গুড্ডুবুড়ার গোয়েন্দা অভিযান

অলংকরণ: নাইমুর রহমান

গুড্ডুবুড়ার নতুন নতুন বোকামির গল্প শুনলে হাসতে হাসতে তোমাদের পেট ফেটে যাবে। গুড্ডুবুড়ার দাদি বেড়াতে এসেছেন তাদের ঢাকার কলাবাগানের বাসায়। সকালবেলা তিনি বললেন,

‘গুড্ডুবুড়া, তুমি দাঁত মেজেছ?’

‘না, দাদি।’

‘যাও। দাঁত মেজে আসো।’

গুড্ডুবুড়া রান্নাঘরে গেল। বাসনকোসন মাজার লিকুইড সাবান আর স্পঞ্জ দিয়ে মাজতে লাগল দাঁত। তা দেখে মা চিৎকার করে উঠলেন, ‘গুড্ডু, তুমি কী করছ?’

‘দাদি বলেছেন দাঁত মাজতে। তাই দাঁত মাজছি।’

‘কেন, তুমি সকালে ব্রাশ করোনি?’

‘করেছি।’

‘তাহলে?’

‘দাদি যে বললেন দাঁত মাজতে। তাই দাঁত মাজছি।’

গুড্ডুবুড়ার দাদি সকালে এক চামচ ওষুধ খান। এতে নাকি আদা, মধু, লেবুর রস আছে। খেলে গলা পরিষ্কার হয়। বুকে কফ জমে না। ঠান্ডা লাগে না। দাদি বললেন,

‘খাবি? খা। এক চামচ খা।’

‘এক চামচ খেলে কী হবে?’

‘গলা পরিষ্কার হবে। বুকে কফ জমবে না। ঠান্ডা লাগবে না। সর্দি-কাশি হবে না।’

‘দাও এক চামচ।’

দাদি তাকে এক চামচ ওষুধ দিলেন। গুড্ডুবুড়া ওষুধ ফেলে দিয়ে চামচ খেতে চেষ্টা করতে লাগল। সমস্যা হলো, চামচ কীভাবে খেতে হয়, গুড্ডুবুড়া জানে না। চামচ কি চিবিয়ে খেতে হয়, নাকি সেদ্ধ করে খেতে হয়, নাকি পানি দিয়ে খেতে হয়? চিবুতে গিয়ে গুড্ডুবুড়ার একটা দাঁত গেল ভেঙে। মা ছুটে এলেন। বাবা ছুটে এলেন। দাদি ছুটে এলেন।

‘কী হলো?’

‘চামচ খেতে গিয়ে দাঁত ভেঙে ফেলেছি!’

‘চামচ কেন খেতে হবে?’

‘দাদি বলেছেন, “খা এক চামচ। খেলে বুক পরিষ্কার হবে।”’

এই হলো গুড্ডুবুড়া। তোমরা ওকে চেনো। ওর এই সব গল্প তোমাদের মুখস্থই হয়ে গেছে। কিন্তু এই কাণ্ডটার কথা শুনলে তোমাদের হাসি আসবে না। কান্না পাবে।

গুড্ডুবুড়ার বাসায় এক আন্টি এসেছেন লন্ডন থেকে। তিনি রান্না করবেন। তার রান্নার জন্য লাগবে চিলি পেস্ট। তিনি বলছেন, চিলি পেস্ট চাই। চিলি পেস্ট।

গুড্ডুবুড়া দূর থেকে দেখছে। বেশ লাল রঙের একটা পেস্ট। এটা দিয়ে দাঁত মাজা ট্রাই করা দরকার।

তা-ই করল গুড্ডুবুড়া। মরিচবাটা দিয়ে দাঁত মাজতে আরম্ভ করে দিল। তারপর ঘটনা যা ঘটল, সে-ও কি তোমাদের খুলে বলতে হবে? ঝালের চোটে গুড্ডুবুড়া ঝাঁপাতে লাগল। লাফাতে লাগল। চিৎকার–চেঁচামেচি করে বাড়ির ছাদ ভেঙে ফেলার উপক্রম করল তো বটেই, তার নাচানাচি–ঝাঁপাঝাঁপিতে ঘরের মেঝেও ভেঙে যায় যায় অবস্থা।

সবাই দৌড়ে এল।

‘কী হয়েছে?’

‘আমি পেস্ট দিয়ে দাঁত মেজেছি।’

‘তাতে কী হয়েছে?’

‘ঝাল। ঝাল। উরে বাবা রে মা রে...মারা যাচ্ছি রে...’

‘ঝাল কেন?’

‘ওই লাল পেস্ট।’

‘সর্বনাশ! ওটা তো মরিচের পেস্ট। পেষা মরিচ...’

গুড্ডুবুড়ার এ ধরনের গল্প তোমাদের আর কত বলব! তোমরা তো সবই জানো! বরং তোমাদের বলা যায় গুড্ডুবুড়ার গোয়েন্দাগিরির গল্পটা।

গুড্ডুবুড়ার ছোট খালা বাসায় এসেছেন। তিনি চট্টগ্রামে থাকেন। ঢাকায় তার ট্রেনিং প্রোগ্রাম। সে জন্য তাকে ১৫ দিন থাকতে হবে ঢাকায়। কলাবাগানে গুড্ডুবুড়াদের বাসাতেই তিনি থাকছেন।

খালার আবার গোয়েন্দা গল্প ভীষণ পছন্দ। তিনি সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদাসমগ্র বারবার পড়েছেন, পড়ে ভাজা ভাজা করে খেয়েছেন। গুড্ডুবুড়ার বাবা এই কথাটা বলেন গুড্ডুবুড়ার খালাকে। ‘কী রে ছোটু, তুই তো ফেলুদা ভাজা ভাজা করে খেয়েছিস।’

খালা বলেন, ‘ভাজা ভাজা মানে সেই রকম ভাজা ভাজা। একেবারে এক কড়াই তেলে সেই রকমভাবে গরম করে ডিপ ফ্রাই।’

শার্লক হোমসের গল্পও ছোট খালার খুব পছন্দ। আর তিনি টেলিভিশনে যত গোয়েন্দামার্কা ছবি আছে, সিরিয়াল আছে, সেসবও দেখেন। ১৫টা দিন তিনি থাকলেন ঢাকায়। ১৫টা রাত তিনি রোজ গুড্ডুবুড়াকে একটা করে গোয়েন্দা গল্প বললেন।

গুড্ডুবুড়ার সমস্যা হলো, ওর তো মাথার বুদ্ধি শুকিয়ে গেছে। কারণ, সে খায় না। অতটুকুন একটা বাচ্চা, ক্লাস ফোরে পড়ে, সে খাবে, ঘুরবে, নাচবে, দৌড়াবে, খেলবে। তা তো না! গুড্ডুবুড়া খেতে চায় না। নড়তে চায় না। পড়তে চায় না। তাই তার ব্রেনও শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেছে।

খালা রোজ বানিয়ে বানিয়ে গোয়েন্দা গল্প বলেন। কখনোবা বইয়ের পড়া কিংবা অন্যের মুখে শোনা গল্প বলেন। খালা বললেন, ‘গুড্ডু। আজকে রাতে তোকে একটা গোয়েন্দা সমস্যা দিই। তুই সমাধান কর।’

গুড্ডু বলল, ‘আচ্ছা।’

শীতকাল। ঢাকায় তেমন ঠান্ডা পড়েনি। খালা একটা কাঁথা পায়ের ওপর দিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছেন। মাথার ওপর বাতি জ্বলছে।

গুড্ডুবুড়া তার কাঁথার নিচে পা ঢুকিয়ে দিল। খালা যে কী সমস্যা দেন?

খালা বললেন, ‘আচ্ছা, একটা ঘরে তোর সমান উঁচু একটা ছোট্ট ছেলেকে রাখা হয়েছে আটকে। সঙ্গে একটা গার্ড। ভেতরে ছিটকিনি দেওয়া। ছিটকিনিটা অনেক উঁচুতে। এই ঘরে আর কোনো আসবাব নেই। কোনো লাঠিকাঠি নেই। গার্ডটা মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়ল।

ঘুম থেকে জেগে গার্ড দেখল, ছিটকিনি খোলা। ছেলেটা পালিয়ে গেছে।

গার্ডটা তো ভেবে পাচ্ছে না, ছেলেটা ছিটকিনি খুলল কীভাবে? ওর যা হাইট, ছিটকিনি পর্যন্ত তার হাত উঠবে না। তবে হ্যাঁ, দরজার কাছে মেঝেতে পড়ে আছে পানি।

‘বল, ছেলেটা ছিটকিনি পর্যন্ত হাত নিয়ে যেতে পারল কীভাবে?’

গুড্ডুবুড়া ভেবে ভেবে সারা। কোনো কূলকিনারা সে করতে পারে না।

খালা বলল, ‘তোকে একটা ক্লু দিই। দরজার কাছে অনেক পানি পড়ে ছিল।’

গুড্ডুবুড়া তা-ও পারে না। শেষে বলে, ‘ঘরে কোনো লোক লুকিয়ে ছিল। সে দরজা খুলে দিয়েছিল।’

খালা বললেন, ‘না। হয়নি। ঘরে আর কেউ ছিল না।’

‘তাহলে কোনো রিমোট কন্ট্রোল ছিটকিনি। রিমোট টিপে ছিটকিনি খুলেছে।’

খালা বললেন, ‘না, রিমোট ছিল না।’

‘তাহলে ছেলেটা ছিটকিনি খুলল কীভাবে?’

‘সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি।’

‘ছেলেটা আসলে ভূত হয়ে গিয়েছিল। তার হাত লম্বা হতে লাগল। লম্বা হতে হতে হাত গিয়ে পৌঁছাল ছিটকিনির কাছে। ছিটকিনি খুলে গেল।’

খালা বললেন, ‘তুই তো ভালোই কল্পনা করেছিস। ছেলেটা ভূত নয়। ভেবে বল, পানি এল কোথা থেকে?’

‘ঘরে একটা ভূত এসেছিল। সেই ভূতটা দরজা খুলে দিয়েছিল। আর ভূত দেখে ভয়ে ছেলেটা হিসু করে দিয়েছিল।’

ছোট খালা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে লাগলেন। ‘উফ্। এমন হাসির কথাও গুড্ডু বলতে পারে?’

‘আচ্ছা, তোকে ক্লু দিই। পানির তিনটা অবস্থা আছে—কঠিন, তরল, বায়বীয়। পড়িসনি বিজ্ঞানের ক্লাসে?

‘কী জানি পড়েছি কি না। কিছু তো মনে করতে পারি না।’ গুড্ডু বলল।

‘পানি গরম করলে বাষ্প হয়, ঠান্ডা করলে বরফ হয়। এবার বল। কার ওপর ছেলেটা চড়তে পারে?’

‘না। পারলাম না।’

‘গুড্ডু রে। তুই একটা বুদ্ধু রে। আরে একটা বরফের খণ্ড ছিল। তার ওপর চড়ে ছেলেটা ছিটকিনি খুলেছিল।’

‘বরফটা তাহলে কই গেল?’

‘বরফ গলে গেছে।’

‘বরফ গলে গেল কেন?’

‘আরে গুড্ডু। আমরা একটা সম্ভাবনার কথা বলছি। এইখানে একটা বড় বরফের খণ্ড ছিল। ছেলেটা তাতে চড়ে ছিটকিনি খুলল। আর তুই বলছিস, বরফ গলল কেন? বরফ রুমের টেম্পারেচারে থাকবে? গলে যাবে না?’

‘আচ্ছা। এরপর দেখো, ঠিকই তোমার কঠিন কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব। জিজ্ঞেস করো।’

‘আচ্ছা, বল। একটা লোককে ধরা হয়েছে চুরির অপরাধে। ঘটনা ঘটেছে কুড়ি তারিখে। ঢাকায়। লোকটা বলল, হতেই পারে না। কুড়ি তারিখে আমি ছিলাম বরিশালে। ট্রেন থেকে নেমে সোজা গেলাম ডিসি অফিসের সামনে। লোকটা কি অপরাধী, নাকি না?’

‘তুমি আবার কঠিন প্রশ্ন করছ। সোজা প্রশ্ন করো।’

‘সোজা প্রশ্ন মানে?’

‘সোজা প্রশ্ন মানে কমন প্রশ্ন। যার উত্তর আমার জানা আছে। যেমন একটা ছেলে একটা ফাঁকা ঘরে আটকা ছিল। ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগানো ছিল। গার্ড ঘুম থেকে উঠে দেখল দরজার কাছে পানি। এই প্রশ্নটা করো।’

‘আরে বুদ্ধু। যে উত্তর তোকে একটু আগে বললাম, সেইটা আমি কেন জিজ্ঞেস করব।’

‘স্কুলে তো তা-ই হয়। উত্তর শিখিয়ে দেওয়া হয়। পরীক্ষায় গিয়ে তা-ই লিখতে হয়।’

‘স্কুলে এভাবে পরীক্ষা নেওয়া হয় বলেই তো সবার মাথায় কেবল গোবর। তা-ও যদি ভেজা গোবর হতো! একেবারে শুকনা গোবর।’

‘আচ্ছা। আচ্ছা। চলো, আমরা একটা গোয়েন্দা অভিযান করি তুমি আর আমি মিলে।’

‘কোনোই দরকার নাই। তুই এমন একটা বোকার মতো কাণ্ড করে বসবি। পরে আমও যাবে, ছালাও যাবে।’

‘আমরা আম তো ছালায় রাখি না। ফ্রিজে রাখি।’

‘তাহলে আমও যাবে, ফ্রিজও যাবে।’

‘আচ্ছা। তাহলে তুমি গোয়েন্দা গল্প বলো। আমি শুনি।’

ছোট খালা গল্প বলতে শুরু করেন। শীতের রাত। বিছানায় কম্বলের নিচে পা দিয়ে দুজনে আধশোয়া হয়ে আছে।

‘আচ্ছা, তোকে একটা গল্প বলি। এই গল্পটা নাসিরউদ্দিন হোজ্জার। একবার দুটো লোককে ধরে আনা হলো। তাদের দুজনের একজন হাঁস চুরি করেছে। বাড়িতে এই দুজন লোকই ছিল। এদের কেউ একজন একটা হাঁস ধরে মাথায় করে নিয়ে গেছে। বাইরের দারোয়ান দেখেছে নিয়ে যেতে। তবে অন্ধকার ছিল বলে দারোয়ান ধরতে পারেনি ঠিক কোনজন হাঁসটা নিয়ে গেছে। এখন বের করতে হবে, হাঁসটা কে চুরি করেছে। দুজনের একজন।’

‘কে হাঁস চুরি করেছে?’ গুড্ডুবুড়া জিজ্ঞেস করল।

‘সেটাই তো প্রশ্ন। তখন নাসিরউদ্দিন হোজ্জার কাছে বিচার গেল। হোজ্জা দুজনের দিকে একবার তাকালেন। তারপর বললেন, আরে, তোমার মাথায় দেখি এখনো হাঁসের পালক লেগে আছে। অমনি একজনের হাত চলে গেল মাথার ওপর। তখন হোজ্জা বললেন, আমরা আমাদের অপরাধীকে পেয়ে গেছি। এই লোকটা। যে লোকটা নিজের অজান্তেই মাথায় হাত দিয়ে হাঁসের পালক খুঁজছিল।’

গুড্ডুবুড়া চোখ গোল গোল করে ফেলল। বলল, ‘কী বুদ্ধি ছিল নাসিরউদ্দিন হোজ্জার!’

খালা বললেন, ‘নাসিরউদ্দিন হোজ্জা যখন ঠিকমতো খেতে শুরু করলেন, ব্যায়াম শুরু করলেন, তারপর না তার বুদ্ধি খুলে গেল। তার আগে তো তিনি বোকাই ছিলেন। তোর মতো।’

‘কেমন?’

‘একবার নাসিরউদ্দিন হোজ্জা তার পরনের কাপড়টা বারান্দায় শুকাতে দিয়েছেন। রাতের বেলা হোজ্জার ঘুম ভেঙে গেল। তিনি দেখেন, বারান্দায় কে যেন দাঁড়িয়ে। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। ভাবলেন, চোর এসেছে। অমনি তির-ধনুক এনে তির ছুড়ে মারলেন জামাটার দিকে। পরদিন দিনের আলোয় বাইরে গিয়ে দেখেন, কোথায় চোর-ডাকাত। তির লেগেছে তার জামায়। তিনি কাঁদতে লাগলেন। “ভাগ্যিস, জামাটার ভেতরে আমি ছিলাম না। কী হতো, যদি জামার ভেতর আমি থাকতাম। তাহলে তো তির এসে আমার গায়েই লাগত!”’

ছোট খালা জোরে জোরে হাসতে লাগলেন। গুড্ডুবুড়া কিছুতেই বুঝছে না, এতে হাসির কী হলো।

গুড্ডুবুড়া স্কুলে গেল।

তার মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা। একটা গোয়েন্দা অভিযান করতে হবে। ফেলুদা বা শার্লক হোমসের মতো তাকেও কোনো একটা রহস্যের ভেদ করতে হবে। সে হবে ডিকেটটিভ গুড্ডুবুড়া। কিন্তু তার আগে একটা অপরাধ তো ঘটতে হবে। ক্রাইম। সে বন্ধুদের বলল, ‘শোনো, আমি না বড় হয়ে ডিটেকটিভ হব। বিশাল নামকরা গোয়েন্দা। ফেলুদা। শার্লক হোমস।’

ওর বন্ধুরা হাসতে লাগল। সবাই জানে, গুড্ডুবুড়ার মাথায় কিছু নেই। সে একটা হাঁদারাম। তার গায়েও কোনো জোর নেই। সে কী করে গোয়েন্দা হবে?

গুড্ডুবুড়া বলল, ‘সমস্যা কী, জানিস?’

ওর বন্ধু উপল বলল, ‘সমস্যা কী?’

গুড্ডুবুড়া বলল, ‘স্কুলে কোনো ক্রাইম ঘটছে না। একটা খুন, একটা ডাকাতি, একটা চুরি, কিছু একটা না ঘটলে আমি অপরাধী ধরব কেমন করে?’

জারিন বলল, ‘গুড্ডু, তোকে গোয়েন্দা বানানোর জন্য স্কুলে বুঝি এখন ক্রাইম করতে হবে? যাহ্, বোকা কোথাকার!’

গুড্ডুবুড়া বলল, ‘তা না হলে আমি গোয়েন্দা হব কেমন করে? এই তোরা কেউ একটা ক্রাইম কর না। আমি তোদের মধ্যে কে ক্রিমিনাল, তা ধরে ফেলি। আমার একটু নামধাম হোক। গোয়েন্দাগিরি প্র্যাকটিস হোক।’

টিফিন পিরিয়ডের আগেই ক্লাসে একটা ‘অপরাধ’ ঘটে গেল।

সাবিনা একটা সুন্দর কলম এনেছিল। ম্যাজিক ইঙ্কের পেন। জাদুর কলম। সেই কলম দিয়ে কী লেখা হয় কাগজে, কেউ তা জানে না। সেই কাগজ পানিতে ভেজালে তখন লেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেটা হারিয়ে গেছে। সেকেন্ড পিরিয়ডেও কলমটা সাবিনার ব্যাগে ছিল। ফোর্থ পিরিয়ডে এসে দেখা গেল, কলম ব্যাগে নেই। সাবিনা কাঁদতে শুরু করল। ক্লাসে এসেছেন অঙ্কের মিস দিলরুবা।

সাবিনাকে কাঁদতে দেখে তিনি বললেন, ‘এই সাবিনা, কী হয়েছে?’

সাবিনা বলল, ‘আমার এত ফেবারিট পেনটা! আমাকে মামা গিফট করেছিল। ম্যাজিক ইঙ্কের পেন। সেটা ব্যাগ থেকে চুরি হয়ে গেছে।’

গুড্ডুবুড়ার বুক ধড়াক করে লাফিয়ে উঠল। এই তো মহাসুযোগ। সাবিনার কলম উদ্ধার করতে হবে। গোয়েন্দাগিরি করার এই সুযোগ সে ছাড়তেই পারে না।

দিলরুবা মিস বললেন, ‘এই শোনো। তোমরা যদি কেউ দুষ্টুমি করে বা ভুল করে সাবিনার পেনটা নিয়ে থাকো, তাহলে চুপচাপ আমাকে দিয়ে যেয়ো। আমি কাউকেই বলব না।’

সাবিনার কান্না থামে না। টিফিন পিরিয়ডে সে কিছুই খাচ্ছে না। উপল, জারিন, সায়মন, টুটুল—সবাই এগিয়ে গেল গুড্ডুবুড়ার দিকে। ‘গুড্ডু, এই সুযোগ। তুই বের করে ফেল, চোর কে। তাহলে তোর নাম গোয়েন্দা হিসেবে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে।’

গুড্ডুবুড়া বলল, ‘ঠিক বলেছিস। এইটাই আমার ফার্স্ট কেস। এটাতে সফল হতেই হবে।’

গুড্ডুবুড়া নিজের মনের মধ্যে ছক কেটে নিচ্ছে। কোনটার পর কোনটা করতে হবে। প্রথমে ক্রাইম স্পট ভিজিট করতে হবে। সেখানে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় কি না, দেখতে হবে। তারপর সাবিনার সঙ্গে কথা বলতে হবে। সে কি কাউকে সন্দেহ করছে?

‘সোজা প্রশ্ন মানে কমন প্রশ্ন। যার উত্তর আমার জানা আছে। যেমন একটা ছেলে একটা ফাঁকা ঘরে আটকা ছিল। ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগানো ছিল। গার্ড ঘুম থেকে উঠে দেখল দরজার কাছে পানি। এই প্রশ্নটা করো।’

গুড্ডুবুড়া তার ছোট্ট নোটবইটা নিয়ে এগিয়ে গেল সাবিনার দিকে। সাবিনার চোখের নিচে তখনো পানির দাগ।

গুড্ডু বলল, ‘সাবিনা। তোমার পেনটা কোথায় ছিল বলো তো?’

‘তা দিয়ে তুমি কী করবে?’

‘আমি হলাম গোয়েন্দা। ডিটেকটিভ গুড্ডু। তোমার পেন আমি উদ্ধার করে দেব। আর কে তোমার পেনটা চুরি করেছে, তা-ও বের করে দেব।’

‘পেনটা এই ব্যাগে ছিল। আমার স্কুলব্যাগের মধ্যে ছিল পেনসিল রাখার ব্যাগ। তার ভেতরে ছিল ম্যাজিক পেনটা।’

গুড্ডুবুড়া বেঞ্চের নিচে দেখতে লাগল। নিচে পড়েটড়ে গেছে কি না। আশপাশের সবার দিকে তাকাল। উপল, জারিন তার দিকে কেমন করে তাকাচ্ছে। তার মানে, এই দুজনেরই কেউ হয়তো কলমটা নিয়েছে।

গুড্ডুবুড়া বলল, ‘সাবিনা, তোমার কলম দিয়ে লিখলে লেখাটা পড়া যায় না। কিন্তু পানিতে কাগজটা ভেজালে পড়া যায়। তা-ই তো!’

‘ঠিক তা-ই।’

‘আচ্ছা, আমি দেখছি।’

গুড্ডুবুড়া করল কি, জারিন আর উপল যখন ক্লাসরুমের বাইরে গেছে, তখন তাদের ব্যাগ হাতড়ে দেখল ভেতরে কলম আছে কি না। এরপর তার মনে হলো, যদি এরা কলম নিয়ে থাকে, নিশ্চয়ই খাতায় এরা কিছু লিখেছে। খাতা যদি পানিতে ভেজানো যায়, তাহলেই চোর ধরা পড়ে যাবে। সে জারিনের ব্যাগে পেল দুটো খাতা, উপলের ব্যাগে তিনটা। তিনটা নিয়ে সে নিজের সিটে এল। তার পানির ফ্লাস্ক থেকে পানি ঢেলে দিতে লাগল পাঁচটা খাতায়।

একটু পর ক্লাসে মহা হইচই। ঘটনা গুরুতর। গুড্ডুবুড়া দুজনের ব্যাগ থেকে খাতা বের করেছে। তারপর সেসব পানিতে ভিজিয়ে নষ্ট করেছে।

টিফিনের পর ক্লাসে এলেন পিটি স্যার। বদরাগী হিসেবে তার দুর্নাম আছে। জারিন আর উপল স্যারের কাছে নালিশ করল।

‘স্যার, গুড্ডুবুড়া আমাদের খাতায় পানি ঢেলে দিয়েছে। সব খাতা নষ্ট করেছে।’

স্যার চিৎকার করে বললেন, ‘কী বলিস? খাতায় পানি ঢেলে দেয়, এ ধরনের কথা তো এর আগে কখনো শুনিনি। কে করেছে?’

‘গুড্ডু করেছে, স্যার।’

‘গুড্ডু...স্যার এমন জোরে চিৎকার করলেন যে ক্লাসরুমের জানালার কাচ ভেঙেই গেল।’

গুড্ডু ভয়ে জড়সড়।

‘গুড্ডু, তুমি ওদের ব্যাগে হাত দিয়েছিলে?’

‘জি স্যার।’

‘কেন দিয়েছিলে?’

‘স্যার, সাবিনার কলম চুরি গেছে স্যার।’

‘তো?’

‘জারিন আর উপল সাবিনার দিকে কেমন করে তাকাচ্ছিল আর হাসছিল। তাতেই আমার সন্দেহ হয়েছিল স্যার। তাই আমি ওদের ব্যাগ চেক করেছি।’

‘পেয়েছিস কলম?’

‘না স্যার।’

‘তাহলে তুই ওদের খাতা না বলে বের করলি আর তাতে পানি ঢেলে দিলি। ব্যাপার কী!’

‘স্যার, ওর কলমটা জাদুর কলম স্যার। এটা দিয়ে কাগজে লিখলে লেখা দেখা যায় না। কাগজটা ভেজালে দেখা যায় স্যার। আমি ভাবলাম, ওরা যদি কলমটা চুরি করে, নিশ্চয়ই নিজেদের খাতায় কিছু একটা লিখে ট্রাই করবে। ম্যাজিকটা হয় কি হয় না, তাই খাতা ভিজিয়েছি স্যার।’

‘পেয়েছিস কিছু?’

‘না স্যার।’

‘ওকে। সাবিনার কলম পাওয়া যাবে কি যাবে না, সে বিচার পরে হবে। তুই যে উপল আর জারিনের ব্যাগ থেকে খাতা নিলি, তার বিচার হবে আগে। আয়, সবার সামনে কানে ধরে ওদের দিকে তাকিয়ে থাক। বল, “আর কোনো দিন কারও ব্যাগে না বলে হাত দেব না।”’

সাবিনা বলল, ‘স্যার, আমার কলম স্যার...’

পিটি স্যার বললেন, ‘সে-ও হবে। আমি সবার ব্যাগ সার্চ করব। সবার আগে করব গুড্ডুবুড়ার ব্যাগ চেক। গুড্ডু, ব্যাগ আন।’

গুড্ডুবুড়া ব্যাগ নিয়ে গেল স্যারের কাছে। স্যার হাত ঢোকাতেই বেরিয়ে এল সাবিনার কলম। গুড্ডুবুড়া কাঁদতে লাগল। ‘আমি কিছু জানি না স্যার। আমি কলম চুরি করিনি স্যার।’

পিটি স্যার বললেন, ‘একে বাংলায় বলে, বমাল চোর ধৃত। ইংরেজিতে বলে, কট রেড হ্যান্ডেড। হাতেনাতে ধরা। বল, তোকে কী শাস্তি দেব?’

‘আমি চুরি করিনি স্যার।’

পিটি স্যার বললেন, ‘আমার নাম পিটি স্যার। তা-ই তো?’

সবাই বলল, ‘জি স্যার।’

‘পিটি স্যার মানে কী?’

সবাই চেঁচিয়ে বলল, ‘ফিজিক্যাল ট্রেনিং স্যার।’

‘নো। পিটি মানে দয়া। আমার দয়ার শরীর। আমি গুড্ডুবুড়াকে ক্ষমা করে দিলাম। ঠিক করেছি কি না।’

সবাই বলল, ‘ইয়েস স্যার।’

‘কিন্তু গুড্ডুবুড়াকে ক্ষমা পাওয়ার জন্য একটা কাজ করতে হবে? কী কাজ করতে হবে?’

‘কী কাজ করতে হবে স্যার!’

‘ওকে ঠিকমতো খেতে হবে। ওকে ঠিকমতো এক্সারসাইজ করতে হবে। ঠিক বলেছি কি না!’

‘ঠিক বলেছেন স্যার।’

‘কী কী খেতে হবে? তোমরা জানো?’

‘জি স্যার।’

‘একজন দাঁড়িয়ে বল।’

বুশরা ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। সে দাঁড়াল।

‘ভাত-রুটি খেতে হবে।’

সঙ্গে সঙ্গে সবাই বলতে লাগল, ‘ভাত-রুটি খেতে হবে।’

‘মাছ-মাংস খেতে হবে।’

সবাই বলল, ‘মাছ-মাংস খেতে হবে।’

‘ডিম খেতে হবে।’

—ডিম খেতে হবে।

‘দুধ খেতে হবে।’

—দুধ খেতে হবে।

‘শাকসবজি খেতে হবে।’

—শাকসবজি খেতে হবে।

‘ফলমূল খেতে হবে।’

—ফলমূল খেতে হবে।

‘চিনি খাওয়া কম কম।’

—চিনি খাওয়া কম কম।

‘নুন খাওয়া কম কম।’

—নুন খাওয়া কম কম।

‘তেল খাওয়া পরিমাণমতো।’

—তেল খাওয়া পরিমাণমতো!

‘খেলাধুলা বেশি বেশি।’

—খেলাধুলা বেশি বেশি।

‘রাতের বেলা ঘুম, দিনের বেলা জাগা।’

—রাতের বেলা ঘুম, দিনের বেলা জাগা।

‘মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ভিডিও গেমস কম কম।’

—মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ভিডিও গেমস কম কম।

স্যার বললেন, ‘গুড্ডুবুড়া শুনেছিস?’

‘জি স্যার।’

‘কথা শুনবি?’

‘জি স্যার।’

‘কথা যদি শুনিস, ঠিকভাবে খাওয়াদাওয়া, ঠিকভাবে খেলাধুলা, ঠিকভাবে ঘুম...তাহলে কী হবে?’

‘গুড্ডুবুড়া বলল, ‘বুদ্ধি হবে।’

‘হ্যাঁ, বুদ্ধি হবে। শক্তি হবে। মন ভালো থাকবে। শরীর ভালো থাকবে। সবকিছুতে ভালো করবি। নে। বস।’

সেদিন থেকে গুড্ডুবুড়া ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতে লাগল। সে ভাত খায়, মাছ খায়, ডিম খায়, দুধ খায়, শাকসবজি খায়, ফলমূল খায়। বিকেল হলেই বাড়ির ছাদে যায়। দৌড়াদৌড়ি করে। একটা ব্যাডমিন্টনের কোট কাটা হয়েছে বাড়ির সামনের লনে। সেখানে গিয়ে সে ব্যাডমিন্টন খেলে। তার শরীর এখন শক্তপোক্ত হয়ে উঠছে। মাথায় বুদ্ধি গিজগিজ করতে শুরু করেছে, কাজে-কর্মে দেখা যাচ্ছে বুদ্ধির ঝিলিক, চোখেমুখে সেই বুদ্ধির রোশনাই।

এবার গুড্ডুবুড়া আর বোকা নয়। সে এখন চালাক গুড্ডুবুড়া। সে ফোন করল ছোট খালাকে। ‘ছোট খালা, গুড্ডু বলছি।’

ছোট খালা বললেন, ‘সে তুই না বললেও আমি বুঝতে পারি যে তুই গুড্ডুবুড়া। ফোন এসেছে বড় আপার মোবাইল থেকে। আর তুই যখনই ছোট খালা বলেছিস, অমনি আমি বুঝেছি, তুই গুড্ডু।’

‘আর আমি বুঝেছি, তুমি ফোন করছ তোমার ডাইনিং টেবিল থেকে। তোমার সামনে এক কাপ চা। চা ভীষণ গরম। তোমার চোখে চশমা। তোমার চোখের কাচ চায়ের ভাপে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।’

‘তাজ্জব তো। কী করে বুঝলি? আমরা তো ভিডিও কল করিনি।’

‘সোজা। তোমার ফোনে টেলিভিশনের আওয়াজ আসছে। তোমাদের বাসায় টেলিভিশনটা ডাইনিং রুমে। এখন বাজে সকাল নয়টা। তার মানে, তুমি খবরের কাগজ পড়ছ অথবা টেলিভিশন দেখছ। দুটোতেই তোমার চশমা লাগে। আর তুমি চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার শব্দ করেছ। সুড়ুৎ। গরম চা ছাড়া এ ধরনের শব্দ হওয়ার কথা নয়। আর গরম চা থেকে বাষ্প বের হবেই। আর তাতে তোমার চশমার কাচ ঘোলা হবেই।’

‘আরে গুড্ডু। তুই তো একেবারে ফেলুদা হয়ে গেছিস।’

‘না না। প্রদোষ মিত্তিরের কানি আঙুল হওয়ার যোগ্যতাও আমার নাই। আমি যে গুড্ডু, সে গুড্ডুই রয়ে গেছি। শোনো।’

‘বল।’

‘তুমি এই শীতের মধ্যে উত্তর দিকের জানালা খুলে রেখেছ কেন?’

‘উত্তর দিকের জানালা খুলে রেখেছি তোকে কে বলল?’

‘তোমাদের বাড়ির উত্তর দিকে গলি আছে। রিকশা চলাচল করে। রিকশার ক্রিং ক্রিং আওয়াজ আমি ফোনেই শুনতে পাচ্ছি। তার মানে, তোমাদের উত্তর দিকের জানালা খোলা।’

‘গুড্ডু! তুই তো শার্লক হোমস হয়ে গেছিস। শুধু সঙ্গে যদি একজন ডাক্তার ওয়াটসন পেতাম। আমি নাহয় তোর ডা. ওয়াটসন হব!’

‘আরে না। ওয়াটসনকে নিয়ে কৌতুক আছে, জানো তুমি!’

‘কোনটা?’

‘ওই যে শার্লক হোমস বনের মধ্যে ক্যাম্পিং করতে গেছেন। তার পাশে ঘুমুচ্ছেন ডা. ওয়াটসন। শার্লক হোমসের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি দেখলেন, আকাশে অনেক তারা। তিনি ডা. ওয়াটসনকে ডেকে বললেন, ডা. ওয়াটসন, দেখুন আকাশে অনেক তারা। এর মানে কী?

ওয়াটসন বললেন, এর মানে, আকাশ পরিষ্কার। আগামীকাল একটা রোদেলা দিন হবে।

হয় নাই।

পুব দিগন্ত ফরসা হতে শুরু করেছে। তার মানে, ভোর হতে বেশি বাকি নাই।

বুদ্ধু, আমাদের মাথার ওপর যে তাঁবু ছিল, সেটা চুরি হয়ে গেছে।’

ছোট খালা হি হি করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘তাহলে আমি ডা. ওয়াটসন হব না। কে আর বুদ্ধু হতে চায়! ফোন করেছিস কেন?’

‘ফোন করেছি; কারণ, পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। এরপর ছুটি। কটা দিন তোমাদের ওখানে বেড়াতে গেলে কেমন হয়। তুমি বলো।’

‘খুব ভালো হয়। তুই এলে আমাদের এলাকার কোনো একটা রহস্যের সমাধানে দুজনে মিলে লেগে পড়া যেত!’

‘তোমাদের ওখানে কোনো ক্রাইম ঘটছে নাকি!’

‘না ঘটলেও ঘটতে কতক্ষণ। আর যদি না ঘটে, তাহলে আমরা বেড়াতে চলে যাব কক্সবাজার, না হলে রাঙামাটি। তুই আয় তো। একা আসবি, নাকি আপা–দুলাভাইকে সঙ্গে নিয়ে আসবি?’

‘মা-বাবা গেলে তো কোনো কথাই নাই। না গেলেও আমি ঠিক চলে আসতে পারব। এখন তো আমি খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করি।’

‘হি হি হি। এখন তো তুই আর বোকা গুড্ডুবুড়া না। এখন তো তুই রীতিমতো চালাক গুড্ডুবুড়া!’

স্কুলে মহা হইচই। প্রধান শিক্ষিকা গুলশান আপার হীরার আংটি চুরি হয়ে গেছে।

সহকারী প্রধান শিক্ষিকা জোবায়দা চৌধুরী দুপুরের পর ঢুকেছেন হেড মিস্ট্রেসের চেম্বারে। কথা হচ্ছে, পরীক্ষা শেষ হলে কত তাড়াতাড়ি রেজাল্ট দিয়ে দেওয়া যায়।

জোবায়দা বললেন, ‘আপা, আমরা দুই সপ্তাহের মধ্যে রেজাল্ট দেব। আপা, আপনার কানের দুল দুইটা তো সুন্দর। কোথা থেকে কিনেছিলেন।’

‘এইটা। এটা দিয়েছিল আমার মেজ ভাবি। আমার হাতের আঙুলের আংটির সঙ্গে ম্যাচ করে পরলাম। আজ আমার শখের হীরার আংটি পরে এসেছি। কত দিনের টাকা জমিয়ে এটা কিনেছিলাম।’

‘হঠাৎ তিনি বাঁ হাতের আঙুলের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, হায় আল্লাহ, আমার আংটি কই? ডায়মন্ডের রিং।’

তার ফরসা মুখ সেদ্ধ খোসাছাড়া আলুর মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

জোবায়দা আপা বললেন, ‘আপনি পরে এসেছিলেন, ঠিক মনে আছে তো?’

‘হ্যাঁ। আংটি পরলাম। তার সঙ্গে মিলিয়েই তো দুল পরলাম। কোনো ভুল নাই।’

‘তাহলে আংটি কোথায় পড়ে গেল? আঙুল থেকে খসে পড়েছে? অনেক ঢিলা ছিল?’

‘না না। টাইট। এই দেখেন, আমার আঙুলে দাগ পড়ে গেছে।’

‘তাহলে কোথায় খুলে রাখলেন?’

‘মনে পড়েছে। অজু করার সময় বেসিনে খুলে রেখেছি। হেড মিস্ট্রেস ছুটলেন তার চেম্বারের ভেতরেই পাশের ঘরে। সেখানে একটা বেসিন। অজু করার জায়গা। তারপর একটা বাথরুম।’

‘হায় খোদা। এখানেই তো রেখেছিলাম। গেল কই?’ তিনি কাঁদতে শুরু করলেন, ‘আমার এত শখের আংটি। আমার এত শখের ডায়মন্ড। আমার এত শখের ডায়মন্ড।’

তিনি বললেন, ‘অজু করার সময় খুলে রেখেছিলাম। বেসিনের ওপর। আমার মনে আছে।’

তিনি উঠলেন। পাশের বেসিনের ঘরে গেলেন।

‘হায় খোদা। এখানেই তো রেখেছিলাম। গেল কই?’ তিনি কাঁদতে শুরু করলেন, ‘আমার এত শখের আংটি। আমার এত শখের ডায়মন্ড। আমার এত শখের ডায়মন্ড।’

জোবায়দা মিস কী করবেন, বুঝছেন না। তিনি ভাবলেন, তিনিও বসের সমর্থনে কান্না জুড়ে দেন। কিন্তু তা কি উচিত হবে?

তিনি বললেন, ‘আপনার ঠিক মনে আছে এখানে খুলেছিলেন।’

‘হ্যাঁ।’

‘এই ঘরে কেউ ঢুকেছিল?’

‘না।’

ঘরটা তিনতলায়। একটা জানালা আছে বটে। তবে তার গ্রিলের ফাঁক গলে কোনো মানুষের পক্ষে এই পর্যন্ত আসা সম্ভব নয়। আগেকার দিনের সরকারি বিল্ডিং। অনেক বড়সড় রুম। উঁচু ছাদ। ছাদের কাছে একটা বড় তাক। চড়াই পাখি কিচিরমিচির করে এই ঘরে। আসা-যাওয়া করে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে।

বড় আপা বলতে লাগলেন, ‘আমার মনে আছে, আমি এই জায়গায় আংটিটা খুলে রাখলাম। তারপর অজু করলাম। তারপর নামাজ পড়লাম নিজের ঘরে। ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। কেউ আসেনি। তারপর আপনিই প্রথম এসেছেন।’

জোবায়দা প্রমাদ গুনলেন। ‘আপা কি আমাকে সন্দেহ করছে নাকি?’—তিনি ভাবলেন।

‘আপনি অজু শেষ করে আংটিটা এনে আপনার টেবিলে রাখেননি তো?’

‘না, রাখিনি।’—বলতে বলতে বড় আপা নিজের ড্রয়ার খুললেন। ভালো করে খুঁজলেন। তারপর নিজের ব্যাগের জিনিস সব নামিয়ে একটা একটা করে তল্লাশি করলেন। না, ডায়মন্ডের রিং ভ্যানিশড।

তিনি হঠাৎ নিজের চেয়ারে এলিয়ে পড়লেন। তারপর তার পুরো শরীর কাত হয়ে মেঝের কার্পেটে পড়ল গড়িয়ে। জোবায়দা আপা দৌড়ে গিয়ে ধরতে ধরতেই তিনি পপাতধরণিতল।

তিনি হেড মিস্ট্রেসের কলবেলে টিপ দিলেন। দপ্তরি আয়নাল হোসেন ছুটে এলেন। আয়া কুলসুম এলেন। আয়া আর জোবায়দা আপা মিলে তাকে ধরে পাশের ইজিচেয়ারে শুইয়ে দিলেন। আয়নাল হোসেন বুদ্ধি করে গেলাসে পানি নিয়ে এসেছেন।

জোবায়দা হেড মিস্ট্রেসের চোখেমুখে পানির ছিটা দিতে লাগলেন।

একটু পর তার হুঁশ হলো। তিনি বললেন, ‘আমি বুশরার আব্বুকে বলব, কেমন করে আমি ডায়মন্ড রিং হারিয়ে ফেলেছি।’

পিটি স্যারকে ডাকা হলো। তিনি স্কুলের নিরাপত্তা দেখে থাকেন। তিনি বললেন, ‘ব্যাপারটা চিন্তার। তবে দুশ্চিন্তার কিছু নাই।’

শায়লা আপা বললেন, ‘এইটা ভূতের কাণ্ড। ভূত ছাড়া কারও পক্ষে ওই জানালা দিয়ে ঢুকে এই আংটি নিয়ে যাওয়া সম্ভব না।’

বড় আপা বললেন, ‘ভূত!’

‘জি, ভূত।’

‘ভূত আংটি নিয়ে কী করবে?’

‘ওরা পোষা ভূত। আংটি চুরি করে নিয়ে গিয়ে মালিককে দেবে। মালিক বিক্রি করে আরামে পায়ের ওপর পা রেখে খাবে। পা দোলাবে।’ শায়লা আপা চেয়ারে বসে নিজের পা দুলিয়ে দেখালেন, ভূতের মালিক কীভাবে পা দুলিয়ে থাকে।

পিটি স্যার বললেন, ‘দুশ্চিন্তার কিছু নাই। সমস্যার সমাধান অতি সহজ।’

‘অতি সহজ?’ প্রধান শিক্ষিকা বললেন।

‘ইয়েস। ইজি লাইক সুজি।’

‘বলেন কী?’

‘হ্যাঁ। সমস্যার সমাধান হলো গুড্ডু। গুড্ডুকে ডাকলেই সমাধান হয়ে যাবে।’

‘কীভাবে?’

‘জানেন না, গুড্ডু এখন গোয়েন্দা বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করছে। ওকে ডেকে এনে এই অ্যাসাইনমেন্ট দিলেই সব ইজি। লাইক সুজি।’

‘আপনার সুজি জিনিসটা কী?’

‘সুজি হলো সুজি। এটা দিয়ে হালুয়া বানানো যায়। ফিরনি বানানো যায়।’

গুড্ডুকে ডাকা হলো। হেড মিস্ট্রেস কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘বাবা গুড্ডু, আমার ডায়মন্ডের রিংটা উদ্ধার করে দাও বাবু।’

গুড্ডু এবার গম্ভীর। সে তার ছোট্ট হাত দুটো কোমরের পেছনে বেঁধে রুমের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। আর মুখে বলতে লাগল, ‘আপনি শিওর যে আপনি আংটি পরে এসেছেন।’

বড় আপা বললেন, ‘হ্যাঁ।’

‘আপনি শিওর যে আপনি এটা পাশের ঘরের বেসিনে রেখেছিলেন? ’

‘হ্যাঁ।’

‘তারপর?’

‘তারপর অজু করলাম। এই ঘরের দরজা লক করে নামাজ পড়লাম।’

শায়লা আপা বললেন, ‘আর এই ফাঁকে ভূত এসে আংটিটা নিয়ে উড়াল দিল।’

‘আপনি চুপ করেন’—বড় আপা রাগত স্বরে বললেন।

‘তারপর?’ গুড্ডুবুড়া বলল।

‘তারপর দরজা খুললাম। জোবায়দা আপা এলেন। তারপর...’

জোবায়দা আপা আর্তনাদের সুরে বললেন, ‘আমি আংটি দেখিনি।’

গুড্ডু বলল, ‘চলুন, বেসিনটা দেখে আসি।’

গুড্ডু বেসিন দেখতে গেল। সঙ্গে বড় আপা, জোবায়দা আপা, পিটি স্যার। শায়লা আপা ওই ঘরে যাবেন না। তিনি দোয়া-দরুদ পড়তে লাগলেন।

গুড্ডু বলল, ‘ঠিক কোন জায়গায় আংটিটা রেখেছিলেন?’

বলতে বলতে গুড্ডু একটা খড়ের কুটা ঘরটা থেকে তুলল। ওপরে ভেন্টিলেটরের বাক্সে চড়াই পাখির বাসা। তারা খড় নিচে ফেলেছে।

বড় আপা আংটি খোলার জায়গা দেখালেন। কীভাবে অজু করার আগে তিনি আংটিটা খুলেছিলেন, তার বর্ণনা দিয়ে চললেন।

গুড্ডুবুড়া হেসে বলল, ‘চোর ধরা পড়েছে।’

বড় আপা বললেন, ‘চোর আসবে কোত্থেকে।’

গুড্ডুবুড়া বলল, ‘এ ঘরেই সে থাকে।’

বড় আপা চিৎকারের মতো করে বললেন, ‘এই ঘরে চোর থাকে।’

‘ইয়েস।’ গুড্ডুবুড়া বলল।

‘ধরা পড়বে?’ বড় আপার কণ্ঠে ব্যাকুলতা।

‘না-ও পড়তে পারে। তবে জিনিস পাবেন।’

‘জিনিস পেলেই হলো। তবে চোর এ ঘরে থাকবে কেন। কীভাবেই তা সম্ভব।’

গুড্ডু বলল, ‘জানালার এই পাটাতনটার দিকে দেখুন। কী দেখতে পাচ্ছেন?’

সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।

‘আমি দেখছি বিষ্ঠা। চড়াই পাখির বিষ্ঠা। কিন্তু এই যে পেস্টের মতো সাদা সাদা, এগুলো কাকের বিষ্ঠা।’

সবাই চুপ করে দেখল।

‘এবার মেঝেতে তাকান। ওই ভেন্টিলেটর বরাবর নিচে চুনের দাগ। মানে কাকের বিষ্ঠা।’

‘তাতে কী হলো?’

‘তার মানে, ভেন্টিলেটরে কাকের বাসা আছে।’

‘তা থাকতে পারে।’

‘তার মানে, কাক এসে আপনার আংটি নিয়ে গেছে। এরা এই জাতীয় জিনিস কুড়িয়ে নিচের বাসায় রাখে। এখন আয়নাল মামাকে বলুন মই আনতে।’

আয়নাল হোসেন মই আনলেন। গুড্ডু বলল, ‘মামা, একটু ওঠেন।’

মই সেট করা হলো। আয়নাল হোসেন ওপরে উঠতে যাবেন। অমনি একটা কাক উড়ে চলে গেল ভেন্টিলেটরের বাসা থেকে জানালা দিয়ে বাইরে।

আয়নাল হোসেন মোবাইল ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে দেখতে লাগলেন বাসাটা।

আংটিটা পাওয়া গেল।

গুড্ডুবুড়ার মুখে বিজয়ীর হাসি।

বড় আপা তাকে কোলে তুলে নিলেন। সে লজ্জিত মুখে বলতে লাগল, ‘আরে, করেন কী, করেন কী। ছাড়েন। ছাড়েন।’

সারা স্কুলে গুড্ডুবুড়ার সুনাম ছড়িয়ে পড়ল।

বাড়িতে এসে গুড্ডুবুড়া ফোন করল ছোট খালাকে। ‘ছোট খালা। গোয়েন্দা হিসেবে আমার প্রথম মিশন সাকসেসফুল।’

ছোট খালা বলল, ‘কংগ্র্যাচুলেশনস।’

গুড্ডুবুড়া পুরো ঘটনা খুলে বলল ছোট খালাকে।

ছোট খালা বললেন, ‘তা তোদের শায়লা মিস কী বলেন এখন?’

তিনি বলেন, ‘ওটা কাক নয়। কাকের বেশে ভূত!’

কয়েক দিন পর গুড্ডুবুড়া ফোন করল ছোট খালাকে।

‘ছোট খালা, চলে এসো।’

‘কোথায়?’

‘ঢাকায়। আমাদের বাসায়।’

‘কেন?’

‘একটা বড় ক্রাইম ঘটে গেছে। আমি এটার মিস্ট্রি সমাধান করতে চাই।’

‘কী রকম?’

‘একটা মার্ডার।’

‘মার্ডার?’

‘হ্যাঁ। আমাদের বিল্ডিংয়ের চারতলার ফোর–বির খান সাহেব মার্ডার হয়েছেন।’

‘বলিস কী?’

‘হ্যাঁ। সকালবেলা তিনি হাঁটতে যান ধানমন্ডি লেকে। তিন দিন আগে ভোরবেলা মিরপুর রোডে তাকে রিভলবার বা পিস্তল দিয়ে গুলি করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, ভোরবেলার ছিনতাইকারীরা করেছে। খবরের কাগজেও সেই কথা বলা হচ্ছে।’

অলংকরণ: নাইমুর রহমান

‘তো তুই এর ভেতরে ঢুকতে চাইছিস কেন?’

‘কারণ, আমাদের কাজের মেয়ে জরিনা একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে ।’

‘কী কথা?’

‘বলেছে, খান সাহেব এবারের লটারিতে ৫০ লাখ টাকার প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন।’

‘সেটা জরিনা জানল কী করে?’

‘জরিনাকে বলেছে খান সাহেবের ড্রাইভার।’

‘উফ্। পারিসও বটে। তো ৫০ লাখ টাকা লটারিতে পেলে কী হয়?’

‘খুন হয়।’

‘তো তুই কী করে এই খুনের রহস্য উদ্ধার করবি?’

‘আগে থেকে কী করে বলব। আগে তো কেসটা হাতে নিই।’

‘তোকে কেসটা নিতে দিচ্ছেটা কে বাপু?’

‘মোটকা মারুফ।’

‘মোটকা মারুফ?’

‘হ্যাঁ। আমার ক্লাসফ্রেন্ড। ওর বাবা পুলিশের ডিআইজি। সে বাবাকে বলেছে, আমার বন্ধু গুড্ডু তোমাদের এই জটিল কেসের সহজ সমাধান করে দিতে পারবে।’

‘তো ওর বাবা হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন নিশ্চয়ই।’

‘না। হেসে উড়িয়ে দেননি। তিনি বলেছেন, হ্যাঁ, হতে পারে। অনেক বড় সমস্যার খুব সহজ সমাধান অনেক সময় ছোটরা দিতে পারে। “জুতা আবিষ্কার” কবিতায় বড় বড় পণ্ডিত যা পারেননি, একজন মুচি তা করে দিয়েছেন।’

‘তা অবশ্য ঠিক।’

‘তাহলে তুমি কালকের মধ্যেই চলে এসো। ফ্লাইটে এসো।’

ছোট খালা চলে এলেন।

তিনি এর মধ্যে পারলারে গিয়ে চুল ছোট করে এসেছেন। তার পিঠে লম্বা লম্বা চুল ছিল। এখন ছোট চুল, ঘাড়ে দোল খাচ্ছে, তাকে দেখতে স্কুলের কিশোরীর মতো লাগছে। তিনি ঘরে ঢুকে স্যুটকেসটা রাখলেন একটা চেয়ারের ওপর। তারপর বললেন, ‘বাপ রে, চিটাগাং থেকে ঢাকা আসতে কুড়ি মিনিট, আর এয়ারপোর্ট থেকে কলাবাগান আসতে তিন ঘণ্টা। কোনো মানে হয়?’

তিনি হাতমুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলেন। গুড্ডুবুড়ার মা ভাত বাড়তে লাগলেন। ছোট খালা উঠে মাইক্রোওভেনে তরকারি গরম করে টেবিলে আনলেন।

গুড্ডুবুড়া আর ছোট খালা দুপুরের খাবার খাচ্ছে।

গুড্ডুবুড়া বলল, ‘মোটকা মারুফের বাবা আমাকে এসএমএস পাঠিয়েছেন। মার মোবাইলে সেটা আছে। তিনি লিখেছেন, গুড্ডু, গো অ্যাহেড উইথ দ্য খান মার্ডার কেস। কী বুঝলে?’

‘হুম্। এসব খুনোখুনির মধ্যে তোর মতো পিচ্চি ছেলের যাওয়াটা কি উচিত হবে?’

‘আমি খুনোখুনির মধ্যে যাচ্ছি না। আমি খুনের রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে যাচ্ছি।’

‘আচ্ছা। চল, তাহলে শুরু করি। কোথা থেকে শুরু করবি?’

‘তুমি খেয়েদেয়ে তৈরি হয়ে নাও। তারপর ওই ফ্ল্যাটে যাই।’

‘ওই ফ্ল্যাটে তোকে ঢুকতে দেবে কেন?’

‘দেবে। আমরা এই বিল্ডিংয়ের বাসিন্দা না?’

তারা গেল মরহুম খান সাহেবের ফ্ল্যাটে। গুড্ডুবুড়া পকেটে নিয়েছে গোপন টেপরেকর্ডার (ছোট খালার কাছ থেকে পাওয়া), নোটপ্যাড, একটা দড়ি, আতশি কাচ আর একটা ছোট চাকু। ছোট খালা নিয়েছেন স্মার্টফোন। আর একটা পেপার স্প্রে। মরিচের স্প্রে। যাতে কেউ আক্রমণ করলে তার চোখেমুখে স্প্রে করে পালিয়ে যাওয়া যায়।

খান সাহেবের বাড়িতে তার বিধবা স্ত্রী। দুই ছেলে-মেয়ে বিদেশে পড়াশোনা করে। তারা বাবাকে দেখতে আসেনি। ছুটি পায়নি। তেমনটাই জানালেন মিসেস খান। তিনি পরে আছেন হালকা রঙের শাড়ি। মাথা চাদরে ঢাকা। গুড্ডুর মনে হলো, মিসেস খানের চোখেমুখে ভয়।

গুড্ডু বলল, ‘আমরা আপনাদের বিল্ডিংয়েই দোতলায় থাকি। এত বড় দুর্ঘটনা ঘটল। তাই আপনাদের সঙ্গে একটু সাক্ষাৎ করতে এলাম। উনি আমার খালা।’

মিসেস খান কিছু বললেন না।

গুড্ডু বলল, ‘খান আঙ্কেল বড় ভালো লোক ছিলেন। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের জন্য তিনি টেবিল টেনিস সেট কিনে দিয়েছিলেন। আমরা কমিউনিটি হলের পাশে খেলতাম।’

মিসেস খান তবু নীরব।

‘আচ্ছা, আপনারা কি কাউকে সন্দেহ করেন? কে খুন করতে পারেন এত ভালো মানুষটাকে?’

‘আল্লাহ বিচার করবেন। আমি কাউকে সন্দেহ করি না। পুলিশ বলছে ছিনতাইকারী।’

গুড্ডু বলল, ‘না, ছিনতাইকারী নয়। পুলিশ এই এলাকার ছিনতাইকারীদের সরদারকে ধরেছে। সে বলেছে, এটা তাদের কারও কাজ নয়। বাইরের কারও কাজ।’

‘পুলিশ একবার এটা বলে, আরেকবার ওটা বলে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন মিসেস খান।

ছোট খালা মুখ খুললেন। ‘আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটির ক্রিমিনোলজি বিভাগ থেকে পড়েছি। এখন চট্টগ্রামে একটা বেসরকারি কলেজের লেকচারার। আমার কাজই অপরাধ নিয়ে। আপনি আমাদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারেন। আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারি।’

‘আর কী সাহায্য করবেন। যিনি গেছেন, তিনি তো আর ফিরে আসবেন না।’

গুড্ডু বলল, ‘লটারিতে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন আঙ্কেল। টাকাটা কি তিনি তুলতে পেরেছিলেন।’

‘আপনারা এখনি চলে যান। আমার শরীরটা ভালো না।’

‘আচ্ছা, চলে যাচ্ছি। তবে আমরা আবার আসব। আপনি আমাদের নিজেদের লোক ভাববেন।’ বলে উঠলেন ছোট খালা।

গুড্ডুবুড়াও তার সঙ্গে উঠে পড়ল।

১০

খালা বললেন, ‘কী মনে হলো?’

গুড্ডু বলল, ‘আমি নিশ্চিত, এটা রাস্তার ছিনতাইকারীর কাজ নয়। লটারির টাকার সঙ্গে এই খুনের কোনো সম্পর্ক আছে।’

খালা বললেন, ‘তুই কি মনে করিস, মিসেস খান, বা তার কেউ খানকে খুন করেছে। বাড়িতে শুনলাম, মিসেস খানের ভাই এসে উঠেছেন। পারিবারিক কোন্দল হতে পারে? স্বামী-স্ত্রীর গন্ডগোল?’

‘সন্দেহের তালিকায় সবাইকে রাখতে হবে। মিসেস খান, তার ভাই আসলাম আকন্দ। কেউ সন্দেহের তালিকার বাইরে না।’

‘তুই মিসেস খানের ভাইয়ের নাম জানলি কী করে?’

‘কিছুটা আমাদের কাজের লোক। কিছুটা নিচের গার্ড। বাকিটা ফেসবুক।’

‘তোর ফেসবুক আছে?’

‘আমার নাই। তবে মার আছে। মায়ের অ্যাকাউন্ট থেকেই আমি একটু গবেষণা করেছি মাত্র।’

‘এরপর কী করবি?’

‘পুলিশের সাহায্য লাগবে। খান আঙ্কেল, অর্থাৎ জহুরুল হক খান সাহেবের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চেক করতে হবে।’

মোটকু মারুফের বাবা ডিআইজি সাহেব লোক দিয়ে দিলেন। গুড্ডুবুড়া যে সহযোগিতা চাইবে, তা যেন করা হয়। দুদিন লাগল ব্যাংক হিসাব বের করতে। লটারিটা ছিল উদ্বাস্তু সেবা সংঘের নামে। সেখান থেকে ৫০ লাখ টাকার চেক এসেছে। এরপর ৪০ লাখ টাকা খান সাহেব ক্যাশ উইথড্র করেছেন। সেটা তিনি কী করেছেন, জানা যাচ্ছে না।

ছোট খালা বললেন, ‘চল, মিসেস খানকে আবার জেরা করি।’

গুড্ডু বলল, ‘তিনি কিছু বলবেন না।’

‘কেন বলবে না?’

‘দাঁড়াও। আরেকটু ভেবে বলি।’

পুলিশের সাহায্যে খান সাহেবের মোবাইল ফোনটা থানা থেকে বের করে আনা হলো। এটা বিক্রির জন্য গিয়েছিল চোরাই মোবাইলের বেচাকেনা চক্রের কাছে। সেখান থেকে পুলিশ এটা উদ্ধার করেছে। পুলিশের আইটি বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে মোবাইলটা অন করল গুড্ডুবুড়া। তারপর তার সার্চ হিস্ট্রি দেখল। ই-মেইল, জিমেইলও সব দেখল। দেখল সব এসএমএস।

সবটা অ্যানালাইসিস করে গুড্ডু বলল, ‘আমি একটা লাইন পেয়ে গেছি। কেন মিসেস খান কথা বলছেন না। কেন তিনি সহযোগিতা করছেন না।’

খান সাহেবের কললিস্ট দেখে ব্যাপারটা অ্যানালাইসিস করার চেষ্টা করল সে। উদ্বাস্তু সমিতির সাধারণ সম্পাদক রিয়াজুল বশীরের সঙ্গে খান সাহেব কথা বলেছেন সবচেয়ে বেশি। খুব স্বাভাবিক। লটারিতে তার টিকিটের নম্বর ওঠার পর তিনি টাকার জন্য এদের সঙ্গে যোগাযোগ তো করবেনই।

ছোট খালা বললেন, ‘কী রে। সাত দিন হয়ে গেল। তুই তো কোনো কূলকিনারাই করতে পারলি না।’

‘করব। তবে ফেলুদার মতো সবাইকে একটা ঘরে এনে একেবারে বলব।’

১১

পুলিশের ইনভেস্টিগেশন ব্যুরোর একটা গেস্টহাউসে মোটকু মারুফের বাবা আফজাল হোসেন আঙ্কেল অনেককেই দাওয়াত দিয়েছেন। মিসেস খান আছেন। তার ভাই, নিহত খান সাহেবের শ্যালক আসলাম আকন্দ আছেন। লটারির আয়োজকদের মধ্যে উদ্বাস্তু সেবা সংঘের সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদক আছেন। আর আছেন ছোট খালা, গুড্ডু, পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।

গুড্ডুর মন খাওয়ায়। সে তো আর আগের গুড্ডুবুড়া নেই যে খেতে চাইবে না। কাচ্চি বিরিয়ানি থেকে ধোঁয়া উঠছে। পরিমিত পরিমাণে আজ এটা না খেলেই নয়।

খেতে খেতে গুড্ডু বলল, ‘ছোট খালা, দেখেছ, মিসেস খান খাচ্ছেন না। আর রিয়াজুর রশীদ লোকটা গোগ্রাসে গিলছেন।’

খাওয়া শেষে গুড্ডু বলল, ‘আজ আপনাদের আমি একটা গল্প বলব। গল্পটা কিন্তু বাংলাদেশের সিনেমাকেও হার মানাবে।’

‘বাংলাদেশে ইদানীং ভালো সিনেমা হয় না।’ ডিআইজি সাহেব বললেন। ‘ভালো গল্প পেলে আমরা সেটা দিয়ে নাহয় একটা সিনেমা বানিয়েই ফেলব।’

গুড্ডু বলল, ‘এই যে লটারি হলো, এতে প্রথম পুরস্কার জেতে চ ১৯৭৮৯৬৭ নম্বরের টিকিট। খান আঙ্কেল সেই টিকিটের স্ক্যান কপি জমা দেন উদ্বাস্তু সেবা সংঘে। তিনি দাবি করেন, প্রথম পুরস্কারটা তার।

তখন সাধারণ সম্পাদক রিয়াজুর রশীদ সাহেব আকাশ থেকে পড়েন। তিনি বলেন, অসম্ভব! আপনি টিকিট জাল করেছেন।

খান সাহেব বলেন, ‘আমি জাল করব কী করে। আপনাদের টিকিট আপনারা কি এমনভাবে তৈরি করেন যে জাল করা যায়?

রিয়াজুর রশীদ বলেন, আমরা প্রথম পুরস্কার দিয়েছি সেই সিরিজটাকে, যা আমরা বাজারে ছাড়িনি। এটা আমাদের কাছেই আছে। কাজেই আপনার টিকিট যে জাল, তাতে আমাদের কোনোই সন্দেহ নেই।’

খাওয়া সেরে রিয়াজুর সাহেব কেবল ধনে চিবুচ্ছেন। তিনি চিৎকার করে ওঠেন, ‘অসম্ভব। মিথ্যা কথা। আমরা লটারি করেছি প্রকাশ্যে। সেই অনুষ্ঠান ফেসবুকে লাইভ প্রচারিত হয়েছে।’

গুড্ডু বলে, ‘আমি সেটা দেখেছি। সেটা দেখেই আমি বলছি।

প্রথম পুরস্কার দেওয়ার জন্য যে নম্বরগুলো লাগে, সেসব সততার সঙ্গে তোলা হয়। লটারির গোল ড্রামটা ঘোরানো হয়, যা ওঠে, তা-ই বলা হয়।

কিন্তু কোন সিরিজ থেকে এই পুরস্কার দেওয়া হবে, তা সিদ্ধান্ত দেন আপনি। আসুন, সবাই ফেসবুকের লাইভটা দেখে নিই।’

একটা বড় মনিটরে ফেসবুকের লাইভে দেখা যায়, লটারির ড্রাম ঘুরছে। একটা অক্ষর তোলা হলো। তুলল একটা বাচ্চা ছেলে। পড়ে শোনালেন রিয়াজুর রশীদ সাহেব। তারপর তিনি সেই অক্ষরটা আবারও ড্রামে ভরে ফেললেন।

গুড্ডুবুড়া বলল, ‘চ উঠেছে, না খ উঠেছে, এটা কেবল জানেন রিয়াজুর রশীদ সাহেব। যা-ই উঠুক না কেন, তিনি চ বলবেন, এটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত।

কারণ, চ সিরিজের কোনো টিকিট ছাপা হয়নি।

ব্যাপারটা ক্লিয়ারলি বলতে পারবেন এই লটারি যে প্রেসে ছাপা হয়েছে, সেই এভারেস্ট প্রিন্টিং প্রেসের ম্যানেজার যাদববাবু।’

‘যাদববাবু।’

একজন প্রবীণ লোক উঠলেন। মাথায় টাক। পরনে পায়জামা, গায়ে পাঞ্জাবি। তিনি বললেন, ‘কথা সত্য। আমরা টিকিট ছেপেছি। কিন্তু চ সিরিজ ছাপা হয়নি। এই যে ওয়ার্ক অর্ডার, বিল, মানি রিসিট, চালান।’

গুড্ডুবুড়া বলল, ‘আসলে অনেকগুলো নম্বর ছাড়া টিকিট রিয়াজুর রশীদ নিজের কাছে রাখেন। তারপর প্রথম পুরস্কারের নম্বরটি তিনি একটা টিকিটে বসিয়ে নিয়ে নিজে সেই টাকা আত্মসাৎ করবেন বলে স্থির করে রাখেন।

এই সময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো খান সাহেব চ সিরিজের প্রথম পুরস্কারের টিকিট এনে হাজির করেন।

এটা তিনি করলেন কী করে? কারণ, তার নিজের ছাপাখানা আছে। নিজের প্রেসে তিনি টিকিট ছাপেন। হলোগ্রাফিক স্টিকারটা তিনি করিয়ে আনেন চীন থেকে। লটারির টিকিট বিক্রি হওয়ামাত্রই তিনি হলোগ্রাফিক স্টিকারের অর্ডার দেন।

তারপর টিকিট নকল করে হলোগ্রাফিক স্টিকার লাগিয়ে বিজয়ী নম্বরটি বসিয়ে তিনি উদ্বাস্তু সেবা সংঘের অফিসে জমা দেন।

রিয়াজুর রশীদ তাকে বলে ফেলেন যে এই সিরিজের টিকিট আসলে ছাপাই হয়নি। কাজেই এটা নকল। খান সাহেব তখন নকলের কথা স্বীকার করেন। বলেন, ঠিক আছে, আপনারা আমাকে ৫০ লাখ টাকার চেক দেন। ৪০ লাখ টাকাই আমি ফেরত দিব। নকলের কথা আপনারা বলতে পারবেন না। আর আপনাদের জুয়াচুরির কথাও আমি বলব না। ৪০ লাখ টাকা ক্যাশ দেন তিনি। তবে টাকা হস্তান্তরের একটা ভিডিও তিনি করে রাখেন নিজের মোবাইল ফোনে গোপনে। সেটা এবার দেখুন পর্দায়।’

মনিটরে দেখা যায়, ৪০টা ১ হাজার টাকার বান্ডেল তুলে দেওয়া হচ্ছে রিয়াজুর রশীদ সাহেবের হাতে।

গুড্ডুবুড়া বললেন, ‘আসলে অনেকগুলো নম্বর ছাড়া টিকিট রিয়াজুর রশীদ নিজের কাছে রাখেন। তারপর প্রথম পুরস্কারের নম্বরটি তিনি একটা টিকিটে বসিয়ে নিয়ে নিজে সেই টাকা আত্মসাৎ করবেন বলে স্থির করে রাখেন।’

‘রিয়াজুর রশীদ সাহেব প্রমাদ গোনেন। এখন যদি পুরো ব্যাপারটা খান সাহেব ফাঁস করে দেন, তাহলে তার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। তিনি পেশাদার খুনি ঠিক করেন।

পুলিশ মোবাইল ফোনের চোরাই মার্কেটে খোঁজ নেয় এই মোবাইল কোন পার্টি এনেছিল বিক্রির জন্য। সেখান থেকে ধরে ফেলা হয়েছে পেশাদার খুনি কালা শমসেরকে।

শমসেরকে হাজির করুন।’

শমসের লোকটা মোটেও কালো নন। তার রং রীতিমতো ফরসা। নিজেকে আড়ালে রাখার জন্য তিনি নিজের নামের আগে কালা শব্দটা লাগিয়েছেন।

কালা শমসের আসার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক রিয়াজুর রশীদ অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন।

‘এখন পুরা ছবিটা স্পষ্ট।’ গুড্ডুবুড়া বলে চলেছে, ‘খুনটা করিয়েছেন রিয়াজুর রশীদ। করেছে কালা শমসের। তবে আমাদের খান আঙ্কেল লটারির টিকিট নকল করেছিলেন। আন্টি তা জানতে পেরে ভাত খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সেটা জানিয়েছে তার ড্রাইভার।

গাড়িতে বসে আমরা বহু গল্প করি। ড্রাইভাররা সব জানে।

খান আঙ্কেলের ড্রাইভারও আমাদের কাছে এবং পুলিশের তদন্তকারীদের কাছে বহু তথ্য দিয়েছেন।

একই কাজ করেছেন সভাপতি সাহেবের ড্রাইভার আর সাধারণ সম্পাদক সাহেবের ড্রাইভার। তারা দুজনই বলছেন, সভাপতি সাহেব ভালো মানুষ। তিনি এসবের সাতেও নাই, পাঁচেও নাই।’

রিয়াজুর রশীদ বলেন, ‘কিন্তু ৪০ লাখ টাকার ২০ লাখ তো আমি সভাপতি সাহেবকে দিয়েছি। সেটার প্রমাণও আমি রেখে দিয়েছি আমার মোবাইল ফোনে।’

গুড্ডুবুড়া বলল, ‘এইটা আমার তদন্তের মধ্যে আমি ধরতে পারি নাই। খুনের সঙ্গে সভাপতি সাহেব জড়িত কি না, এটা পুলিশ আঙ্কেলদের দেখতে হবে। তবে রিয়াজুর সাহেব যে জড়িত, তার সাক্ষী কালা শমসেরই দেবেন।

পুলিশের কাছে রিভলবারটা আছে। তাতে শমসেরের আঙুলের ছাপ আছে। আর রিভলবারের ছয়টা বুলেটের চারটা আছে। দুটো খান সাহেবের বডি থেকে ময়নাতদন্তের সময় বের করা হয়।’

ছোট খালা বললেন, ‘গুড্ডুরে। চল, বাড়ি যাই। আমার তো ভয় লাগছে।’

কালা শমসের বলল, ‘আপা, ভয় পাইবেন না। এই আঙ্কেলের ব্রেন দেইখা আমি টাস্কি খাইতাছি। আমি খুন করছি, এইটা সত্য। কিন্তু ক্যান খুন করছি, সেইটা এই আঙ্কেল না কইলে তো জানবারই পারতাম না। এনার কোনো ক্ষতি হইতে আমরা দিমু না।’

ডিআইজি আফজাল আঙ্কেল বললেন, ‘আমার ছেলে মারুফ একটা ভালো কাজ করেছে। গুড্ডুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে। তা না হলে আমরা এ ধরনের একটা কঠিন কেসের সমাধান এত অল্প সময়ে করতে পারতাম না।’

গুড্ডু বলল, ‘না, না, এটা তো খুব সোজা কেস। এটার সমাধান করতে যে কেউ পারে। তবে কথা হলো, ঠিকমতো খেতে হবে। ঠিকমতো ব্যায়াম করতে হবে। ঠিকমতো পড়াশোনা করতে হবে।’

আফজাল আঙ্কেল বললেন, ‘আমার মারুফ তো শুধু খায়। দৌড়ঝাঁপ করে না।’

‘তাহলে তো চলবে না আঙ্কেল। খেলাধুলা করতে হবে।’

‘বাবা, তুমি একটু ওকে বোঝাও তো।’

‘আচ্ছা, আঙ্কেল, কাল থেকে আমি আর মারুফ একসাথে সকালে দৌড়াতে বের হব।’

১২

মারুফ আর গুড্ডু দৌড়াচ্ছে।

মারুফ পারছে না। হাঁপিয়ে উঠছে।

এই সময় পেছন থেকে একটা কুকুর তাদের তাড়া করল। গুড্ডু একটা দেয়াল টপকে মাঠের মধ্যে ঢুকে গেল। মারুফ কিছুতেই দেয়াল টপকাতে পারছে না। কুকুরটা তার দিকে এগিয়ে আসছে। গুড্ডু আবার দেয়াল থেকে লাফিয়ে নেমে কুকুরের পাশ দিয়ে দৌড় ধরল। কুকুরটা মারুফকে বাদ দিয়ে গুড্ডুর পেছনে দৌড় আরম্ভ করতেই গুড্ডু রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্রাকের পেছনে উঠে পড়ল। সেখানে নির্মাণশ্রমিকেরা পাউরুটি খাচ্ছিলেন।

এক টুকরা রুটি গুড্ডু কুকুরের দিকে ছুড়ে মারল। কুকুর শান্ত হলো। মারুফ উল্টো দিকে রওনা হয়েছে। এভাবে কয়েক মাস দৌড়ালে যদি মারুফের ওজনটা কমে আসে।