কানমলা যেভাবে কানডলা হলো

‘দেখি, একখানা বহি দাও’—ক্লাসরুমে ঢুকেই হাঁক দিলেন সামাদ স্যার। পুরো নাম আবদুস সামাদ। আমাদের বাংলা পড়ান। ছাত্রদের মধ্যে যারা রোজকার পড়া শিখে না আসে, তাদের জন্যে বরাদ্দ ‘স্পেশাল কানমলা’। এই ব্যাপারটাকে তিনি রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। প্রথমে কানের লতিটাকে দুই আঙুলে ধরে অতি যত্নের সঙ্গে ভেজিটেবল রোলের মতো প্যাঁচান। তারপর এমনভাবে চাপ দিতে থাকেন, মনে হয় কান নিংড়ে তেল বের করাই তাঁর মূল লক্ষ্য। বাংলা ক্লাসের দুই ঘণ্টা পর স্কুল ছুটি হয়। ছুটির পরেও ছাত্রদের সিঁদুরে আমের মতো কানের লতি দেখে বলে দেওয়া যায় কে কে সামাদ স্যারের ক্লাসে পড়া পারেনি।

‘কই, একখানা বহি দাও’। বহি শব্দটার শেষে স্যার লম্বা করে টান দেন। যারা পড়া শিখে আসেনি, তারা সমস্বরে বলে ওঠে, স্যার, আজ কোনো পড়া ছিল না। স্যার ধমক লাগান, ‘দু...য়ো ব্যাটারা, বোকা পাইছনি আমারে?’ তারপর সামনের বেঞ্চে বসা মোমেন গনি তড়াক করে দাঁড়িয়ে ওর বাংলা বইটা এগিয়ে দেয়। বরাবর ও থার্ড বেঞ্চে বসে। বেচারা আজ পড়া শিখে আসেনি। তাই বুদ্ধি করে প্রথম বেঞ্চে বসেছে। স্যার সাধারণত পেছনের দিকে বসা ছাত্রদের ফাঁকিবাজ মনে করে ওদেরই পড়া ধরেন। মোমেনের দ্বিতীয় বুদ্ধিটা হচ্ছে হাসিমুখে পরম উৎসাহে স্যারের হাতে বইটা তুলে দেওয়া। স্যার যাতে স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেন, ও পড়াটা শিখে এসেছে, তাই অন্য কাউকে ধরা যাক। মোমেনের তৃতীয় বুদ্ধিটাও যে ছিল, সেটা আমরা টের পেলাম কিছুক্ষণ পরে।

স্যার বইটা হাতে নিয়েই বললেন, ‘এই তো সুবোধ ছেলে, নামটাও মোমেন। তোকে দিয়েই শুরু করি বাবা। বল আজকের পড়াটা—কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী।’

মোমেনের তখন কলে আটকা পড়া ইঁদুরের মতো অবস্থা। বেচারা দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করতে থাকে। স্যার হাসতে হাসতে বলেন, ‘ও, নাটকটা তো ভালোই করছ। এইবার পাইছি তোমারে।’ তারপর দুই আঙুলে মোমেনের বাঁ কানের লতিটা ধরে প্যাঁচাতে লাগলেন। এবার আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, স্যার নিজেই ভড়কে গেছেন। কানের লতিটাকে কিছুতেই বাগে আনতে পারছেন না। রোল পাকানোর আগেই কান পিছলে যাচ্ছে। তারপর স্যার ধরলেন ওর ডান কানটা। এখানেও একই অবস্থা। আঙুল পিছলে যাচ্ছে। মোমেন রোবটের মতো কান পেতে সটান দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে যেন গান গাইছে, ‘আমি কান পেতে রই’।

টঙ্গী পাইলট হাইস্কুলে সামাদ স্যারের সাত বছরের শিক্ষকতায় এমন কান ফসকানোর রেকর্ড আর নেই। এত বছর পর ক্লাস এইটের এই ছেলেটা তাকে টেক্কা মেরে দিচ্ছে! স্যার এটা কিছুতেই মানতে পারছেন না। এবার মোমেনের কান ছেড়ে তিনি নিজের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে তুড়ি বাজানোর চেষ্টা করলেন কয়েকবার। একবারও বাজল না। ‘ব্যাপারটা কী রে!’-স্যার নিজেকেই যেন প্রশ্নটা করলেন। তারপর আঙুল দুটি নাকের সামনে ধরে শুঁকতে লাগলেন। চোখ বন্ধ করে নিবিড় মনোযোগের সঙ্গে দু-তিনবার আঙুলের গন্ধ নিলেন। তারপর চোখ খুলে আর্কিমিডিসের মতো আবিষ্কারের আনন্দে ক্লাসের সবাইকে বললেন, ‘এইবার কারণটা ধরতে পারছি রে। এই বদমাশটা দুই কানেই ভ্যাসলিন মেখে এসেছে।’

স্যারের কথা শুনে পুরো ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়ল। পেছনের বেঞ্চে বসা কয়েকজন ফিসফাস করে যুক্তি করতে লাগল—আগামীকাল থেকে তারাও ভ্যাসলিন মেখে আসবে। কেউ গ্রিজ, কেউ মবিল মাখানোর ইচ্ছাও প্রকাশ করল। ক্লাসের পেছন দিকে ফিসফাস, গুঞ্জন শুনে স্যার আবার ধমক লাগান, ‘অ্যাই, পেছনে কথা...বলে কে রে?’ এটা তাঁর কমন ডায়ালগ। এই বাক্যেও ‘কথা’ শব্দটার শেষে তিনি লম্বা করে টান দেন।

স্যারের এক ধমকেই ক্লাস চুপ। এবার মোমেনকে তিনি বললেন, ‘তুমি থাক ডালে ডালে, আমি থাকি পাতায় পাতায়। কানমলা তোমাকে খেতেই হবে।’ এই বলে নিজের সার্টের একটা কোনা তুলতে লাগলেন মোমেনের কান প্যাঁচানোর উদ্দেশ্যে। আমি পাশেই বসা। কল্পনায় দেখতে পেলাম-বেচারা মোমেনের কানের লতিটা সাদা টিস্যু পেপারে মোড়ানো একটা ভেজিটেবল রোল হয়ে গেছে। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম-মোমেনটাকে বাঁচাতে হবে।

‘আস্তে স্যার, একটা কথা আছে।’ উঠে দাঁড়িয়ে বললাম আমি।

‘কেন রে ব্যাটা? তোর আবার কী কথা?’

‘স্যার, ভ্যাসলিন অতি তৈলাক্ত পদার্থ। আপনার সাদা শার্টে একবার যদি দাগ পড়ে, সহজে উঠবে না।’

‘বড়ই চিন্তার কথা।’ স্যার একটু থমকালেন।

‘আরও বড় চিন্তার বিষয় আছে স্যার।’

‘সেটা আবার কী?’

‘কয়েক দিন আগেই তো আরবি স্যার “সতর ঢাকা”র বিষয়ে ক্লাসে পড়িয়েছেন। এখন আপনার শার্টের কোনাটা মোমেনের কান পর্যন্ত ওঠালে আপনার সতর কি পুরোটা রক্ষা পাবে? এই নিয়ে নানান জনে নানান কথা বলবে।’

‘ঠিকই তো!’ স্যার ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। ‘কিন্তু এই বদমাশটাকে শায়েস্তা না করেই ছেড়ে দেব?’

সেকেন্ড বেঞ্চে বসা পাপ্পু এবার জবাব দিল। ওর কাজই হলো ক্লাসে হঠাৎ হঠাৎ কথা বলে শিক্ষকদের বেকায়দায় ফেলা। পাপ্পু বলল, ‘স্যার, আজকে না হয় ছেড়ে দিন। আগামীকাল আপনি বাড়ি থেকে টাকি মাছ কোটার ছাই নিয়ে আসবেন। সেই ছাই দিয়েই মোমেনের পিছলা কানটা মলে দেবেন।’ স্যারের প্রতিবেশী হিসেবে পাপ্পু আগে থেকেই জানত যে স্যার টাকি মাছ খান না। তাই খোঁচাটা ও ইচ্ছে করেই মারল।

এবার স্যারের পুরোটা রাগ গিয়ে পড়ল পাপ্পুর ওপর। উত্তেজনার বশে মোমেনকে বসার অনুমতি দিয়ে ফেললেন তিনি। তারপর গিয়ে দাঁড়ালেন পাপ্পুর সামনে। ‘ইয়ার্কি করো? দাঁড়াও, মজা দেখাচ্ছি’ বলে ওর কানের দিকে হাত বাড়িয়েই থমকে গেলেন।

‘সবই দেখছি এক গোয়ালের গরু! তোর কানে আবার সাদা পাউডার কেন রে? তুই কি কবুতরের গু মাখিয়েছিস?’

‘কানে চর্মরোগ হয়েছে স্যার। ভীষণ চুলকায়। গতকাল ডাক্তার দেখিয়েছি। তিন দিন এই পাউডার মাখতে দিয়েছে। আর বলেছে, রোগটা নাকি মারাত্মক ছোঁয়াচে।’

স্যার থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমরা দারুণ মজা পাই। পাপ্পু আবার শুরু করে—

‘আপনি কোনো টেনশন নেবেন না স্যার। নিশ্চিন্তে আমার কানটা মলে দিন। তিন দিনে আমার পাউডারের ডিব্বাটার অর্ধেকও ফুরাবে না। বাকিটুকু আপনাকেই দিয়ে দেব। মনে রাখবেন—দিনে তিনবার আক্রান্ত আঙুলে পাউডারটা মাখতে হবে। আর একদম পানি লাগানো চলবে না।’

আমাদের প্রবল পরাক্রমশালী বাংলা শিক্ষক আবদুস সামাদ এবার যেন খানিকটা মুষড়ে পড়লেন। মাথাটা সামান্য নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে তিনি ক্লাসের ভেতরে পায়চারি করতে লাগলেন। গভীর চিন্তায় মগ্ন। এভাবেই কাটল কয়েক মিনিট। তারপর ঘণ্টির আওয়াজ পাওয়া গেল। ঢং ঢং করে ঘণ্টি পিটিয়ে দপ্তরি আলী ভাই জানিয়ে দিলেন এই পিরিয়ড শেষ।

স্যার ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। দরজার সামনে গিয়ে কী মনে করে আবার ঘুরে দাঁড়ালেন। পাপ্পুকে বললেন, ‘ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে স্কুলে আসবি না। আগামী তিন দিন তোর ছুটি, আমি হেড স্যারকে বুঝিয়ে বলব।’ পাপ্পু তো আনন্দে গলে যায় যায় অবস্থা। আর আমরা হিংসায় মরি। ইশ্! স্কুলের গেটের সামনের পান দোকান থেকে একটু চুন নিয়ে আমরাও কেন যে কানে মাখলাম না! স্যার আবার কথা বলে উঠলেন, ‘ক্লাস ক্যাপ্টেন কোথায় রে?’

ফার্স্ট বয় খোরশেদ ওর পাটকাঠির মতো শরীরটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল,

‘জি স্যার, বলেন।’

‘শিরীষ কাগজ চিনিস?’

‘চিনি। কাঠমিস্ত্রিরা ব্যবহার করে। ওই কাগজ ডলে কাঠের ফার্নিচার মসৃণ করা হয়।’

‘ভেরি গুড। কাল থেকে ওই কাগজের একটা টুকরা সব সময় তোর পকেটে রাখবি।’

‘কেন স্যার?’ খোরশেদ বিস্মিত হয়। মনে মনে ভাবে—এ আবার কোন ধরনের তাবিজ-কবজ!

এবার স্যার খোলাসা করে বলেন, ‘কাল থেকে আর খালি হাতে কান মলব না। যে যত চালাকি করুক, শিরীষ কাগজ দিয়ে কান পেঁচিয়ে তারপর দেব ডলা। কানমলা বাদ, এবার কানডলা শুরু।’