঁশ হয় এমার। সত্যিই তো এই এক হাত পরিমাণ পথ দিয়ে কোনো মানুষের নিচে নামা সম্ভব হবে না। এমা বলল, ‘তাহলে তো আরও খুঁড়ে গর্তের মুখটা বড় করতে হবে। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?’

এবার তাকে বেশ হতাশ দেখায়। হাতে–পায়ে কাদা, ক্লান্ত, শ্রান্ত, কাঁদো কাঁদো মুখ। স্বাভাবিক, তীরে এসে তরি ডোবার মতো অবস্থায় পড়েছে ও। আমিও এখন কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। এমন সময় আমাদের অবাক করে এমার কুকুর ব্যাগা লাফ দিয়ে গর্তের মধ্যে নেমে গেল। তাড়াতাড়ি মোবাইলের সার্চলাইট জ্বালালাম, কিন্তু ব্যাগাকে দেখতে পেলাম না। এমা গর্তের কাছে মুখ দিয়ে ‘ব্যাগা, ব্যাগা মাই ডিয়ার, কাম আপ, কাম আপ বেবি’ বলে ডাকতে শুরু করল। আর তার একটু পরেই লাফ দিয়ে ব্যাগা বেরিয়ে এল, আর বললে বিশ্বাস করবি না, দেখি কী ব্যাগার মুখে একটা সাদা লম্বা মানুষের পায়ের হাড়। হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে গর্ত থেকে উঠেই মুখ থেকে হাড়টা এমার পায়ের কাছে ফেলে দিল ব্যাগা।

‘ওয়াও, দ্য বোন অব মিস্টার ওয়াটসন।’

হাড়টা কুড়িয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল এমা। ব্যাগা যথারীতি ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। এমা তো ব্যাগাকে জড়িয়ে ধরে ‘থ্যাংক ইউ বেবি, গুড ডগ, থ্যাংক ইউ’ বলতে থাকল।

আর সেই সময়ই শুনি কারা যেন কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে। ব্যাগাও দেখলাম কান খাড়া করে ঘেউ ঘেউ শুরু করল। এমা দ্রুত চোখে কালো চশমা পরে মাথাটা স্কার্ফে মুড়ে নিল। হাড়টা ঢুকিয়ে ফেলল ব্যাগে। আমি একঝটকায় গর্তটার মুখে আংটাওয়ালা দরজাটা বসিয়ে দিয়ে যতটা পারি মাটি দিয়ে গর্তটা বুজিয়ে দিলাম। এরই মধ্যে দেখি কয়েকজন মানুষ নিয়ে রামচন্দ্রপুর হাটের সেই দোকানি এসে উপস্থিত। একজন বুড়োমতো লোক আমাদের কাছে এসে বলল, ‘কুন্টে থেকে আসিচ্ছো তুমরা বাপু? এই বেটি ছাওয়াল কে হন?’

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘উনি বিলাত থেকে এসেছেন এই কুঠিবাড়ি দেখতে। দেখা শেষ, এখন আমরা চলে যাব। এমা চলো।’

শুনতে পেলাম লোকগুলো বলাবলি করছে, ‘পুলিশ কি একেই খুঁজিচ্ছে নাকি বে, কলো যে বিদেশি মেয়া হারায় গেছে...’

‘না না উনাকে কেন খুঁজবে? উনাকে না...’

বলে আমি ওদের সামনে থেকে এমাকে প্রায় টেনে নিয়ে মোটরসাইকেলে উঠে গেলাম। এমা বলল, ‘বাট, হোয়ার ইজ ব্যাগা?’

লোকগুলো আসার সঙ্গে সঙ্গেই কুকুরটা দৌড়ে চলে গিয়েছিল আমি দেখেছিলাম, তাই বললাম, ‘পরে ওর খোঁজ করব এখন তাড়াতাড়ি চলো। শুনছ না তোমাকে খুঁজতে পুলিশ বেরিয়ে গেছে।’

জোড়া তালগাছ পেরিয়ে হাট ছাড়িয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে মূল রাস্তায় ওঠার পর এমা বলল, ‘আই অ্যাম সো হাংরি, কিছু না খেলে মনে হচ্ছে মরে যাব।’

আমি তো পড়লাম মহাবিপদে। একে এখন কী খাওয়াই? হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশে একটা কালাই–রুটির দোকান। এমাকে বললাম, ‘কালাই–রুটি খাবা?’

এমা বলল, ‘যাই দেও তাই খাব। হাতি দিলে হাতি খেয়ে ফেলতে পারব।’

মোটরসাইকেল থামিয়ে গরম গরম কালাই–রুটি আর বেগুনভর্তার অর্ডার দিলাম। এমা প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই রুটি খেল। বলল, ‘দারুণ টেস্ট।’

‘পুলিশ কি একেই খুঁজিচ্ছে নাকি বে, কলো যে বিদেশি মেয়া হারায় গেছে...’

ব্যাগার জন্য খুব মায়া হচ্ছে, সেটাও বলল ও। তারপর ব্যাগ থেকে হাড়টা বের করে দেখল কিছুক্ষণ। বলল, ‘উপহারটা পেলাম না। কে জানে বুড়ো ওয়াটসন কী উপহার রেখে গেছিল? যাকগে যা পেয়েছি তাতেই চলবে, বেচারা ব্যাগা, তুমি কিন্তু ওর খোঁজ রাখবে। গুড ডগ।’

আমি এমাকে তাড়া দিয়ে বললাম, ‘চলো চলো, তোমাকে হোটেলে রেখে আসি। তুমি যদি সত্যিই এমা ওয়াটসন হও তাহলে তো তোমার খোঁজে সারা রাজশাহী এতক্ষণে তোলপাড় হয়ে গেছে।’

‘হুম, চলো।’

এমা তাড়াতাড়ি হাড়টা ওর ব্যাগে ঢোকাতে গিয়েই ঘটল বিপত্তি। হাড়টা ছিটকে পড়ল মেঝেতে। আর কী আশ্চর্য ওটা ভেঙে দুই টুকরা হয়ে গেল।

‘ওহ মাই গড। কী হলো এটা?’ এমা চিত্কার করে উঠল। আমি হাড়টা তুলতে গিয়ে দেখি হাড়ের ভেতরটা ফাঁপা, আর সেই ফাঁপা অংশ থেকে বেরিয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে কয়েকটা ঝকঝকে পাথর।

এমা পাথরগুলো নিয়ে ঘুরিয়ে দেখে বলল, ‘দিজ আর ডায়মন্ড, অর্ণব, এইতো বুড়ো ওয়াটসনের উপহার।’

আমি ওর হাত থেকে পাথরগুলো নিয়ে দেখছি, এমন সময় সাঁই সাঁই করে কয়েকটা পুলিশের গাড়ি এসে থামল দোকানের সামনের রাস্তায়, আর মুহূর্তের মধ্যেই পঁচিশ–তিরিশজন পুলিশ এসে পুরো রুটির দোকান ঘিরে ফেলল। দুজন পুলিশ আমার দিকে বন্দুক তাক করে বলল, ‘হ্যান্ডসআপ।’

কয়েকজন সাদা চামড়ার লোক দৌড়ে এসে এমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে গেল। বুঝলাম, এরা সবাই এমার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বেচারাদের ঘাম ছুটে গেছে এমাকে খুঁজতে খুঁজতে। পুলিশ তো ভেবে বসল আমি কিডন্যাপার। এমাকে কিডন্যাপ করে বড় অঙ্কের মুক্তিপণ আদায়ের ধান্দা করছি। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে এমা পুলিশকে বোঝাতে পারল যে সে স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে গিয়েছিল।

যা–ই হোক, পরদিনই এমা ফিরে গিয়েছিল ওর দেশে। আমাকে বারবার করে বলে গিয়েছিল যেন ওর ব্যাগার খবর রাখি।

‘খবর রেখেছিলে?’ আমরা জানতে চাই।

‘রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জানিস রামচন্দ্রপুর তন্নতন্ন করে খুঁজেও ওই লাল–সাদা রঙের কুকুরটাকে খুঁজে পাইনি আমি।’

অর্ণব ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। সুরমা বলে, ‘তাহলে কি ওটা ওয়াটসনের সেই বাঘা কুকুরের প্রেতাত্মা ছিল?’

অর্ণব ভাইয়া চলে যেতে যেতে বলল, ‘কী জানি?’