দিন দুয়েক আগে কোরবানির ঈদ গেছে, কিন্তু ছুটির আমেজ কাটেনি। রাজধানীর বাইরে ঈদ করতে যাওয়া মানুষ ফিরতে শুরু করেনি। তাই ঢাকা এখনো বেশ ফাঁকা। রাস্তায় বেরোলে রাজধানীকে চেনা যায় না।
আজ সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টি হয়েছে। তবে আকাশ পরিষ্কার হয়নি। এখন ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। থেমে থেমে বইছে হিমেল হাওয়া।
ফার্মগেটের পদসেতুর সিঁড়িতে পা রেখে মনটা দুরু দুরু করে নিসারের। তাকে ঠিক ভিতু বলা যাবে না। কিন্তু ঠ্যাকবাজের খপ্পরে পড়লে সাহস দেখানো কোনো কারণ নেই। এক পা-দু পা করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে সে। রাত খুব বেশি হয়নি। ১০টার মতো বাজে। এ সময় পদসেতুতে একটা মানুষও থাকবে না—এটা কেমন কথা!
নিসারের ডানহাতের তিনটা আঙুলে এক ডজন চাঁপাকলা ঝুলছে। খানিক আগে ফুটপাত থেকে কিনেছে। ঝুলন্ত কলার সরু দড়িতে আঙুলগুলো আলগোছে শক্ত হয়ে চেপে বসে। মনে মনে দোয়া ইউনুস আওড়ে সেতুর ওপরে ওঠে সে। চাতাল একদম ধু ধু। আধো আঁধার, হিমেল বাতাস, ক্ষণে ক্ষণে বিজলির চমক—সব মিলিয়ে গা ছমছমে পরিবেশ।
সেতুর ডান দিকে যে শাখাটা গেছে, ওখানে কেউ ঘাপটি মেরে আছে নাকি? সন্দেহটা খচমচ করে নিসারের মনে। কাছে গিয়ে পৌঁছাতেই মনে হয়, এক্ষুনি কেউ ছুরি নিয়ে লাফ দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে। আগ্নেয়াস্ত্র থাকতে পারে। বুকে ঠেকিয়ে বলবে, ‘যা আছে, দিয়া দে!’
সন্দেহটা সত্যি হতে সময় লাগে না। সামনে লাফ মেরে দাঁড়ায় একটা কায়া। বাজখাঁই গলায় বলে, ‘এই, থাম!’
নিসার জমে যায়। পা কাঁপছে তার। কিন্তু এ তো ছিনতাইকারীর মতো নয়। মাথায় উষ্কখুষ্ক লম্বা চুল, দুর্গন্ধে ভরা ছেঁড়া পোশাক।
হেঁড়ে গলায় হাঁকে সে, ‘এই, তোর হাতে কী রে? ও কলা। দে, একখান কলা দে।’
নিসার সঙ্গে সঙ্গে একটা কলা ছিঁড়ে দেয় তাকে। অমনি কতকত করে সাবাড় করে সে। এর মধ্যে বোঝা সারা—এই ব্যাটার স্ক্রু ঢিলা। অবশ্য ভাবের পাগলও হতে পারে। কত রকম ধান্দাবাজিই তো চলছে!
সাহস ফিরে আসে নিসারের। অন্তত শক্তিতে এই পারবে না আলুথালু। পা বাড়াতে যাবে, অমনি আবার হাত বাড়ায় উটকো ফ্যাচাং।
‘আরেকটা কলা দে।’
বিরক্ত হলেও আরেকটা দেয় নিসার। ভাবে, পাগলকিসিমের মানুষ, খাক না। নিমেষে কলাটা কতকত করে হাওয়া।
আবার হাত বাড়ায় লোকটা, ‘দে, কলা দে!’
চোঁ করে চাঁদি গরম হয়ে যায় নিসারের। ফেটে পড়ে সে, ‘কলা তোর গলা দিয়ে দেব! যাবি, না লাথি মেরে ফেলব নিচে!’
নিসারের বেপরোয়া ভাব দেখে ভড়কে যায় আলুথালু বেশ। লাফ দিয়ে পিছিয়ে যায় দু-কদম। এই সুযোগে দ্রুত পা চালায় নিসার। পেছন থেকে চিৎকার আসে, ‘ওই কলা খাইতে পারবি না। ভূতের বাপে খাইব তোর কলা!’
গায়ের রোম সব ফড়ফড়িয়ে দাঁড়িয়ে যায় নিসারের। আরও জোরে পা চালায় সে।
সেতুর গোড়ায় রিকশা আছে দুটো। একটাও যাবে না। অগত্যা শরীরটাকে দুই পায়ের ওপর ছেড়ে দেয় ও।
হেঁটেই শাহীনবাগের বাসায় চলে আসে নিসার। দারোয়ান ঝিমোচ্ছে। এ বাসায় দুজন দারোয়ান। দুই ঈদে পালা করে ছুটি কাটায় তারা। একজন যায়, একজন থাকে। বাড়িওয়ালার কল্যাণে এই দারোয়ান ভালোই গরুর মাংস পেয়েছে। এখন মাংস খায়, আর ঝিমায়। খানিক পর পর শরীর মুচড়ে জলহস্তীর মতো হাই তোলে।
বুকের ভেতর কষ্ট চিনচিন করে নিসারের। এখনো কোরবানির গরুর একটা হাড্ডিও চুষতে পারল না! একটা জরুরি কাজের উছিলায় সওদাগরি অফিসের বস ওকে আটকে দিয়েছেন। টিভি চ্যানেলের খবরে বলেছে, এবার ৬৫ লাখ মানুষ ঈদের ছুটিতে ঢাকা ছেড়েছে। কেবল তার কপালে খেংরাকাঠি। তবে বউ আর তিন বাচ্চাকে টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। ফেরার সময় নিয়ে আসবে কোরবানির মাংস। বউটা যে ভুলোমনা, মাংসের হাঁড়িটা বাসের ভেতর ফেলে না এলে হয়! একবার এমন হয়েছিল।
নিসারের উল্টো দিকের ফ্ল্যাটের সাইদুল হকও ঈদে বাড়ি যায়নি। সে-ও বউ-বাচ্চা পাঠিয়ে দিয়েছে। সাইদুল অবশ্য স্বাধীন। ব্যবসা করে। কী কারণে যায়নি, তা সে-ই জানে।
ফ্ল্যাটের দরজা খোলার সময় সাইদুলের সঙ্গে দেখা হয়।
‘কী ভাই, ফিরলেন?’ কলার দিকে দৃষ্টি সাইদুলের।
‘হ্যাঁ, কলা খাবেন?’
‘দিন দুটো?’
দুটো কলা ছিঁড়ে নিসার মনে মনে বলে, ‘এরা দেখছি কলা খেতে দেবে না।’
নিসারের চেহারা দেখে সাইদুল কী ভাবল, জানতে চাইল, ‘ভাইয়ের মুখটা শুকনা ক্যান?’
একটু হকচকিয়ে যায় নিসার। বলবে না বলবে না করেও শেষে ফার্মগেটের পদসেতুর ঘটনাটা বলে ফেলে।
সাইদুল বিজ্ঞের মতো বলে, ‘অল্পের জন্য বাঁইচা গেছেন, ভাই। খারাপ কিছুর পাল্লায় যে পড়েন নাই, আল্লাহর কাছে শোকরিয়া করেন।’
‘ছিনতাইকারীর কথা বলছেন?’
‘না মানে, অন্য কিছুও তো হইতে পারত।’
‘কী রকম?’
‘এই ধরেন, আমার ভাইগনার ঘটনাটা। রাত করে এ রকম নির্জন ওভারব্রিজ দিয়া আসতেছে, হঠাৎ এক বাচ্চা পোলা টাকা চাইল। ছেলেটা একেবারে নাছোড়। ভাইগনার তাড়া ছিল। সে বলল পরে দেবে।’
এই বলে থামল সাইদুল। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিসার একটা ঢোঁক গিলে বলল, ‘তারপর?’
‘রাইত দুইটার সময় দরজায় ঠকঠক। ভাইগনা দরজা খুলে দেখে সেই ছেলেটা দাঁড়ানো!’
‘এ্যাঁ, কী বলেন!’
‘এইটা আমার ভাইগনার মুখ থেকে শোনা। সত্য-মিথ্যা জানি না।’
এই বলে নিজের ফ্ল্যাটে ঢোকে সাইদুল। নিসারের ভেতরটাও কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। ফ্ল্যাটে ঢুকে সব ঘরে আলো জ্বালে সে। শুধু ডাইনিং স্পেস বাদ থাকে। বাল্ব নষ্ট। আনতে মনে নেই। অবশ্য পাশের ঘর থেকে হালকা আলো আসছে।
ডাইনিং স্পেসের দেয়ালে ক্যালেন্ডারের হুকের সঙ্গে কলাগুলো ঝুলিয়ে রাখে নিসার। মনের ভেতর এলোপাতাড়ি চিন্তা সব ঠেলে বাথরুমে ঢোকে সে। রান্নাবান্নায় বেজায় আলসেমি আছে তার। হাতমুখ ধুয়ে কলা আর টেবিলে রাখা পাউরুটি খেয়ে শুয়ে পড়বে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে চুল আঁচড়ে নেয় নিসার। এমন সময় দরজায় টোকা। বুকটা ধড়াস করে ওঠে নিসারের। সারা বাড়ি তো সুনসান। কে এল?
টোকা পড়তেই থাকে—টুক টুক, টুক টুক। কিন্তু পা সরে না নিসারের। কেবলই মনে হচ্ছে, দরজা খুললে স্যাঁৎ করে লম্বা একটা হাত সেঁধোবে। বাজখাঁই গলায় শোনা যাবে, ‘দে, কলা দে!’
এটা হরর সিরিয়াল দেখার কুফল। বউ বারবার বারণ করে, তবু দেখে। দেখবে না দেখবে না করেও কীভাবে যেন দেখা হয়ে যায়। আরও একবার পণ করে সে, এসব ছাতামাথা আর দেখবে না।
নিসার দূর থেকে শুকনা গলায় বলে, ‘কে?’
মিনমিনে জবাব আসে, ‘আমি সাইদুল হক।’
ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে আসে। দরজা খোলে নিসার। সাইদুল হক তার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বলে, ‘মুখটা এমন ক্যান, ভাই? বিরক্ত করলাম?’
হকচকিয়ে যায় নিসার। জবাব দেয় না।
সাইদুল হক বলে, ‘রাতে এক বন্ধুর বাসায় থাকব। বিল্ডিং তো ফাঁকা। একটু খেয়াল রাখবেন, ভাই। আর সাবধানে থাকবেন। আয়াতুল কুরসি জানেন?’
শুকনা গলায় ঢোঁক গেলে নিসার। বিদায় নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোয় সাইদুল। দরজা বন্ধ করে ডাইনিং স্পেসে চলে আসে নিসার। কলার সামনে গিয়ে সে থ। দুই দুই করে চারটে কলা চলে যাওয়ার পর আছে আটখান। সেই আটটার একটা খুবলে খাওয়া। এমন করে কলা খেল কে?
ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে নিসার। মাথার ভেতর একশটা লাটিম যেন ঘুরছে বোঁ বোঁ করে। এমন সময় বেজে ওঠে মুঠোফোন। হাত বাড়াতে ভয় হয়। মনে হয়, মুঠোফোন কানে ঠেকালেই শোনা যাবে, ‘কইছিলাম না, ভূতের বাপে খাইব তোর কলা...!’
কিন্তু মুঠোফোনের স্ক্রিনে বউয়ের নাম। কানে ঠেকাতেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত কণ্ঠ শোনা যায়, ‘তোমারে একটা কথা বলতে বারবার ভুইলা যাই। বাসায় কোত্থিকা একটা চামচিকা আসে। খুঁইজা পাই না। খাবারটাবার একটু সাবধানে রাইখো।’
ঠিক এ সময় একটা চামচিকা এসে আরেকটা কলার ওপর বসল।
অলংকরণঃ ষুভ