কয়েনের জাদু

অলংকরণ: বিপ্লব চক্রবর্তী

পত্রিকার স্ট্যান্ড থেকে একটা পত্রিকা নিলাম। একঠোঙা বাদাম কিনে বসলাম পার্কের শেড দেওয়া একটা বেঞ্চের ওপরে। ঘড়িতে সকাল ৯টা। পেপারটা দেখে নিলাম একনজর। কেটে গেল ৭ মিনিট। একটা আর্টিকেল পড়লাম নদীতে শাকসবজির চাষবিষয়ক। ইন্টারেস্টিং। ট্যানারি কম্পাউন্ডে কী হচ্ছে তা নিয়ে ছাপা ফিচারটাও পড়লাম। এবং সম্পাদকের কাছে লেখা শ্রমিকদের পাঠানো চিঠিও। সব মিলে গেল ২২ মিনিট।

কিছু একটা খেতে হবে। পেপারটা ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ালাম এবার। এই এলাকায় আমি নতুন। যাব চাঁপাই। রাতে কুয়াশার তোড়ে দিক ভুলে এই শহরটায় এসে পড়েছি। প্রথমে ভেবেছিলাম রাজশাহী। কিন্তু পরে মনে হলো এর আশপাশের কোনো সীমান্তবর্তী এলাকা হবে। সাইনবোর্ডে দেখতে পাচ্ছি লেখা রামপাকুর। রামচন্দ্রপুর বলে একটা জায়গা আছে, অনেক দূরে পাকুর বলেও একটা জেলা আছে সম্ভবত। কিন্তু রামপাকুরের নাম কখনো শুনিনি। আমি অবশ্য ভূগোলে খুবই কাঁচা।

রাতেই একটা রেস্টহাউসে উঠেছি। খুবই বিচিত্র ধরনের রেস্টহাউস। কুচুটে বাড়িওয়ালি আগাম ভাড়া নিয়ে ড্রয়ার হাতড়ে কিছু টাকাপয়সা দিয়েছিল। সেটাই এখন ভাঙছি। ভাঙতে ভাঙতে এখন আছে শুধু ৫০ টাকার একটা কয়েন। ৫০ টাকার কয়েন! আমার নিজেরই পয়লা বিশ্বাস হচ্ছিল না। ৫ টাকার কয়েন থেকে সামান্য মোটা আর সামান্য বড়। তামাটে রং। বেশ পুরোনো আমলের বলে মনে হলো। পাশের দেশের কি না কে জানে! সীমান্তের এলাকাগুলোতে নাকি দুই দেশের মুদ্রাই চলে কখনো-সখনো। যাকগে, এটাও ঝেড়ে ফেলা যায় কি না, ভাবতে ভাবতে কাছের রেস্তোরাঁয় গিয়ে নাশতার অর্ডার দিলাম। ক্যালসিয়াম ব্রেড আর পুদিনা সস, সঙ্গে বিশাল এক ডিমপোচ আর তিতকুটে কফি। সব মিলে ৫০ টাকাই বিল হলো। ম্যানেজার বিনা বাক্যে কয়েনটা নিল। খুশি মনে বেরিয়ে এলাম।

তেমন পথচারী ছিল না। একটু দক্ষিণে যেতেই রাস্তাটা একটু নিচে নেমে সোজা ডান দিকে নদীর খাড়া বাঁধে গিয়ে শেষ হয়েছে। একটা ট্রাক দেখলাম বাঁধটা টপকে গেল। হাঁটতে হাঁটতে বাঁধের ওপরে উঠলাম। এক পাশে বেঞ্চিতে পা ঝুলিয়ে বসে নদী আর নদীর ওপারের ল্যান্ডস্কেপটা উপভোগ করলাম কিছুক্ষণ। খানিক বাদে হেঁটে ফিরতে লাগলাম শহরে।

হঠাৎ মনে ভাবনা এল, আরে! ট্রাকটা কোথায় গেল? বাঁধের পরে তো আর কোনো রাস্তা নেই। চারদিকে তাকালাম। আর তখনই ছোট্ট কিন্তু অদ্ভুতদর্শন কয়েকটা বাড়ি নজরে এল। অবাক কাণ্ড, ১০ জানালার দোতলা বাড়িগুলোর কোনোটিতে একটাও দরজা নেই। সব বাড়ির জানালাগুলোর নিচের অর্ধেকটা সাদা রং করা। একটা বাড়ির ছাদ থেকে হঠাৎ একঝাঁক কাক উড়ে কা কা করতে করতে ঘুরতে লাগল চক্রাকারে। চোখ নামিয়ে ঘুরে আবার সাহেব চত্বরের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। ট্রাকটার হাওয়া হয়ে যাওয়া, অদ্ভুত বাড়ি, কাকের চক্রাকারে ওড়া—এসব কিছু নিয়ে একটু ধন্দে পড়ে গেছি। চোখের মধ্যে বালু পড়ার মতো খচখচ করছে।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চত্বরে এসে একটা সফট ড্রিংকসের দোকানের পাশে দাঁড়ালাম। তখনই মনে পড়ল পকেটে কোনো টাকাপয়সা নেই। এখন দরকার হলে চেক ভাঙাতে হবে। পকেটে হাত ঢোকাতে ঢোকাতে ভাবলাম, মুখে একটা তোষামুদে হাসি ঝুলিয়ে সফট ড্রিংকস বিক্রি করা মেয়েটিকে বলব...কিন্তু না, তার আগেই হাতের আঙুলে একটা মুদ্রা ঠেকল। বের করে দেখি সেই ৫০ টাকার কয়েনটা। আরেব্বাস, এটা আবার কোত্থেকে এল? অবাক হলাম, আনন্দিত তো বটেই। যত দূর মনে পড়ে, আগেরবার পুরো ৫০ টাকাই খরচ করে ফেলেছিলাম। তাহলে? যাকগে, অত ভাবাভাবির কিছু নেই। পেয়েছি যখন আগে এস্তেমাল করা যাক। কিলিমানজারো নামে নতুন একটা স্মুদি দেখলাম তালিকায়। নিলাম ওটা। পান করে দাম চুকানোর পর একটা ভেজা ৫ টাকার কয়েন দিল জলবালিকা। খুশিতে আবহাওয়া আর ঘন কুয়াশা নিয়ে একটু আলাপও করে ফেললাম তার সঙ্গে। কয়েনটা পকেটে চালান করতে করতে ভাবলাম, আর নয়, এবার রেস্টহাউসে ফেরা যাক। কিন্তু না, পথে নামার আগেই পকেটে চালান করা হাতটা থেমে গেল পরম বিস্ময়ে, কারণ ইতিমধ্যে তার তর্জনীর অগ্রভাগ তলদেশে আরেকটি মুদ্রার উপস্থিতি টের পেয়েছে। আলগোছে বের করা হলো সেটিকে এবং খুব ভালো করে নিরীক্ষণ করে দেখা গেল একটু ভেজা ভেজা, কিন্তু গায়ে ৫০ টাকা, ২০৩০ খোদাই করা আছে যথাযথভাবেই। মনের মধ্যে এমন একটা অনুভূতি হলো, যেটা বলে বোঝানো সম্ভব না।

কিছুক্ষণ হাঁটলাম ধীর পায়ে। অন্যমনস্কভাবে কয়েনটাকে টস করতে করতে ভাবনাগুলো একটা ফোকাসে আনার চেষ্টা করলাম। এমন সময় নজরে এল কফি বার। ঢুকলাম। কয়েনটা আমার দুই আঙুলের ফাঁকে। কাউন্টারে গিয়ে সেটা দিয়ে কফি পান করলাম। কিন্তু এবার খুব মজা পেলাম না। তারপর ভাংতিটা হাতে নিয়েই এক পাশে গিয়ে পকেটটা চেক করলাম।

এবার আর বিশেষ অবাক হলাম না। পকেটে কয়েনটাকে না পেলেই বরং অবাক হতাম। কিন্তু না, ওটা ছিল যথাস্থানে। ভেজা ভেজা, ২০৩০ খোদাই করা। পাশের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গিয়ে তিন বাক্স ম্যাচ কেনার পরও পকেটে হাত চালিয়ে টের পেলাম, হ্যাঁ, জিনিস জায়গামতো চলে এসেছে। একেবারেই শান্ত থাকলাম। এবং আমার পরীক্ষা চালিয়ে যেতে লাগলাম একের পর এক। একটা বড়সড় ব্যাগ কিনে নিলাম তার আগে।

ঘণ্টাখানেক চলল। এই এক ঘণ্টার মধ্যে দশবার পাক খেয়েছি পুরো চত্বর। সফট ড্রিংকসে ভেসে গেলাম। রাজ্যের ম্যাচবাক্স আর খবরের কাগজ কিনলাম। এসব করতে করতে দোকানিদের সঙ্গে খায়খাতির হয়ে গেল। এমন মজার ক্রেতা তো তারা সহসা দেখেনি। বেশ কিছু চমকপ্রদ বিষয়ও টের পেলাম। যেমন, কয়েনটাকে খরচ করলেই কেবল পরেরটা আসবে। কিছু না কিনে ওটা যদি ছুড়ে ফেলি বা কোথাও রেখে সরে আসি, তাতে আর নতুন কয়েন আসে না। কয়েনটা যেখানে রাখা হয় সেখানেই থাকে। একমাত্র দোকানির হাতে দিলে খুচরা ফেরত আসার মুহূর্তেই ওটা ফিরে আসে পকেটে। এক পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখলে অন্য পকেটে আসে। জিপার লাগানো পকেটে মুদ্রাটা আসে না। দুই হাত পকেটে রেখে যদি কনুই দিয়ে ভাংতি নিতে গিয়ে দেখেছি, তখন শরীরের অন্য কোথাও গিয়ে হাজির হয় কয়েনটা। যেমন ধরো জুতার ভেতরে। দোকানি মুদ্রার বাক্সে রাখামাত্র সেটা হাওয়া হয়ে যাচ্ছে কোনো রকম সাড়াশব্দ না করেই, আর চলে আসছে আমার কাছে।

তো এভাবে খরচ-অসম্ভব কয়েনটাকে নিয়ে ঘুরপাক খেলাম অনেকক্ষণ। এটা যেকোনোভাবেই খরচ করে ফেলা যাচ্ছে না, সেটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিল না মোটেই। আমার মনে বরং বস্তুর স্থানান্তরকরণের সম্ভাব্যতা নিয়ে কিছু ভাবনাচিন্তা খেলা করছিল। অনেকেই ম্যাটার ট্রান্সমিশনের কথা মনে করতে পারবে। একদা বিভিন্ন কল্পকাহিনিতে এর সম্ভাব্যতা আমাদের অভিভূত করেছিল।

কিন্তু হায়, আমার কাছে কোনো ইনস্ট্রুমেন্ট ছিল না। সামান্য একটা ল্যাব থার্মোমিটারও অনেক তথ্য দিতে পারে, কিন্তু আমার কাছে তা-ও ছিল না। বাধ্য হয়ে স্রেফ ভিজ্যুয়াল অবজারভেশনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছিল আমাকে। অবশ্য সেটাও বেশিক্ষণ চালানো গেল না।

চত্বরের কফি বারটায় যখন তৃতীয়বারের মতো গেলাম, তখন দেখি আমার জন্য পুলিশের এক সদস্য আগেই সেখানে এসে দাঁড়িয়ে আছেন।

‘তো...’ কথা শুরু করলেন তিনি, কণ্ঠে পেশাদারি একটা ভঙ্গি। সতর্ক চোখে পর্যবেক্ষণ করলাম তাঁকে। বিপদের গন্ধ পাচ্ছি।

‘আপনার কাগজপত্র দেখতে পারি, জনাব?’ বেশ ভদ্রতার সঙ্গেই বললেন তিনি।

পকেট থেকে আইডি কার্ডটা বের করতে করতে বললাম, ‘কোনো প্রবলেম?’

‘সঙ্গে কয়েনটাও দেখতে চাই।’ আইডিটা হাতে নিতে নিতে বললেন পুলিশের কর্তাটি।

কথা না বলে ৫০ টাকার কয়েনটা চালান করে দিলাম পুলিশের হাতে। কফি বারের ম্যানেজারের মুখের হাবভাব বদলে গেল। চোখ সরু করে দেখতে লাগল আমাকে। মনে মনে হয়তো গালিগালাজও করছে। পুলিশ কর্মকর্তা কয়েনটি দেখে একবার উল্টেপাল্টেই খুশি মনে শুধু বললেন, ‘বাহ্।’ তারপর এমনভাবে সেটি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন, মনে হলো কোনো গ্রন্থানুরাগী দুষ্প্রাপ্য কোনো পাণ্ডুলিপি হাতে পেয়েছে এইমাত্র, আর সেটি উল্টেপাল্টে দেখছে। ধীরে ধীরে আমাদের চারপাশে ভিড় জমে গেল, তাদের মধ্যে চত্বরের বেশ কয়েকজন দোকানিও আছে। আমার সম্পর্কে নানা রকম সন্দেহ প্রকাশ করছে সবাই, টের পেলাম। অনেকেই আমার বিভিন্ন রকম জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করতে শুরু করল। বলা বাহুল্য, তার কোনোটাই খুব প্রীতিকর নয়। দু-একজন আমার কেসটা কোর্ট অব্দি তুলে দিল।

ভিড়ের অবস্থা দেখে পুলিশই একসময় বলল, ‘চলেন, হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।’

অলংকরণ: বিপ্লব চক্রবর্তী

স্টেশনে এসে পুলিশ মহোদয় আমার আইডি কার্ডটি ফেরত দিলেন। আর কর্তব্যরত সাব-ইন্সপেক্টরকে কয়েনটি দিয়ে দুটি বাক্যে কী যে বললেন, তার মর্ম আমি উদ্ধার করতে পারলাম না। ধাতব মুদ্রাটি উল্টেপাল্টে দেখে ইন্সপেক্টর বসতে বললেন। বসলাম। ‘খুচরা কত আছে বের করেন।’ কণ্ঠে স্পষ্ট তাচ্ছিল্য। তামার পয়সাগুলো বের করে টেবিলে রাখলাম। ‘কাবিল, গুনে দেখো তো।’ বললেন কাউকে উদ্দেশ করে। তারপর আমার দিকে তাকালেন খুব ঠান্ডা চোখে।

‘অনেক কেনাকাটা হয়েছে, না?’

‘হ্যাঁ, অনেক।’

‘যা যা কিনেছেন, সেসবও দিয়ে দেন।’

দুটি জাতীয় দৈনিক, স্থানীয় পত্রিকা সোনালী দিন-এর তিনটা ইস্যু, একটা লিটারেরি গেজেটের দুটি কপি, আট বাক্স ম্যাচ, চার প্যাকেট তাস, ৬ পিস গোল্ডেন কি টফি, স্টোভ পরিষ্কার করার একটা ব্রাশ ইত্যাদি বিছিয়ে রাখলাম টেবিলের ওপর।

‘ড্রিংকসগুলো দিতে পারছি না, সরি।’ বিরসবদনে বললাম। ‘পাঁচ গ্লাস জুস, স্মুদি ইত্যাদি আর দুই মগ কফি।’

ভেতের ভেতরে নাস্তানাবুদ হচ্ছিলাম এটা ভেবে যে নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমাকে না জানি কী অজুহাত খাড়া করাতে হয় এখন।

‘৭৪ টাকা, ইন্সপেক্টর।’ তরুণ কাবিল রিপোর্ট করল তার বসের কাছে। ইন্সপেক্টর বিরসবদনে পত্রিকার স্তূপের দিকে তাকালেন, দেখলেন ম্যাচের বাক্সগুলো।

‘এতগুলো পুরোনো পত্রিকা, এতগুলো ম্যাচ। ঘটনাটা কী? আপনি কি মজা করছিলেন মশাই? নাকি...?’ জিজ্ঞেস করলেন।

‘নাকি কী?’ বিরসবদনে জানতে চাইলাম।

‘আপনাকে দেখে তো বিচক্ষণ বলেই মনে হয়। কাজটা মোটেই ঠিক হয়নি। বলেন তো আসলে ঘটনাটা কী?’

খুলে বললাম। কাহিনির শেষে এসে ইন্সপেক্টরকে আন্তরিকভাবে অনুরোধ করলাম, সে যেন মনে না করে যে নতুন একটা গাড়ি কেনার টাকা জমানোর চেষ্টা করেছি আমি ওই ৫০ টাকার কয়েন ব্যবহার করে।

কথা শুনে ইন্সপেক্টর মৃদু হাসলেন। ঠিক বুঝতে পারলাম না, আমার কথাটাকে তিনি কীভাবে নিলেন।

শ্রাগ করলাম আমি, ‘বিশ্বাস করুন, ও রকম চিন্তা আমার মাথায় আসতেই পারে না।...ধ্যাত্তেরি কী বলছি। আসতে পারে না নয়, আসেইনি। সত্যি বলছি।’

এবারও সেই একই হাসি। কিঞ্চিত প্রসারিত।

‘এর চেয়ে রাস্তায় বসে ভিক্ষে করাও ভালো।’ বেশ জোর দিয়ে বললাম।

‘উঁহু, ভিক্ষাটাকে আমরা নির্মূল করতে চাই।’ বললেন তিনি, বলার ভঙ্গিতে কিছু একটা বোঝাতে চাইলেন।

‘তা তো বটেই। সেটাই তো স্বাভাবিক।’ বললাম আমি সঙ্গে সঙ্গেই। ‘আসলেই তো, আমি ভিক্ষা করতে যাব কোন দুঃখে, ভিক্ষার সঙ্গে আমার কী।’ ইন্সপেক্টর ভিক্ষার পক্ষে বললেও আমি তাঁকে জোর সমর্থন দিতাম, সন্দেহ নেই। আমি আসলে এই ঝুটঝামেলা থেকে কোনোভাবে বেরিয়ে যেতে পারলেই বাঁচি।

কোনো কথা না বলে ইন্সপেক্টর একমনে মুদ্রাটা নিরীক্ষণ করলেন অনেকক্ষণ ধরে। বিরক্তিকর নীরবতা কাটিয়ে একসময় তাঁর মুখে আওয়াজ ফুটল।

‘একটা রিপোর্ট তৈরি করতে হবে।’ বলতে বলতে কাগজ-কলম টেনে নিলেন ইন্সপেক্টর।

‘প্লিজ, অফকোর্স...যদিও...’ উত্তেজনায় হড়বড় করে বলতে শুরু করলাম আমি এবং যদিওর পরে কী বলব, সেটা আর ঠিক করে উঠতে পারলাম না। যদিও শব্দটাই বা বলতে গেলাম কোন দুঃখে কে জানে। কী আর করা। চুপ করে থাকলাম।

পুরো বাক্য শোনার আশায় কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন ইন্সপেক্টর। কিন্তু আমি ততক্ষণে চোখ বুজে ভাবার চেষ্টা করছি, আমার অপরাধটা ক্রিমিনাল কোডের কোন ধারায় পড়তে পারে। অবশ্য কোনো মানুষই নিজেকে অপরাধী মনে করে না। সে হিসেবে আমিও অপরাধী নই। কিন্তু অপরাধ, আমার মনে হয়, অবজেক্টিভ-সাবজেক্টিভ দুই রকমই হতে পারে। আর সত্য তো সত্যই: ৭৪ টাকার তাম্রমুদ্রা, যদি আইনের ভাষায় বলি, চুরিরই ফসল, যা কিনা সম্ভব হয়েছিল একটি খরচ করা যায় না এমন একটি মুদ্রার সহায়তায়।

ভেবে কোনো কূলকিনারা হলো না। চোখ মেলে দেখি ইন্সপেক্টর লেখা প্রায় শেষ করে এনেছেন। কী যে লিখছেন কে জানে। চারদিকের দেয়ালে ঝোলানো পোস্টারগুলো দেখতে দেখতে একবার আনমনে ভাবলাম, ছোঁ মেরে আইডি কার্ডটা নিয়ে জানালা দিয়ে লাফিয়ে ভেগে গেলে কেমন হয়। পরক্ষণেই বাতিল করে দিলাম আইডিয়াটা, আমার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একেবারেই যায় না। তা ছাড়া দৌড়েও আমার খুব সুনাম নেই।

‘লেখাটা পড়ে একটা স্বাক্ষর করে দিন।’ লেখা শেষ করে কাগজটা এগিয়ে দিতে দিতে বললেন ইন্সপেক্টর।

পড়লাম। প্রতিবেদনের ভাষ্য এ রকম:

আমি, নিম্নস্বাক্ষরকারী, আরিক আরবান, এআই, অজ্ঞাত উপায়ে আমার কাছে চলে আসে খরচ-অসম্ভব এমন একটি ধাতব ৫০ টাকার কয়েনের কার্যকর মডেল, অল-ইউনিয়ন গভর্নমেন্ট স্ট্যান্ডার্ড টাইপ ৭ ১৮-৬২, এবং আমি স্বেচ্ছায় এর অপব্যবহার করি; উপরন্তু, আমি, নিম্নস্বাক্ষরকারী, এটা ব্যবহার করি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করার আগ্রহ থেকেই, এবং কাউকে ঠকানোর কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না; উপরন্তু যারা আমার পরীক্ষামূলক কর্মকাণ্ডের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, আমি তাঁদের ক্ষতিপূরণ প্রদানে প্রস্তুত ছিলাম, যার পরিমাণ সাড়ে ৮০০ টাকা; এবং সর্বশেষ রামপাকুর সিটি কাউন্সিলের ২২ মার্চ ২০২৯-এর রেজল্যুশন মোতাবেক, আমি উপরোক্ত খরচ-অসম্ভব ৫০ টাকার ধাতব মুদ্রাটি দায়িত্বরত ইন্সপেক্টর সৌগত সিভিকের কাছে হস্তান্তর করেছি এবং পরিবর্তে রামপাকুরের সীমানার মধ্যে ব্যবহারযোগ্য বৈধ ৫০ টাকার একটি মুদ্রা গ্রহণ করেছি।

স্বাক্ষর।

খুশিতে আপনা থেকেই হাসি ফুটে উঠল মুখে। যাক বাবা, কঠিন কোনো অভিযোগ আনেনি। দ্রুতই স্বাক্ষর করে দিলাম। আইডির সঙ্গে প্রতিবেদনে করা আমার স্বাক্ষরটা মিলিয়ে দেখলেন লেফটেন্যান্ট। তারপর আবার তামার মুদ্রাগুলো গুনলেন। একজনকে ডেকে টফি আর ব্রাশের দামগুলো ঠিক আছে কি না চেক করতে বললেন। এরপর একটা রসিদ লিখে দিলেন আমায়। সঙ্গে রামপাকুরের সীমানার মধ্যে ব্যবহারযোগ্য ৫০ টাকার একটি মুদ্রা। দারুণ স্বস্তি বোধ করলাম।

‘আপনি এবার যেতে পারেন,’ আইডিটা ফেরত দিয়ে বললেন ইন্সপেক্টর। ‘তবে এখন থেকে সাবধান থাকবেন। রামপাকুরে আর কত দিন আছেন?’

‘কালই বিদায় নিচ্ছি, জনাব।’ দ্রুত জবাব দিলাম।

‘তাহলে কাল অব্দি একটু সাবধানে থাকবেন।’

‘তা আর বলতে।’ আইডিটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বললাম। তারপর নিজের অজান্তেই একটা প্রশ্ন বেরিয়ে এল আমার মুখ থেকে, ‘আচ্ছা ইন্সপেক্টর, কিছু যদি না মনে করেন, এই রামপাকুরে সবকিছুই একটু অদ্ভুত, তাই না?’

ইন্সপেক্টর অবশ্য ততক্ষণে তাঁর কাজের মধ্যে ডুবে গেছেন। অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলেন, ‘আমি এখানে অনেক দিন ধরে আছি। এসব গা-সওয়া হয়ে গেছে।’

(আর্কাদি ও বরিস স্ট্রুগািস্কর মানডে বিগিনস অন স্যাটারডে বইয়ের চতুর্থ অধ্যায় অবলম্বনে)