ক্লাস এইটের অনির্বাণ

অলংকরণ: সারা তৌফিকা

লোকটিকে দেখতে ভয়ংকর মনে হচ্ছে। এখন গরমকাল। অথচ লম্বা কোট পরেছে। ময়লা কোটটি থেকে বিশ্রি একটা গন্ধ ভেসে আসছে। অনির্বাণের মনে হলো, কোটের গন্ধের চোটে হয়তো এক্ষুনি সে বমি করে ফেলবে। পার্কের বেঞ্চিতে পাশাপাশি বসে আছে তারা। অনির্বাণ প্রথম এসেছে। কিছুক্ষণ পর অদ্ভুত লোকটি তার পাশে এসে বসে। লোকটিকে দেখেই ভয়ে বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করে ওঠে অনির্বাণের। ছেলেধরা নয়তো? গল্প উপন্যাসে ছেলেধরার বর্ণনা যেমন থাকে, এই লোকের চেহারার সঙ্গে তা হুবহু মিলে যাচ্ছে। অনির্বাণের মনে হলো, এক্ষুনি তার চলে যাওয়া উচিত। তা নাহলে হয়তো মারাত্মক একটা বিপদে পড়ে যাবে সে।

লোকটির কোটের গন্ধ আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। তাই অনির্বাণের মুখে বমি বমি ভাবটা ক্রমশ বাড়ছে! একবার ‘ওয়াক থু...’ বলে বমি করার চেষ্টা করল। বমি হলো না। এবার মনে হলো পেটের ভেতরেও গোলমাল শুরু হয়েছে। বমি না করলে স্বস্তি আসবে না। বেঞ্চিতে বসেই মাথা ঝুঁকিয়ে আবার বমি করার চেষ্টা করল অনির্বাণ।

ভয়ংকর লোকটি অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটির চোখ দুটো মার্বেলের মতো দেখতে। মুখে প্রথম সারির দুটো দাঁত বেশ উঁচু। মাথায় কাউবয় টাইপের হ্যাট। ডান হাতে ধরা একটা লম্বা টিনের কৌটা, বাঁ হাতে সাপের মতো দেখতে অদ্ভুত আকারের একটা ছোট্ট লাঠি। পায়ে চামড়ার তৈরি দুই রঙের জুতা। ডান পায়েরটা লাল। বাঁ পায়েরটা কালো। লোকটির বাঁ কাঁধে পাটের তৈরি একটা ব্যাগ ঝুলছে! ওই ব্যাগের মুখ থেকে একটা ছোট্ট ইঁদুর মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে আসছে। আবার ঝুপ করে ব্যাগের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।

অনির্বাণ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। পার্কের এই বেঞ্চিতে আর নয়। দূরে অন্য কোনো বেঞ্চির ওপর গিয়ে বসবে সে। কিন্তু হঠাৎ তার মনে হলো, লোকটির ময়লা কোট থেকে ভেসে আসা সেই উত্কট গন্ধ এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। বরং ফুলের সুগন্ধ পাচ্ছে সে। ফুলের সুগন্ধটাই তাকে বেঞ্চি থেকে উঠতে দিচ্ছে না।

অদ্ভুত লোকটি এই প্রথম কথা বলল। অনির্বাণের কাছে জানতে চাইল, খোকা তোমার কি মন খারাপ?

লোকটির কণ্ঠ শুনে অবাক হয়ে গেল অনির্বাণ। তার ভয়ংকর চেহারা দেখে আন্দাজ করেছিল কথাবার্তাও হয়তো ভয়ংকর টাইপের হবে। অথচ লোকটির মুখে ‘খোকা তোমার নাম কী?’ এই চারটি শব্দ শুনেই মন ভরে গেল। ভয় কেটে যেতে শুরু করেছে। বেঞ্চি থেকে উঠে যাচ্ছিল অনির্বাণ। লোকটির কথা শুনে বেঞ্চিতে বসতে বসতে আড়চোখে তাকাল। লোকটি এবার প্রশ্ন করলো, খোকা, তোমার নাম তো অনির্বাণ? লোকটির মুখে নিজের নাম শুনে যারপরনাই অবাক হলো অনির্বাণ। এই লোক তার নাম জানল কী করে? এর আগে তার সঙ্গে কোথাও দেখা হয়েছে বলে তো মনে পড়ছে না। তা ছাড়া এ ধরনের অদ্ভুত টাইপের কোনো লোকের সঙ্গে অনির্বাণের দেখা হবেই–বা কেন? কিন্তু লোকটি যেভাবে অনির্বাণের নাম বলল, তাতে সহজেই মনে হতে পারে, দুজনের মধ্যে আগে কোথাও দেখা হয়েছে। সত্যি কি এর আগে লোকটির সঙ্গে কোথাও দেখা হয়েছে? আবার মনে করার চেষ্টা করল অনির্বাণ। না, মনে পড়ছে না।

লোকটিকে প্রশ্ন করল অনির্বাণ, আপনি আমার নাম জানলেন কীভাবে?

লোকটি মৃদু হেসে বলল, শুধু নাম নয়, আমি তোমার অনেক কিছুই জানি...

অবাক বিস্ময়ে পাল্টা প্রশ্ন করল অনির্বাণ, আমার অনেক কিছুই জানেন মানে? আপনি কে?

লোকটি আগের মতোই হাসতে হাসতে বলল, আমার পরিচয়টা তোমাকে পরে দিচ্ছি। তার আগে তোমার ব্যাপারে বলি। তুমি ধানমন্ডি গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্র, রাইট?

হ্যাঁ।

তোমার রোল নম্বর ২৭, রাইট?

হ্যাঁ।

আজ তোমার হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে, রাইট?

হ্যাঁ।

তুমি অংক আর ইংরেজিতে ডাব্বা মেরেছ, অর্থাৎ ফেল করেছ, রাইট?

হ্যাঁ। বলেই এবার লোকটির মুখের দিকে তাকাল অনির্বাণ। লোকটিকে ঘিরে বিস্ময়ের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। কে এই লোক? অনির্বাণের এত খবর সে জানে কী করে? সাহস করে প্রশ্নটা করেই ফেলল।

এই যে... আপনি আমার এত খবর জানেন কী করে? আপনি কে, বলেন তো?

লোকটি আগের মতোই মৃদু হেসে বলল, আমার পরিচয় তোমাকে পরে দিচ্ছি। তবে তুমি আমাকে চেনো। তুমিই আমাকে এখানে আসতে বলেছ...

লোকটির কথা কেড়ে নিয়ে অনির্বাণ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, আমি আপনাকে চিনি? আমিই আপনাকে এখানে আসতে বলেছি? কিন্তু আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না। আপনি কে বলেন তো? এর আগে আমাদের কি দেখা হয়েছিল?

উঁচু দাঁতওয়ালা অদ্ভুত টাইপের লোকটির মুখে হাসিটা এখন বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে ছোট্ট ইঁদুরটা মাথা বের করে তাকিয়ে আছে। তার পাশে হঠাৎ একটা চিকন টাইপের সাপ লম্বা জিভ বের করে ইঁদুরের পাশেই মাথা তুলে তাকাল। অনির্বাণের যেন কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না। এত দিন শুনে এসেছে সাপ আর ইঁদুর হলো পরস্পরের কঠিন শত্রু। কেউ কাউকে দেখতে পারে না। অথচ সাপ আর ইঁদুর কত সহজভাবে পরস্পরের পাশে মাথা তুলে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে তারা অনির্বাণ ও ভয়ংকর লোকটির কথোপকথন গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে!

শর্তের কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল অনির্বাণের। ‘শর্ত’ নামের এই একটা শব্দ তার জীবনকে ফানাফানা করে দিয়েছে। বাসায় মা–বাবার বেঁধে দেওয়া শর্ত, স্কুলে শিক্ষকদের বেঁধে দেওয়া শর্তের কারণে অনির্বাণের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।

অনির্বাণ ভয়ংকর লোকটিকে আবার একই প্রশ্ন করল, আচ্ছা, আমাদের কি এর আগে কোথাও দেখা হয়েছিল?

হ্যাঁ। বহুবার আমাদের দুজনের দেখা হয়েছে।

মানে? অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করল অনির্বাণ।

অদ্ভুত লোকটি বলল, মানে খুবই পরিষ্কার। তুমি বিপদে পড়লেই আমাকে স্মরণ করো। আমিও ছুটে আসি। আজ স্কুলে যখন তোমার পরীক্ষার রেজাল্ট দিচ্ছিল, তখনো আমার কথা স্মরণ করেছ। তাই তো আমাকে ছুটে আসতে হলো। শোনো, পরীক্ষায় খারাপ করেছ বলে মন খারাপ কোরো না। টমাস অলভা এডিসনের নাম শুনেছ নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ, শুনেছি। একজন পৃথিবীখ্যাত বিজ্ঞানী...বিদ্যুতের আবিষ্কারক...

অদ্ভুত লোকটি এবার অনির্বাণকে বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলল, ছোটবেলায় টমাস আলভা এডিসনও ক্লাসের সবচেয়ে দুর্বল ছাত্র ছিলেন! কাজেই একদম মন খারাপ করবে না। তুমি যদি চাও, তাহলে ক্লাসের পরীক্ষায় ভালো করার একটা পদ্ধতি বলে দিতে পারি। তুমি কি সেটা চাও?

অপরিচিতি এই অদ্ভুত লোককে এতক্ষণ বিরক্তিকর মনে হলেও এখন তাকে বেশ পছন্দ হচ্ছে অনির্বাণের। লোকটি পরীক্ষায় ভালো করার পদ্ধতি শেখাবে। অনির্বাণ তো সেটাই চায়। পরীক্ষায় ভালো করতে না পারার কারণেই সে পার্কে এসে বসে আছে। এতক্ষণে বাসায় নিশ্চয়ই হইচই শুরু হয়ে গেছে। গাড়ির ড্রাইভার মজনু ভাইয়ের জন্য খুব খারাপ লাগছে অনির্বাণের। স্কুল ছুটির পর তাকে ফাঁকি দিয়ে অনির্বাণ পার্কে এসে বসে আছে। অনির্বাণকে না পেয়ে মজনু ড্রাইভার নিশ্চয়ই বাসায় ফিরে গেছে। মা–বাবা এতক্ষণে হয়তো তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। ‘বল, অনির্বাণকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস?’ এই ধরনের প্রশ্ন করে হয়তো মজনু ড্রাইভারকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।

অদ্ভুত লোকটি আবার একই প্রশ্ন করল, তুমি কি ক্লাসের পরীক্ষায় ভালো করার পদ্ধতি শিখতে চাও?

হ্যাঁ চাই। অনেক আগ্রহ নিয়ে বলল অনির্বাণ। অদ্ভুত লোকটির ব্যাগে এখনো মাথা তুলে তাকিয়ে আছে ইঁদুর আর পাতলা লিকলিকে সেই সাপটি। দুটি প্রাণীকেই কৌটার ভেতরে পুরল অদ্ভুত লোকটি। তারপর কৌটার মুখ বন্ধ করে দিয়ে অনির্বাণের মুখের দিকে তাকাল।

তুমি নিশ্চয়ই জাদু ভালোবাসো?

হ্যাঁ, জাদু দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।

কার জাদু দেখে তুমি জাদুর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছ? একটু ভেবে নিয়ে অনির্বাণ বলল, জুয়েল আইচ...

অনির্বাণকে থামিয়ে দিল অদ্ভুত লোকটি। মৃদু হেসে বলল, তুমি সত্যি কথা বলছ না। জুয়েল আইচ তোমার প্রিয় জাদুকর, এটা ঠিক আছে। কিন্তু তুমি প্রথম জাদু দেখো গ্রামের এক অখ্যাত জাদুকরের কাছে। গ্রামের বৈশাখী মেলায় জাদু দেখিয়েছিল সেই অখ্যাত জাদুকর। নাম ছিল জালাল উদ্দিন। সে তোমার হাতে একটা টিনের কৌটা তুলে দিয়ে বলেছিল, দেখো তো কৌটার ভেতর কিছু আছে কি? কৌটা দেখে তুমি বলেছিলে, কৌটা তো ফাঁকা। ভিতরে কিছু নাই। জালাল উদ্দিন জাদুকর খালি কৌটায় কিছু বালু ভরে কৌটার মুখ বন্ধ করে ‘ছুঁ মন্তর ছুঁ...’ বলে কয়েকবার ঝাঁকি দিয়ে সবার সামনে কৌটার মুখ খোলে। সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখতে পায়, কৌটার বালু হয়ে গেছে সাদা মুড়ি। সেই মুড়ি তোমাকে খেতে দেওয়া হয়েছিল। মনে আছে সে কথা?

নিমেষেই কয়েক বছর আগের কথা মনে পড়ে যায় অনির্বাণের। মা–বাবার সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল সে। কুড়িগ্রাম শহর ছেড়ে কিছুদূর গেলেই বালিকান্দি নামের একটি গ্রাম। ওই গ্রামের মাঝখানে পাকা সড়কের পাশেই একটি হাট। সপ্তাহে দুদিন শনি ও মঙ্গলবার এই হাট বসে। ওই হাটের পাশেই একটি সরকারি স্কুলের মাঠে বৈশাখী মেলা উপলক্ষে সার্কাস বসেছিল। ছোট চাচার সঙ্গে সার্কাস দেখতে গিয়েছিল অনির্বাণ। সার্কাস শুরুর আগে রংবেরঙের পোশাক পরা একটি লোক (পরে জেনেছে এ ধরনের লোককে জোকার নামে ডাকা হয়) কৌটার ভেতর বালু ফেলে নিমেষেই সেই বালুকে মুড়ি বানিয়ে ফেলে। এই জাদু দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছিল অনির্বাণ। সেদিনই সে সিদ্ধান্ত নেয়, বড় হয়ে জাদুকর হবে!

অদ্ভুত টাইপের লোকটি অনির্বাণের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কী মিয়া, মনে পড়েছে সেই জাদুকরের কথা?

অনির্বাণ মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ, মনে পড়েছে...

ওই জাদুটা কি আবার দেখতে চাও?

অনির্বাণ অবাক হয়ে বলল, কে দেখাবে? আপনি?

হ্যাঁ। বলেই হাতের কৌটার চারপাশে লাঠি ঘোরাতে লাগল ভয়ংকর লোকটি।

অনির্বাণ তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল, আপনার কৌটায় তো সাপ আর ইঁদুর ভরিয়েছেন। সাপ আর ইঁদুরই কি মুড়ি হয়ে যাবে?

হ্যাঁ, তুমি চাইলেই হবে। তুমি মুড়ি চাও, নাকি অন্য কিছু?

অনির্বাণ ভেবে নিয়ে বলল, এর আগে বালু থেকে মুড়ি হওয়া দেখেছি। ওই মুড়ি খেতে ঝামেলা হয়নি। কিন্তু এবার সাপ আর ইঁদুর থেকে মুড়ি তৈরি হতে দেখলে খেতে রুচি হবে না। আপনি বরং অন্য কিছু তৈরি করেন।

অদ্ভুত লোকটি বলল, তুমি কী চাও, তা–ই বলো...

অনির্বাণ ভেবে নিয়ে বলল, আমি একটা কলম চাই। ওই কলমের একটা বিশেষ শক্তি থাকতে হবে। পরীক্ষার হলে বসলে কলমটি নিজেই পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের উত্তর লিখে দেবে। পারবেন এ ধরনের একটি জাদুকরি কলম বের করতে?

অনির্বাণ ভেবেছিল অদ্ভুত লোকটি এবার হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে ‘না’ বলে দেবে। কিন্তু অদ্ভুত লোকটি তাকে অবাক করে দিয়ে বলল, জো হুকুম মহারাজ। এক্ষুনি জাদুকরি কলম আপনার সামনে হাজির হয়ে যাবে।

অদ্ভুত লোকটি অদ্ভুত ভঙ্গিতেই তার হাতের কৌটা ঝাঁকাতে শুরু করে দিল। কয়েকবার ‘ছুঁ মন্তর ছুঁ’ বলে হঠাৎ কৌটার ভেতর থেকে একটি সোনালি রঙের কলম বের করে অনির্বাণের সামনে তুলে ধরল। অনির্বাণ তো অবাক। এটা কীভাবে সম্ভব? হাত বাড়িয়ে কলমটি নিতে চাইল সে! কিন্তু অদ্ভুত লোকটি অনির্বাণের হাতে কলম দিল না। হাতের কৌটা বন্ধ করে দিয়ে অনির্বাণকে বলল, এই কলম পেতে হলে তোমাকে কিছু শর্ত পালন করতে হবে।

শর্তের কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল অনির্বাণের। ‘শর্ত’ নামের এই একটা শব্দ তার জীবনকে ফানাফানা করে দিয়েছে। বাসায় মা–বাবার বেঁধে দেওয়া শর্ত, স্কুলে শিক্ষকদের বেঁধে দেওয়া শর্তের কারণে অনির্বাণের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। হয়তো দেখা গেল মাঠে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে ইচ্ছে করছে অথবা কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছে অনির্বাণের, তখনই এল অঙ্কের প্রাইভেট মাস্টার। অঙ্ক শেষ হতে না হতেই ইংরেজির মাস্টার এসে যায়। ইংরেজির মাস্টার চলে যাওযার পরপরই ‘হুজুর’ চলে আসেন। হুজুর চলে যাওয়ার পরপরই স্কুল থেকে দেওয়া হোমওয়ার্ক করতে বসতে হয়। হোমওয়ার্ক শেষ করে আবার পড়তে বসতে হয়। তারপর রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর জন্য বিছানায় যেতে হয়। পরের দিন সকাল হতে না হতেই মা ডাকতে থাকেন, অনির্বাণ...বাবা...ওঠ, স্কুলে যাবার সময় হয়ে গেছে...

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘুম থেকে উঠে হাত–মুখ ধুয়ে কোনোমতে নাশতা সেরে স্কুলে যায় অনির্বাণ। স্কুলেও ঘণ্টা ধরে নিয়মের পর নিয়ম। এত নিয়ম মোটেই ভালো লাগে না অনির্বাণের। সে কারণে পড়াশোনায় মন বসাতে পারে না। ফলে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল হয় না। মা–বাবা বকাঝকা করেন। তাই অনির্বাণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর স্কুলেই যাবে না। কিন্তু স্কুলে না গিয়ে সে কী করবে, এ ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য পার্কে এসেছে সে। এখন মনে হচ্ছে পার্কে আসায় একটা কাজের কাজ হয়েছে। অদ্ভুত টাইপের লোকটির কাছ থেকে সোনালি রঙের কলমটি নিতে পারলেই কেল্লাফতে! তখন আর পড়াশোনা করতে হবে না। ক্লাসের পরীক্ষায় খাতা নিয়ে বসলেই হবে। কলমই খাতা ভরিয়ে প্রশ্নোত্তর লিখে দেবে। কিন্তু অদ্ভুত টাইপের লোকটি শর্তের কথা বলছে কেন? শর্তগুলো কি খুব কঠিন হবে? দেখাই যাক না, সে কী ধরনের শর্ত আরোপ করে। এমনও তো হতে পারে, শর্তগুলো খুবই সহজ টাইপের হবে। অদ্ভুত টাইপের লোকটি অনির্বাণের চোখের দিকে তাকিয়েই আছে। হঠাৎ অনির্বাণকে প্রশ্ন করল, তুমি কি শর্তগুলো শুনতে চাও?

শর্তগুলো কি খুব কঠিন টাইপের হবে? জানতে চাইল অনির্বাণ। লোকটি মৃদু হেসে বলল, শর্ত সব সময়ই কঠিন টাইপের হয়। তবে যারা সৎ, কর্মঠ ও মেধাবী, তাদের জন্য কখনোই কোনো শর্ত কঠিন মনে হয় না। আচ্ছা তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি? লোকটি অনির্বাণের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল।

অনির্বাণ মাথা নেড়ে বলল, অবশ্যই... বলেন, কী জানতে চান!

তুমি পার্কে এভাবে বসে আছ কেন? লোকটির প্রশ্ন শুনে অনির্বাণ বলল, আপনি ঠিকই জানেন আমি কেন পার্কে বসে আছি। জেনেও না জানার ভান করছেন কেন?

লোকটি এবার মৃদু ধমক দিল অনির্বাণকে, ধরো আমি কিছুই জানি না। কেন পার্কে বসে আছ, সেটা তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।

অনির্বাণ বলল, আমি পরীক্ষায় ভালো করিনি। তাই পার্কে বসে আছি।

কেন ভালো করোনি? অদ্ভুত লোকটির এবারের প্রশ্ন শুনে অনির্বাণ বিরক্ত হয়ে বলল, পড়াশোনা আমার ভালো লাগে না। তাই পরীক্ষায় ভালো করতে পারিনি।

অদ্ভুত টাইপের লোকটি এবার কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল, ঠিক আছে, মানলাম তোমার পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না। তাহলে কী তোমার পছন্দ? কী করতে ভালো লাগে?

ঘুরতে, আড্ডা দিতে ভালো লাগে।

কোথায় ঘুরতে ভালো লাগে? দেশে, না দেশের বাইরে?

দেশ-বিদেশ দুই জায়গায়ই...

আড্ডা দাও কার সাথে? বন্ধুদের সাথে নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ। বন্ধুদের সাথেই আড্ডা দেই।

অনির্বাণের কথা শুনে অদ্ভুত লোকটি সিদ্ধান্ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ঠিক আছে, আজ থেকে তুমি শুধু ঘুরবে আর আড্ডা দেবে। তবে সে ক্ষেত্রে একটা শর্ত আছে!

শর্ত? কী? অবাক চোখে অদ্ভুত লোকটির দিতে তাকাল অনির্বাণ।

লোকটি বলল, তোমার বন্ধুর সংখ্যা কত?

অনির্বাণ ভেবে নিয়ে বলল, তা ধরেন গিয়ে প্রায় ২০ জন।

তুমি রোজ কজনের সাথে আড্ডা দাও?

১০–১২ জনের সাথে তো বটেই।

এবার তোমাকে শর্তের কথাটা বলি। একটাই শর্ত থাকবে তোমার জন্য। তোমাকে স্কুলে যেতে হবে না। পড়াশোনাও করতে হবে না। তুমি রোজ আড্ডা দিয়ে সময় কাটাবে। কিন্তু প্রতিটি আড্ডায় কম করে হলেও তোমার পাঁচ–সাতজন বন্ধু থাকতে হবে। বেশি না, পরপর মাত্র তিন দিন তুমি যদি তোমার সাতজন বন্ধুর সাথে যখন খুশি আড্ডা দিতে পারো, ঘুরে বেড়াতে পারো, তাহলে এই সোনালি কলম তোমাকে দিয়ে দেব। আর যদি আমার শর্ত পালন করতে না পারো, তাহলে তুমি আমাকে কী দেবে, বলো?

অনির্বাণ খুশি হয়ে বলল, মাত্র সাতজন বন্ধুর সাথে আড্ডা দেওয়া! এটা কোনো ব্যাপারই না। আমি যদি হেরে যাই, তাহলে আপনি যা বলবেন, আমি তা–ই করব। আর আমি যদি জিতে যাই, তাহলে পড়াশোনার ঝামেলায় আমি আর থাকব না। এ ব্যাপারে আমার মা– বাবাকে আপনিই বোঝাবেন। রাজি আছেন?

অদ্ভুত লোকটি মৃদু হেসে বলল, ইয়েস, আমি রাজি। আজ থেকে তিন দিন পর আমরা আবার এই জায়গায় মিলিত হব। তুমি যদি জিতে যাও, তাহলে এই সোনালি কলম হবে তোমার। আর যদি হেরে যাও, তাহলে আমি যা বলব তা–ই তোমাকে করতে হবে। কথা শেষ করে দুজনই একসঙ্গে পার্ক থেকে বেরিয়ে গেল।

অদ্ভুত লোকটি মৃদু হেসে বলল, ইয়েস আমি রাজি। আজ থেকে তিন দিন পর আমরা আবার এই জায়গায় মিলিত হব। তুমি যদি জিতে যাও, তাহলে এই সোনালি কলম হবে তোমার।

পরের দিন বন্ধুদেরকে সঙ্গে নিয়ে বেশ হইচই করে সময় কাটাল অনির্বাণ। ২০ জনের মধ্যে ১৭ জনই অনির্বাণের ডাকে হাজির। সবাই পার্কে ঘুরল, রেস্টুরেন্টে খেল। ধানমন্ডি লেকের ধারে বসে জম্পেশ আড্ডা দিল। তারপর সন্ধ্যার আগেই যে যার বাসায় চলে গেল। যাওয়ার আগে সিদ্ধান্ত হলো, আগামীকাল সকাল ১১টায় সবাই ধানমন্ডি লেকের ধারেই মিলিত হবে। কিন্তু পরের দিন অনির্বাণ বাদে মাত্র পাঁচজন ধানমন্ডি লেকের ধারে এল। তার পরের দিন কাউকেই আর পাওয়া গেল না। অস্থির হয়ে উঠল অনির্বাণ। যাকেই ফোন করে, সে–ই ফোন কেটে দেয়। অথবা বলে, দোস্ত, এখন ব্যস্ত আছি। পরে ফোন কর।

লেকের ধারে একা একটি বেঞ্চির উপর বসে আছে অনির্বাণ। বন্ধুদের কথা ভাবছে। প্রথম দিন সবাই কি বাহবাটাই না দিয়েছে অনির্বাণকে। অথচ মাত্র তিনদিনেই কেউ তার পাশে নাই। তার মানে হেরে গেছে অনির্বাণ? এখন কী করবে?

হঠাৎ অদ্ভুত লোকটির ডাকে চমক ভাঙল অনির্বাণের। অসহায়ের মতো লোকটির মুখের দিকে তাকাল সে। বলল, আমি হেরে গেছি। এখন আপনি যা বলবেন, আমি তা–ই করব!

অদ্ভুত লোকটি অনির্বাণকে বলল, চলো আমার সাথে... অনির্বাণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব?

লোকটি আদরের ভঙ্গিতে বলল, কোন প্রশ্ন করবে না। আমি তোমাকে যেখানে নিয়ে যাব, তুমি সেখানেই যাবে। এসো আমার সাথে!

অনির্বাণের মনে হলো অদ্ভুত লোকটির সঙ্গে আকাশে উড়ে যাচ্ছে সে। একে একে শহরের ২০টি বাসায় অনির্বাণকে নিয়ে গিয়ে পরিস্থিতি দেখাল অদ্ভুত লোকটি। প্রতিটি বাসায় পড়াশোনায় ব্যস্ত অনির্বাণের বন্ধুরা।

সবচেয়ে কাছের বন্ধু তানভির, সজল, সাব্বির গতকালও অনির্বাণের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছে। কী সুন্দর সুন্দর কথাই না বলেছে অনির্বাণকে। দোস্ত, পড়াশোনা করে কিছুই হবে না। শুধু শুধু সময় নষ্ট। আমরা প্রতিদিন এভাবেই ঘুরব। আড্ডা দেব...

অনির্বাণের ইচ্ছা হলো সে সরাসরি তানভির, সজল আর সাব্বিরের সঙ্গে কথা বলবে। অনির্বাণের ইচ্ছার কথা জানতে পেরে অদ্ভুত লোকটি তারও সুযোগ করে দিল। শুধু তিন বন্ধু নয়, অনির্বাণ অন্য বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চাইলেও সেটা সম্ভব। অনির্বাণকে শুধু মনে মনে ইচ্ছার কথাটা প্রকাশ করতে হবে। ইচ্ছা প্রকাশ করামাত্রই কাঙ্ক্ষিত বন্ধুর কাছে যেতে পারবে অনির্বাণ। বন্ধুকে সে দেখতে পাবে। কিন্তু বন্ধু তাকে দেখতে পাবে না।

প্রথমে তানভিরের সঙ্গে দেখা করার কথা ভাবল অনির্বাণ। সঙ্গে সঙ্গেই তানভিরের পড়ার টেবিলে হাজির হলো অনির্বাণ। পড়ার টেবিলের পাশেই বিছানায় বসে সজলের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলছে তানভির। ‘বুঝলি সজল, অনির্বাণকে দিয়ে আসলে কিছুই হবে না। ও কি ভেবেছে আমরা ওর সাথে তাল মিলিয়ে পড়াশোনা বাদ দিয়ে ঘুরে বেড়াব। অত বোকা আমরা নই, কী বলিস? দোস্ত এখন ফোন রাখি। এখন পড়তে বসতে হবে।’

সজলের ফোন কেটে দিয়ে সাব্বিরকে ফোন দিল তানভির। ‘কীরে, তুই কি অনির্বাণের ওখানে গিয়েছিলি? যাস নাই? ভালো করেছিস? কী বললি? আমি গিয়েছি কি না? শোন, আমি অত বোকা নই যে পড়াশোনা বাদ দিয়ে অহেতুক ঘুরে বেড়াব। অনির্বাণ ফোন দিয়েছিল। আমি ফোন ধরিনি। ফোন ধরে কী বলব, বল? তবে কথা কি জানিস, অনির্বাণ খুবই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট...ও যদি পড়াশোনার ব্যাপারে একটু সিরিয়াস হয়, তাহলে আমরা কেউ ওর সাথে পারব না...’

আকাশে অদ্ভুত লোকটির সঙ্গে পাশাপাশি উড়ে যাচ্ছে অনির্বাণ। মা–বাবার কথা মনে পড়ছে। মা প্রায় প্রতিদিনই একটা পরামর্শ দেন, ‘বাবারে, আর যা–ই করিস, পড়াশোনায় ফাঁকি দিস না। এত যে “বন্ধু বন্ধু” করিস, তুই ছাড়া সবাই কিন্তু পড়াশোনাকেই প্রথম গুরুত্ব দেয়। পড়াশোনায় ভালো কর, দেখবি তোর অনেক বন্ধু হবে। আর যদি পড়াশোনায় ভালো না করিস, তাহলে তোর সাথে কোনো বন্ধুই থাকবে না।’

লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারছে না অনির্বাণ। অদ্ভুত লোকটি প্রশ্ন করল, খুব বেশি খারাপ লাগছে?

অনির্বাণ বলল, হ্যাঁ...।

এখনো তোমার মন বলছে, পড়াশোনার প্রয়োজন নাই?

না, সে কথা মনে হচ্ছে না। পড়াশোনার প্রয়োজন আছে।

তাহলে তোমার কী করা উচিত?

অনির্বাণ বলল, কথায় নয়, এখন আমি কাজে প্রমাণ করে দেখাব।

দুজনই আকাশে উড়তে থাকল।

সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙল অনির্বাণের। প্রচণ্ড জ্বর এসেছে। মা অনির্বাণের মাথায় হাত দিয়ে জ্বরের মাত্রা বুঝে আঁতকে উঠলেন, সর্বনাশ, তোর তো অনেক জ্বর রে বাবা। ডাক্তার ডাকতে হবে। এক কাজ কর, তুই শুয়ে থাক। আজ আর স্কুলে যেতে হবে না।

মাকে অবাক করে দিয়ে অনির্বাণ বিছানা থেকে নেমে বলল, সামান্য জ্বরে আমার কিছুই হবে না মা। আমাকে স্কুলে যেতেই হবে। মা যতই বলেন, স্কুলে যাওয়ার দরকার নাই, অনির্বাণ ততই জেদি হয়ে ওঠে। ছেলের পরিবর্তন দেখে মা মনে মনে খুশি হন। আনন্দে তাঁর চোখ ছলছল করে ওঠে। কান্না লুকাতে পাশের ঘরে চলে যান। বিছানায় বসে রাতে দেখা স্বপ্নের কথা ভাবে অনির্বাণ। স্বপ্নে দেখা ঘটনাগুলোর সঙ্গে কি বাস্তবের কোনো মিল আছে? যাচাই করার জন্য প্রথমে তানভিরকে ফোন করার কথা ভাবে। তানভির কথা দিয়েছিল, আজ স্কুলে যাবে না। অনির্বাণের সঙ্গে সারা দিন এখানে–সেখানে আড্ডা দেবে।

অনির্বাণের ফোন পেয়ে তানভির তো অবাক। কিরে এত সকালে ফোন দিয়েছিস কেন?

আজ না আমাদের সারা দিন ঘুরে বেড়ানোর কথা...অনির্বাণের কথা কেড়ে নিয়ে তানভির বলল, তুই কি পাগল হয়েছিস? স্কুল কামাই করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াব! না ভাই, আমি সেটা পারব না। তুই পরীক্ষায় বরাবরই খারাপ করিস। এটা সবাই জানে। তাই কেউ কিছু বলে না। কিন্তু আমার লড়াইটা তো প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হওয়া নিয়ে। হাফ ইয়ার্লিতে একটু পিছিয়ে গেছি দোস্ত। ফাইনালে সেটা কাভার করতে হবে। রাখি রে দোস্ত... অনেকটা মুখের ওপর ফোন কেটে দেয় তানভির। অনির্বাণের ভেতরে একটা জেদ চেপে বসে। পরীক্ষায় ভালো করার জেদ। তার মানে ক্লাসের পড়াশোনায় মনোযোগী হতে হবে। জ্বর শরীরেই গাড়িতে চড়ে স্কুলের দিকে রওনা হয় অনির্বাণ। হঠাৎ দেখতে পায় রাস্তার ধারে রাতে স্বপ্নে দেখা সেই অদ্ভুত লোকটি দাঁড়িয়ে আছে। হাত নেড়ে তাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। কী যে ভালো লাগছে অনির্বাণের...