ওই লেবুঝোপগুলোর কাছে যেয়ো না। ওখানে এক জোড়া গোখরো সাপ আছে। ভারি পাজি সাপ!
চমকে পেছন ফিরে তাকাল শমী, এদিক-ওদিক তাকাল, কাউকে দেখতে পেল না। কোথাও কেউ নেই। তাহলে কথা বলল কে! শমী পরিষ্কার শুনল স্নিগ্ধ সুন্দর মেয়েকণ্ঠে খুব কাছ থেকে কথাগুলো বলল কেউ। কিন্তু বাগানের এই শেষ দিকটায় কেউ নেই, শুধু গাছপালা। আকাশ ঢেকে রাখা বড় বড় সব গাছ। তলার দিকে আছে লেবুঝোপ, হাসনাহেনা, মেহেদির ঝোপ। জবা, বেলি, কামিনীর ঝোপ আছে। আর আছে অচেনা বুনো ঝোপঝাড়। সাত-আটটা বাঁশঝাড় মিলে বাঁশের বন হয়ে আছে। কোনো কোনো বাঁশ হেলে পড়েছে, কোনোটার পাতায় লেগেছে মড়ক। বাঁশঝাড়তলার মাটি শুকনো পাতায় ছেয়ে আছে।
ফাগুন মাসের হাওয়ায় শন শন করছে বাঁশবন। মাথার ওপর স্বচ্ছ নীল আকাশ। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে ছেঁড়া কাগজের মতো রোদ পড়েছে বাগানে। গাছে গাছে পাখি ডাকছে, ঝোপঝাড়ে উড়ছে প্রজাপতি। হাওয়ায় ভাসছে বুনোফুলের গন্ধ। এক জোড়া ঘুঘু পাখি উড়ে গেল বাঁশবন ছাড়িয়ে বাড়ির পেছন দিককার ফসলের মাঠে।
এই অবস্থায় কথা বলল কে! শমী ছাড়া তো এদিকটায় কেউ নেই!
চিন্তিত ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগল শমী। নিজের অজান্তেই লেবুঝোপগুলোর কাছাকাছি এল। তখন আবার সেই কণ্ঠ। তুমি বুঝতে পারছ না, খুবই বিষধর সাপ! ছোবল দিলে রক্ষা নেই!
এবারও আগের মতো চমকাল শমী, এদিক-ওদিক তাকাল। না নেই, কোথাও কেউ নেই।
শমী চিন্তিত হলো। কেউ নেই কিন্তু পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে কথা, তাও একবার না, পরপর দুবার। এ কী করে সম্ভব! ঘটনা কী!
শমী ভাবল, আবার যদি কথা শোনা যায় তাহলে কোন দিক থেকে আসছে কথা, সেই দিকটা তীক্ষভাবে খেয়াল করবে। তখন হয়তো রহস্যটা বোঝা যাবে। বাড়ির কেউ আড়াল থেকে মজা করছে কি না বোঝা যাবে।
কিন্তু মেয়েকণ্ঠের কে এমন মজা করবে শমীর সঙ্গে! গলার স্বরে বোঝা যায় শমীর বয়সী মেয়ে। এই বয়সী মেয়ে কেউ নেই বাড়িতে। যারা আছে তারা বয়স্ক। বাড়ির বহু বছরের পুরোনো কেয়ারটেকার পবন দাস, তার স্ত্রী লক্ষ্মীরানী, ছোট মেয়ে পারুল, পারুলের স্বামী নান্টু আর তাদের ছোট ছোট দুটো ছেলে। একটার বয়স তিন, আরেকটার আট মাস। পারুল যত কাজের নান্টু ততই অলস। ছেলে দুটোকে আগলায়। বাড়ির কাজ বলতে গেলে করেই না। শ্বশুর-শাশুড়ি আর বউয়ের ওপর দিয়ে জীবন চালিয়ে যাচ্ছে। যেখানে স্ত্রী সামলাবে বাচ্চা আর স্বামী করবে কাজ, সেখানে নান্টু ধরেছে উল্টো পথ। এই নিয়ে পবন আর লক্ষ্মীরানী কতটা বিরক্ত কে জানে, পারুল যে খুবই বিরক্ত তা তার মুখ দেখলেই বোঝা যায়। বাইশ-তেইশ বছরের মেয়েটি সারাক্ষণ গম্ভীর। মুখে হাসির চিহ্নমাত্র নেই। যেন স্বামীর ওপরকার রাগ গজগজানি ভেতরে চেপে মা-বাবার সঙ্গে সাতাশি বিঘার বিশাল বাড়িটি সামলাচ্ছে। সুযোগ পেলে নান্টুকে সে একদিন দেখে নেবে।
রতনপুরের এই বাড়ি ছিল এলাকার জমিদার মানবেন্দ্র রায়চৌধুরী মহাশয়ের। এলাকার লোকে তাঁকে ‘মানুবাবু’ ডাকে। মানুবাবুর বাড়ি শ খানেক বছরের পুরোনো। একটা বিশাল দোতলা বিল্ডিং, ভেতরবাড়িতে পাকা রান্নাঘর, গোলাঘর, ভাঁড়ার ঘর আর কাজের লোকজনের থাকার ঘর। বাড়িতে ঢোকার মুখে বাঁধানো ঘাটলার বড় পুকুর। পুকুরের তিন পাড়ে নারকেলগাছ। ঘাটলার দুপাশে অনেকগুলো কদমগাছ। আষাঢ় মাসে কদমফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয় দশ দিক। আরেকটা পুকুর আছে পশ্চিম দিকে। মাঝারি সাইজের সেই পুকুর ব্যবহার করত বাড়ির মেয়েরা। পুরোনো বাড়ি বলে দালানকোঠা, ঘাটলা সবকিছুতেই ভাঙন ধরেছে। পলেস্তারা খসা ইট হাঁ করে আছে। বট-অশ্বত্থের চারা গজিয়েছে দালান ফুঁড়ে। টিয়া পাখি বাসা বেঁধেছে কার্নিশের গর্তে, চড়ুই পাখি বাসা বেঁধেছে। বুনো কবুতর ঝাঁক বেঁধে আসে, ঝাঁক বেঁধে চলে যায়।
শমীর মামাবাড়ি এই গ্রামে। একমাত্র মামা মির্জা সাহেব বিশাল বড়লোক। তাঁর জাহাজের ব্যবসা। একসময় নিজে একা ব্যবসা সামলাতেন। দিনে দিনে সেটা বড় হয়েছে। এখন একা সামলানো কঠিন। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে জামাইদের লাগিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়। বড় জামাই ঢাকার অফিস সামলায়, ছোটজন সামলায় চিটাগং অফিস। দিনে দিনে ভালো উন্নতি করছে তারা। গুলশানে রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি মির্জা সাহেবের। দীর্ঘদিন ব্যবসা করে ক্লান্ত তিনি। মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার পর, মেয়েজামাইদের ব্যবসায় ঢুকিয়ে দেওয়ার পর এখন ঝাড়া হাত-পা। তাঁর ইচ্ছা ঢাকায় আর থাকবেন না, থাকবেন গ্রামে। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাকি জীবনটা নিরিবিলিতে কাটাবেন। নিজ পুকুরের মাছ খাবেন, গোয়ালের গরু দুধ দেবে, সেই দুধ খাবেন। মাঠে বিস্তর ধানি জমি, নিজের পছন্দের কাটারিভোগ চাল আসবে মাঠ থেকে। ফলের বাগান থেকে আসবে ফল, শাকসবজি আসবে। একদম ভেজালমুক্ত খাবার। সঙ্গে আছে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। ঢাকার পরিবেশ, কী পরিবেশ! পরিবেশ হচ্ছে গ্রামে। ফ্রেশ খাওয়া, ফ্রেশ হাওয়া। জীবন এমনিতেই দীর্ঘ হয়ে যাবে।
মির্জা সাহেবের পৈতৃক বাড়ি তেমন বড় আর খোলামেলা না। মধ্যবিত্ত স্কুলমাস্টারের ছেলে তিনি। ছোট্ট ঘিঞ্জিমতো বাড়ি রেখে গেছেন বাবা। ওই বাড়িতে মির্জা সাহেবের পোষাবে না। এ জন্য মানুবাবুর বাড়িটা তিনি কিনেছেন। মানুবাবু বাড়ি বিক্রি করে কলকাতা চলে গেলেন। ছেলেমেয়েরা কলকাতাতেই থাকত সবাই। বৃদ্ধ মানুবাবু কেয়ারটেকার নিয়ে একা থাকতেন। ছেলেমেয়ে নাতি নাতনিরা বছর-দুবছরে দল বেঁধে বেড়াতে আসত। মানুবাবুও যেতেন। বয়স হয়ে যাওয়ার পর ছেলেমেয়েরা কিছুতেই গ্রামে আর তাঁকে রাখতে চাইল না। গ্রামের পাট পুরোপুরি চুকিয়ে দিলেন মানুবাবু। এলাকায় এত বড় সম্পত্তি কেনার লোক একজনই, মির্জা সাহেব। তিনি ব্যবসায়ী মানুষ। বলতে গেলে জলের দরে কিনে রাখলেন বিশাল বাড়িটি।
এসব খুব বেশি দিন আগের কথা না। বছর দেড়েক হবে। বাড়ি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে শুনে পবন পড়েছিল দুশ্চিন্তায়। তার ছেলে নেই। তিন মেয়ে। তিনজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। দুই মেয়ের একজনের শ্বশুরবাড়ি দিঘির পারের ওদিককার কামারখাড়া গ্রামে, আরেকজনের ইছাপুরা। ছোট মেয়ের শ্বশুরবাড়ি ষোলোঘর। অলস নান্টু বউ নিয়ে চলতে পারে না দেখে বাড়ি থেকে বিতাড়িত। বিয়ে হয়েছে সাত বছর। মেয়ে কান্নাকাটি করে দেখে পবন নিজের কাছে নিয়ে এসেছে। মানুবাবুই বলেছিলেন নিয়ে আসতে। কারণ, পবনের মেয়েগুলো তাঁর চোখের সামনে জন্মেছে। প্রত্যেকের বিয়েই তিনি দিয়েছেন। সাধ্যমতো খরচা করেছেন। দুজনের কপালে সুখ জুটেছে, একজন অসুখী। যদি এই বাড়িতে এনে তাকে সুখে রাখা যায়!
বাপের সংসারে এসে সুখে পারুল আছে ঠিকই, অলস স্বামী নিয়ে গঞ্জনা শুনতে হয় না, না খেয়ে থাকতে হয় না, কিন্তু দিন যত যাচ্ছে নান্টুর ওপর রাগ তত বাড়ছে। পুরুষমানুষ এমন হবে কেন? এই রাগে সারাক্ষণ গম্ভীর সে।
মানুবাবু বাড়ি বিক্রি করে চলে যাচ্ছেন, পবনের উপায় হবে কী! মাঠে ফসলের জমি যা ছিল তা আগেই বিক্রি করে ছেলেমেয়েদের টাকা দিয়েছেন। কলকাতার সল্টলেকে বাড়ি করেছে ছেলেরা। মেয়েদের অবস্থাও ভালো। রতনপুরে যেমন রাজার হালে ছিলেন মানুবাবু কলকাতায় গিয়েও সেই হালেই থাকবেন। কিন্তু পবন! তার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। জীবন কাটল মানুবাবুর বাড়ি দেখভাল করে।
মানুবাবুকে সে ডাকে কর্তা। এক সন্ধ্যায় হাতজোড় করে তাঁর সামনে দাঁড়াল। কর্তা...
কথা শেষ করতে পারল না। বাবু বললেন, পুবের মাঠে তিন বিঘা জমি তোর জন্য আমি রেখেছি। নিজে চাষ করলে ওই দিয়ে চলতে পারবি। আর যদি ভাগে লাগাস তাহলে পাবি অর্ধেক ফসল। এই নে দলিল।
লোহার সিন্দুক খুলে দলিল বের করে দিলেন।
পবন তখন বাকরুদ্ধ। চোখ ভরে গেছে জলে। অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের জল সামলাল।
বাবু বললেন, মির্জা সাহেবকে তোর কথা বলেছি। তিনি বলেছেন অন্য কেয়ারটেকার রাখবেন না। আমার সঙ্গে যেভাবে ছিলি, তাঁর সঙ্গেও সেভাবে থাকতে পারবি। অসুবিধা হবে না।
অসুবিধা পবনের হয়নি। মানুবাবুর কাছে সে যেমন ছিল, মির্জা সাহেবের কাছেও তেমনই আছে। বাড়ির দেখভাল তদারকি সব আগের মতোই তার হাতে। সাত হাজার টাকা বেতন পাচ্ছে মাসে। তিন বিঘা জমি লাগিয়েছে ভাগে। ধান যা আসে বছরের চালটা হয়ে যায়। জীবন আগের মতোই চলছে। সাত হাজার টাকার হাজার দু-তিনেক খরচা হয়। বাকিটা জমে। ছোট মেয়ে তো সঙ্গেই আছে, অন্য দু মেয়ে চম্পারানী, বকুলরানীও স্বামী-সন্তান নিয়ে বছরে একবার বেড়াতে আসে। হইচই আমোদ আনন্দে ভালোই কাটে দিন।
বাড়ি কেনার পর থেকেই মির্জা সাহেব ভাবছেন বাড়ি যেমন আছে তেমনই থাকবে, শুধু মেরামত করাবেন। চুনকাম করিয়ে বাড়ির চেহারা ঘোরাবেন। বাগান পরিপাটি করবেন, পুকুর দুটো সংস্কার করবেন। পুরোনো ফার্নিচারগুলো তাঁর খুবই পছন্দ। এসব জিনিস লাখ লাখ টাকা দিলেও আজকাল পাওয়া যাবে না। যে ফার্নিচারের যেমন বার্নিশ ঠিক সেই বার্নিশ করাবেন। অর্থাৎ পুরোনো আমলটাকে নতুন করে ধরে রাখবেন। আজ করি কাল করি করে দেড় বছর কেটে গেছে, কাজ ধরা হয়নি। বড় ব্যবসায়ীদের এই এক সমস্যা, সব গুছিয়ে কিছুতেই ঝাড়া হাত-পা হতে পারেন না। কোনো না কোনো ঝামেলা থেকেই যায়। যদিও মেয়ের জামাইরা ভালোই সামলাচ্ছে সব, তবু জটিলতা কিছু থাকে। মির্জা সাহেব হাত না লাগালে সমাধান হয় না।
গত দেড় বছরে তিনি অবশ্য আরেকটা কাজ করেছেন, দুই মেয়েকেও লাগিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়। তাদের শিখিয়ে-পড়িয়ে দিয়েছেন। বাচ্চাকাচ্চা সামলে তারাও অফিসে বসতে শুরু করেছে। ছোট মেয়েকে চিটাগংয়ে বাড়ি কিনে দিয়েছেন। সেখানে থেকে স্বামীর সঙ্গে সে অফিসে বসছে। বড় মেয়ে বসছে ঢাকার অফিসে। ফলে এখন মোটামুটি অবসরে তিনি। এবার প্রতিজ্ঞা করেছেন, আর না, বাড়ির কাজ ধরবেনই।
মির্জা সাহেব গ্রামে আসেন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। রাতটা নিজ বাড়িতে থেকে সকালবেলা চলে আসেন মানুবাবুর বাড়িতে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রামে থাকেন। ছুটির দিন দুটো কাটান। এবারও সেভাবেই এসেছেন। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ছোট বোনের একমাত্র ছেলে শমীকে। তবে অন্যবারের তুলনায় এবারের ব্যাপারটা অন্য রকম। এবার আর নিজ বাড়িতে ওঠেনইনি। সোজা চলে এসেছেন এই বাড়িতে। মোবাইল ফোনে পবনকে জানিয়ে দিয়েছিলেন দুই রাত দুদিন এই বাড়িতেই থাকবেন। পবন যেন সব পরিপাটি করে রাখে। শুক্রবার সকালে ঢাকা থেকে লোক আসবে। নামকরা কোম্পানির লোক। বাড়ির কোথায় কী কাজ করতে হবে ওসব দেখে দু-চার দিনের মধ্যে কাজ শুরু করবে। মাস খানেকের মধ্যে কাজ শেষ করবে।
পবন সেইভাবে সব ব্যবস্থা করেছে। পুকুর থেকে নানা রকমের মাছ ধরেছে। সেন্টু ময়রার দোকানের দই-মিষ্টি আনিয়েছে। লক্ষ্মীরানীর রান্নার হাত অসাধারণ। কাল রাতে খেতে বসে মুগ্ধ হয়ে গেছেন মির্জা সাহেব আর তাঁর স্ত্রী। শমী মাছ তেমন পছন্দ করে না। তার জন্য মুরগি করা হয়েছিল। সেও বেশ মজা করেই খেয়েছে।
রাতের খাবারের চেয়ে শমীর ভালো লেগেছে আজ সকালের নাশতা। খাঁটি ঘিয়ে ভাজা চমৎকার লুচি আর সুজির হালুয়া। হালুয়াতেও ঘি। গন্ধেই অর্ধেক খাওয়া হয়ে যায়। মির্জা সাহেব আর তাঁর স্ত্রী মিষ্টি তেমন খান না। তাঁরা খাচ্ছিলেন সবজি আর মুরগি ভুনা।
তখনই কথাটা বললেন মির্জা সাহেব। পবন, ধরে নাও দুমাস পর থেকে আমি পাকাপাকিভাবে এই বাড়িতে উঠছি।
আমি তো তাই চাই সাহেব। মানুকর্তা ছিলেন, বাড়িটা ভরভরাট ছিল। আপনি থাকলে সেই অবস্থা ফিরে আসবে।
এবার যা বললাম এটা একেবারে পাকা কথা। মাস খানেকের মধ্যে বাড়ির কাজ শেষ হবে, তারপর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে আরও দিন পনেরো, তারও দিন পনেরো পরে একদিন দেখবে ঠিক আমরা দুজন এসে হাজির। এই বাড়িতে পাকাপাকি জীবন।
পবন একেবারে বিগলিত হয়ে গেল। খুব খুশি হলাম সাহেব, খুব খুশি হলাম।
মির্জা সাহেব তারপর শমীর দিকে তাকালেন। শোন বাপ, কাল সন্ধ্যায় তো বাড়ির কিছুই দেখতে পারিসনি। এখন ঘুরে ঘুরে সব দেখ। দুমাস পরে বাড়ির চেহারা অন্য রকম হয়ে যাবে। তখন তার এই পুরোনো ভাব পুরোপুরি পাবি না।
নাশতা শেষ করে চায়ে চুমুক দিয়েছেন মির্জা সাহেব, একটা গাড়ি এসে ঢুকল বাড়িতে। ঢাকা থেকে লোকজন এসে গেছে। শমী তাদের দিকে তাকিয়েও দেখল না, নিঃশব্দে বাড়ি দেখতে বেরোল। সে একটু ভাবুক প্রকৃতির নির্জনতাপ্রিয় ছেলে। এ বছর ক্লাস সেভেনে উঠেছে। বয়স তেরো বছর আট মাস।
বাড়ি দেখতে বেরিয়ে পুকুরঘাটে গিয়েছে শমী, পুকুরের এপার-ওপার গিয়েছে। নারকেল, কদমের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থেকেছে। বারবাড়ি ভেতরবাড়ি সব দেখে পেছন দিককার বাগানে এসেছে। চারদিক দেখতে দেখতে উদাস ভঙ্গিতে হাঁটছে, লেবুঝোপগুলোর কাছাকাছি আসতেই ওই কাণ্ড।
শমী ভাবল আবার যদি কথা শোনা যায় তাহলে কোন দিক থেকে আসছে কথা সেই দিকটা তীক্ষভাবে খেয়াল করতে হবে। তখন হয়তো রহস্যটা বোঝা যাবে। তবে লেবু ঝোপের দিকে না গেলে সেই কণ্ঠ কথা বলবে বলে মনে হয় না।
সাপে ভীষণ ভয় শমীর। গোখরো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা আছে। অ্যানিম্যাল প্লানেট, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল, ডিসকভারি চ্যানেলে পৃথিবীর বহু রকমের সাপ নিয়ে ডকুমেন্টারি দেখেছে। একবার একটা বিশাল কিং কোবরা দেখেছিল ঝোপের ভেতর লম্বা শরীর মেলে ধীরে ধীরে মাঝারি সাইজের আরেকটা সাপ গিলছে। আফ্রিকার ব্ল্যাক মামবা, আর্জেন্টিনার অ্যানাকোন্ডা সব ওই চ্যানেলগুলোতে দেখেছে সে। বাংলাদেশে দুই হাজারের ওপর লোক সাপের কামড়ে মারা যায় প্রতিবছর। ভয়াবহ ব্যাপার। যে সাপের কামড়ে মারা পড়ে লোকগুলো, তার সবই বলতে গেলে গোখরো। যেমন রাগী তেমন বিষধর সাপ। শরীরের কাছে গাছের পাতা ঝরে পড়লেও শাঁ করে ফণা তোলে, পাতাতেই ছোবল দেয়। গোখরো সাপে ছোবল দিলে খবর আছে।
তবু পা টিপে টিপে লেবুঝোপের দিকে এগোল শমী। উদ্দেশ্য দুটো। কে কথা বলে সেই রহস্য উদ্ঘাটন করা আর লেবুঝোপে সত্যি সত্যি সাপ আছে কি না পরীক্ষা করা।
কাছাকাছি মাত্র গিয়েছে, শমীর পায়ের ওইটুকু শব্দেই প্রায় একসঙ্গে শাঁ করে ফণা তুলল দুটো সাপ। কালো কুচকুচে শরীর, হাতের পাঞ্জার মতো ফণা। ফণার কাছে রোদ পড়েছে। সেই রোদে ফণা আলকাতরার মতো চকচক করছে।
তখন আবার সেই কণ্ঠ। তুমি আমাকে বিশ্বাস করোনি। ভুল করেছ। এখন নিঃশব্দে পিছু হটে এসো। দৌড় দিলে সাপও দৌড়ে আসবে ছোবল দিতে।
শমীর তখন সেই কণ্ঠের দিকে মন নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বুকের ভেতর হূিপণ্ড লাফাচ্ছে কাটা কইমাছের মতো।
তবু সেই মেয়ের কথা মত যতটা সম্ভব শব্দ বাঁচিয়ে পিছু হটে এল শমী। সাপ দুটো তখনো ফণা তুলে স্থির হয়ে আছে। দূর থেকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল শমী। একসময় লেবুঝোপের আবছা অন্ধকারে ফণা নামাল তারা।
শমীর গলা তখনো শুকনো, হূিপণ্ডের লাফালাফি কিছুটা কমেছে। নিরাপদ দূরত্বে এসে ভাবল এক দৌড়ে ভেতরবাড়ির দিকে চলে যাবে। তখন আবার সেই কণ্ঠ। এখন আর ভয়ের কিছু নেই। সাপ দেখে তুমি যেমন ভয় পেয়েছ সাপেরাও তোমাকে দেখে তেমন ভয় পেয়েছে। এক্ষুনি লেবুঝোপ ছেড়ে পালাবে। বাঁশবনের ওদিকে উধাও হয়ে যাবে। এদিকে আর আসবেই না। বেশ কিছুদিন ওদের আর দেখাই যাবে না। বাড়ির কাজ শুরু হলে নানা রকমের শব্দ হবে, সেই শব্দে ওরা হয়তো বাড়ি ছেড়েই পালাবে।
যেদিক থেকে কথা আসছিল সেই দিকে নিজের অজান্তেই যেন তাকাল শমী। মানুষজনের চিহ্ন নেই, শুধুই গাছপালা। একটা বেশ অদ্ভুত গাছ চোখে পড়ল। তেমন বড় গাছ না। দশ-বারো ফুট উঁচু হবে। গোড়া থেকে সোজা উঠে গেছে ওপর দিকে। মাথার কাছে গিয়ে ছাতার মতো ডালপালা মেলেছে। পানপাতার মতো বড় বড় গাঢ় সবুজ পাতা। দেখেই বোঝা যায় আমের নতুন পাতার মতো নরম কোমল পাতা। সেই পাতা এখন তিরতির করে নড়ছে।
এ রকম গাছ কখনো দেখেনি শমী! কী গাছ এটা!
গাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। যে কথা বলেছে তার কথা সে এখন পুরোপুরি বিশ্বাস করছে। ফলে সাপের ভয়টা নেই। হূিপণ্ডের লাফালাফি বন্ধ হয়েছে। শুকনো গলা স্বাভাবিক হয়েছে।
শমী বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কে কথা বলল! কিন্তু কথা যে সত্য তা বুঝতে পেরেছি।
শমীর কথার জবাব এল না।
সাপের ব্যাপারে সাবধান করার জন্য ধন্যবাদ।
এবারও সেই কণ্ঠ আর কথা বলল না। শমী অবাক হয়ে দেখল অদ্ভুত সেই গাছের পাতাগুলো একেবারেই নেতিয়ে পড়েছে। তিরতিরে কাঁপন বন্ধ করে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে।
গাছ কি কখনো ঘুমায়! এই গাছের পাতা দেখে মনে হচ্ছে খানিক আগে জেগেছিল, এইমাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে।
দিনদুপুরেও শমীর কী রকম ভয় ভয় করতে লাগল। গায়ে কাঁটা দিল। দ্রুত হেঁটে দোতলা বিল্ডিংয়ে ফিরল সে। সাপ আর ওই কণ্ঠের কথা কাউকে বলল না।
দুই
দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে ঢাকা থেকে আসা লোকগুলো চলে গেল। তারা সব দেখেশুনে নোট নিয়েছে। মির্জা সাহেব কী কী চান সেই অনুযায়ী প্ল্যান করেছে। আগামী সপ্তাহ থেকে পনেরো-কুড়িজন লোক লেগে যাবে কাজে। মাস খানেকের মধ্যে এই বাড়ি পুরোনো আদলেই নতুন রূপ নেবে।
বাগানের ওই ঘটনার পর থেকে শমী বেশ গম্ভীর। খেতে বসে মামি তাকে লক্ষ করলেন। কী রে শমী, কী ভাবছিস?
শমী চমকে মামির দিকে তাকাল। কই?
আমার মনে হচ্ছে।
মির্জা সাহেব বললেন, আরে ও তো এ রকমই। ভাবুকটাইপ। এই বাড়িতে এসে, একা একা ঘোরাফেরা করে আরও ভাবুক হয়ে গেছে।
শমী মনে মনে বলল, না মামা, আমি সত্যি এক ভাবনায় ডুবে আছি। কে আমাকে ওভাবে সাবধান করল? কে কথা বলল? রহস্যটা কী? বাগান থেকে ফিরে আসার পর থেকে মাথায় ওই এক চিন্তা। তোমাদের সঙ্গে থেকেও আমি আসলে তোমাদের সঙ্গে নেই, একা হয়ে আছি।
তখন মির্জা সাহেবও শমীকে খেয়াল করলেন। না, তোকে আজ বেশি ভাবুক মনে হচ্ছে। ভাত নাড়াচাড়া করছিস, খাচ্ছিস না। ঘটনা কী?
শমী হাসল। কোনো ঘটনা নেই মামা। রাতে ভালো ঘুম হয়নি, ঘুম ঘুম লাগছে। এ জন্য হয়তো...
তাহলে ভাত খেয়ে লম্বা একটা ঘুম দে। এ রকম নির্জন বাড়িতে ঘুম ভালো হবে।
খাওয়াদাওয়া সেরে বারান্দার দিককার রুমে শুয়েছে শমী। ঠিক তার মুখ বরাবর বিশাল জানালা। জানালা দিয়ে পুকুর-বাগান দেখা যাচ্ছে, গাছপালা দেখা যাচ্ছে। শালিক, বুলবুলি ওড়াউড়ি করছে। ঘুঘু ডাকছে। ঘুঘুর ডাকে নির্জন দুপুরবেলাটা আরও নির্জন হয়ে গেছে।
বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে শমী, বুঝতে পারেনি। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে, তা-ও জানে না। ঘুমের ভেতর হঠাৎই শুনতে পেল জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে কেউ তাকে ডাকছে। চমকে চোখ মেলেছে, জানালার দিকে তাকিয়েছে, দেখে একটি কিশোরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপূর্ব সুন্দর দেখতে। দুধে আলতায় মেশানো গায়ের রং। পটোলচেরা চোখ বলতে যা বোঝায় ঠিক তেমন চোখ। তীক্ষ নাক, পাতলা গোলাপি ঠোঁট আর মুখের গড়ন পানপাতার মতো। মাথায় ঘন কালো লম্বা চুল, পরনে সাদা ধবধবে ফ্রক।
শমী তার দিকে তাকাতেই এমন করে হাসল, সেই হাসিতে যেন উজ্জ্বল হয়ে গেল চারদিক।
শমী বিছানায় উঠে বসল। তুমি কে?
কিশোরী কথা বলল না। নিঃশব্দে হেসে জানালার কাছ থেকে সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রুম থেকে বেরোল শমী, বারান্দায় এল। এসে দেখে ধীর পায়ে বাগানের পেছন দিকে যাচ্ছে সে।
শমী ডাকল। এই, দাঁড়াও, দাঁড়াও।
কিশোরী দাঁড়াল না। শমীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে আগের মতোই নিঃশব্দে হাসল। নিজের অজান্তেই শমী তাকে অনুসরণ করতে লাগল।
এখন শেষ দুপুর। মির্জা সাহেব আর তাঁর স্ত্রী ঘুমিয়ে আছেন। পবনের ওদিকেও লোকজনের সাড়া নেই। বাড়িটা একেবারে নিঝুমপুরি হয়ে আছে। শুধু পাখির ডাক শোনা যায় আর সবকিছু ছবির মতো স্থির। একটুও হাওয়া নেই, গাছের পাতা একদমই নড়ে না।
শমীর তখন আর কিছুই খেয়াল নেই, কোনো দিকেই খেয়াল নেই। কিশোরীর পিছু পিছু সে এক ময় ছুটতে লাগল। তুমি কে? দাঁড়াও। আমার সঙ্গে কথা বলো।
শমীকে ছুটতে দেখে কিশোরীও ছুটতে লাগল। এখন তার পরিষ্কার হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। জলতরঙ্গের মতো মিষ্টি রিনরিন শব্দে হাসছে সে আর পেছন ফিরে শমীর দিকে তাকাচ্ছে।
একসময় সেই অচেনা গাছটার কাছে এল সে। তারপর হাসতে হাসতে শমীর চোখের সামনেই উধাও হয়ে গেল। শমী ভাবল নিশ্চয় কোনো ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়েছে। সে ছুটতে ছুটতে গাছটার কাছে এল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিশোরীকে খুঁজতে লাগল। এই, কোথায় তুমি? আরে! কোথায় লুকালে! বেরিয়ে এসো। কথা বলো আমার সঙ্গে। তুমি কে? কোত্থেকে এলে এই বাড়িতে?
এতক্ষণ যেন ঘুমিয়ে ছিল সেই গাছের পাতা, শমীর কথা শুনে জেগে উঠল। তিরতির করে কাঁপতে লাগল।
কোথাও শিশুর শ্বাস ফেলার মতো হাওয়া নেই অথচ এই গাছের পাতা কাঁপছে!
ঘোর লাগা চোখে গাছের দিকে তাকিয়ে রইল শমী। খুব কাছ থেকে ঠিক তখনই ভেসে এল সকালবেলার সেই কণ্ঠ। আমাকে তুমি আর খুঁজে পাবে না।
শমী চমকাল, এদিক-ওদিক তাকাল। কে কথা বলছে?
আমি। এইমাত্র আমাকে তুমি দেখেছ।
এখন কোথায় তুমি? কোথায় লুকিয়েছ?
তোমার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছি।
তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?
দেখতে পাচ্ছ, বুঝতে পারছ না।
মানে?
যে গাছের তলায় তুমি দাঁড়িয়ে আছ, আমি সেই গাছ!
শমী কেঁপে উঠল। বল কী! এইমাত্র মানুষ, এইমাত্র গাছ! কী করে সম্ভব?
তা আমিও জানি না। সাঁইত্রিশ বছর আগে বাগানের এদিকটায় সাপে কেটেছিল আমাকে। তখন আমার বয়স তেরো বছর আট মাস।
শমীর তখন মনে হচ্ছে, সে আর বাস্তবে নেই, সে চলে গেছে এক স্বপ্নের জগতে। ঘটনা যেন বাস্তবে ঘটছে না, ঘটছে স্বপ্নে। ঘোর লাগা গলায় বলল, আশ্চর্য! আমার বয়স এখন ঠিক তেরো বছর আট মাস।
এ জন্যই তোমার সঙ্গে আমার দেখা হলো। সাঁইত্রিশ বছর আগে সাপের কামড়ে মরে গেলাম। আমার বাবা মানবেন্দ্র রায়চৌধুরী, মা নীলিমা রায়চৌধুরী কত কাঁদলেন আমার জন্য। আমরা সাত ভাইবোন ছিলাম। আমি তৃতীয়। প্রথমে বড়দা, তারপর দিদি, তারপর আমি। অন্যরা আমার পর। সবাই কত কাঁদল আমার জন্য। কত ওঝা-বদ্যি এল বাড়িতে, জলধর কাকা ডাক্তার, তিনি এলেন। কিছুতেই বাঁচাতে পারলেন না আমাকে। তুমি যে সাপ দেখেছ ঠিক ও রকম কালো গোখরো কেটেছিল আমাকে। এ রকম ফাগুন মাস, সকালের ও রকম সময়ে মা আমাকে পাঠিয়েছিলেন লেবু তুলতে। তখন এই বাড়িতে লেবুর বলতে গেলে বাগান ছিল। আমি গুনগুন করে গান গাইছি আর লেবু তুলছি। তখনই সাপটা ছোবল দিল। আমি শুধু ‘মা’ বলে একটা চিৎকার দিতে পেড়েছিলাম...। আমার মা আমার দুঃখে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। বেশি দিন আর বাঁচেননি। বাবা শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। সাঁইত্রিশ বছর আগের ঘটনা তো, দিনে দিনে সবাই আমার কথা ভুলে গেল। কিন্তু আমি কাউকে ভুলতে পারিনি। এই বাড়ি ছেড়ে চলেও যেতে পারিনি। অচেনা এক গাছ হয়ে আছি।
শমী কথা বলতে পারল না। ঘোর লাগা অপলক চোখে গাছটার দিকে তাকিয়ে রইল।
...সাপের বিষে অদ্ভুত ধরনের এক নেশা, জানো। ছোবল দেওয়ার পরপরই মনে হলো শরীর ভেঙে নামছে গভীর ঘুম, তীব্র ঘুম। ঘুমের চাপে শরীর জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে। এমন ঘুম, এই ঘুম কখনো ভাঙবে না। আমি তার পর থেকে শুধু ঘুমাই। কখনো একটুখানি ভাঙে ঘুম। তখন পাতাগুলো কাঁপে, ঘুমভাঙা চোখে যেমন করে কাঁপে চোখের পাতা।
শমীর ভয় লাগছে না, গা কাঁটা দিচ্ছে না। এ রকম নির্জনে এমন ভৌতিক কাণ্ড, কিছুই মনে হচ্ছে না। অতি স্বাভাবিক গলায় বলল, তোমার নাম কী?
বাবুই। বাবুই বলে ডাকত সবাই। ভালো নাম ছিল অপর্ণা রায়চৌধুরী।...আহা কী সুন্দর দিন ছিল এই বাড়িতে। কত লোকজন, কত আনন্দ। পবনকে আমরা ডাকতাম পবনদা। লক্ষ্মীবউদির সঙ্গে মাত্র বিয়ে হয়েছে তার। বাড়ির কাজের লোক, তার পরও তার বিয়েতে কত ধুমধাম। দিনে দিনে দিন চলে গেল। সবার বয়স বাড়ল, সবাই বড় হলো, শুধু আমি আর বড় হলাম না। তেরো বছর আট মাস বয়সে রয়ে গেলাম।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল বাবুই। সবাই আমার কথা ভুললেও বাবা কখনো ভোলেননি। মা মারা গেলেন, দাদা-দিদিরা যে যার মতো কলকাতায় গিয়ে জীবন গোছাল, শুধু বাবা রয়ে গেলেন এই বাড়িতে। কাউকে বলতেন না কেন রয়ে গেছেন। শুধু আমি জানতাম, বাবা রয়ে গেছেন আমার জন্য। এই সেদিন পর্যন্ত লাঠি হাতে বাগানের এদিকটায় আসতেন। সাঁইত্রিশ বছর ধরেই তাঁকে দেখলাম লাঠি হাতে এদিকটায় আসতে। কেন আসতেন সেই রহস্য জানি শুধু আমি আর বাবা। আসতেন আমাকে যে মেরেছে তাকে মারতে। কন্যা হত্যার প্রতিশোধ নিতে। সাঁইত্রিশ বছরে অনেকগুলো সাপ তিনি মেরেছেন। একটা সাপ মরলেই তাঁর মনে হতো, একটু প্রতিশোধ তিনি নিতে পারছেন।...গভীর রাতে বাবা একা একা আমার জন্য কাঁদতেন। নিঃশব্দ কান্না। তবু এখান থেকে সেই কান্না আমি শুনতাম। বাবার কান্না শুনে আমার ঘুম ভাঙত। আমিও নিঃশব্দে বাবার জন্য কাঁদতাম।...বাবা চলে গেছেন, আমাদের বাড়ির মালিকানা বদলে গেছে, আমিও আর এই বাড়িতে থাকব না। আমিও চলে যাব।
অনেকক্ষণ পর কথা বলল শমী। কোথায় যাবে?
জানি না। তুমি যাও। আমি এখন ঘুমিয়ে পড়ব। তোমার সঙ্গে আমার আর কথা হবে না, দেখাও হবে না কোনো দিন। কিন্তু সারা জীবন আমার কথা তোমার মনে থাকবে। কীভাবে থাকবে সে কথা জানবে শুধু তুমি।
তারপরই থেমে গেল বাবুইয়ের কণ্ঠ। তিরতির করে কাঁপতে থাকা পাতাগুলো স্থির হলো।
তিন
শেষ বিকেলে বাড়ির সামনের দিককার পুকুরঘাটে বসে আছে পবন। বসার ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় সারা দিনের খাটাখাটনির পর একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। আরামদায়ক ফুরফুরে হাওয়া বইছে। এ রকম হাওয়ায় মন ভালো হয়ে যায় মানুষের। কিন্তু শমীর-মন ভালো নেই। যে অদ্ভুত ঘটনা তার জীবনে আজ ঘটেছে সেই ঘটনায় যতটা না শিহরিত হওয়ার কথা, রোমাঞ্চিত হওয়ার কথা, তা না হয়ে বাবুই মেয়েটির জন্য কষ্ট হচ্ছে। তবু পবনকে খুঁজতে ঘাটলায় এসেছে সে। দু-একটা ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া দরকার। যে বাবুইকে সে দেখল, গাছ হয়ে যে তার সঙ্গে কথা বলল, সেসব কথার সত্যতা যাচাই করা দরকার।
শমীকে দেখে হাসল পবন। কী সাহেব, কিছু দরকার?
পবনের মুখোমুখি বসল শমী। হ্যাঁ, দরকার। দু-একটা কথা জানা দরকার।
বলুন।
রায়চৌধুরী সাহেবের স্ত্রীর নাম কি নীলিমা রায়চৌধুরী?
পবন সামান্য চমকাল। হ্যাঁ। কিন্তু আপনি এই নাম জানলেন কী করে? কত আগে মারা গেছেন! আমিই তো তাঁর নাম ভুলে গিয়েছিলাম।
পবনের কথা এড়িয়ে গেল শমী। এই বাড়ির কোনো মেয়ে সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিল?
এবারও চমকাল পবন। হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কেমন করে?
আমাকে তুমি করে বলুন।
সেটা না হয় বললাম। কিন্তু...
মেয়েটির নাম কি বাবুই? ভালো নাম অপর্ণা রায়চৌধুরী!
আচমকা যেন কেউ একটা ধাক্কা দিয়েছে পবনকে এমনভাবে চমকাল সে। আরে, আরে! এ তো সাঁইত্রিশ বছর আগের ঘটনা। তেরো বছর আট মাস বয়স ছিল বাবুইদির। হ্যাঁ হ্যাঁ, অপর্ণা রায়চৌধুরী ছিল ভালো নাম। পরির মতো সুন্দর মেয়ে...। কিন্তু...কিন্তু তার কথা তো সবাই ভুলে গেছে! দাদা-দিদিরা, কলকাতার আত্মীয়স্বজনেরা। কর্তা শুধু মনে রেখেছিলেন...
প্রতিদিন লাঠি হাতে বাগানের দিকে যেতেন...
এবার কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল পবন। তুমি কোথা থেকে কেমন করে এসব তথ্য জোগাড় করলে? এসব তো কেউ জানে না!
শমী আগের মতোই এড়িয়ে গেল। বাবুই লেবু তুলতে গিয়েছিল, বেলা এগারোটার দিকে...
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
শমী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঠিক আছে, আমার আর কিছু জানার নেই।
কিন্তু আমার আছে।
শমী উঠল। আমি আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর দেব না। আপনি আমার আর একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। লেবুঝোপগুলোর ওদিকটায় অচেনা একটা গাছ আছে...
পবন সঙ্গে সঙ্গে বলল, ওই গাছটাও অদ্ভুত। বাবুইদি যেদিন মারা গেল, সেদিন গাছের চারাটা জন্মাল। দিনে দিনে বড় হলো। একেবারেই অচেনা গাছ। কত মানুষ দেখে গেছে, কেউ নাম বলতে পারেনি। আমরা কেউ গাছটার কাছে যাই না। কেমন ভয় ভয় করে। গা কাঁটা দেয়।
শমী আর কথা বলল না।
চার
তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। শমী এখন লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকে। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে গ্র্যাজুয়েশন করছে। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে অনেক গাছ। সে যে এলাকায় থাকে, সেখানে অনেক গাছ। তার ফ্ল্যাটবাড়িতে ঢোকার মুখে গাছ। প্রতিদিন কোনো না কোনো গাছের দিকে সে তাকায়। তাকালেই মনে পড়ে বাবুইয়ের কথা, রতনপুরের রায়চৌধুরী বাড়ির সেই অদ্ভুত গাছের কথা।
সেবার ঢাকায় ফিরে আসার কিছুদিন পর পবনকে সে ফোন করেছিল। অচেনা সেই গাছের কথা জানতে চেয়েছিল। পবন বলল, আশ্চর্য ব্যাপার, তোমরা চলে যাওয়ার দিন থেকেই গাছের পাতাগুলো শুকাতে শুরু করল। তিন-চার দিনের মধ্যে গাছটা মরে কাঠ হয়ে গেল।
শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল শমী। তার মানে চিরবিদায় নিল বাবুই। বেশ কয়েক দিন মন খারাপ থাকল। কিন্তু বাবুইয়ের কথা, অচেনা সেই গাছের কথা আজ পর্যন্ত কাউকে সে বলেনি। বলবেও না কোনো দিন। শুধু গাছের দিকে তাকাবে, হাওয়ায় কাঁপতে থাকা পাতার দিকে তাকাবে আর মনে মনে বলবে,
গাছের পাতা নড়েচড়ে
তোমার কথা মনে পড়ে!