কুকুর

হুমায়ূন আহমেদ যে বাংলাদেশের কিংবদন্তী কথাসাহিত্যিক, তা তোমরা সবাই জানো। চলো, সবাই মিলে তাঁর এই গল্পটি আবার পড়ি। পড়লেই বুঝবে, কী অদ্ভুত একটা ঘোরলাগা গল্প লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। ‘কুকুর’ গল্পটি আছে হুমায়ূন আহমেদের ‘গল্পসমগ্র’ বইয়ে। বইটি প্রকাশ করেছে কাকলী প্রকাশনী।

‘কেমন আছেন প্রফেসর সাহেব?’

আমি মনের বিরক্তি গোপন করার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে বললাম, ‘জি, ভালো আছি।’

ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, ‘বসব খানিকক্ষণ?’

‘বসুন। আমি অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরুব।’

‘আমাকে কি চিনতে পারছেন?’

‘জি না।’

‘ওই যে মোড়ের সিগারেটের দোকানের সামনে আলাপ হলো। আপনি সিগারেট কিনছিলেন, আমি পান।’

আমি ভদ্রলোককে চিনতে পারলাম না। মোড়ের পানের দোকানে সামান্য আলাপের পর সারা জীবন চিনে রাখব আমার স্মৃতিশক্তি এত ভালো নয়। ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, ‘আমার নাম আলীমুজ্জামান। পোস্টাল সার্ভিসে ছিলাম। তিন বছর আগে রিটায়ার করেছি। এইটথ মে, মঙ্গলবার। এখন ঘরেই থাকি। একটা বাগান করেছি।’

‘ভালো, খুবই ভালো।’

ভদ্রলোক সোফায় বসেছেন। কৌতূহলী চোখে চারদিক দেখছেন। বারবার আমার বইয়ের আলমিরায় তাঁর চোখ আটকে যাচ্ছে। আমি শঙ্কিত বোধ করছি। এখনই হয়তো বলবেন, ‘আপনার তো অনেক বই। কয়েকটা নিয়ে যাই। পড়ে ফেরত দেব।’

আমি এখন পর্যন্ত কাউকে দেখিনি যে বই পড়ে ফেরত দেয়। ইনিও দেবেন তা মনে হয় না। বই নেওয়ার ছুতায় রোজ এসে বিরক্ত করবেন। আমি এমন কোনো মিশুক লোক না যে এই বুড়ো মানুষটির সঙ্গ পছন্দ করব।

‘প্রফেসর সাহেব, আপনি কি ভূত-প্রেত এই সব বিশ্বাস করেন?’

‘জি না, করি না।’

‘শুনে ভালো লাগল। আজকাল শিক্ষিত লোক দেখি এই সব বিশ্বাস করে। মনটা খারাপ হয়। মানুষ চাঁদে যাচ্ছে বিশ্বাস করছে আবার ভূতও বিশ্বাস করছে। ফিজিকসের এক প্রফেসরের হাতে দেখেছি চারটা পাথরের আংটি।’ আমি চুপ করে রইলাম। আমার কাছ থেকে উত্তর না পেলে ভদ্রলোকের আলাপের উত্সাহ হয়তো কমে যাবে। তিনি বিদায় হবেন।

‘প্রফেসর সাহেব।’

‘জি।’

‘আপনি কি কোইনসিডেন্সে বিশ্বাস করেন?’

‘আপনার প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।’

‘কাকতালীয় ঘটনা।’

‘আমি এখনো আপনার প্রশ্নটা বুঝতে পারছি না।’

‘আরেক দিন আপনাকে বলব। আজ মনে হচ্ছে আপনি একটু বিরক্ত। তবে ঘটনাটা বলা শুরু করলে আপনার বিরক্তি কেটে যেত।’

আমি ভদ্রলোকের কথায় সত্যিকার অর্থেই লজ্জিত বোধ করলাম। আমি বিরক্ত নিশ্চয়ই হয়েছি কিন্তু সেই বিরক্তি উনি ধরে ফেলবেন তা বুঝতে পারিনি। রিটায়ার্ড মানুষ। একা একা থাকেন। কথা বলার সঙ্গী তো তাঁদেরই দরকার।

‘প্রফেসর সাহেব, উঠি।’

‘উঠবেন?’

‘জি। আজকাল কোথাও বেশিক্ষণ বসি না। রিটায়ার্ড মানুষদের কেউ পছন্দ করে না। সবাই ভাবে সময় নষ্ট করার জন্য গিয়েছি। তা ছাড়া মানুষের সঙ্গ আমি নিজেও খুব পছন্দ করি না।’

‘আপনি আসবেন, আপনার সঙ্গে গল্প করব। কোনো অসুবিধা নেই। আজ অবিশ্যি একটু ব্যস্ত।’

‘গল্পগুজব আমি তেমন পারি না। কোইনসিডেন্সের একটা ব্যাপার আমার জীবনে আছে—ওই গল্পটা ছাড়া আমি কোনো গল্প জানি না। গল্পটা খুবই ব্যক্তিগত। এই জীবনে অল্প কয়েকজনকে বলেছি। আপনাকে কেন জানি বলার ইচ্ছা করছিল।’

‘অবশ্যই বলবেন।’

‘আপনি যদি দয়া করে একটু বারান্দায় আসেন তাহলে আমার বাসাটা আপনাকে দেখাতাম। হঠাত্ কোনো একদিন চলে এলে ভালো লাগত।’

আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ভদ্রলোক হাত উঁচু করে দেয়াল দিয়ে ঘেরা একতলা একটি বাড়ি দেখালেন। পুরোনো বাড়ি। দোতলার কাজ শুরু করা হয়েছিল। শেষ হয়নি। বাড়ির সামনে দুটো জড়াজড়ি কাঁঠালগাছ।

‘একদিন যদি আসেন আপনার ভালো লাগবে। আমার জীবনের কোইনসিডেন্সের ঘটনাও শুনবেন।’

‘জি, আচ্ছা, একদিন যাব।’

‘আমার নামটা আপনার মনে আছে তো?’

‘জি আছে।’

‘নামটা বলুন তো?’

আমি দ্বিতীয়বার লজ্জা পেলাম। কারণ, ভদ্রলোকের নাম কিছুতেই মনে করতে পারলাম না।

ভদ্রলোকের স্বভাবও এমন বিচিত্র যে আমার লজ্জা বুঝতে পেরেও জবাবের জন্য মাথা নিচু করে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

‘নামটা বোধ হয় আপনার মনে পড়ছে না, তাই না?’

‘জি না।’ ‘মনে থাকার কথাও না। আনকমন নাম মানুষের মনে থাকে। আমার নাম খুবই কমন, আলীমুজ্জামান। একদিন আসবেন আমার বাসায় দয়া করে। ঘটনাটা বলব। শুনতে আপনার খারাপ লাগবে না।’

‘জি আচ্ছা, আমি যাব। খুব শিগগিরই একদিন যাব।’

এক বৃহস্পতিবার বিকেলে ভদ্রলোকের বাসায় উপস্থিত হলাম। গল্প শোনার আগ্রহে নয়, লজ্জা কাটানোর জন্য। ভদ্রলোক ওই দিন আমাকে খুব লজ্জায় ফেলেছিলেন।

বাসায় ঢুকে আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। সাধারণ একটা বসার ঘর। বেতের কয়েকটা চেয়ার। দেয়ালজোড়া বইয়ের আলমিরা। খুব কম করে হলেও হাজার পনেরো বই ভদ্রলোকের সংগ্রহে আছে। কারও ব্যক্তিগত সংগ্রহে এত বই থাকে আমার জানা ছিল না। নিজের অজান্তেই আমি বললাম, ‘অপূর্ব!’

ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, ‘বলেছিলাম না, আমার বাসায় এলে আপনার ভালো লাগবে।’

‘আপনার বইয়ের সংখ্যা কত?’

‘ষোলো হাজারের কিছু বেশি। আমার শোবার ঘরেও বেশ কিছু বই আছে। আপনাকে দেখাব।’

‘সব আপনার নিজের সংগ্রহ?’

‘আমার বাবার সংগ্রহ অনেক আছে। বই কেনার বাতিক বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। বইপাগল লোক ছিলেন। খুব বই পড়তেন। আমি তাঁর মতো পড়তে পারি না। অনেক বই আছে আমি কিনে রেখেছি, এখনো পড়িনি।’

‘এখন তো প্রচুর অবসর। এখন নিশ্চয় পড়ছেন।’

‘আমার চোখের সমস্যা আছে। বেশিক্ষণ একনাগাড়ে পড়তে পারি না। আমি খুব খুশি হব যদি আমার লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে আপনি পড়েন। বই তো পড়ার জন্যই, আলমিরায় সাজিয়ে রাখার জন্য না।’

‘আপনি কি সবাইকেই বই পড়তে দেন?’

‘জি দেই।’

‘তারা বই ফেরত দেয়?’

‘অনেকেই দেয় না। সেই সব পরে কিনে ফেলি। আমার সংসার ছোট। একটা মাত্র মেয়ে, স্ত্রী মারা গেছেন। সংসারের তুলনায় টাকাপয়সা ভালোই আছে। বই কেনায় একটা অংশ ব্যয় করি। আপনি ঘুরে ঘুরে বই দেখুন। আমি চা নিয়ে আসছি।’

‘চা লাগবে না।’

‘কেন লাগবে না? চা খেতে খেতে গল্প করব। আমার ঘটনাটা আপনাকে বলব। আপনাকে বলার জন্য আমি একধরনের আগ্রহ অনুভব করছি।’

‘কেন বলুন তো?’

‘আপনি বিজ্ঞানের মানুষ। আপনি শুনলে একটা ব্যাখ্যা হয়তো দাঁড় করাতে পারবেন। অবিশ্যি ব্যাখ্যার জন্য আমি খুব ব্যস্তও না। প্রতিটি বিষয়ের পেছনে একটা কার্যকরণ যে থাকতেই হবে এমন তো কোনো কথা না। আমরা কোত্থেকে এসেছি, আমরা কোথায় যাচ্ছি—এই বিষয়গুলোর তো এখনো মীমাংসা হয়নি, কী বলেন প্রফেসর সাহেব...’

অন্য সময় হলে এই ভদ্রলোকের কথায় আমি তেমন কোনো গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু যাঁর বাড়িতে বইয়ের সংখ্যা ষোলো হাজার, তাঁর কথা মন দিয়ে শুনতে হয়। তাঁর তুচ্ছতম কথাও অগ্রাহ্য করা যায় না।

ভদ্রলোকের গল্প সেই কারণেই অতি আগ্রহ নিয়ে শুনলাম। যেভাবে শুনেছি ঠিক সেভাবে বলার চেষ্টা করছি। ভদ্রলোক গল্পের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে ইংরেজিতে বলা শুরু করেছেন। আমি তা করছি না। কোনো রকম ব্যাখ্যা বা টীকা-টিপ্পনীও দিচ্ছি না। পুরোটা পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি।

ভাই, ঘটনাটা তাহলে বলা শুরু করি।

কিছু কিছু মানুষ আছে পশুপ্রেমিক। কুকুর-বিড়াল, গরু-ভেড়া এই সব জন্তুর প্রতি তাদের অসাধারণ মমতা। রাস্তায় একজন ভিখিরি চিত্কার করে কাঁদলে সে ভিখিরির কাছে এগিয়ে যাবে না কিন্তু একটা বিড়াল কুঁইকুঁই করে কাঁদলে ছুটে যাবে, বিড়ালটাকে পানি খাওয়াবে।

আপনাকে শুরুতেই বলে রাখি—আমি এ রকম কোনো পশুপ্রেমিক না। কুকুর-বিড়াল এসব আমার অপছন্দের প্রাণী। একটা গরু বা ভেড়ার গায়ে আমি হাত দিতে পারি কিন্তু কুকুর বা বিড়ালের গায়ে হাত দিতে আমার ঘেন্না লাগে। তা ছাড়া ডিপথেরিয়া, জলাতঙ্ক এই সব অসুখ এদের মাধ্যমে ছড়ায়—এটাও আমি সব সময় মনে রাখি।

যাই হোক, মূল গল্পে ফিরে যাই! আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। শীতকাল। কলেজ প্রাকটিক্যাল শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তখন পড়ি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। আমাদের বাসা ঠাকুরপাড়ায়।

একদিন বাসায় ফিরছি। দিনটা মনে আছে—বুধবার। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। গায়ে গরম কাপড় ছিল না। প্রচণ্ড শীত লাগছে। বাসার কাছাকাছি এসে দেখি পাড়ার তিন-চারটা ছেলে কাগজ, শুকনো কাঠ—এসব জড়ো করে আগুন জ্বালাচ্ছে। আমাদের সামনের বাসার নান্টুকেও দেখা গেল। মহা ত্যাঁদড় ছেলে। তার হাতে একটা কুকুরছানা। ছানাটার গায়ে কাপড় জড়ানো। শুধু মুখ বের হয়ে আছে। কুকুরছানা আরামে কুঁইকুঁই করছে।

আমি বললাম, ‘কী হচ্ছে রে নান্টু?’

নান্টু দাঁত বের করে হাসল। অন্য একজন বলল, ‘নান্টু কুকুরকে কম্বল পরিয়েছে। শীত লাগে তো এই জন্য।’ দলের বাকি সবাই হো হো করে হেসে উঠল। ছেলেগুলোর বয়স দশ থেকে এগারোর মধ্যে। এই বয়সের বালকেরা সব সময় খুব আনন্দে থাকে। নানা জায়গা থেকে আনন্দের উপকরণ সংগ্রহ করে। কুকুরকে কাপড় দিয়ে মোড়া হয়েছে, এতে তাদের আনন্দের সীমা নেই।

মানুষের সাধারণ প্রবৃত্তি হচ্ছে আনন্দে অংশগ্রহণ করা। আমি ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, আমার এগিয়ে যাওয়াটা কেউ তেমন পছন্দ করছে না। মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। হয়তো তারা চায় না ছোটদের খেলায় বড়রা অংশগ্রহণ করুক। নান্টুকে খুবই বিরক্ত মনে হলো।

ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ানোমাত্র কেরোসিনের গন্ধ পেলাম। হয়তো বাসা থেকে কেরোসিন এনে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়েছে। বালকেরা কায়দা-কানুন করতে খুব ভালোবাসে।

‘কেরোসিন দিয়েছিস নাকি?’

কেউ কোনো জবাব দিল না। নান্টুর মুখ কঠিন হয়ে গেল। আমি ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না। নান্টু বলল, ‘আপনি চলে যান।’

তার গলা কঠিন। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। তাকিয়ে দেখি নান্টুর কোলের কুকুরছানা ভিজে চুপচুপ করছে। বুকটা ধক করে উঠল। এরা কুকুরছানাটার গায়ের কাপড় কেরোসিন দিয়ে চুবিয়েছে নাকি? নতুন কোনো খেলা? একে আগুনে ছেড়ে দেবে না তো? শিশুরা মাঝে মাঝে নিষ্ঠুর খেলায় মেতে ওঠে। আমি কড়া গলায় বললাম, ‘এই নান্টু, তুই কুকুরটার গায়ে কেরোসিন ঢেলেছিস?’

নান্টু কঠিন মুখে বলল, ‘তাতে আপনার কী?’

‘কেন কেরোসিন ঢাললি?’

নান্টু কিছু বলল না। অন্য একজন বলল, ‘কুকুরটাকে আগুনের মধ্যে ছাড়বে। এর গলায় ঘুঙুর বাঁধা আছে। আগুনে ছাড়লে এর গায়ে আগুন লাগবে আর সে দৌড়াবে। ঘুঙুর বাজবে। যত তাড়াতাড়ি দৌড়াবে তত তাড়াতাড়ি ঘুঙুর বাজবে। এইটাই মজা।’

আমি হতভম্ব। এরা বলে কী! এরা বলে কী! ছেলেটার কথা শেষ হওয়ার আগেই নান্টু কুকুরছানাটা আগুনে ফেলে দিল। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। কুকুরছানা দৌড়াল না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। হয়তো-বা সে মানুষের নিষ্ঠুরতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল।

আমি আগুনের ওপর লাফিয়ে পড়লাম। আমার শার্টে আগুন ধরে গেল। প্যান্টে আগুন ধরে গেল। এই সব কিছুই গ্রাহ্য করলাম না। আমার একমাত্র চিন্তা বাচ্চাটিকে আগুন থেকে বের করতে হবে।

আলীমুজ্জামান সাহেব থামলেন।

আমি বললাম, ‘বের করতে পেরেছিলেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘বাচ্চাটা বেঁচেছিল?’

‘না বাঁচেনি। বাঁচার কথাও না। আমার গায়ে থার্ড ডিগ্রি বার্ন হয়ে গেল। কুমিল্লা মেডিকেলে কিছুদিন থাকলাম। তারপর আমাকে পাঠানো হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ। দুই মাসের ওপর হাসপাতালে থাকতে হলো। একপর্যায়ে ডাক্তাররা আমাকে বাঁচানোর আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। সেই সময় বার্নের চিকিত্সার তেমন ব্যবস্থা ছিল না। স্কিন গ্রাফেটিং হতো না। অল্পতেই শরীরে ইনফেকশন হয়ে যেত। যা-ই হোক, বেঁচে গেলাম। তবে সেই বছর পরীক্ষা দিতে পারলাম না।’

আলীমুজ্জামান সাহেব নিশ্বাস নেওয়ার জন্য থামামাত্র আমি বললাম, ‘আপনি একজন অসাধারণ মানুষ।’

‘মোটেই না। আমাকে বোকা বলতে পারেন। সামান্য একটা কুকুরছানার জন্য নিজের জীবন যেতে বসেছিল। তখন সবাই আমার বোকামির কথাটা আলোচনা করত। আমার নিজেরও মাঝে মাঝে মনে হয়েছে হয়তো বোকামিই করেছি। একজন মানুষের জীবন কুকুরের জীবনের চেয়ে অবশ্যই মূল্যবান।’

‘আপনার গল্প শুনে মুগ্ধ হয়েছি।’

‘এটা কিন্তু গল্প না। এটা গল্পের ভূমিকা। মূল গল্প এখন বলব।’

ঢাকা থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছি। শরীর তখনো খুব দুর্বল। ডাক্তার বলে দিয়েছেন প্রচুর রেস্ট নিতে। শুয়ে-বসেই দিন কাটছে। আমার ঘর দোতলায়। মাথার কাছে বিরাট জানালা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে শুয়ে থাকলে খুব খারাপ লাগে না।

এক রাতের কথা। হঠাত্ ঘুম ভেঙে গেছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ফকফকে জ্যোত্স্না। এই জ্যোত্স্নায় অদ্ভুত একটা দৃশ্য চোখে পড়ল। রাজ্যের কুকুর এসে জড়ো হয়েছে বাসার সামনে। কেউ কোনো সাড়াশব্দ করছে না বা ছোটাছুটি করছে না। সব কটা মূর্তির মতো বসে আছে। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ব্যাপারটা কী!

একসঙ্গে এতগুলো কুকুর আমি এর আগে কখনো দেখিনি। এদের এই জাতীয় আচরণের কথাও শুনিনি। আমাকে দেখে ওরা সবাই মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাল।

অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি—দেখি, হঠাত্ তাদের মধ্যে একধরনের চাঞ্চল্য দেখা গেল। এরা একে-একে চলে গেল। যেন ওদের কোনো গোপন অনুষ্ঠান ছিল, অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে—এখন চলে যাচ্ছে।

এই ব্যাপার মাঝে মাঝে ঘটতে লাগল। নির্দিষ্ট কোনো সময় না। মাসে একবার কিংবা দুই মাসে একবার এ রকম হয়।

এ রকম একটা ঘটনা চাপা থাকার কথা নয়। সবাই জেনে গেল। অনেকেই দুপুর রাতে কুকুরের দল দেখতে আসত। খবরের কাগজেও ঘটনাটা উঠেছিল। দৈনিক আজাদ-এ। ক্যাপশন ছিল—কুকুরের কাণ্ড।

আমার ছোট বোন আমাকে খুব খ্যাপাত। সে বলত কুকুরের জন্য তুমি জীবন দিতে যাচ্ছিলে, কাজেই তারা তোমাকে তাদের রাজা বানিয়েছে। তুমি হচ্ছ ‘কুকুর-রাজা’।

আমার বাবা পরের বছর বদলি হয়ে পাবনা চলে গেলেন। আমিও বাবার সঙ্গে গেলাম। সেখানেও একই কাণ্ড। এক মাস দুই মাস পরপর হঠাত্ রাজ্যের কুকুর বাসার সামনে এসে জড়ো হয়। মূর্তির মতো চুপচাপ বসে থাকে। একসময় মাথা নিচু করে চলে যায়। যেখানে গিয়েছি এই কাণ্ড ঘটছে। যেন কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে কুকুরগুলো আমার খবর পৌঁছে দিয়েছে। শুধু তা-ই না, আমার মনে হয় কুকুরগুলো আমাকে পাহারা দেয়। আমি যখন রাস্তায় হাঁটি, একটা-দুটো কুকুর সব সময় আমার সঙ্গে থাকে।

আজ আমার বয়স সাতষট্টি। আজও এই ব্যাপার ঘটছে। আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘বলেন কী!’

‘যা বলছি তার মধ্যে এক বর্ণ মিথ্যা নেই। তবে কুকুরের সভা আগের মতো ঘন ঘন হয় না। ছয় মাসে, এক বছরে একবার হয়। তবে হয়। কুকুরের ভাষা আমি জানি না। জানলে জিজ্ঞেস করতাম, তোমরা কী চাও? এই সব কেন তোমরা করো?’

‘ব্যাপারটা কি আপনার পছন্দ হয় না?’

‘না, পছন্দ হয় না। এক দিন দুই দিনের ব্যাপার হলে হয়তো পছন্দ হতো। এক দিন দুই দিনের ব্যাপার তো নয়, দিনের পর দিন ঘটছে।’

‘ভবিষ্যতে আবারও হবে বলে কি আপনার ধারণা?’

‘হ্যাঁ, হবে। আজ রাতেও হতে পারে। আপনি কি দেখতে চান?

বলতে বলতে আলীমুজ্জামান সাহেবের চোখ-মুখ বিকৃত হয়ে গেল। যেন তিনি প্রচণ্ড রাগ করছেন। যেন এই মুহূর্তে চেঁচিয়ে উঠবেন। আমি বললাম, ‘আপনি মনে হয় পুরো ব্যাপারটায় খুব আপসেট। এতে আপসেট হওয়ার কিছু নেই। পশুরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে—এতে রাগ হওয়ার কী আছে? কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অধিকার নিশ্চয়ই পশুদেরও আছে।’

‘এটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কোনো ব্যাপার নয়। এটা একটা ভৌতিক ব্যাপার। সুপারন্যাচারাল ব্যাপার।’

‘এর মধ্যে সুপারন্যাচারালের অংশ কোনটি?’

‘পুরো ব্যাপারটিই সুপারন্যাচারাল। এই অংশটি আপনাকে বলিনি বলে আপনি বুঝতে পারছেন না।’

‘বলুন শুনি।’

‘যে কুকুরছানাটিকে আমি বাঁচাতে চেয়েছিলাম, সেই কুকুরছানাটি দলটার মধ্যে সব সময় থাকে। পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া একটা কুকুর। গলায় ঘুঙুর বাঁধা। কুকুরছানাটা মাথা দোলায় আর ঘুঙুরের শব্দ হয়।’

‘আপনি ছাড়া অন্যরাও কি এই কুকুরছানাটা দেখে?’

‘না, আর কেউ দেখতে পায় না। শুধু আমি দেখতে পাই। দেখুন ভাই, আমি বিজ্ঞানের ছাত্র না। আমার বিষয় ইতিহাস। তবু অবৈজ্ঞানিক কোনো কিছুই আমি আমার জীবনে গ্রহণ করিনি। ভূত-প্রেত, ঝাড়ফুঁক, পীর-ফকির কিছুই না। অথচ সেই আমাকেই কি না সারা জীবন একটি অতিপ্রাকৃত বিষয় হজম করে যেতে হচ্ছে।’

আমি বললাম, ‘আবার কখনো এ রকম কিছু হলে আপনি দয়া করে আমাকে খবর দেবেন।’ তিনি জবাব দিলেন না।

আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম। তার পাঁচ মাস পর রাত দুটোয় টেলিফোন বেজে উঠল। আলীমুজ্জামান সাহেব টেলিফোন করেছেন। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘ওরা এসেছে। আপনি কি আসবেন?’

শ্রাবণ মাসের রাত। বাইরে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ির বাইরে পা দিলেই এক হাঁটু পানি। এমন দুর্যোগের রাতে কোথাও যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমি টেলিফোন নামিয়ে বিছানায় চাদরের নিচে ঢুকে পড়লাম।

অলংকরণ: রাজীব