‘মরে ভূত হয়ে গেলি দাদা?’ ‘কী করব বল? তাও তো ভূত হতে পেরেছি। কিছুই যদি না হতে পারতাম!’
‘যাই বলিস, ভালো করিসনি। জানিস, আমি ভূত ভয় পাই।’
‘আমাকে দেখেও ভয় পাচ্ছিস নাকি?’
‘ভয় পাব না? দাদা হলেও তুই তো ভূত। ভ-এ দীর্ঘ ঊকার আর ত।’
দাদা হাসল। প্রাণ খুলে হাসল। হা! হা! হা!
প্রাণ খুলে! ভূতদের কি প্রাণ থাকে?
ভূতেরা কি প্রাণী?
‘দাদা! ও দাদা!’
‘কী?’
‘এ রকম করে কথা বলছিস কেন তুই?’
‘তবে কী রকম করে বলব? ভূঁতদেঁর মঁতো কঁরে বঁলব?’
ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় যায়, এই সময় ঘুম ভেঙে গেল কিডোর। ওহ্! এক শ একটা থ্যাংকস দিল সে নিজেকে। লাইট নিভিয়ে ঘুমায়নি বলে। নাহলে ও রকম একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখে অন্ধকারে ঘুম থেকে উঠলে, বারোটা না, তেরোটা বেজে যেত, বাবা রে! রাত এখন কত? বারোটা উনত্রিশ। রূপের ডালি খেলা বইটা পড়তে পড়তে তার ঘুম ধরে গিয়েছিল। রাশিয়ান গল্পের বই। বইয়ের প্রথম পাতায় দাদা লিখে দিয়েছে, ‘এমন চমত্কার গল্পের বই পৃথিবীতে আর আধখানাও লেখা হয়নি, কিডো দ্য স্কুইরেলকে...।’
কিডো দ্য স্কুইরেল। দাদা যে এ রকম কত কী ডাকে কিডোকে। কিডো দ্য মারমেইড, কিডো দ্য নীল ঘাসফুল, কিডো দ্য লিটল উইমেন।
দাদা অনেক পড়াশোনা করে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ। কিডোও পড়ে। তবে দাদার মতো অত না। কিডোর প্রিয় ‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজ। সব পড়ে। আর পড়ে দাদা সেসব বই পড়তে দেয়। পরীক্ষার পর এর মধ্যে পড়েছে লিটল হাউস ইন দ্য প্রেইরি, বুড়ো আংলা, বৃষ্টি আর নক্ষত্র, ইশকুল, চুক আর গেক এবং তিমুর ও তার দলবল। এখন তো রূপের ডালি খেলা পড়ছে।
কিডো লরেন্স। নটর ডেম কলেজের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক আরভিন লরেন্সের মেয়ে। কিডোর জন্মের সময় আরভিন লরেন্স মাদার অ্যান্ড চাইল্ড কেয়ার ক্লিনিকের ওয়েটিং রুমে ছিলেন। অস্থির, উদ্বিগ্ন। ওয়েটিং রুমে টেলিভিশন চলে। এইচবিও চ্যানেলে তখন কিল বিল মুভি দেখাচ্ছিল। ভলিউম-ওয়ান। উমা থারম্যান করেছেন, কিল বিল-এর কিডো রোলটা। দেখতে না চাইলেও দেখা হয়ে যাচ্ছিল। এ ছাড়া মুভিটা এর আগে আরও দুবার দেখেছেন আরভিন লরেন্স।
মেই পেইয়ের সঙ্গে কথা বলছে কিডো, এইচবিওতে, এই সময় কেবিনের আয়া শুভ সংবাদ দিল। ছেলের পর এবার একটা মেয়ে হয়েছে আরভিন লরেন্সের। আরভিন লরেন্স তত্ক্ষণাৎ মেয়ের নাম ঠিক করলেন ‘কিডো’। স্কুলের নাম এলিসিয়া কিডো লরেন্স। পড়ত সেভেনে। এইটে উঠবে এবার। বার্ষিক পরীক্ষার পর তাদের স্কুল ছুটি এখন। বড়দিনের পরপর তারা রাঙামাটি গিয়েছিল। সেমন্তী আন্টি-হারমেন আংকেলের কাছে। ফরেস্টের রেঞ্জার হারমেন আংকেল। সেমন্তী আন্টি আর্টিস্ট। ছবি আঁকা শেখান পাহাড়ি বাচ্চাদের।
শীত কী পাহাড়ে! দারুণ দারুণ দারুণ কেটেছে আট দিন।
এখনো তার নাকের ডগায় সেই পাহাড়ের কিছু শীত লেগে আছে। মনে হয় কিডোর।
রাঙামাটি থেকে তারা ফিরেছে সোমবারে। বাপ আর মেয়ে। কিডোর মা নেই। সুদীপ্তা লরেন্স। এগারো বছর আগে ঈশ্বরের কাছে চলে গেছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। দাদাও ছিল সঙ্গে। ফোন যখন আসে, আরভিন লরেন্স কলেজে ছিলেন। ছোট্ট কিডো বাসায়। সতেরো দিন কোমায় ছিল দাদা। আশা ছেড়ে দিয়েছিল সবাই। আঠারো দিনের দিন দাদা যখন প্রথম তাকাল, রেসপন্স করল, ডাক্তার মাহবুব রেজা বলেছিলেন, ‘মিরাকল! আনবিলিভেবল!’ কিডো এসব কথা পরে শুনেছে।
কিডোর বয়স এখন তেরো। ঘুম ধরার আগে রূপের ডালি খেলা বইটার সোয়া দুইটা গল্প সে পড়েছে। বীরব্রতী ভাসিয়া, রূপের ডালি খেলা এবং কোথায় আকাশের শুরু কিছুটা। রূপের ডালি খেলা পড়ে কান্না পেয়েছিল। নিনকা মেয়েটার জন্য মন কী রকম করছিল। নিজেকে নিনকা মনে হচ্ছিল। মা থাকলে মাকে নিনকার মা মনে হতো। বীরব্রতী ভাসিয়া গল্পটাও ভালো। কোথায় আকাশের শুরুও ভালো। কিন্তু ঘুম ধরে গেল দুপাতা পড়তেই। ঘুমিয়ে আবার এমন বিশ্রী একটা স্বপ্ন! এ কেউ দেখে?
বিশ্রী লাগছে কিডোর। রাগ লাগছে। তাদের সঙ্গে পাহাড়ে যায়নি। মোবাইল ফোন বন্ধ করে দাদা রাতারগুল চলে গেছে আট দিন আগে। অথচ এর আগেও রাতারগুল গেছে সে একবার। বর্ষায়। এবার গেছে শীতের রাতারগুল দেখতে। রাতারগুলের জল-অরণ্য। যা! থাক গিয়ে! চিরকাল রাতারগুলে থাক গিয়ে! তাই বলে মোবাইল ফোন, ট্যাব কিছু নিয়ে যাবি না, এ কেমন কথা! তুই একটা খারাপ লোক, দাদা! তুই ফোন না করলে আমি আর রূপের ডালি খেলা বইটা পড়ব না। গান করব না। মুভি দেখব না। তুই যা যা বলিস, কিছুই করব না। এসব ভেবে আরও রাগ হলো কিডোর। আবার রাগ কমেও গেল! একেকটা মানুষ তো একেক রকম আসলে। দাদা দাদার মতোই থাকুক। আলাভোলা। শুধু অনেক অনেক ভালোবাসুক কিডোকে। সকালে টেক্সট পাঠাক, ‘গুড মর্নিং, কিডো দ্য স্লিপিং বিউটি’ বা ‘গুড মর্নিং, কিডো দ্য ক্ষ্যান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ি।’ এত বিশ্রী একটা স্বপ্ন দেখার পর এখন দাদার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলে কি অনেক ভালো লাগত না কিডোর?
দাদা একটা আজব!
দাদা একটা ইমোটিকন!
দাদা একটা যা ইচ্ছে তাই!
উইলিস লরেন্স। কিডোর দাদা। ইংরেজিতে মাস্টার্স, কিছু করে না। মানে যখন যা মনে হয় করে। গ্রিসে ছিল বছর তিনেকের মতো। বেইলি রোডে চায়ের দোকান দিয়েছিল একবার। সিটি করপোরেশনের সংবাদপত্র বিক্রয়কেন্দ্র ভাড়া নিয়ে পত্রপত্রিকা বিক্রি করেছে কিছুদিন। কচ্ছপ চাষ করবে বলে খ্যাপা ছিল কিছুদিন। কচ্ছপ চাষ! শুনেই চোখ বড় হয়ে গিয়েছিল কিডোর।
‘কচ্ছপ চাষ করবি! কেন রে দাদা? কচ্ছপেরা তিন শ বছর বাঁচে কি না দেখবি? হি! হি! হি!’
কচ্ছপ প্রজেক্টের পর স্টেবিয়া প্রজেক্ট। আছে এমন একটার পর একটা। পারেও! দাদাটা আসলে একটা পাগল। এখন আছে ব্যান্ড মিউজিক নিয়ে। দাদা, পিপুল ভাই, ‘ম্যামথ’ ভাই, ডোডোদা। ম্যামথ ভাই হলো মাহমুদ ভাই। ডোডোদা আর্টিস্ট হিরণ দাসের ছেলে। পিপুল ভাই জব করে একটা মোবাইল ফোন কোম্পানিতে। তাদের দলের নাম ‘পিয়াইন’। কোথায় একটা নদী আছে পিয়াইন, সেই নামে নাম। ব্যান্ডের লাইনআপ, দাদা ভোকালিস্ট এবং হার্প বাজায়। হার্প। গ্রিসে যখন ছিল বাজাতে শিখেছে। দেশে ফিরেছে একটা বিরাট হার্প নিয়ে। সেটা বাজায়। পিয়াইনের লিরিসস্ট, গিটারিস্ট পিপুল ভাই। ম্যামথ ভাই বেজিস্ট। ডোডোদা ড্রামার, ব্যাক ভোকালিস্ট। মাত্র তেরো দিন আগে ইউটিউবে তারা প্রথম তাদের একটা গান রিলিজ করেছে, ‘হলুদ একটা পাতা’। সেটা দেড় লাখ বার দেখা হয়েছে এর মধ্যে। কিন্তু দাদা সব ছেড়েছুড়ে একদিন চলে যাবে কোথাও। বলেছে কিডোকে।
‘কোথায় যাবি তুই, দাদা?’
‘যাব একখানে।’
‘সে কোথায়?’
‘বলা যাবে না।’
‘আমাকেও বলা যাবে না?’
‘দুঃখ করে না, কিডো দ্য জলপরি। যদি যাই তোকে না বলে যাব না।’
‘না, তুই কোথাও যাবি না।’
‘একবার তো চলেই গিয়েছিলাম প্রায়! হা! হা! হা!’
দাদা একটা সো-ও-ও সুইট থিং!
কিডোর ঘরে একটা বইয়ের র্যাক আছে। অর্ধেক বই দাদা দিয়েছে। তাকে তাকে তার প্রিয় কিছু বই সারির বাইরে সাজিয়ে রেখেছে কিডো। মলাট দেখা যায়। দ্বিতীয় তাকে যেমন ‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজের দ্বীপ-রহস্য বইটা রেখেছে। এটা তার গত জন্মদিনের সারপ্রাইজ। ‘তিন গোয়েন্দা’র লেখক রকিব হাসান স্বয়ং তাকে অটোগ্রাফসহ উপহার দিয়েছেন। দাদার কাণ্ড। আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রেখে জন্মদিনের দিন বিকেলে বাইকে করে রকিব হাসানের বাসায় নিয়ে গিয়েছিল কিডোকে। রকিব হাসান অনেকক্ষণ তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ওনার সঙ্গে সেলফিও তুলেছে কিডো!
দাদা হলো, পৃথিবীর শুধু না, সৌরজগতের, ছায়াপথের, মহাবিশ্বের সেরা দাদা।
তেইশে অক্টোবর জন্মদিন কিডোর। দেরি আছে আরেকটা জন্মদিন আসতে। সেই জন্মদিনে ঠিক করে রেখেছে, দাদাকে উল্টো একটা সারপ্রাইজ দেবে সে। পলা আপুকে ধরে নিয়ে আসবে বাসায়। দাদার বেস্ট ফ্রেন্ড। এখনো একবারও তাদের বাসায় আসেনি।
রাতারগুলে এখন কী করছে দাদাটা? জঙ্গল খাচ্ছে?
কিডোর কথা শুনে উইলিস হাসল।
কোনখানে হাসল?
রাতারগুল জঙ্গলে?
না। তবে? কিডোর মনে হলো তার মাথার ভেতরে। হা হা হাসি না, এমনি কথায় কথায় যে রকম হাসে দাদা। স্পষ্ট শুনল কিডো, নাকি মনের ভুল?
‘আরে না পাগলি, মনের ভুল না।’ উইলিস বলল।
‘দাদা তুই! তুই কোথায়?’
‘ওরে ও কিডো দ্য বাচ্চা চিল্লানোসোরাস! চেঁচাচ্ছিস কেন?’
‘চেঁচাব না! তুই কোথায়? কোথায় বল?’
‘কোথায় আবার? রাতারগুল জঙ্গলে।’
‘রাতারগুল! রাতারগুল থেকে তুই আমার সঙ্গে কথা বলছিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী করে?’
‘মনে মনে।’
‘যাহ! কী করে?
‘কেন? তুই আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না?’
‘তা পাচ্ছি।’
‘তবে? তুইও মনে মনে বল।’
‘কী বলব?’
‘কী বলবি মানে? কথা বল।’
কিডো মনে মনে বলল, ‘সত্যি?’
উইলিস বলল, ‘হ্যাঁ। আই বিলিভ আই ক্যান ফ্লাই শুনবি?’
‘শুনব। শোনা।’
রন কেলির গান এটা। আই বিলিভ আই ক্যান ফ্লাই। রন কেলি এমনিতেই প্রিয় কিডোর। উইলিসেরও। রন কেলির কয়েকটা গান সে পারে। হার্প বাজিয়ে গায়। আই বিলিভ...গায় একদম রন কেলির মতো।
রাতারগুলে জোছনা কেমন ফুটেছে? সন্ধ্যায় চাঁদ দেখেছে কিডো। ছাদে উঠেছিল। আধখানা চাঁদ। রাতারগুল থেকে কেমন দেখাচ্ছে? গানের পর জিগ্যেস করতে হবে দাদাকে।
টুং! টাং!
টুং! টুং!
টাং!
হার্পের টুং টাং!
দাদা গান ধরল।
I used to think that I could not go on
And life was nothing but an awful song
But now I know the meaning of true love
I’m leaning on the everlasting arms
If I can see it, then I can do it
If just believe it, there’s nothing to it
I believe I can fly
I believe I can touch the sky
রাতারগুলে তো হার্প নিয়ে যায়নি, তাহলে হার্প কী করে বাজাচ্ছে দাদা? হার্পই তো? নাকি অন্য কিছু একটা বাজাচ্ছে? না, হার্পই। তবে অদ্ভুত। গিটার, পিয়ানো, হারমনিকা, সব মিলিয়ে যেন কিছু একটা। রাতারগুলে এমন একটা হার্প কী করে জোগাড় করল দাদা? তার পক্ষে সব সম্ভব! অদ্ভুত লাগছে কিডোর। অদ্ভুত ভালো লাগছে ‘আই বিলিভ...’ শুনতে।
Hey, if just spread my wings
I can fly
I can fly...
শুনতে শুনতে ঘুম ধরে গেল কিডোর। নাকি এটাও একটা স্বপ্নই? না হলে এ রকম হয় নাকি সত্যি? মনে মনে এভাবে কথা বলা যায়? গান শোনা যায়? আর একটা স্বপ্নই দেখেছে কিডো। এই যে ঘুমন্ত মুখ দেখা যাচ্ছে তার। দেখা যাক। সকালে কিডো কি মনে করতে পারবে, স্বপ্নে সে কী কী দেখেছে?
সত্যি স্বপ্ন দেখলে হয়তো সব মনে করতে পারত না। কিন্তু স্বপ্ন না। এতক্ষণ যা ঘটেছে স্বপ্ন না কিছুই। সব সত্যি। নাহলে উইলিস কী করছে এখন? রাতারগুল জঙ্গলে?
কথা বলছে।
কার সঙ্গে? যার সঙ্গে তাকে কি মানুষ বলা যায়? যায় কিছুটা। মানুষের মতো সে খানিক। কিন্তু মনে হচ্ছে কাচের বানানো। জঙ্গলে কুয়াশা এবং অল্প জোছনা। কাচের মানুষ বলল, ‘উইলিস?’
উইলিস বলল, ‘বল।’
‘মেয়েটা কি ধরতে পেরেছে?’
‘কী?’
‘তুমি কী?’
‘না। কী করে পারবে?’
‘মেয়েটা কি ধরতে পেরেছে?’
‘কী?’
‘টিউনিয়া হার্প বাজিয়েছ তুমি?’
‘না।’
‘বললে না কেন? অপার্থিব একটা ইনস্ট্রুমেন্ট শুনল, জানলে খুশি হতো না মেয়েটা? টিউনিয়ান তোমার পার্থিব বোন। হা! হা! হা।’
‘হাসছ কেন? এটা কি কিছু হাসির কথা হলো? টিউনিয়ান হার্পের কথা তাকে আমি বলতে পারিনি। কারণ, আমার বোন ঘুমিয়ে পড়েছে। তুমি তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছ।’
‘হা! হা! হা! ভালো বলেছ। চলো এখন, দেরি হয়ে যাচ্ছে। শিপ থেকে ঘন ঘন সিগন্যাল পাঠাচ্ছে।’
‘আমি যাব না।’
‘কী? পাগলামি কোরো না, উইলিস। তুমি মানুষ না। তুমি একজন টিউনিয়ান। অন্য গ্রহ এবং অন্য মাত্রার প্রাণী। তোমার জিন ম্যাপিংয়ে ত্রুটি আছে কিছু। নাহলে পৃথিবীর মানুষ সম্পর্কে তুমি কেন আগ্রহী হবে? তাও টিউনিয়া বিজ্ঞান একাডেমি তোমার ইচ্ছা পূরণ করেছে। কম দিন না, এগারো বছর থাকতে দিয়েছে পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে। এখন তোমার গ্রহ টিউনিয়া এবং টিউনিয়ানরা অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।’
‘আমার জন্য কিডোও অপেক্ষা করছে।’
‘পৃথিবীর একটা মেয়ে ও, উইলিস। আবার বলছি তুমি মানুষ না, টিউনিয়ান। অন্য মাত্রার প্রাণী। দুর্ঘটনায় মেয়েটার মায়ের সঙ্গে তার ভাইয়েরও মৃত্যু হয়েছিল। নাহলে তুমি তার ভাই হতে পারতে? আর দেরি করো না এখন। চলো।’
‘আমি যাব না, মানুষ থাকব।’
‘তুমি মানুষ না।’
‘কেন, আমি মানুষ না কেন? আমার শরীরে দুই শ ছয়টা হাড় নেই? আমার ডিএনএ পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে না আমিও তিন শটা হাড় নিয়ে জন্মেছিলাম, যেকোনো মানব শিশুর মতো? আমার মন নেই? আমার মধ্যে মানুষের মতো অনুভূতি নেই?’
‘তুমি জানো, সবই বানানো, উইলিস। প্রোগ্রাম।’
‘তাহলে সব মানুষই তো প্রোগ্রাম।’
‘অবশ্যই। তুমি একটা প্রোগ্রাম হয়ে থাকতে চাও?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু মানুষ স্বল্পায়ু, উইলিস। যখন তখন মরে যায়।’
‘আমি জানি।’
‘টিউনিয়ানরা বিজ্ঞানসম্মতভাবে দীর্ঘায়ু। কেউ নির্দিষ্ট সময়ের আগে মরে না।’
‘নির্দিষ্ট সময়? বিজ্ঞান একাডেমি ঠিক করে দেয় তো। আমার কাছে এটা কোনো কাজের মনে হয় না। আমি মানুষ থাকব এবং যখন তখন মরব।’
‘কেন উইলিস? মেয়েটার জন্য? তুমি কি বুঝতে পারছ না, তুমি মায়ায় আটকে গেছ? মানুষের মতো।’
‘বলো, এই মায়াও প্রোগ্রাম!’
‘তুমিও জানো প্রোগ্রাম। টিউনিয়ান হিসেবে অবশ্যই জানো।’
‘আমি আর টিউনিয়ান না, মানুষ। টিউনিয়ান হলে আমার কোনো নাম থাকার কথা না। তুমি কেন আমাকে উইলিস ডাকছ, বলো? কারণ আমি উইলিস। আমার বোন কিডো লরেন্স। হা! হা! হা!’
‘হেসো না, উইলিস। তুমি এখনো মানুষ আছো বলে আমি তোমাকে উইলিস বলছি।’
‘আমিও তোমাকে বলেছি, আমি মানুষ থাকব।’
‘তুমি কি মানুষ হিসেবে কথাটা বলছ? নাকি টিউনিয়ান হিসেবে বলছ?’
‘টিউনিয়ান হিসেবে বলছি। সজ্ঞানে সচেতনভাবে বলছি। আর কিছু?’
‘না। টিউনিয়ান, টিউনিয়ান তুমি।’
‘তাতে কী?’
‘তাতে কী তুমি জানো না?’
‘জানি। নির্দিষ্ট সময়ের পর আমি আর টিউনিয়ান মাত্রার প্রাণী থাকব না। নির্দিষ্ট দীর্ঘায়ু হারাব।’
‘তারপরও?’
‘তারপরও কী?’
‘তুমি পৃথিবী নামক এই গ্রহেই থাকবে।’
‘হ্যাঁ।’
‘বলেছি, তোমার জিন ম্যাপিংয়ে ত্রুটি রয়ে গেছে কিছু। কিছু না, অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে দেখছি।’
‘হ্যাঁ, অনেক।’
‘টিউনিয়ার আইন অনুসারে আমি অবশ্যই বাধাগ্রস্ত করতে পারব না তোমাকে। বিজ্ঞান একাডেমিও নির্দেশ দিয়ে রেখেছে। তুমি একজন বিশেষ টিউনিয়ান। কে জানে কেন এ রকম মনে করে তারা? থাকো তবে তুমি। বিদায় পৃথিবীর মানুষ, উইলিস।’
উইলিস হাসল।
‘বাচ্চা একটা মেয়ের জন্য তুমি এটা করবে?’
‘করব।’
পরদিন সকালে কিডো ঘুম থেকে উঠল আটটা আটে। শীত, কী শীত রে! জানালার কাচে কুয়াশা বৃষ্টির ফোঁটার মতো জমে আছে। কফি বানিয়ে খেতে হবে এক মগ। কিডো উঠল। দরজা খুলল। এবং ভূত দেখার মতো চমকাল।
দাদা!
উইলিস হাসল, ‘গুড মর্নিং, কিডো দ্য ফড়িংনি।’