কলের কান্না

একটা বাসায় ছিল একটা ছোট্ট পানির কল। তার বয়স খুবই কম। মাত্র এক মাস হলো এসেছে এই বাসায়। সে থাকে একটা ছোট্ট বেসিনে। তার কাজ হলো, কেউ মাথা ধরে মোচড় দিলে পানি দেওয়া। কম মোচড় দিলে সে কম পানি দেয়, বেশি মোচড় দিলে বেশি পানি দেয়।

তার আব্বু আর আম্মুও এই বাসায় আছে প্রায় ১২ বছর হলো। এই কলটার আবার একটা বোন আছে। নাম নেলি। সে তার পাশের বেসিনেই পানি দিয়ে যাচ্ছে দুই বছর হয়।

এই পানির কলটা সবার ছোট। তাই তাকে বসানো হয়েছে বাসার ছোট্ট মেয়েটার বাথরুমের ছোট্ট বেসিনে। এই বেসিন কেউ খুব একটা ব্যবহারই করে না। শুধু বাসার ছোট মেয়েটা সকালবেলা এসে দাঁত মাজে একবার করে। যদিও তার আম্মু বলে দিয়েছে রাতেও একবার করে দাঁত মাজতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সে শুধু সকালে একবার দাঁত মাজে। আর সেটাও খুব হেলাফেলা করে। আর এমনিতে মেয়েটা সারা দিনই চকলেট খায়। তাই যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। কালকে শোনা গেল তার নাকি দাঁতে ব্যথা করছে। তাকে নিয়ে তার আম্মু দাঁতের ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে।

যেদিন এই কলটাকে বাজার থেকে কিনে আনা হলো, সেদিনটার কথা তার স্পষ্ট মনে আছে। খুব ভয় পেয়েছিল সে। কার বাসায় যাচ্ছে, সেখানকার লোকজন কেমন, এসব নিয়ে তার চিন্তা হচ্ছিল খুব। নতুন এই বেসিনে যখন বসানো হলো তাকে, তখন প্রথমবার তার মাথায় মোচড় দিয়ে পানি বের করার সময় খুব ব্যথা লেগেছিল। এমনই ব্যথা যে একেবারে চোখে পানি চলে এসেছিল।

ছোট্ট মেয়েটার বেসিনে বলে তার তেমন কোনো কাজ নেই। সারা দিন বেসিনে চুপচাপ বসে থেকে থেকে তার আর ভালো লাগে না। সে যেখানে থাকে, সেখান থেকে আবার টিভিও দেখা যায় না যে অবসর টিভি দেখবে। এদিকে ১৫ দিন ধরে বাসার মেয়েটাও আর এই বেসিনে দাঁত মাজছে না। সে গেছে তার নানুর বাসায় বেড়াতে। এভাবে বসে থাকতে থাকতে পানির কলটার ভেতর একেবারে জং ধরে যেতে থাকল।

তারপর একদিন সকালে খুব হইচই। ছোট্ট মেয়েটা নানুর বাসা থেকে ফিরে এসেছে। এসেই সে কলটার মাথা ধরে দিল এক মোচড়। সেই মোচড়ে কলটা এমন ব্যথা পেল যে আর বলার না। তার চোখ ফেটে একেবারে টপটপ করে পানি চলে এল। কিন্তু ছোট হলেও কলটার তো মান-সম্মান বলে একটা কথা আছে। সে তো আর সবার সামনে বসে কাঁদতে পারে না। অনেক কষ্টে সে কান্না থামাল।

এদিকে কান্না থামার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা আরও জোরে মোচড় দিল কলটার মাথা ধরে। কী যে ব্যথা পেল কলটা। কিন্তু কলের ব্যথা বুঝতেই পারল না মেয়েটা। সে এবার হাত দিয়ে জোরে জোরে থাপ্পড় মারতে লাগল কলটার গায়ে। তাতেও কাজ হচ্ছে না দেখে মেয়েটা এবার ঘরের কোণে পড়ে থাকা একটা হাতুড়ি দিয়ে কলটাকে মারতে লাগল। এতটুকুন একটা কল। সে কি আর এত বড় হাতুড়ির ব্যথা সহ্য করতে পারে! সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল ব্যথা পেয়ে, চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল তার। কী যে ব্যথা! কী যে ব্যথা! সেই ব্যথায় তার কান্না আর থামেই না। সারা দিন ধরে সে কেঁদেই চলল আর চোখ দিয়ে পানি পড়তেই লাগল টপটপ করে। দিন শেষে রাতেও তার কান্না আর থামে না। তখনো সে কেঁদে চলল টপটপ করে।

কলটার কান্নার টপটপ আওয়াজ শুনে ছোট্ট মেয়েটার আব্বু আর আম্মু রাতে এল বেসিনে। তারা অনেক চেষ্টা করল কলটার কান্না থামানোর। নানাভাবে আদর করে দিল কিন্তু কোনো কাজ হলো না। হাতুড়ি দিয়ে এমন বাড়ি মারার পর কান্না কি থামে! কলটা ব্যথায় সারা রাত কেঁদেই চলল টপটপ, টপটপ, টপটপ...।

জেনে রাখা ভালো

মানুষের কান্না থামানোর জন্য যেমন আদর আর চকলেট দিলেই কাজ হয়, তেমনি কলের কান্না থামাতে কিন্তু এসব আদর আর চকলেটে কাজ হয় না। পানির কলের কান্না থামাতে দরকার হয় কলের ডাক্তারের, যাকে মানুষেরা পানির কলের মিস্ত্রি বলে ডাকে। তোমার বাসার বেসিনের কলও যদি এভাবে টপটপ করে কাঁদে, তবে তোমার আব্বু-আম্মুকে বলো পানির কলের মিস্ত্রি ডেকে আনতে।