কালো নাইটের বর্ম

অলংকরণ: সাঈফ মাহ্‌মুদ

এক

রাতটা পূর্ণিমার।

নির্জন রাস্তা ধরে দ্রুতগতিতে ছুটছে একটা গাড়ি। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি গাছ শাঁই শাঁই করে সরে যাচ্ছে। চাঁদের ধবধবে সাদা আলোয় পরিবেশটা অদ্ভুত হয়ে উঠেছে।

‘এ রকম পরিবেশেই বোধ হয় মানুষ কবিতা লেখে,’ জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখতে দেখতে হঠাৎ বলল অয়ন হোসেন।

‘তুইও লিখবি নাকি?’ পাশ থেকে ফোড়ন কাটল জিমি পারকার। ‘উচ্চমার্গের কথাবার্তা শুরু করলি যে!’

‘কবিতাকে এত ছোট করে দেখিস না, জিমি,’ গম্ভীর গলায় বলল অয়ন। ‘জানিস, গদ্যকারের চেয়ে পদ্যকারেরাই বেশি নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন?’

‘তাই নাকি!’ জিমি অবাক। ‘সত্যি?’

‘জানি না,’ ফিক করে হেসে ফেলল অয়ন। ‘চাপা মারলাম।’

ড্রাইভিং সিটে বসা মিসেস শার্লি ওয়াল্টারও হেসে ফেললেন। জিমি বলল, ‘দেখে চালাও, খালা। শেষে অ্যাকসিডেন্ট হবে।’

‘রাগ করলি নাকি?’ অয়ন জিজ্ঞেস করল।

‘করে লাভ কী? তোর সঙ্গে কথায় পারা কি আমার কাজ?’

জিমির শেলি খালা নামি আর্কিওলজিস্ট। তার সঙ্গে ছোট্ট শহর টুলসবারিতে যাচ্ছে ওরা। ইংল্যান্ড থেকে একজন পরিচিত আর্কিওলজিস্ট কী একটা পুরাকীর্তি যেন নিয়ে আসছেন টুলসবারি মিউজিয়ামের জন্য। তার সঙ্গে দেখা করার জন্যই যাচ্ছেন খালা। অয়ন-জিমির স্কুল সপ্তাহখানেকের জন্য বন্ধ। তাই এ সুযোগে নতুন জায়গা দেখার লোভে জুটে গেছে ওরাও। সন্ধেবেলায় রওনা দিয়েছে।

‘আচ্ছা খালা,’ হঠাৎ বলল জিমি। ‘কার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি আমরা?’

‘প্রফেসর হাওয়ার্ড ডিকেন্স,’ শেলি খালা বললেন। ‘একসময় আমার শিক্ষক ছিলেন।’

‘কী আনছেন উনি ইংল্যান্ড থেকে?’ অয়ন প্রশ্ন করল।

‘যত দূর জানি, একটা আর্মার স্যুট, কোনো এক প্রাচীন নাইটের।’

‘আর্মার মানে বর্ম?’

‘হ্যাঁ।’

‘কিন্তু এ রকম একটা জিনিস টুলসবারি মিউজিয়ামে দেওয়া হচ্ছে কেন? আরও বড় কোনো মিউজিয়ামে রাখা যেত না?’

‘বড় বড় প্রায় সব মিউজিয়ামেই আর্মার আছে, অয়ন। নতুন একটা দিয়ে তারা করবে কী? তা ছাড়া এরা হয়তো বিশেষ তদবির করেছিল। অ্যানিওয়ে, আমি এ নিয়ে তেমন ইন্টারেস্টেড নই। আমি যাচ্ছি প্রফেসরকে একটা সারপ্রাইজ ভিজিট দিতে।’

কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন শেলি খালা। হঠাৎ জিমি চেঁচিয়ে উঠল।

‘খালা, সাবধান!’

ব্রেক কষলেন খালা। সামনের সিটের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল অয়ন আর জিমি। ব্যথা পেয়ে ককিয়ে উঠল দুজনই। শেলি খালার সিটবেল্ট বাঁধা ছিল, তাই বেঁচে গেছেন। তিনি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, ‘তোমরা ঠিক আছ?’

‘মাথাটা কিসের সঙ্গে যেন ঠোকা লেগেছে। জিমি?’ অয়ন বলল।

‘আমারও। বোধ হয় দুজনের মাথাতেই ঠোকাঠুকি লেগেছে।’

‘হয়েছিল কী?’ অয়ন শুধাল।

রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা হাফ ট্রাক। জায়গাটা গাছের ছায়ায়, দূর থেকে দেখা যায় না। আরেকটু হলেই একটা অ্যাকসিডেন্ট ঘটে যেত।

‘লোকজনের যে আজকাল কী হয়েছে!’ বিরক্ত কণ্ঠে বললেন শেলি খালা। ‘এটা একটা গাড়ি রাখার জায়গা হলো?’

কয়েকবার হর্ন চাপলেন তিনি। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।

‘কেউ নেই নাকি?’ বিড়বিড় করল অয়ন।

‘দেখা দরকার,’ দরজা খুলে নামলেন শেলি খালা। পিছু পিছু অয়ন আর জিমিও।

ট্রাকের ড্রাইভিং ক্যাবে স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে বসা একটা আবছা ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। অয়ন গলা উঁচিয়ে ডাকল, ‘এই যে, শুনতে পাচ্ছেন?’

কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। কী মনে করে সোজা গিয়ে ট্রাকের দরজা খুলে ফেললেন শেলি খালা। পরমুহূর্তে আঁতকে উঠলেন। ড্রাইভারের কাটা মুণ্ডু গড়িয়ে পড়েছে মাটিতে। তার পায়ের কাছে। ঠং করে একটা শব্দ হলো।

‘হা ঈশ্বর!’

‘খামোখা ভয় পাচ্ছেন, খালা,’ অয়ন জিনিসটা পরীক্ষা করে বলল। ‘এটা একটা শিরোস্ত্রাণ, কোনো কাটা মুণ্ডু নয়।’

‘ড্রাইভিং সিটে...’

‘বর্মের বাকি অংশ। খালি। কোনো মানুষ নেই।’

‘এটা এখানে এল কোত্থেকে?’

‘ভাবছি, এটাই সেটা নয়তো?’ অয়ন ঠোঁট কামড়াচ্ছে।

‘খালা, দেখে যাও!’ হঠাৎ ট্রাকের পেছন থেকে জিমির উত্তেজিত কণ্ঠ শোনা গেল।

‘কী ব্যাপার?’ দুজনই এগিয়ে গেল।

‘এটা দেখো,’ ইঙ্গিত করল জিমি।

ট্রাকের পেছনে একটা লম্বা কাঠের বাক্স, দেখতে অনেকটা কফিনের মতো। সাড়ে ছয় ফুট লম্বা একজন মানুষের অনায়াসে জায়গা হয়ে যাবে। বাক্সটার ঢাকনা খোলা, একটা ট্যাগও আছে। পকেট টর্চ জ্বেলে ওরা দেখল, ট্যাগটা ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের। তাতে লেখা:

প্রফেসর হাওয়ার্ড ডিকেন্স

ডিপার্টমেন্ট অব আর্কিওলজি

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি

লন্ডন, ইংল্যান্ড।

‘এ দেখছি আপনার প্রফেসরের,’ অয়ন বলল।

‘কিন্তু উনি গেলেন কোথায়?’ শেলি খালা হতবাক।

‘ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না। প্রফেসরকে দেখছি না। বর্মটাই–বা ড্রাইভিং সিটে গেল কী করে?’

‘কী বলতে চাস?’ জিমি ভুরু কোঁচকাল।

‘মনটা খুঁতখুঁত করছে। বর্মটা ফেলে প্রফেসর কোথাও চলে যাবেন, ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়।’

‘কী করতে চাও?’ শেলি খালা বললেন।

‘চারপাশটা একটু ঘুরেফিরে দেখি। কোনো ভালো টর্চ আছে?’

‘গ্লাভ কম্পার্টমেন্টে আছে বোধ হয় একটা।’

টর্চ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল অয়ন আর জিমি। প্রথমে ট্রাকটা খুঁটিয়ে দেখল। সেটার দরজায় লেখা: জেফারসন’স কার রেন্টাল।

‘একটা ভাড়া করা ট্রাক,’ বলল অয়ন। ‘কী বুঝছিস?’

‘বর্মটা আনার জন্য এটা ভাড়া নেওয়া হয়েছিল।’

‘কে ভাড়া করল? চালাচ্ছিলই–বা কে?’

‘কে কী করে বলব?’

‘হুঁ, জানতে পারলে ভালো হতো।’

ট্রাকটা ছেড়ে এবার রাস্তার ওপর মনোযোগ দিল ওরা। একটু সামনেই রাস্তার এক পাশে খানিকটা বৃত্তাকার জায়গা ভেজা দেখা গেল। নিচু হয়ে তরল পদার্থটা স্পর্শ করল অয়ন, আঙুলটা নাকের কাছে এনে শুঁকল। পেট্রলের গন্ধ।

‘কী হলো?’ জিমি বলল।

‘একটা গাড়ি এখানে অপেক্ষা করছিল,’ উত্তর দিল ও। ‘সেটার ফুয়েল লাইনে লিক আছে।’

‘আর?’

‘দাঁড়া, দেখছি।’

রাস্তার পাকা অংশের পাশেই মাটিতে টায়ারের দাগ দেখা যাচ্ছে, গাড়িটা সাইড করে রাখায় পড়েছে।

‘হুঁ,’ বলল অয়ন। ‘গাড়িটা তেমন বড় নয়। কার হতে পারে, বড়জোর মিনিট্রাক; এটুকু চওড়া টায়ার অন্য কোনো গাড়ির হতে পারে না। আর হ্যাঁ, মালিক লোকটা কঞ্জুস, নাহয় গরিব, নাহয় বেখেয়ালি।’

এবার অবাক না হয়ে পারল না জিমি। বলল, ‘এটা কী করে বললি?’

‘টায়ার একদম ক্ষয়ে গেছে। আরও আগেই বদলানো উচিত ছিল।’

‘কী করছ তোমরা?’ শেলি খালার অধৈর্য কণ্ঠ শোনা গেল।

‘আসছি খালা!’ জবাব দিল অয়ন। তারপর জিমিকে বলল, ‘আর কিছু দেখার নেই, চল ফিরি।’

‘অন্য গাড়িটার কথা বলবি খালাকে?’

‘বলে লাভ কী? শুকানো পেট্রল দেখে মনে হচ্ছে, কমপক্ষে আধঘণ্টা আগে চলে গেছে ওটা। চেষ্টা করলেও ধরতে পারব না। তার চেয়ে চুপচাপ থাকাই ভালো।’

‘কী করতে চাও?’ শেলি খালাকে প্রশ্ন করল জিমি।

‘বুঝতে পারছি না।’ খালা বললেন। ‘টুলসবারি আর বেশি দূরে নয়। ওখানে গিয়ে পুলিশে খবর দেওয়াটাই বোধ হয় উচিত।’

‘আর্মারটার কী হবে?’

‘রেখেই যেতে হবে। আমাদের গাড়িতে তো জায়গা নেই।’

‘সেটা কি ঠিক হবে?’ অয়ন বলল। ‘এত দামি একটা জিনিস...’

‘কী করতে চাও তাহলে?’

‘এক কাজ করি। আমি আর জিমি এখানে থেকে যাই। আপনি পুলিশ পাঠিয়ে দিন।’

‘না না!’ মাথা নাড়লেন খালা। ‘তোমাদের একা ফেলে যাব না আমি।’

‘খামোখা ভয় পাচ্ছেন। এতে অসুবিধা কী?’

জিমিও যোগ দিল। ‘হ্যাঁ, অসুবিধা কী?’

জবাব দিতে পারলেন না খালা। শেষ পর্যন্ত ওদের পীড়াপীড়িতে নিমরাজি হলেন। বললেন, ‘সাবধানে থেকো! আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরব।’

চলে গেলেন শেলি খালা। এবার জিমি বলল, ‘তোর কাজকর্ম আমি ঠিক বুঝতে পারি না, অয়ন। আসলে রয়ে গেলাম কেন?’

‘কেন, তোর ইচ্ছা ছিল না?’

‘মোটেই না।’

‘তাহলে আমাকে সাপোর্ট করলি কেন?’

‘কারণ, তুই অকারণে কিছু করিস না। আসলে ব্যাপারটা কী?’

‘ব্যাপারটা যে কী, তা আমি নিজেও অবশ্য জানি না। তবে আমার সিক্সথ সেন্স বলছিল, এখানে আমাদের থেকে যাওয়াটা জরুরি। কিছু একটা ঘটে যেতে পারে।’

‘তাই নাকি!’ ঠোঁট ওলটাল জিমি। ‘তা তোর সিক্সথ সেন্স আর কী বলছে?’

‘আমার সিক্সথ সেন্স বলছে,’ মিটিমিটি হাসল অয়ন। ‘আরেকটা রহস্য পেয়ে গেছি আমরা।’

দুই

সময় কাটানোর জন্য দুজন মিলে বর্মটা কাঠের বাক্সে ভরে ফেলল। পুরোটা একবারে আনা গেল না, ভাগ ভাগ করে আনতে হলো। কাজ শেষে বাক্সটার ঢাকনা লাগিয়ে দিল।

‘এবার কী করবি?’ জিমি বলল।

‘চল বসি,’ বলে রাস্তার ধারে ঘাসের ওপর গিয়ে বসল অয়ন।

জিমিও বসল।

‘কয়েকটা ব্যাপার পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার,’ বলল অয়ন। ‘প্রফেসর গেলেন কোথায়? যত দূর মনে হচ্ছে, ইচ্ছা করে যাননি। তাহলে বর্মটা ফেলে যেতেন না।’

‘তার মানে তাকে কি কিডন্যাপ করা হয়েছে?’ জিমি ভুরু কোঁচকাল।

‘অবস্থাটা কি তা-ই দাঁড়াচ্ছে না?’

‘কিন্তু কেন? বিদেশি একজন প্রফেসর আমেরিকায় পা রেখেই কিডন্যাপ হয়ে যাবেন কেন? তার মতো মানুষের কী এমন শত্রু থাকতে পারে?’

‘কথা হচ্ছে, কজন মানুষ জানত যে প্রফেসর আজই আসছেন? গাড়িটা আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। তার মানে ব্যাপারটা পূর্বপরিকল্পিত। যারা জানত, তাদের হাত আছে এতে।’

‘টুলসবারিতে পৌঁছেই এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে, কী বলিস?’

‘হুঁ, কিন্তু আমার ভাবনা হচ্ছে বর্মটা নিয়ে। ওটা ড্রাইভিং সিটে গেল কী করে? কিডন্যাপারই কি রাখল?’

‘আমার তা মনে হয় না। কেন রাখবে? রেখে লাভ কী?’

‘বোকার মতো কথা বলিস না, জিমি। কেউ না রাখলে ওটা ওখানে গেল কী করে? হেঁটে হেঁটে? একটা পুরোনো খালি বর্ম কি হাঁটতে পারে?’

‘এটা বোধ হয় পারে।’ ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল জিমি।

‘মানে?’ অয়ন অবাক!

‘পেছনে তাকা!’

ঝট করে ঘাড় ফেরাল অয়ন, সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল। ট্রাকের পাশ দিয়ে দুহাত উঁচিয়ে বর্মটা ওদের দিকেই ছুটে আসছে, ও ঘাড় ফেরাতেই গর্জনও করল।

‘ভ্...ভ্...ভূত!’ জিমি তোতলাচ্ছে।

চরম বিপদেও বুদ্ধি হারায় না অয়ন। উঠে দাঁড়াল ও। জিমির হাত ধরে টান দিয়ে বলল, ‘পালা!’

দৌড়ে রাস্তা থেকে নেমে গাছপালার ভেতরে নেমে গেল ওরা, ছুটতে শুরু করল। পেছনে ঝোপঝাড় ভেঙে বর্মটাও ছুটে আসছে। ছোটার গতি বাড়িয়ে দিল ওরা।

পূর্ণিমার চাঁদের আলো বনের ভেতর সামান্যই ঢুকেছে। বলতে গেলে কিছুই দেখা যায় না। শিকড়ের সঙ্গে পা জড়িয়ে বেশ কয়েকবার হুমড়ি খেয়ে পড়ল দুজন। ঝোপঝাড়ের ঘষা খেয়ে হাত-পা ছিলল, কিন্তু থামল না ওরা। ছুটতে থাকল, জান বাঁচানো দরকার আগে।

কতক্ষণ একটানা ছুটেছে বলতে পারবে না। হঠাৎ টান দিয়ে জিমিকে থামাল অয়ন।

‘থামলি কেন?’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল জিমি। ‘মরতে চাস নাকি?’

‘একটু জিরিয়ে নিই,’ অয়নও হাঁপাচ্ছে।

‘বেঁচে থাকলে সারা জীবন জিরোতে পারবি, এখন চল।’

‘না!’ জিমিকে থামাল অয়ন। ‘খামোখাই দৌড়াচ্ছি আমরা। ট্রাকের কাছ থেকে সরে আসা মোটেই উচিত হয়নি।’

‘তোর মাথাটাথা ঠিক আছে তো? একটা ভূত তাড়া করেছিল আমাদের!’

‘বোগাস! ভূত বলে কিছু নেই।’

‘তাহলে কী দেখলাম আমরা? সার্কাস? নাকি যেমন খুশি তেমন সাজোর প্রতিযোগী?’

‘ওসব কিছু নয়, জিমি। কেউ একজন ভয় দেখিয়েছে আমাদের। ট্রাকের কাছ থেকে দূরে সরিয়েছে।’

‘কিন্তু কেন? ওই ট্রাকে কী এমন আছে?’

‘বর্মটা আছে, একটা মূল্যবান আর্টিফ্যাক্ট!’

‘নাটবল্টু সব গেছে তোর!’ জিমি বিরক্ত হলো। ‘ওটা তো আমাদের পেছন পেছন ধাওয়াই করছিল, ট্রাকে থাকে কী করে?’

‘আসল বর্মটাই যে ধাওয়া করছিল, কোনো প্রমাণ আছে? চাঁদের আলোয় কতটুকুই–বা দেখেছি আমরা?’

‘কী বলতে চাস?’

‘নকল একটা বর্ম পরে কেউ ভয় দেখিয়েছে আমাদের। আসলটা এখনো ট্রাকেই আছে। ছোটাছুটি না করে ওখানেই ফেরা উচিত আমাদের।’

‘তুই গেছিস!’ জিমি বলল। ‘অয়ন, আমার কথা শোন। চল তাড়াতাড়ি ভাগি। বর্মের ভূতটা যেকোনো মুহূর্তে এসে যাবে।’

‘আসবে না,’ নিশ্চিত গলায় বলল অয়ন। ‘আমাদের তাড়াতে চেয়েছিল, পেরেছে। আর ধাওয়া করার দরকার নেই। কারণ, সাধারণ আর কোনো লোক এ ঘটনার পর ট্রাকের কাছে যাবে না।’

‘তাহলে আমরা যাব কেন?’ জিমি বোকা বোকা কণ্ঠে বলল।

‘কারণ, আমরা সাধারণ নই,’ অয়ন হাঁটতে শুরু করেছে। ‘আমরা অয়ন-জিমি, আমরা গোয়েন্দা।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অয়নকে অনুসরণ করল জিমি। ওর জেদের সঙ্গে পেরে ওঠা কারও কম্ম নয়। সবচেয়ে বড় কথা, বিপদের মুখে বন্ধুকে একা ঠেলেও দেওয়া যায় না।

‘শুনে রাখ,’ জিমি বলল। ‘তোর জন্য যদি ভূতের হাতে মারা পড়ি, তাহলে তোর কপালে খারাবি আছে।’

‘তুই মরলে যে ভূত আমাকে ছেড়ে দেবে, এমন কোনো গ্যারান্টি আছে?’

‘মরেও তুই রেহাই পাবি না, বজ্জাত! কবরে গিয়ে তুলাধুনা করব।’

হো হো করে হেসে উঠল অয়ন। সেটা জিমির মধ্যেও সংক্রমিত হলো। সহজ হয়ে এল পরিবেশ।

ফেরাটা সহজ হলো না, সে সময় ভয়ের চোটে দৌড়াতে দৌড়াতে কোথায় এসে পড়েছে, নিজেরাও জানে না। এখন বেরোতে গিয়ে ঠ্যালা বোঝা গেল। পথ খোঁজার জন্য পকেট টর্চ ব্যবহার করল ওরা। তাতে বিশেষ লাভ হলো না। তবে হাল ছাড়ল না কেউ। সময় লাগল, তবে শেষ পর্যন্ত ঠিকই মেইন রোডে উঠে আসতে পারল। ট্রাক থেকে বেশ দূরে এসে পড়েছে ওরা। এবার রাস্তা ধরে ফেরার চেষ্টা করল।

ট্রাকটা দেখা গেল কিছুক্ষণ পরই। সেই সঙ্গে আরেকটা গাড়ির অবয়ব দেখতে পেল ওরা, ট্রাক থেকেও দূরে, পেছনে টেইললাইট জ্বলছে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সেটা।

‘একটা গাড়ি গেল!’ জিমি বলল।

‘দেখেছি,’ অয়ন মাথা ঝাঁকাল। ‘কিন্তু চলে গেল কেন? বর্মটা...’

দৌড়ে ট্রাকের পেছনে গেল ওরা। যা ভেবেছে তা-ই! কাঠের বাক্সটার ঢাকনা খোলা, ভেতরে বর্মটা নেই।

পুলিশ নিয়ে শেলি খালা ফিরলেন আরও আধঘণ্টা পর।

তিন

‘ব্যাপারটা রীতিমতো রহস্যজনক,’ বললেন শেলি খালা। ‘একটা মানুষ তো আর বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে না।’

‘আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি, মিসেস ওয়াল্টার,’ বললেন শেরিফ জন ওয়েবলি। ‘বেশি সময় লাগবে না, আশা করি প্রফেসরকে পেয়ে যাব। সেই সঙ্গে বর্মটাও।’

‘আমার কিছু ভালো লাগছে না,’ শেলি খালার মন খারাপ। ‘যার সঙ্গে দেখা করার জন্য এত কষ্ট করে ছুটে এলাম, সে-ই কিনা নিখোঁজ হয়ে গেল!’

‘বোধ হয় বর্মটাই এর জন্য দায়ী,’ বললেন কিউরেটর গ্রাহাম জনসন।

‘কী!’ শেরিফের ভুরু কুঁচকে গেছে।

‘হ্যাঁ,’ মাথা ঝাঁকালেন মি. জনসন। ‘বর্মটার একটা কিংবদন্তি আছে। সেটা শুনলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’

পরদিন সকালের ঘটনা। টুলসবারি মিউজিয়ামের কিউরেটরের অফিসে বসে আছে সবাই। রাতের বেলা শেরিফের লোকজন পৌঁছানোর পর সবকিছু খুলে বলেছিল অয়ন আর জিমি। তারা ওই এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে, তবে নিখোঁজ প্রফেসরকে পাওয়া যায়নি। বর্মের ভূতটার কথা অবশ্য কেউ বিশ্বাসই করেনি। শেরিফের ধারণা, বর্মটা চুরি গেছে। চোরদেরই কাউকে দেখে অয়নরা ভয় পেয়েছে, ভূতটুত কিছু নয়। ভদ্রলোকের ব্যাখ্যায় প্রচুর ফাঁক আছে, তবে তা নিয়ে তর্ক করেনি ওরা। করে লাভও নেই। রাতটা একটা ভাড়া করা কটেজে কাটিয়ে সকালে মিউজিয়ামে এসেছে সবাই কিউরেটরের সঙ্গে কথা বলতে।

‘বলুন আপনার কিংবদন্তি,’ শেরিফ বললেন।

‘বর্মটা ত্রয়োদশ শতাব্দীর কোনো এক প্রাচীন নাইটের,’ বললেন মি. জনসন। ‘তার নাম স্যার হেনরি হেডেন। এক যুদ্ধে দারুণ বীরত্ব দেখানোয় তাকে নাইটের উপাধি দেওয়া হয়। স্কটল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলে তার বিরাট জমিদারি ছিল। ভালো যোদ্ধা ছিলেন স্যার হেনরি, তবে শাসক হিসেবে খুবই নিম্নমানের। প্রজাদের ওপর ভীষণ অত্যাচার করতেন। তার নাম হয়ে গিয়েছিল কালো নাইট। শেষে এক পূর্ণিমার রাতে প্রজারা বিদ্রোহ করে বসে। কালো নাইটকে প্রাসাদ থেকে বের করে আনে তারা, জনসমক্ষে হত্যা করে। মৃত্যুর আগে তিনি অভিশাপ দিয়ে যান প্রতিশোধ নিতে আবার ফিরে আসবেন বলে।

‘নাইটের মৃত্যুর এক বছর পর হঠাৎ এক পূর্ণিমার রাতে স্যার হেনরির প্রিয় বর্মটাকে গাঁয়ের রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে দেখা গেল। কোনো মানুষ সেটা পরে ছিল না, ব্যাপারটা রীতিমতো ভৌতিক। সেই রাতেই তিনজন লোক মারা গেল, এরা সবাই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। সেই থেকে প্রায় প্রতি পূর্ণিমার রাতেই কেউ না কেউ মারা যেতে লাগল। প্রজাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল, অনেকে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেল। ধীরে ধীরে স্যার হেনরির জমিদারি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ল।’

‘বর্মটা?’ অয়ন প্রশ্ন করল।

‘সেটা প্রাসাদেই পড়ে ছিল। দুই মাস আগে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তখন থেকেই জিনিসটা পাওয়ার জন্য আমরা চেষ্টা করছিলাম। অনুমতি পাওয়ার পর প্রফেসর ডিকেন্স সেটা নিয়ে আসছিলেন।’

‘ব্যাপারটা কাকতালীয়,’ চিন্তিত কণ্ঠে বলল অয়ন। ‘কিন্তু কাল রাতেও পূর্ণিমা ছিল।’

‘আর পূর্ণিমার রাতেই বর্মটা জীবন ফিরে পায়,’ ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল জিমি। ‘প্রফেসরের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে একটা যুক্তি পাওয়া যাচ্ছে।’

‘ননসেন্স!’ শেলি খালা মাথা নাড়লেন। ‘এসব পুরোনো মিথ। এর মধ্যে কোনো সত্যতা নেই।’

‘কিন্তু আমরা ওটাকে দেখেছি, খালা!’ জিমি প্রতিবাদ করল। ‘ওটা আমাদের তাড়া করেছিল!’

‘ভুল দেখেছ। ব্যাপারটা উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা।’

‘তাহলে বর্মটা গেল কোথায়?’

অলংকরণ: সাঈফ মাহ্‌মুদ

‘চুরি হয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ নিয়ে আর মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আজই আমরা চলে যাব।’

‘কেন?’ অয়ন জিজ্ঞেস করল।

‘যে কাজে এসেছিলাম, তা-ই যখন হলো না, থেকে লাভ কী?’

‘আজকের দিনটা থেকে গেলে কেমন হয়? শেরিফ তো খোঁজ চালাচ্ছেন, প্রফেসরকে পাওয়াও যেতে পারে।’

একটু ভাবলেন শেলি খালা। বললেন, ‘কথাটা মন্দ বলোনি। ঠিক আছে, কাল ফিরব।’

‘আমার কাজ আছে, উঠতে হচ্ছে,’ শেরিফ বললেন। ‘আপনারা কি বসবেন খানিকক্ষণ?’

‘বসেই যাই,’ বললেন শেলি খালা। ‘কাজ তো কিছু নেই। ভাবছি, আপনাদের মিউজিয়ামটা দেখে যাব।’

কথাটা শুনেই মি. জনসন গলা খাঁকারি দিলেন। বললেন, ‘দুঃখিত, সেটা বোধ হয় সম্ভব হবে না। আমাদের কিছু মেইনটেন্যান্সের কাজ চলছে। কোনো ভিজিটরকে ঢুকতে দিচ্ছি না। কিছু মনে করবেন না।’

‘ও! তাই নাকি?’ শেলি খালা হতাশ হয়েছেন। ‘তাহলে তো দুঃখের কথা। আচ্ছা, একটুও কি দেখা যাবে না?’

‘সরি।’

‘মেইনটেন্যান্সের কাজ শুরু করেছেন, আমাকে বলেননি কেন? বাড়তি নিরাপত্তার দরকার হতে পারে না? কত দামি জিনিস রয়েছে ভেতরে!’ শেরিফ বললেন।

‘কাজ খুব বেশি নয় তো! উটকো সমস্যা হলে ম্যাক আর টনিই সামাল দিতে পারবে।’

‘তাহলে তো ভালোই। আচ্ছা চলি।’

শেরিফ চলে যেতেই অয়ন প্রশ্ন করল, ‘ম্যাক আর টনি কে?’

‘আমার সহকারী,’ কিউরেটর বললেন। ‘এখানকার সব কাজকর্ম ওরাই দেখাশোনা করে।’

‘ভালো কথা, মি. জনসন, প্রফেসর ডিকেন্স যে গতকালই আসছেন, এটা কে কে জানত?’

‘মিউজিয়ামের সবাই জানত।’

‘মানে আপনি আর দুই অ্যাসিস্ট্যান্ট?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?’

‘এমনিতেই। কৌতূহল হলো। আচ্ছা, বাইরের কেউ জানত?’

‘তা কী করে বলব?’ কিউরেটর বিরক্ত। ‘আমি কাউকে বলিনি।’

বিদায় নেওয়ার জন্য শেলি খালা উঠলেন। ‘আমরা তাহলে আসি। কাল যাওয়ার আগে কি মিউজিয়ামটা দেখা যাবে? আপনাদের কালেকশন দেখে না গেলে আফসোস থেকে যাবে।’

একটু ইতস্তত করে মি. জনসন বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি দেখব কিছু করা যায় কি না।’

কিউরেটরের অফিস থেকে বেরিয়ে এল ওরা।

‘কোথায় যাব এখন?’ অয়ন প্রশ্ন করল।

‘মার্কেটে,’ বললেন শেলি খালা। ‘ছোটখাটো কয়েকটা জিনিস কিনতে হবে। এখানে স্থানীয়দের বানানো সুন্দর সুন্দর শোপিস পাওয়া যায় বলে শুনেছি।’

‘আমরা তাহলে একটু ঘুরে আসি।’

‘কোথাও যাবে?’

‘শহরটা দেখব।’

‘একা যাওয়ার দরকারটা কী? একটু অপেক্ষা করো, আমিও যাব।’

‘একা কোথায়? জিমি থাকছে।’

‘তোমার জন্য অপেক্ষা করলেই হয়েছে!’ জিমি সুর মেলাল। ‘কতক্ষণ লাগবে আল্লাহই জানে। বাজারে ঢুকলে কি হুঁশ থাকে তোমার?’

‘ঠিক আছে, যাও,’ হাসলেন শেলি খালা। ‘তাড়াতাড়ি চলে এসো।’

‘শিওর!’ বলে পা চালাল ছেলেরা।

‘প্ল্যানটা কী?’ কিছুদূর গিয়ে প্রশ্ন করল জিমি।

‘কিসের প্ল্যান?’ বলল অয়ন।

‘আমার সঙ্গে অভিনয় করিস না, অয়ন। তদন্ত করার জন্য নিশ্চয়ই কোনো প্ল্যান আছে তোর। শেলি খালাকে সে জন্যই ফেলে এসেছিস।’

‘আসলে তেমন কোনো প্ল্যান এখনো খাড়া করতে পারিনি,’ অয়ন অল্প হাসল। ‘পুরো ব্যাপারটাই ঘোলাটে।’

‘বর্মের গল্পটা তো শুনেছিস, চিন্তাভাবনার খোরাক পাসনি?’

‘দূর! ওটা স্রেফ একটা মিথ, খালার সঙ্গে আমি একমত। বর্মটা হেঁটে চলে যায়নি, চুরিই হয়েছে। একটা গাড়ির টেইললাইট দেখেছি আমরা, ভুলে গেছিস?’

‘ওটা চোরদের গাড়ি ভাবছিস? ওরাই ভয় দেখিয়েছে?’

‘সেটাই মনে হচ্ছে না?’

‘ওই গাড়িটার কথা শেরিফকে বললি না কেন?’

‘বলে লাভ কী হতো? লাইসেন্স নম্বর, এমনকি কী রকম গাড়ি, কিছুই তো দেখিনি। তা ছাড়া নিজেদের হাতে কিছু বাড়তি তথ্যও রাখা দরকার।’

‘বুঝলাম,’ জিমি মাথা ঝাঁকাল। ‘এখন বল, কী কী সূত্র পেয়েছিস?’

‘শুনে খুশি হবি না,’ অয়ন শ্রাগ করল। ‘আসলে কোনো সূত্রই পাইনি।’

‘বলিস কী! কিছুই না?’

‘সে রকমই। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জমা হয়েছে।’

‘কী প্রশ্ন?’

‘আমাদের হাতে দুটো সমস্যা আছে। প্রফেসরের অন্তর্ধান আর চুরি যাওয়া বর্ম। কথা হচ্ছে, দুটোই একসুতোয় গাঁথা কি না।’

‘আলাদা ভাবছিস কেন?’

‘ব্যাপারটা ভেবে দেখ, বর্ম চুরির মতলব থাকলে প্রফেসরকে কিডন্যাপ করার সময়েই সেটা নিয়ে যাওয়া যেত না? পরে এসে চুরির দরকার কী ছিল?’

‘যদি না ওটা হেঁটে চলে গিয়ে থাকে।’

‘তুই এখনো ওটাকে জ্যান্ত ভাবছিস?’

‘সরি, ওটা তাড়া করেছিল, ঘটনাটা ভুলতে পারছি না। ভাবলেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে।’

‘এই যদি তোর মনোভাব হয়, তাহলে একটা ভিতুর ডিমকে নিয়ে গোয়েন্দাগিরি করার চেয়ে একটা কলাগাছকে সঙ্গে রাখা ভালো।’

‘কী!’ জিমি রেগে গেছে। ‘আমি কলাগাছ?’

‘উঁহু, তুই কলাগাছেরও অধম।’ ইচ্ছা করে জিমিকে আরও রাগাল অয়ন। ‘কলাগাছ ভয় পায় না।’

‘বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু! মার খাবি।’

‘বাড়াবাড়ি করলাম কোথায়? ভয় পেলে তদন্ত করা যায়?’

‘কী করতে হবে তাহলে?’

‘আমার সঙ্গে চল, জরুরি কাজ আছে।’

‘তাতেই প্রমাণিত হয়ে যাবে আমি ভিতু নই?’

‘উঁহু, অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। তবে আপাতত এতেই চলবে।’ হেসে ফেলল অয়ন।

‘বেশ,’ রাগ পড়ে গেছে জিমির। ‘কোথায় যাচ্ছিস?’

‘মিউজিয়ামটা দেখতে।’

‘পাগল হলি? তোকে ঢুকতে দেবে ভেতরে? ওখানে না মেইনটেন্যান্সের কাজ চলছে!’

‘সেটাই দেখতে যাচ্ছি। কী কাজ যে শেলি খালার মতো নামকরা মানুষকেও ফিরিয়ে দেওয়া হলো!’

‘ঢুকবি কেমন করে?’

ভুরু নাচাল অয়ন। বলল, ‘অয়ন হোসেনকে ঢুকতে দেবে না...’

‘...এমন বান্দা এখনো পয়দা হয়নি,’ বাক্যটা শেষ করল জিমি। ‘কথাটা আগেও বলেছিস। কিন্তু বুদ্ধিটা কী?’

‘কিছুই না। সোজা দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ব।’

‘এতই সোজা? ঘাড় ধরে বের করে দেবে।’

‘পারবে না,’ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল অয়ন। ‘তুই আয় আমার সঙ্গে।’

আর প্রতিবাদ করল না জিমি। অয়ন যখন বলছে, পারবে। ওর একটা অদ্ভুত গুণ আছে, কীভাবে যেন লোকজনকে পটিয়ে ফেলে। কিউরেটরের দুই সহকারীকে ভজিয়ে-ভাজিয়ে রাজিও করিয়ে ফেলতে পারে মিউজিয়াম দেখার জন্য।

আবার মিউজিয়ামে ঢুকল ওরা। প্রদর্শনী হলের দরজা বন্ধ, একটা প্ল্যাকার্ড ঝুলছে। তাতে লেখা:

মেইনটেন্যান্স ওয়ার্ক ইন প্রগ্রেস। নো ভিজিটরস অ্যালাউড।

লেখাটাকে পাত্তা দিল না অয়ন। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। পেছন পেছন জিমিও।

বিশাল একটা হলরুম। অল্প কিছু পুরাকীর্তি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। চারদিকে চারটা দরজা দেখা গেল। চারটা ছোট ছোট প্রদর্শনীকক্ষ আছে ওগুলোর পেছনে। সব মিলিয়ে ঘরটা শূন্য শূন্য লাগছে। আইটেমের স্বল্পতা, সেই সঙ্গে লোকসমাগম নেই বলেই হয়তো। আশপাশে মিউজিয়ামের কাউকে দেখা গেল না।

‘কেউ নেই দেখছি,’ মন্তব্য করল জিমি।

‘ভালোই হলো, ঝামেলা করতে হলো না,’ বলল অয়ন। ‘আয় ঘুরেফিরে দেখি।’

দুজন ডান দিকের প্রথম দরজাটা ধরে ভেতরে ঢুকল। এ ঘরটা পুরোনো মূর্তিতে বোঝাই। নানা আকারের, নানা রকম অনেক মূর্তি সাজানো আছে চারপাশে। দেখতে শুরু করল ওরা।

‘আচ্ছা, কী করছি আমরা?’ হঠাৎ বলল জিমি। ‘মূর্তি দেখার সঙ্গে তদন্তের কী সম্পর্ক?’

‘জানি না,’ স্বীকার করল অয়ন। ‘হয়তো সময়ই নষ্ট হচ্ছে। তবু...কোনো অস্বাভাবিকতা লক্ষ করলে জানাস।’

‘একটা অবশ্য লক্ষ করেছি,’ বলল জিমি। ‘মেইনটেন্যান্সের কাজ চলছে, অথচ কোনো যন্ত্রপাতি অথবা কর্মী দেখলাম না।’

‘গুড পয়েন্ট!’ বলল অয়ন। ‘তোর উন্নতি হচ্ছে।’

‘স্বীকার করছিস?’

‘অবশ্যই। দেখতে হবে না কার চ্যালা?’

‘গুরুটা কে, তুই?’

‘কেন, সন্দেহ আছে?’

‘নিশ্চয়ই। গুরুগিরি ফলাচ্ছিস, না? এমন গাঁট্টা মারব, মাথায় আলু গজাবে। ফাজিল!’

‘ঘাট হয়েছে, ভাই! মাফ চাইছি। কথা বন্ধ করে দেখ আর কিছু পাস কি না।’

হঠাৎ একটা মূর্তির পায়ের কাছে কী যেন পড়ে থাকতে দেখল জিমি। বিড়বিড় করল, ‘এটা আবার কী?’ জিনিসটা তুলে নিল ও।

‘কিছু পেলি?’ অয়ন জিজ্ঞেস করল।

‘এটা,’ জিনিসটা অয়নের হাতে তুলে দিল জিমি।

অদ্ভুত আকৃতির একটা চশমা। কাচের জায়গাটা দুটো ছোট চোঙা দিয়ে একটু বাড়ানো। ডগায় ছোট ছোট দুটো ম্যাগনিফায়িং গ্লাস লাগানো।

‘এমন আজব চশমা জিন্দেগিতে প্রথম দেখলাম,’ জিমি বলল।

ঠিক এ সময় পেছনে পায়ের শব্দ হলো। একটা কর্কশ কণ্ঠ খেঁকিয়ে বলে উঠল, ‘অ্যাই! তোমরা এখানে কী করছ?’

চার

পাঁই করে ঘুরল জিমি, চমকে গেছে। কিন্তু অয়নের ভেতর কোনো তাড়াহুড়ো লক্ষ করা গেল না। চশমাটা সবার অজান্তে পকেটে ভরল, তারপর ধীরেসুস্থে ঘুরে দাঁড়াল। ইউনিফর্ম পরা দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।

‘আরে! আপনাদেরই তো খুঁজছি,’ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল ও। ‘মি. ম্যাক কে?’

‘আমি,’ বলল একজন। ‘আমাদের খুঁজছ কেন? তোমাদের তো চিনি বলে মনে হচ্ছে না।’

‘আমি অয়ন হোসেন, ও জিমি পারকার,’ বলল অয়ন। ‘মিসেস শার্লি ওয়াল্টারের সঙ্গে এসেছি। এখানে এসে মনে হলো আপনাদের সাক্ষাৎকারটা নিয়ে ফেলতে পারলে মন্দ হয় না। তাই...’

‘সাক্ষাৎকার মানে?’ ম্যাক বোকা বনে গেছে। ‘আমাদের দেখে কি ফিল্মস্টারের মতো মনে হচ্ছে?’

‘শুধু ফিল্মস্টাররাই সাক্ষাৎকার দেয়, কে বলেছে আপনাদের?’ অয়ন ভুরু কোঁচকাল।

‘তাহলে?’

‘স্কুল থেকে একটা অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছি আমরা—বিভিন্ন পেশার লোকের ওপর একটা জরিপ করতে হবে। তাই ভাবলাম আপনাদের একটা ইন্টারভিউ নিয়ে ফেললে কেমন হয়? মিউজিয়ামের কাজ, নিশ্চয়ই খুব ইন্টারেস্টিং?’

‘তা তো বটেই!’ টনিকে খুশি খুশি দেখাল। ‘আসলে...’

‘তুমি থামো!’ ধমক দিয়ে তাকে চুপ করাল ম্যাক। ‘ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য বেতন দেওয়া হয় না তোমাকে। আর তোমরা,’ অয়ন-জিমির দিকে ফিরল সে, ‘বেরোও এখান থেকে! বাইরে সাইনবোর্ড দেখোনি? কোন সাহসে ঢুকেছ?’

‘বা রে, দোষটা কী করলাম?’ অয়ন বোকা বোকা কণ্ঠে বলল। ‘ইন্টারভিউ...’

‘ইন্টারভিউ-ফিন্টারভিউ দিতে পারব না আমরা। টুলসবারিতে আমাদের চেয়েও ইন্টারেস্টিং পেশার লোক আছে, তাদের কাছে যাও।’

‘দু–একজনের নাম যদি বলতেন...’

‘বারলো বক্সারের কাছে যাও।’

‘কী করেন উনি?’

‘একটা স্যালভেজ ইয়ার্ড আছে ওর। সুচ থেকে শুরু করে পুরোনো গাড়ি পর্যন্ত সব বাতিল লোহার কারবার করে ও। যাও, ভাগো!’

টেকা যাবে না, বোঝা যাচ্ছে। কথা না বাড়িয়ে মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে এল ওরা। রাস্তায় নেমেই হাসিতে ভেঙে পড়ল জিমি।

‘তুই একটা চিজ, অয়ন!’ বলল ও। ‘কথা দিয়ে যে কীভাবে মানুষকে বোকা বানাস!’

‘এবার খুব একটা কাজ হলো না,’ গোমড়া মুখে বলল অয়ন। ‘ম্যাকটা ভীষণ চালু। আমাদের কথা বিশ্বাস করেনি।’

‘একদম উড়িয়েও তো দেয়নি,’ জিমি বলল। ‘দেখলি না কোন এক বক্সারের কথা বলল। তা ছাড়া বিনা অনুমতিতে ঢুকে চড়থাপ্পড় না খেয়ে বেরিয়ে এলাম, তাই–বা কম কিসে?’

‘তা ঠিক, আর বারলো বক্সারের কথা বলে উপকারও করেছে। তার সঙ্গে দেখা করতে হবে।’

‘কেন? তার সঙ্গে তদন্তের কী সম্পর্ক?’

‘কিডন্যাপারের গাড়ির কথা ভুলে গেছিস? সেটার ফুয়েল লাইনে লিক, টায়ারও ক্ষয়ে গেছে; নতুন গাড়ির এ রকম সমস্যা হওয়ার কথা নয়। মানে, গাড়িটা পুরোনো। আর এ রকম গাড়ির খবর এই শহরে কে সবচেয়ে ভালো দিতে পারবে?’

‘বারলো বক্সার?’ জিমি ভুরু নাচাল।

‘হ্যাঁ। কারণ, সে পুরোনো গাড়িরও ব্যবসা করে।’

‘স্যালভেজ ইয়ার্ডে যেতে চাইছিস?’

‘হুঁ। চল।’

একজন পথচারীর কাছ থেকে স্যালভেজ ইয়ার্ডের ঠিকানা জেনে নিল ওরা। কিন্তু দূরত্বটা জানার পর দমে যেতে হলো। জায়গাটা বেশ দূরে। শহরের প্রান্তে, বাইরেই বলা চলে। এখন গেলে সময়মতো ফেরা যাবে না। শেষে ঠিক করল, বিকেলে যাবে। শেলি খালার সঙ্গে কটেজে ফিরল ওরা।

লাঞ্চ পর্যন্ত সময়টা যেন কাটতেই চায় না। আসলে একবার তদন্ত শুরু করলে সেটা শেষ না করা পর্যন্ত স্বস্তি পায় না ওরা। রীতিমতো উসখুস করতে লাগল দুজন। দুপুরের খাওয়া শেষে শেলি খালা গেলেন বিশ্রাম নিতে। এই সুযোগে ওরা বেরিয়ে পড়ল।

আধঘণ্টার বেশি লাগল স্যালভেজ ইয়ার্ডে পৌঁছাতে। প্রকাণ্ড গেটটা পার হয়ে ভেতরে ঢুকতেই নাকমুখ কুঁচকে ফেলতে হলো। পরিবেশটা দারুণ নোংরা। ইয়ার্ডজুড়ে আবর্জনা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। এখানে সেখানে স্তূপ করে রাখা হয়েছে বাতিল লোহালক্কড়ের জঞ্জাল। এক পাশে খানিকটা খোলা জায়গা, সেখানে সারি বেঁধে পাঁচ-ছয়টা পুরোনো গাড়ি রাখা আছে। দাম লেখা কাগজ সেগুলোর উইশিল্ডে সেঁটে দেওয়া হয়েছে।

‘এহ্‌ হে,’ মুখ বাঁকিয়ে বলল জিমি, ‘কী বাজে জায়গা! মানুষ থাকে কী করে?’

‘স্যালভেজ ইয়ার্ড আর কত পরিষ্কার হবে?’ বলল অয়ন। ‘এখানে তো লোকে ঘুরতে আসে না।’

‘তা-ও ঠিক,’ একমত হলো জিমি।

একতলা একটা বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে, ওটাই সম্ভবত অফিস। এগিয়ে গেল দুই বন্ধু। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই কাউন্টারে দাঁড়ানো লোকটা ফিরে চাইল।

‘কী ব্যাপার, খোকা?’ বলল সে। ‘কিছু কিনতে এসেছ?’

‘মি. বারলো বক্সারকে চাইছিলাম,’ অয়ন বলল।

‘আমিই বারলো বক্সার। কী ব্যাপার?’

বিস্ময়ের সঙ্গে বক্সারকে দেখছে জিমি। লোকটা নিগ্রো, বিশালদেহী। হাতির মতো শরীর, ওজনে শ তিনেক পাউন্ডের কম হবে না। হাতের তালু দেখল, ওটার থাবড়া খেলে ওর মতো মানুষের দু–চারটে হাড়গোড় খসে যাবে।

‘একটা পুরোনো গাড়ির খোঁজ করছিলাম,’ বারলোকে বলল অয়ন। ‘যদি সাহায্য করেন...’

‘কিনবে?’

‘না না, আসলে কাল রাতে ওই গাড়িটা আমাদের গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়েছে। বেশ কয়েক জায়গায় রং উঠে গেছে আমাদের, একটা লাইটও ভেঙেছে। খালা খুব রেগে গেছে। ড্রাইভারকে পেলে আচ্ছা করে ধোলাই দেবে। আমাদের পাঠাল গাড়িটা খুঁজে বের করতে।’

খুবই বিশ্বাসযোগ্য গল্প, সন্দেহ করার কিছু নেই। বারলো বলল, ‘কী গাড়ি ওটা?’

‘কার,’ আন্দাজে ঢিল ছুড়ল অয়ন।

‘রং কেমন ছিল?’

এবার আর চাপা মারা চলবে না। অয়ন বলল, ‘বুঝতে পারিনি, রাতের বেলা ছিল তো! তবে হ্যাঁ, গাড়িটার টায়ার একদম ক্ষয়ে গেছে। ফুয়েল লাইনেও লিক আছে।’

রাতে যেখানে রংই দেখা যায়নি, সেখানে ক্ষয়ে যাওয়া টায়ার আর ফুয়েল লিক কীভাবে দেখা গেল, কথাটা বোধ হয় বারলোর মাথায় খেলল না। সে শুধু বলল, ‘কী জানি! বোধ হয় ম্যাক লোগানের কথা বলছ। নীল রঙের পুরোনো একটা সেডান চালায় ও। একদম ঝরঝরে অবস্থা। কত দিন বললাম আমার কাছে বিক্রি করে দিতে, কে শোনে কার কথা! বোকার হদ্দ, আর কদিন পর মাগনা দিলেও নেব না।’

‘কার কথা বলছেন?’ জিমি প্রশ্ন করল। ‘মিউজিয়ামের ম্যাক?’

‘হ্যাঁ, ম্যাক লোগান আর কজন আছে শহরে?’ বারলো বিরক্ত।

কথাটা শুনে অয়নের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বলল, ‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, মি. বক্সার। আমরা তাহলে আসি।’

‘চমৎকার!’ ইয়ার্ড থেকে বেরিয়ে উৎফুল্ল গলায় বলল জিমি। ‘সন্দেহভাজন একজন ব্যক্তি পাওয়া গেল।’

‘তা তো বটেই,’ অয়ন বলল। ‘কিন্তু অনেক কিছুই এখনো অস্পষ্ট। ম্যাকের ওপর নজর রাখতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সময় বড্ড কম। শেলি খালা কালই চলে যাওয়ার জন্য যেভাবে পাঁয়তারা করছেন, এ রহস্য আর সমাধান করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না।’

‘হাল ছেড়ে দিচ্ছিস কেন? অন্তত চেষ্টা করে দেখি।’

‘হাল ছেড়ে দিয়েছি কে বলল তোকে?’ ভুরু নাচাল অয়ন। ‘আমার মতো নাছোড়বান্দা কটা দেখেছিস জীবনে?’

‘একটাও না,’ স্বীকার করল জিমি।

‘গুড। এবার ভেবেচিন্তে একটা বুদ্ধি বের করতে হবে। কীভাবে এ সমস্যার দ্রুত সমাপ্তি ঘটাতে পারি...আরে, এটা কী?’

কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেছে অয়ন, দৃষ্টি রাস্তার পাশের দেয়ালের ওপর। জিমিও তাকাল।

একটা পোস্টার, কমপক্ষে কয়েক মাসের পুরোনো।

হলদেটে হয়ে এসেছে, রোদ-বৃষ্টির অত্যাচারে ছিঁড়েও গেছে জায়গায় জায়গায়। তবে পড়তে তেমন অসুবিধা হলো না। সেটা এ রকম:

এই গ্রীষ্মে—

টুলসবারি নাট্যচক্রের আকর্ষণ!

কিং আর্থার অ্যান্ড হিজ রাউন্ড টেবিল নাইটস।

আগামী শুক্র, শনি ও রোববার।

সন্ধে সাতটায়।

টুলসবারি থিয়েটার মঞ্চে।

আসন সীমিত। অগ্রিম টিকিট সংগ্রহ করুন!

‘নাটকের একটা পুরোনো পোস্টার,’ মন্তব্য করল জিমি। ‘এত আগ্রহ নিয়ে দেখার কী আছে?’

‘তুই বুঝতে পারছিস না, জিমি,’ অয়ন উত্তেজিত গলায় বলল, ‘এটা একটা ছিন্ন সূত্র!’

‘গ্রিক বলা ছাড়! ছিন্ন সূত্রটা আবার কী জিনিস?’

‘পরে বুঝিয়ে দেব। এখন চল তো!’

‘কোথায়?’

‘টুলসবারি নাট্যচক্রের অফিসে!’

পাঁচ

থিয়েটার ভবনের নিচতলাতেই টুলসবারি নাট্যচক্রের অফিস। বিকেল গড়িয়ে গেছে, ভয় হচ্ছিল অফিস বন্ধই হয়ে গেল কি না। কিন্তু দেখা গেল, না, খোলাই আছে।

অফিসটা ছোট। রুম মোটে দুটো। দরজা দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে মাঝারি আকারের ওয়েটিং রুম, এক কোণে একটা ছোট্ট ডেস্কের ও ধারে বসে সেক্রেটারি। দ্বিতীয় ঘরটাই আসল অফিস।

সেক্রেটারির চেয়ারে চশমা পরা একটা মেয়ে বসে ছিল। ওদের চেয়ে বয়সে খুব একটা বড় হবে না। অয়নরা দরজা ঠেলে ঢুকতেই চোখ তুলে তাকাল।

‘কোনো সাহায্য করতে পারি?’ কণ্ঠটা রিনরিনে।

‘এখানকার সভাপতি কে?’ অয়ন জানতে চাইল।

‘মিস্টার গার্ডনার,’ বলল মেয়েটা। ‘দেখা করতে চাও? কিন্তু উনি তো নেই, অনেক আগেই বেরিয়ে গেছেন। বাকিরাও গেছে মিনিট পনেরো আগে। পাঁচটা বেজে গেছে, আমিও চলে যাচ্ছি। অফিস বন্ধ করে দেব। দেরি করে ফেলেছ তোমরা।’

‘ব্যাপারটা জরুরি...’

‘কী হয়েছে? নতুন নাটকে অভিনয়ের ব্যাপারই তো, নাকি? কাল সকালে এসো।’

‘কিসের নতুন নাটক?’ জিমি ভুরু কোঁচকাল।

‘আগামী মাসে আমাদের নতুন প্রযোজনা নামছে, নতুন মুখ নেওয়া হচ্ছে। বিজ্ঞাপন দিয়েছি তো! দেখোনি?’

‘না তো! দেখলেও আসতাম না। নাটক-ফাটক ভাল্লাগে না আমার।’

‘কী বলছ!’ আহত দেখাল মেয়েটাকে। ‘তাহলে কী চাও এখানে?’

গদাম করে তার অলক্ষ্যে জিমির হাঁটুতে একটা লাথি ঝাড়ল অয়ন। বেচারার কী অবস্থা হলো দেখল না। তাড়াতাড়ি বলল, ‘কিছু মনে করবেন না। আমরা আসলে বেড়াতে এসেছি এখানে। কালই চলে যাব, তাই ইচ্ছা থাকলেও অভিনয় করা সম্ভব নয়। আমার নাম অয়ন হোসেন, ও জিমি পারকার।’

‘আমি শিলা বনেট,’ একটু ইতস্তত করল মেয়েটা। ‘কিন্তু তোমাদের নামটা কোথায় শুনেছি, বলো তো?’

এই রে, প্রমাদ গুনল জিমি, ওদের চিনে ফেললেই সেরেছে!

‘কী করে বলব, বলুন?’ অয়ন বলল। ‘এখানে আমরা এই প্রথম এলাম।’

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও...মনে পড়েছে! অয়ন-জিমি, কিশোর গোয়েন্দা। কদিন আগে একটা বাঘ চোরাচালান ঠেকিয়েছিলে না? পেপারে পড়েছি।’

‘মর জ্বালা!’ বিড়বিড় করল জিমি। আরেক ভক্ত বেরিয়ে গেছে, কাজের কাজ তো হবেই না, উল্টো হাজারো প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।

‘ঠিকই ধরেছেন,’ কাষ্ঠ হাসি হাসল অয়ন, অস্বীকার করে লাভ হবে না। ‘আমরাই।’

‘তা, এখানে কী করছ?’ শিলার কণ্ঠে আগ্রহ। ‘নতুন কোনো রহস্য নয় তো?’

‘অনেকটা সে রকমই। কিছু তথ্য দরকার। সাহায্য করতে পারেন?’

‘বলো, বলো। তোমাদের সাহায্য করব না মানে? কী তথ্য?’

‘রাস্তায় একটা পুরোনো পোস্টার দেখলাম—কিং আর্থার অ্যান্ড হিজ রাউন্ড টেবিল নাইটস...’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তিন মাস আগের নাটক।’

‘কী ধরনের কস্টিউম ব্যবহার করা হয়েছিল ওতে?’

‘সব রকমই। মিডিভাল ড্রামায় কী কী লাগে, জানো তো?’

‘হ্যাঁ। কোনো বর্ম কি ছিল তাতে?’

‘থাকবে না কেন? এতগুলো নাইটের চরিত্র—ওদের আসল কস্টিউমই তো বর্ম।’

‘হুঁ,’ একটু ভাবল অয়ন। ‘বর্মগুলো এখন কোথায়?’

‘কী জানি!’ ঠোঁট ওলটাল শিলা। ‘স্টোরে আছে বোধ হয়। না-ও থাকতে পারে। স্টোররুমটা ছোট, সব জিনিসের জায়গা হয় না। কিছু কস্টিউম পাত্রপাত্রীদের কাছেই থাকে, দরকার পড়লে ওরাই নিয়ে আসে।’

‘শিওর হওয়া যায় না?’

‘তা যায়, রেজিস্টার দেখলে বলতে পারব।’

‘দেখুন না একটু!’

কেবিনেট খুলে একটা মোটা খাতা বের করল শিলা। আলোচ্য নাটকটির পাত্রপাত্রীদের তালিকা বের করল। তারপর সেটা ঠেলে দিল অয়নের দিকে।

যা দেখার তা দুই মিনিটেই দেখা হয়ে গেল। শিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল অফিস থেকে। বিদায় নেওয়ার আগে কথা আদায় করে নিল মেয়েটা, কী ঘটল না ঘটল পরে তাকে জানাতে হবে।

কটেজের দিকে পা চালাল দুই বন্ধু। অনেক দেরি হয়ে গেছে। শেলি খালা না জানি কী ভাবছেন।

‘কী বুঝছিস?’ অয়নকে জিজ্ঞেস করল জিমি।

‘অনেক কিছুই,’ অয়নের চোখ চকচক করছে। ‘রহস্যটা প্রায় সমাধান করে এনেছি। এখন শুধু কিছু নিরেট প্রমাণ দরকার।’

‘কতটা নিরেট?’

‘অনেকটাই। কালো নাইটকে চাই আমার।’

‘মানে!’

‘মানে-ফানে আবার কী? ভূত মহোদয়কে ফাঁদ পেতে ধরব আমি।’

‘ফাঁদ পাততে একটা টোপ তো লাগবে! কোথায় পাবি?’

‘টোপ আমাদের কাছেই আছে,’ রহস্যময় হাসি হাসল অয়ন। ‘শেলি খালা!’

ছয়

‘এ স্রেফ পাগলামি!’ সবকিছু শুনে শেলি খালা চেঁচিয়ে উঠলেন। ‘অয়ন-জিমি, তোমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’

‘মাথা ঠিকই আছে, খালা,’ শান্তস্বরে বলল অয়ন। ‘ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন, পুরো ব্যাপারটার এটাই একমাত্র যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা।’

‘যুক্তিটুক্তি বুঝি না, তোমরা কোথাও ভুল করছ।’

‘না হয় ভুলই করছি, তবু একটা চেষ্টা করতে দোষ কী?’ বলল জিমি। ‘কাজ হলে তো ভালো, না হলেও কোনো অসুবিধা নেই।’

‘কিন্তু এতে ঝুঁকি আছে। উল্টাপাল্টা কিছু ঘটে গেলে তোমাদের মা–বাবা আমাকে আস্ত রাখবে?’

‘উল্টাপাল্টা কিছুই ঘটবে না,’ আশ্বাস দিল অয়ন। ‘আপনি রাজি থাকলে শেরিফকে ফোন করব। উনি সাহায্য করবেন।’

ওদের সঙ্গে কথায় পেরে উঠলেন না শেলি খালা। শেষে বাধ্য হলেন রাজি হতে। পরিকল্পনাটা এবার খুলে বলল অয়ন।

গ্রাহাম জনসনকে ফোন করলেন শেলি খালা। কিউরেটরকে বললেন, মিউজিয়ামে নাকি ষোড়শ শতাব্দীর একটা দুষ্প্রাপ্য চীনা ভাস্কর্য আছে বলে শুনেছেন তিনি। জিনিসটা তাকে দেখতেই হবে, নইলে দারুণ আফসোস থেকে যাবে। সকালেই যাবেন তিনি, কোনো বারণ শুনবেন না।

কিউরেটর নানাভাবে চেষ্টা করলেন তাকে নিরস্ত করার, কিন্তু শেলি খালা নাছোড়বান্দা। কিছুতেই বশ হলেন না। বাধ্য হয়ে রাজি হলেন মি. জনসন। বললেন, সকাল নয়টায় আসতে। তিনি তৈরি থাকবেন।

‘এবার?’ রিসিভার নামিয়ে প্রশ্ন করলেন খালা।

‘শেরিফকে ফোন করুন,’ বলল অয়ন। ‘তাকে বলুন, লোকজন নিয়ে রাতটা কটেজের আশপাশে লুকিয়ে থাকতে। ততক্ষণে আমি আর জিমি ফাঁদটা সাজিয়ে ফেলি।’

অদ্ভুত প্রস্তাবটা শুনে শেরিফ একটু অবাক হলেন, তবে আপত্তি করলেন না। সকালে সব খুলে বলবেন, কথা দিলেন শেলি খালা। একটু পর অয়নরাও ওদের কাজ শেষ করল।

‘এবার আমরা অপেক্ষা করব,’ বলল অয়ন। ‘আমার অনুমান ভুল না হয়ে থাকলে রাতেই দর্শন পাব কালো নাইটের।’

ঘুমোয়নি কেউই, তবে বাতিটাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিল ওরা। বাইরে থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখাতে হবে। তন্দ্রার মতো লেগে এসেছিল চোখে, হঠাৎ মচমচ শব্দে সেটা টুটে গেল। চট করে ঘড়ি দেখল অয়ন। বারোটা দশ বাজে।

সব দরজা আর জানালার সামনে কয়েক প্যাকেট চিপস ফেলে রেখেছিল অয়ন আর জিমি, সেগুলোর ওপর পা ফেলেছে কেউ, তাতেই শব্দ হয়েছে। তবে অনুপ্রবেশকারী যে-ই হোক, শব্দ হওয়ামাত্র স্থির হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে আর কোনো শব্দ হচ্ছে না।

ধাক্কা দিয়ে জিমিকে উঠে পড়ার জন্য সংকেত দিল অয়ন। ঝটপট পায়ে জুতা গলাল ওরা, তারপর টর্চ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এল।

করিডরটা ফাঁকা। একটু আগে কোন দিক থেকে শব্দ হয়েছে, বুঝতে পারেনি ওরা। কাজেই কোন দিকে যাবে, ঠিক করতে পারল না। অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল অয়ন।

হঠাৎ ডান দিক থেকে খটমট করে শব্দ হলো। বাড়িজুড়ে জায়গায় জায়গায় চেয়ার, টিপয় আর কাঠের তক্তা ফেলে রেখেছে ওরা। সেগুলোর একটার সঙ্গে অন্ধকারে ধাক্কা খেয়েছে অনুপ্রবেশকারী। মৃদু স্বরে গাল দিয়ে উঠল সে। শব্দের উৎসের দিকে এগোল দুই বন্ধু।

অলংকরণ: সাঈফ মাহ্‌মুদ

আচমকা ওদের সামনে উদয় হলো ছায়ামূর্তিটা। সঙ্গে সঙ্গে টর্চের আলো ফেলল অয়ন আর জিমি, চেহারাটা দেখার ইচ্ছা।

কালো নাইট! দুহাত তুলে ওদের ধরার জন্য ছুটে এল বর্ম পরা মূর্তিটা। এমন কিছু ঘটবে, আগেই জানা ছিল ওদের। তাই ইতিকর্তব্য নির্ধারণ করে রেখেছে।

টর্চ নিভিয়ে দিল দুই বন্ধু, উল্টো ঘুরে দৌড় দিল। পেছন পেছন ধাওয়া করে এল কালো নাইট। চট করে একটা রুমে ঢুকে পড়ল ওরা। কালো নাইটও ঢুকল এবং ফাঁদে পড়ল।

দরজার সামনেই মেঝে থেকে ছয় ইঞ্চি উঁচুতে টান টান করে বাঁধা ছিল একটা দড়ি। ভেতরে ঢুকতেই সেটার সঙ্গে পা বেঁধে গেল কালো নাইটের, হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ল সে। সঙ্গে সঙ্গে তার গায়ে এক বালতি পানি ঢেলে দিল জিমি, আর অয়ন লোহার বর্মের ওপর একটা খোলা ইলেকট্রিকের তার ফেলল—তারটার অন্য প্রান্ত দেয়ালের সঙ্গে সকেটের ভেতর ঢোকানো। সুইচ অন করতেই নাইটের ভেজা দেহ আর বর্মের ওপর দিয়ে বিদ্যুৎ বয়ে গেল। কেঁপে উঠল সে, আর্তনাদ করল। সামান্য পরেই সুইচটা অফ করল অয়ন। ততক্ষণে শত্রু অজ্ঞান হয়ে গেছে।

‘অপারেশন সাকসেসফুল!’ খুশিতে জিমির বত্রিশটি দাঁত বেরিয়ে গেছে।

‘দেখা দরকার লোকটা কে,’ বলে এগিয়ে গেল অয়ন, শিরোস্ত্রাণটা খুলে ফেলল। জিমি ততক্ষণে ঘরের বাতি জ্বেলে দিয়েছে।

মেঝের ওপর বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকা লোকটা ম্যাক লোগান। অয়ন বলল, ‘যাক, ভুল করিনি তাহলে। ওকেই আশা করেছিলাম আমি।’

তক্ষুনি শেলি খালার ঘর থেকে ধস্তাধস্তির আওয়াজ ভেসে এল। চাপা একটা নারীকণ্ঠের চিৎকারও ভেসে এল। সেদিকে ছুটল ওরা।

খালার রুমে ঢুকেই বাতি জ্বেলে দিল জিমি। দেখল, শেলি খালা বন্দী। একটা হাত মুচড়ে পিঠের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, মুখ ও হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে আক্রমণকারী—তাকে ঢালের মতো ব্যবহার করে এগোনোর চেষ্টা করছে। লোকটা টনি, মিউজিয়ামের দ্বিতীয় গার্ড। ওদের দেখে থমকে গেল সে।

‘আত্মসমর্পণ করুন, মি. টনি,’ কড়া গলায় বলল অয়ন। ‘আপনি ধরা পড়ে গেছেন।’

‘তাই নাকি?’ বলল টনি। ‘কে ধরবে আমাকে, তোমরা? দুটো পুঁচকে ছোড়া?’

‘উঁহু, আমরা,’ কখন যেন এসে পড়েছেন শেরিফ, রুমে ঢুকে তিনিই বললেন কথাটা। ‘মিসেস ওয়াল্টারকে ছেড়ে দাও, টনি। ঝামেলা কোরো না।’

শেলি খালাকে ছেড়ে পিছিয়ে গেল টনি।

‘এসব কী হচ্ছে?’ বিড়বিড় করল সে। ‘ম্যাক কোথায়?’

‘উনি ভালোই আছেন,’ মুচকি হাসল অয়ন। ‘বর্মটর্ম ভারি বাজে জিনিস। ওসব কেউ পরে?’

টনিকে হাতকড়া পরাল শেরিফের সহকারীরা।

‘প্রফেসর ডিকেন্স কোথায়?’ প্রশ্ন করলেন শেলি খালা।

‘মিউজিয়ামের তলকুঠুরিতে,’ জানাল টনি।

‘এক্ষুনি লোক পাঠাচ্ছি,’ বললেন শেরিফ।

‘আরও এক জায়গায় লোক পাঠাতে হবে, শেরিফ,’ বলল অয়ন। ‘নাটের গুরুকে ধরতে হবে না? আমার ধারণা, কিউরেটর সাহেবই ম্যাক আর টনির বস। কী, ঠিক বলিনি?’

নীরবে সায় জানাল টনি।

আধঘণ্টার মধ্যেই উদ্ধার করা হলো প্রফেসর হাওয়ার্ড ডিকেন্সকে। সেই সঙ্গে গ্রেপ্তার হলো গ্রাহাম জনসন। তার বাসার স্টোররুম থেকে উদ্ধার করা হলো চুরি যাওয়া বর্মটা।

সাত

‘আমি রীতিমতো অন্ধকারে,’ বললেন শেলি খালা। ‘লোকগুলো প্রফেসরকে কিডন্যাপ করল কেন? আমার ওপরেই–বা হামলা চালিয়েছিল কেন?’

সকালবেলা। কটেজের আঙিনায় বসে চা খাচ্ছে সবাই। প্রফেসর ডিকেন্স আছেন, আছেন শেরিফ ওয়েবলিও। গত দুই দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

‘হ্যাঁ, আমিও কিছু বুঝতে পারছি না,’ বললেন প্রফেসর। গত দুই দিন মাটির নিচের রুমটাতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে ছিলেন তিনি, সেই বিহ্বলতা এখনো কাটেনি। ‘কারণটা কী?’

‘সবই বলছি,’ শেরিফ হাসলেন। ‘কিউরেটর আর তার দুই শাগরেদ আসলে আর্টিফ্যাক্ট চোরাচালান করত। মিউজিয়ামের সব দামি জিনিস গোপনে বিক্রি করে সে জায়গায় নকল জিনিস সাজিয়ে রাখত। গ্রেপ্তার হওয়ার পর সব স্বীকার করেছে ওরা।

‘টুলসবারি ছোট্ট জায়গা, আর্টের কোনো সমঝদার নেই। আসল আর নকল জিনিসের পার্থক্য বোঝার মতো কেউ নেই এখানে। নিরাপদেই কুকীর্তি চালিয়ে যাচ্ছিল ওরা। কিন্তু বাদ সাধলেন প্রফেসর ডিকেন্স, আপনি। বর্ম নিয়ে মিউজিয়ামে আসছেন আপনি, শিল্পকর্মগুলোও দেখবেন। বুঝে ফেলবেন, ওগুলোর বেশির ভাগই নকল। ব্যাপারটা কিছুতেই ধামাচাপা দেওয়া যাবে না। কাজেই মিউজিয়ামে পৌঁছানোর আগেই আপনাকে কিডন্যাপ করা হলো। বর্মটাও চুরি করল চড়া দামে বিক্রি করবে বলে। এই একই কারণে আপনাকেও মিউজিয়ামে ঢুকতে দিতে চাইছিল না ওরা, মিসেস ওয়াল্টার। পীড়াপীড়ি করায় আপনাকেও কিডন্যাপ করতে চাইছিল। অয়ন আর জিমির জন্যই পারেনি।’

লজ্জিত ভঙ্গিতে দুই বন্ধু একটু হাসল।

‘তোমাদের ওপর আমি কিন্তু ভীষণ ইমপ্রেসড!’ আবার বললেন শেরিফ। ‘আমাকে তো তাজ্জব করে দিয়েছ। কীভাবে এত দ্রুত রহস্যটার সমাধান করলে?’

‘খুলেই বলি,’ নড়েচড়ে বসল অয়ন। ‘জনসন আর তার সঙ্গীরা কী ধরনের কুকর্ম করছে বা আদৌ করছে কি না, জানতাম না আমরা। তবে এটুকু পরিষ্কার বুঝলাম, মিউজিয়ামটা কোনো কারণে শেলি খালাকে দেখতে দিতে রাজি নয় তারা। সে জন্য আমি আর জিমি ওটা দেখতে গেলাম। সেখানে গিয়ে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হলো। মিথ্যা কথা বলেছেন মি. জনসন, ওখানে কোনো মেইনটেন্যান্সের কাজ চলছে না। তার ওপর পেলাম এটা...’ টেবিলের ওপর অদ্ভুত আকৃতির সেই চশমাটা ঠেলে দিল ও।

‘আমার চশমা!’ বলে উঠলেন প্রফেসর। ‘ধস্তাধস্তির সময় নিশ্চয়ই খুলে পড়ে গিয়েছিল।’

‘ঠিক তাই,’ মাথা ঝাঁকাল অয়ন। ‘এ ধরনের চশমা আর্কিওলজিস্টরাই ব্যবহার করে শিল্পকর্ম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার জন্য। ব্যাপারটা জানতাম আমি। পরে সুযোগ বুঝে জিনিসটা পরীক্ষা করে দেখলাম, ফ্রেমে প্রফেসরের নামের দুটো আদ্যক্ষর “এইচ ডি” খোদাই করা। অবাক লাগল, প্রফেসর তো টুলসবারিতেই পৌঁছাতে পারেননি, তার চশমা ওখানে গেল কী করে? তাহলে কি মিউজিয়ামের কেউই কিডন্যাপিংয়ের সঙ্গে জড়িত? ব্যাপারটার পেছনে যুক্তি দেখতে পেলাম। প্রফেসর কখন আসছেন, সেটা শুধু মিউজিয়ামের লোকেরাই জানত। কাজটা তাদের পক্ষেই সম্ভব। কিছু প্রমাণও পেলাম—ঘটনাস্থলে যে রকম গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল, সে রকম একটা গাড়ি ম্যাক লোগানের আছে। মনে হলো, সে-ই এতে জড়িত।’

‘ঠিকই বলেছ,’ প্রফেসর বললেন। ‘ও-ই হাত তুলে রাস্তার মাঝখানে আমার গাড়ি থামায়। ট্রাকটা ভাড়া করে আমি একাই চালিয়ে নিয়ে আসছিলাম। গাড়ি থেকে নামতেই আমার হাত-পা বেঁধে ফেলে ওরা। টনি আমাকে মিউজিয়ামে নিয়ে আসে। ম্যাক রয়ে গিয়েছিল, কেন কে জানে?’

‘পাহারা দেওয়ার জন্য,’ আবার বলতে শুরু করল অয়ন। ‘ছোট্ট কারে বর্মটার জায়গা হয়নি, কাজেই রয়ে যায় সে। তা ছাড়া ভূতের ভয়ও তো দেখাতে হবে। আটঘাট বেঁধেই নেমেছিল ওরা। প্রফেসরের উধাও হয়ে যাওয়ার সঙ্গে কীভাবে কালো নাইটের মিথ মিলিয়ে দিতে হবে, ঠিক করে রেখেছিল। জিনিসপত্র নিয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে রইল সে, এরই মধ্যে আমরা এসে পড়লাম। একটু পরই জিমি আর আমাকে রেখে চলে গেলেন শেলি খালা। ব্যস, ম্যাকের জন্য তো হলো পোয়াবারো! সশরীর কালো নাইট দেখা দেবে, এমন একটা সুযোগই তো খুঁজছিল সে। ইতিমধ্যে শহরে পৌঁছে কিউরেটরকে খবর দিয়েছে টনি। বর্ম আনার জন্য রওনা হয়ে গেলেন তিনি, বড় গাড়ি নিয়ে। যথাসময়ে আমাদের ভয় দেখাল ম্যাক। আমরা পালালাম, সেই সুযোগে বর্মটা চুরি করল জনসন, একই গাড়িতে চড়ে ম্যাকও চলে এল। তবে ভূত সাজতে গিয়েই সে সবচেয়ে বড় ভুল করল।’

‘কী রকম?’ সাগ্রহে জানতে চাইলেন শেলি খালা।

‘দেখুন, কালো নাইট সাজার জন্য একটা বর্ম প্রয়োজন হয়েছে তার। কোথায় পেল সেটা? এ জিনিস তো আর সাধারণ দোকানে পাওয়া যায় না। এই সময় পুরোনো একটা নাটকের পোস্টার দেখলাম, তাতে নাইটের চরিত্র আছে, মানে এর জন্য কস্টিউম হিসেবে বর্মও লেগেছে। নাটকের অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখলাম, ম্যাক নাট্যচক্রের নিয়মিত সদস্য। ওই নাটকে অভিনয় করেছিল সে, একজন নাইটের চরিত্রে। সবচেয়ে বড় কথা, কস্টিউমের একটা বর্ম এখনো তার কাছে রয়ে গেছে।

‘একসঙ্গে অনেকগুলো সূত্র এসে গেল হাতে। প্রফেসরের চশমা, কিডন্যাপারের গাড়ি আর ভূতের বর্ম—সব পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। খেয়াল করলাম, আর্কিওলজিস্টদের মিউজিয়ামে ঢুকতে দিতেই ওদের যত আপত্তি। প্রফেসরকে ঠেকানোর উপায় ছিল না, তাই তিনি কিডন্যাপ হয়েছেন। এখন শেলি খালাও যদি সে রকম চেষ্টা করেন, একই ঘটনা ঘটবে। এটা ভেবেই ফাঁদ পাতলাম, ঠিকই তাতে ধরা দিল ওরা।’

‘মাই গড!’ সব শুনে মাথায় হাত দিলেন শেরিফ। ‘এত কিছু ভেবেছ তুমি?’

‘ও কিছু না,’ সুযোগ বুঝে হুল ফোটাল জিমি। ‘আমাদের অয়ন আবার চিন্তাসাগর কিনা!’

‘জিমি!’ চোখ গরম করে ধমক দিল অয়ন।

‘দুঃখ শুধু একটাই,’ বললেন প্রফেসর। ‘এত দিন ধরে ওরা কত কিছু পাচার করে দিয়েছে, সেসব কি আর ফেরত পাওয়া যাবে?’

‘চেষ্টার কোনো ত্রুটি করব না,’ কথা দিলেন শেরিফ। ‘যা পাওয়া যায়, তা-ই সই। বদমাশগুলোকে যে শেষ পর্যন্ত ধরতে পেরেছি, এতেই আমি খুশি।’

‘খালা,’ এবার বলল জিমি। ‘আমাদের ছাড়ো। ঘুরে আসি। বসে থাকতে ভাল্লাগছে না।’

‘যাও,’ বললেন শেলি খালা। ‘দেখো, নতুন কোনো ঝামেলায় জড়িয়ো না।’

‘মাথা খারাপ!’ উঠে পড়ল দুই বন্ধু।

কিছুদূর গিয়েই খপ করে জিমির কান চেপে ধরল অয়ন। ব্যথায় ককিয়ে উঠে জিমি বলল, ‘উহ্, ছাড় ছাড়! কী করছিস?’

‘তোকে শিক্ষা দিচ্ছি,’ বলল অয়ন। ‘চিন্তাসাগর, না? আমি চিন্তাসাগর নাকি হিংস্রসাগর, এক্ষুনি টের পাবি। আর বলবি কখনো?’

ঝট করে একটানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল জিমি। ‘এক শ বার বলব!’ বলেই দিল ছুট!

‘তবে রে!’ ওকে ধাওয়া করল অয়ন।

পেছন থেকে সমস্বরে হেসে উঠল সবাই।