গোয়েন্দা কিশোর মুসা রবিন | কালো শক্তি

বিকট গর্জন তুলে পশ্চিমে এগিয়ে চলেছে জাম্বো জেট। আটলান্টিকের ওপরে ভেসে চলা সাদা মেঘের স্তরের অনেক ওপর দিয়ে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে স্কটল্যান্ডের উপকূল দেখতে পাচ্ছে তিন কিশোর গোয়েন্দা—কিশোর, মুসা ও রবিন।

‘নামার সময় হয়েছে আমাদের,’ দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে বলল গোয়েন্দাপ্রধান কিশোর পাশা। ‘তারপর আমাদের জানতে হবে কিসের সমাধান করতে হবে। রকি বিচে আমাদের সঙ্গে যখন ফোনে কথা বললেন লর্ড ব্যানকবার্ন, তার কণ্ঠস্বরটাও রহস্যময় মনে হয়েছে আমার কাছে। ঘটনাটা যা-ই হোক, ফোনে বলতে ভয় পাচ্ছিলেন, বোঝা গেছে। নিশ্চয়ই অদ্ভুত কিছু ঘটছে ওখানে।’

লর্ড ব্যানকবার্ন কিশোরের চাচা রাশেদ পাশার একজন পুরোনো বন্ধু। রাশেদ পাশাকে ফোন করেছিলেন তিনি, স্কটল্যান্ডের ব্যানকবার্ন ক্যাসলে গিয়ে তদন্ত করে একটা রহস্যের সমাধান করে দেওয়ার জন্য। কারণ তিনি জানেন, স্যালভিজ ইয়ার্ডে পুরোনো মালের ব্যবসা শুরু করার আগে দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা ছিলেন রাশেদ পাশা। সেই নেশাটা এখনো কাটেনি তাঁর, সুযোগ পেলে কিংবা ইয়ার্ডের কাজে বিরক্ত হয়ে গেলে মাঝেমধ্যে এখনো রহস্য সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

কিন্তু এবার তিনি ইয়ার্ডের জরুরি কাজে এতই ব্যস্ত, স্কটল্যান্ডে যাওয়ার সময় দিতে পারলেন না। লর্ডকে জানালেন, তাঁর ভাতিজা আর তাঁর দুই বন্ধুর রহস্য সমাধানের ভীষণ শখ। ওদের দিয়ে চেষ্টা করা যেতে পারে। লর্ড রাজি হলে, কিশোরকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ওরা এর সমাধান করে দিতে পারবে কি না। স্কুল ছুটি। খুশিমনেই রাজি হয়ে গেল কিশোর। মুসা আর রবিনেরও আপত্তি থাকার কোনো কারণ নেই। বরং অন্যের খরচে স্কটল্যান্ড ঘুরে আসা যাবে।

‘খুব সাবধানে থাকবি,’ সতর্ক করে দিলেন কিশোরের চাচা। ‘লর্ড ব্যানকবার্ন খুব সাহসী লোক। সহজে ভয় পান না। তিনি যখন উদ্বিগ্ন হয়েছেন, তার মানে দুর্গের ভেতর খুব বিপজ্জনক কিছু ঘটছে। পরের প্লেনেই স্কটল্যান্ড রওনা হয়ে যা। সাবধানে থাকিস।’

পরদিন সকালেই ট্যাক্সি নিয়ে রকি বিচ এয়ারপোর্টে চলে এল তিন গোয়েন্দা। সেখান থেকে লোকাল প্লেনে লস অ্যাঞ্জেলেস এসে স্কটল্যান্ডগামী জেট ধরেছে, প্রথমে নিউইয়র্ক ল্যান্ড করবে, সেখান থেকে আটলান্টিক পাড়ি দেবে।

প্লেনটাকে চক্কর দিতে দেখল ওরা। গ্লাসগোর কাছে প্রেস্টউইক এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করল প্লেন। কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের পর বেরিয়ে এসে ট্যাক্সি নিল। ড্রাইভারকে ব্যানকবার্ন দুর্গে যেতে বলল।

দুর্গের কথা শুনেই চমকে উঠল ড্রাইভার। তবে যেতে আপত্তি করল না।

দুই

শহর থেকে বেরিয়ে গ্রাম্য এলাকায় ঢোকার পর মুখ খুলল ড্রাইভার, ‘আমি তোমাদের দুর্গের ভেতর নিয়ে যেতে পারব না। গেটের কাছে নামিয়ে দেব। বাকি পথটা হেঁটে যেতে হবে তোমাদের।’

‘দুর্গের ভেতর যাবেন না কেন?’ জানতে চাইল কিশোর। ‘কোনো সমস্যা আছে ওখানে?’

‘হ্যাঁ, আছে তো বটেই।’

কৌতূহল বাড়ল মুসার। জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যাপারটা কী, আমাদের বলতে অসুবিধে আছে?’

‘কালো শক্তি,’ বিড়বিড় করল ড্রাইভার, খসখসে শোনাল তার কণ্ঠ। ‘ব্যানকবার্নদের বাড়ির ওপর ডাইনির অভিশাপ আছে।’

এমনভাবে ‘অভিশাপ’ শব্দটা বলল সে, চমকে গেল মুসা। ভয় দেখা গেল তার চোখে। কিশোরের দিকে তাকাল। নীরবে যেন বলতে চাইছে—ফিরে চলো কিশোর, দরকার নেই ডাইনির সঙ্গে টক্কর দেওয়ার।

মুসার মনের ভাব বুঝে জবাব দিল কিশোর। ‘এত দূর এসে না দেখে ফিরে যাওয়াটা বোকামি হবে।’

রবিনও কিশোরের সঙ্গে একমত।

হাইওয়ে থেকে একটা কাঁচা রাস্তায় নেমে এল ড্রাইভার। দুই ধারে চষা খেত। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে রাস্তাটা।

মুসার ভয় পাওয়া দেখে বোধহয় সমঝদার লোক ভাবল ড্রাইভার। উত্সাহ পেয়ে বলল, ‘আসল কথাটা আমি জানি না, তবে যতখানি জানি বলি তোমাদের। ডাইনির অভিশাপের গুজব চলে আসছে প্রায় তিন শ বছর আগে সেই দুষ্ট লর্ডের আমল থেকে। দুর্গের প্রথম মালিক ছিল লর্ড জন ব্যানকবার্ন। লোকে তাকে উইকেড লর্ড বলে ডাকত। ডাইনির সেই অভিশাপ নাকি এখনো বহাল আছে। শুনেছি, ডাইনিরা এত ভয়ংকর ক্ষমতাধর, ভূতেও ভয় পায় ওদের, আর আমি তো মানুষ। সে কারণেই আমি দুর্গের সীমানার ভেতর ঢুকব না।’

এর বেশি আর কিছু জানাতে পারল না সে। গ্রামের ভেতর দিয়ে চলতে লাগল। অবশেষে একটা মোটা শিক লাগানো গেটের কাছে থামল গাড়ি। পাল্লার দুই পাশে দুটো পাথরের স্তম্ভ। একটা স্তম্ভের গায়ে বসানো শ্বেতপাথরের ফলকে খোদাই করে লেখা: ব্যানকবার্ন দুর্গ।

‘এখানেই তোমাদের নামতে হবে, সরি,’ ড্রাইভার বলল। গাড়ির পেছন থেকে ছেলেদের স্যুটকেসগুলো বের করে এনে রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর রাখল।

পকেট থেকে ভাড়ার টাকা বের করে দিল কিশোর।

হাত বাড়িয়ে নিল ড্রাইভার। গাড়িতে বসে, ওদের উদ্দেশে দ্রুত একবার হাত নেড়ে বিদায় হয়ে গেল।

গেটের পাল্লায় ঠেলা দিল রবিন। খুলল না গেট।

স্তম্ভের গায়ে কলবেলের সুইচ দেখে সেটা টিপল। কয়েক সেকেন্ড পরই একটা যান্ত্রিক শব্দ হলো। খুলে যেতে শুরু করল পাল্লা। বোঝা গেল, বাড়ির ভেতর থেকে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে গেট খোলা হয়।

যার যার স্যুটকেস হাতে নিয়ে ভেতরে ঢুকল তিনজনে। ভারী স্যুটকেসের বোঝা নিয়ে পা টেনে টেনে এগিয়ে চলল ঘন বনানীর মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া কয়েক শ গজ লম্বা পথটা ধরে। ব্যানকবার্ন দুর্গের সামনে ড্রাইভওয়েতে এসে মিলিত হয়েছে পথটা।

মস্ত, চওড়া ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে সামনের উঁচু বাড়িটার দিকে মুখ তুলে তাকাল ওরা। পাথরের বড় বড় ব্লক সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে বাড়িটা। প্রচুর রোদ-বাতাসের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে, তার ছাপ পড়েছে বহু পুরোনো পাথরের গায়েও। বাড়িটার ওপরে এক কোণে গোল একটা মজবুত ঘর তৈরি করা হয়েছে, পুরোনো আমলে এই ঘরের ভেতর কামান বসানো থাকত শত্রুর ওপর গোলাবর্ষণের জন্য। এ ধরনের ঘরকে সাধারণত টারিট বলে। উঁচু এই ঘরটার ওপরে খুঁটিতে উড়ছে একটা পতাকা। কুচকুচে কালো কাপড়ে সেলাই করে লাগানো হয়েছে সাদা কাপড়ে তৈরি মড়ার খুলি আর মানুষের হাতের হাড়। হাড় দুটো আড়াআড়ি রেখে ক্রস বানিয়ে খুলিটা লাগানো হয়েছে ক্রসের ওপরে ঠিক মাঝখানে।

‘আরে, এ তো জলদস্যুদের পতাকা, জলি রোজার!’ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ‘কয়েক শ বছর আগে জলদস্যুদের আমলে স্পেনে কোনো জাহাজের মাস্তুলে এই পতাকা দেখলেই পালাত লোকে।’

‘খাইছে!’ মুসা বলল। ‘কিন্তু জলদস্যুদের পতাকা জোলি রোজার ব্যানকবার্ন দুর্গের ওপরে উড়ছে কেন?’ অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকাল সে।

বিড়বিড় করল কিশোর, ‘আমিও সেটাই ভাবছি!’

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

তিন

ওরা কথা বলছে, এই সময় সদর দরজা খুলে দিল এক মহিলা। বেরিয়ে এল পাথরে তৈরি চওড়া সিঁড়ির ওপরের ধাপে। মহিলা অনেক লম্বা, ছিপছিপে গড়নের, চোখা চেহারা আর কঠিন মুখভঙ্গি।

‘আমি মিসেস বেন, এখানকার হাউসকিপার,’ জানাল মহিলা। ‘তোমরা নিশ্চয় তিন গোয়েন্দা কিশোর, মুসা, রবিন। লর্ড ব্যানকবার্ন তোমাদের আসার অপেক্ষায় আছেন। এসো।’

মহিলাকে অনুসরণ করে বড় একটা এনট্রান্স হলে ঢুকল কিশোর গোয়েন্দারা। একজন চাকর এসে ওদের স্যুটকেসগুলো ওপরতলায় নিয়ে গেল। সেও মুখটাকে গোমড়া করে রেখেছে, মেঘে ভরা আকাশের মতো থমথমে, যেন কী এক অজানা আশঙ্কায় অস্থির।

‘এদিক দিয়ে,’ কর্কশ কণ্ঠে বলল মহিলা। ‘লর্ড ব্যানকবার্নের স্টাডি দেখিয়ে দিই।’

মহিলাকে অনুসরণ করে লম্বা একটা হলঘর ধরে এগিয়ে চলল ওরা, যার একদিকের দেয়ালে সারি দিয়ে ঝোলানো ব্যানকবার্নদের পূর্বপুরুষদের ছবি। হাতে আঁকা। ছবির মুখগুলো যেন বিরক্ত হয়ে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। পাশ দিয়ে যেতে যেতে কিশোর লক্ষ করল সারির একটা জায়গা শূন্য। ওয়ালপেপারের গায়ে লম্বা একটা চারকোনা পুরোনো দাগ বুঝিয়ে দিচ্ছে একটা ছবি ছিল এখানে।

হারানো ছবিটার ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে মিসেস বেনকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, ‘ছবিটা সরানো হয়েছে কেন?’

‘তা জানি না, হয়তো লোকে দেখে ভয় পায় বলে,’ ভ্রুকুটি করল মহিলা। ‘শেষবার এই প্রশ্নটা যে করেছিল, সে এমনই ভয় পেয়েছিল, সেই যে গেছে, কোনো দিন আর ফেরেনি।’

তার কথায় কেঁপে উঠল মুসা। কিশোর গম্ভীর। আর রবিনের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

মৃদুস্বরে বিড়বিড় করল কিশোর, ‘এটা কোন ধরনের রহস্য?’

হাউসকিপারকে অনুসরণ করে একটা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল তিন গোয়েন্দা। দুই পাশের দেয়ালে ধাতব বর্ম ঝোলানো। সিঁড়ির মাথায় দরজার শোভাবর্ধনের জন্য দুটো তলোয়ার আড়াআড়ি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মিসেস বেন দরজায় টোকা দিতে বেরিয়ে এলেন লর্ড ব্যানকবার্ন। ছোটখাটো দেহের একজন বৃদ্ধ। পরনে পশমি কাপড়ের তৈরি ঢোলা আলখেল্লার মতো স্কটল্যান্ডীয় পোশাক। মাথায়ও পশমের তৈরি গোল টুপি। লর্ডের সঙ্গে ছেলেদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে গেল হাউসকিপার।

তিন গোয়েন্দার সঙ্গে হাত মেলালেন দুর্গের মালিক। স্টাডিতে নিয়ে গিয়ে সোফা দেখিয়ে দিলেন বসার জন্য। কালো রং করা একটা ছোট জানালা দিয়ে চুইয়ে ঢোকা রোদের আলোয় আবছাভাবে আলোকিত হয়ে আছে ঘরটা। মেঝেতে পাতা কার্পেট এতই ভারী, হাঁটার সময় জুতোর শব্দ হয় না।

মস্ত একটা ডেস্কের অন্য পাশে গিয়ে বসলেন লর্ড ব্যানকবার্ন। এক পাশে একটা নেকড়ের মূর্তি ক্রুদ্ধ গর্জনের ভঙ্গিতে হাঁ করে আছে। আরেক পাশে একটা রূপকথার প্রাণী নৌমের মূর্তি নির্বোধ হাসি হাসছে, চেহারাটা মানুষের মতো, তবে বেঁটে। ডেস্কের মাঝখানটা একেবারে ফাঁকা।

‘তোমাদের দেখে খুশি হলাম,’ শুরু করলেন লর্ড। ‘তোমাদের সাহায্য আমার ভীষণভাবে দরকার।’

‘আপনাকে সাহায্য করতেই এসেছি আমরা,’ রবিন বলল।

তার সঙ্গে যোগ করল মুসা, ‘বলুন আমাদের, কী করতে হবে।’

‘সেটা বলার আগে কিছু কথা তোমাদের জানা দরকার, না জানলে বুঝতে পারবে না কিসের বিরুদ্ধে লাগতে যাচ্ছ তোমরা,’ লর্ড বললেন। ‘ঢোকার আগে দুর্গের চূড়ায় একটা পতাকা উড়তে দেখেছ হয়তো।’

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

‘জলি রোজার!’ জবাব দিল কিশোর।

‘নিশ্চয়ই অবাক হয়েছ দুর্গের মাথায় জলদস্যুদের পতাকা কেন?’ লর্ড বললেন। ‘এটা আমাদের পুরোনো প্রথা। ওটা এনেছিলেন আমার পূর্বপুরুষ, জন ব্যানকবার্ন। জলদস্যু ছিলেন। তিন শ বছর আগে স্প্যানিশ মেইনে যত খারাপ জলদস্যু ছিল, তার মধ্যে তিনি একজন।’

অবাক হয়ে লর্ডের দিকে তাকিয়ে রইল ছেলেরা। শ্রাগ করলেন তিনি। ‘কুখ্যাত জলদস্যু ক্যাপ্টেন কিডের সহকারী ছিলেন তিনি। শেষবার যখন সমুদ্রযাত্রা করে ক্যাপ্টেন কিড, তার সঙ্গে ছিলেন জন। রাজার সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে ক্যাপ্টেন, ফাঁসি হয়। তবে জনকে ধরতে পারেনি ওরা, তিনি প্রচুর ধনরত্ন নিয়ে পালিয়ে আসেন নিজের দেশ স্কটল্যান্ডে। এখানে বাড়ি বানান। রাজার লোকজনকে ঘুষ দিয়ে লর্ড উপাধিও জোগাড় করেন।’

হাসল মুসা। ‘বাহ্, দারুণ গল্প। ছিলেন জলদস্যু, হয়ে গেলেন লর্ড।’

‘হ্যাঁ। আর জন ছিলেন ভয়ানক নিষ্ঠুর। এখানে ওর নামই হয়ে গিয়েছিল উইকেড লর্ড। কোনো কিছুই ওকে ঠেকাতে পারত না। কোনো কিছু চাইলে সেটা তিনি নিয়েই ছাড়তেন।’

কিশোর বলল, ‘হলঘরের দেয়াল থেকে ছবিটা কি আপনিই সরিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ’, বিষণ্ন ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন লর্ড। ‘তবে ওর কুখ্যাতির জন্য ছবিটা নামাইনি, নামিয়েছি তার কুিসত চেহারার জন্য। দেখতে চাও?’

একটা বোতাম টিপলেন লর্ড। ডেস্কের ঠিক মাঝখানে লাফিয়ে উঠল কবজা লাগানো একটা প্যানেল। একটা গোপন কুঠুরি বেরিয়ে পড়ল। সেখান থেকে একটা আয়তাকার ক্যানভাস বের করলেন তিনি। সামনের দিকটা ছেলেদের দিকে ঘোরালেন। ধরে রাখলেন দেখার জন্য।

চার

চমকে গেল তিন গোয়েন্দা। ভয়ংকর একটা মুখ জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। প্রথম লর্ড জন ব্যানকবার্ন। পেছনে টেনে আঁচড়ানো বেণি করা চুল খুলির সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। ভোঁতা নাক, কদর্য হাসি, আর বেঁকে যাওয়া হলদে দাঁত, সেই সঙ্গে কালো কাপড়ে ঢাকা একটা নষ্ট চোখ বীভৎস করে তুলেছে চেহারাটাকে। ভালো চোখটায় ভয়ংকর নিষ্ঠুর চাহনি। একটা হাত উঁচু করা, সে হাতে একটা ভোজালি এমনভাবে ধরে রেখেছে যেন যে তার ছবির দিকে যে তাকাবে তাকেই কোপ মারবে।

গায়ে কাঁটা দিল ছেলেদের।

‘তোমাদের মুখ দেখেই বুঝতে পারছি দুষ্ট লর্ডকে তোমাদের পছন্দ হয়নি,’ হাসলেন ব্যানকবার্ন। ‘যারাই দুর্গ দেখতে আসে, হলঘরে জন ব্যানকবার্নের ছবি দেখে ভয় পায়। তাই ওটা খুলে এনে লুকিয়ে রেখেছি, যাতে কারও চোখে না পড়ে। আরও একটা কারণে এখানে এনে রেখেছি, ভয় পেয়ে কেউ এটা নষ্ট করে ফেলার কথা ভাবতে পারে। আমি আমার পূর্বপুরুষদের কোনো ছবিই নষ্ট হতে দিতে চাই না।’

ভয়ংকর ছবিটা আবার গোপন কুঠুরিতে রেখে দিলেন লর্ড। সুইচ টিপে ডেস্কের প্যানেল নামিয়ে দিলেন। সামনে ঝুঁকে দুই কনুই টেবিলে রাখলেন। হাতের আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢোকালেন। গম্ভীর ভঙ্গিতে তাকালেন ছেলেদের দিকে।

‘দুষ্ট লর্ডের ছবি দেখলে’, ভারী কণ্ঠে বললেন তিনি। ‘যদি চাও, তার সঙ্গেও দেখা হবে তোমাদের।’

‘মানে?’ চমকে উঠল মুসা।

মুসার কথায় যোগ করল রবিন, ‘তিন শ বছর আগেই তো তিনি মারা গেছেন।’

‘তিনি ফিরে এসেছেন’, রহস্যময় কণ্ঠে জবাব দিলেন ব্যানকবার্ন। ‘এই দুর্গেই বাস করে তাঁর প্রেতাত্মা। রাতেরবেলা ঘুরে বেড়ায়।’

পিঠ সোজা করল কিশোর। ‘তার মানে, ভূত?’

‘ঠিক তা-ই। জন ব্যানকবার্নের ভূত। ছবিটাতে যেমন দেখেছ, অবিকল সেই রূপে আসেন তিনি।’

‘আপনি ওকে নিজের চোখে দেখেছেন?’ অবিশ্বাসী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

‘হ্যাঁ। দুই সপ্তাহ আগে এ বাড়ির একমাত্র ওয়ারিশ হিসেবে দুর্গটা আমি বিক্রি করার পরিকল্পনা করি গ্লাসগোর একটা রিয়্যাল এস্টেট কোম্পানির কাছে। সেই রাতেই আমি একটা অদ্ভুত শব্দ শুনি। সেলারে কে যেন গান গাইছে, জলদস্যুদের সারিগান। দেখতে নিচে নেমে গেলাম—মাটির নিচের ঘরে। দেখে আঁতকে উঠলাম। সেলারে দাঁড়িয়ে আছেন জন ব্যানকবার্ন। আমাকে দেখেই উধাও হয়ে গেলেন।’

‘ভয় পাননি?’ মুসা জিজ্ঞেস করল।

‘পাইনি মানে? আরেকটু হলেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত। তারপর, কয়েক রাত আগে বিছানায় শুয়ে আছি, এ সময় সেলারে শিকলের ঝনঝনানি শুনলাম। সিঁড়ি বেয়ে শব্দটা উঠে আসতে লাগল আমার বেডরুমের দিকে। এক মুহূর্ত পরই উইকেড লর্ডকে দেখলাম আমার ঘরের ভেতর, হাতে সেই শিকল, যে শিকল দিয়ে তিনি জাহাজে তাঁর ধনরত্নের বাক্স বেঁধে রাখতেন। শিকলটা অবশ্যই ভুতুড়ে শিকল। আসলটা রয়েছে সেলারে।’

‘তারপর?’ প্রচণ্ড কৌতূহলে জানতে চাইল রবিন।

‘একটা সেকেন্ড আমার চোখে চোখে তাকিয়ে রইল ভূতটা, তারপর মিলিয়ে গেল’, জবাব দিলেন লর্ড ব্যানকবার্ন। ‘পরের দিন একটা কাজে গ্লাসগো গেলাম। রাতের বেলা ফিরে দেখি টারিটের ওপর জলদস্যুদের পতাকাটার নিচে দাঁড়িয়ে আছেন উইকেড লর্ড। জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। দৌড়ে গিয়ে টারিটে উঠলাম, তবে তিনি তখন চলে গেছেন।’

ভেঙে পড়া মানুষের মতো মাথা নাড়তে লাগলেন লর্ড। যেন ভয়ানক স্মৃতিটা ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন মগজ থেকে।

‘লর্ড ব্যানকবার্ন, দুর্গের আর কেউ কি এই ভূতটাকে দেখেছে?’ কিশোর জিজ্ঞেস করল।

মাথা ঝাঁকালেন বৃদ্ধ। ‘মিসেস বেন দেখেছে। আমার বাটলার ডগলাস দেখেছে। ওরা দুজনেই সারিগান আর শিকলের শব্দও শুনেছে। এতই ভয় পেয়েছে আমার সব কর্মচারী, কেউ আর এখন সেলারের কাছে যেতে চায় না।’

‘কারও কাছ থেকে সাহায্য চাননি?’ জিজ্ঞেস করল রবিন।

‘চেয়েছি। গ্লাসগো থেকে একজন ডিটেকটিভ আনিয়েছিলাম। ভূতপ্রেতে বিশ্বাস ছিল না তার। তাকে উইকেড লর্ডের ছবিটা দেখিয়ে সব জানালাম। রাতে সেলারের কাছে পাহারায় রইল সে। তারপর ভূতটাকে দেখে এমন ভয় পাওয়া পেল, আর একটা মুহূর্তও দুর্গে থাকতে রাজি হলো না।’

‘তার মানে এই লোকটার কথাই মিসেস বেন আমাদের বলেছে’, কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল রবিন। ‘ছবিটা কোথায় জিজ্ঞেস করেছিল, ভয় পেয়ে দুর্গ থেকে পালিয়েছিল।’

‘ধরা যাক আমরাও ভূতটাকে দেখতে পেলাম’, লর্ডকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, ‘তখন কী করব?’

‘অকাল্টের ওপর লেখা কিছু বই আমার লাইব্রেরিতে আছে, সেগুলো ভালোমতো ঘেঁটে দেখেছি,’ জবাব দিলেন ব্যানকবার্ন। ‘একটা বইতে লিখেছে, ভিন্ন দেশ থেকে আসা অপরিচিত লোকের সঙ্গে নাকি কথা বলে ভূতেরা। তোমরাও বিদেশি। হয়তো তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারে ভূতটা। তোমরা নিশ্চয়ই ভয় পাবে না। তোমাদের ওপর ভরসা করছি, কারণ, রাশেদ পাশা তোমাদের পাঠিয়েছে।’

‘না, পাব না,’ নির্দ্বিধায় জবাব দিল কিশোর। ‘এখন বলুন, ভূতটা যদি দেখা দেয়, কী করব আমরা?’

‘ওটাকে দুর্গ থেকে বের করার ব্যবস্থা করতে হবে,’ লর্ড বললেন। ‘যা-ই হোক, দোতলায় তোমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছি। তবে রাতে সেলারের কাছে বসে পাহারা দিতে হবে। ভূত এলে যাতে তোমাদের চোখ না এড়ায়। ডিনারের পর ডগলাস তোমাদের সেখানে পৌঁছে দেবে।’

ডগলাসকে ডেকে পাঠালেন তিনি। ছেলেদের ঘর দেখিয়ে দিতে বললেন।

বিশালদেহী মানুষ ডগলাস, বিষণ্নতায় ভরা মুখ। চওড়া সিঁড়ি বেয়ে ছেলেদের নিয়ে দুর্গের দোতলায় উঠতে উঠতে ভূতের গল্প শোনাল।

‘গত সপ্তায় এক রাতে সেলারের পাশ দিয়ে স্টোররুমে যাওয়ার সময় উইকেড লর্ডকে দেখেছি আমি,’ বলল সে। ‘একটা শব্দ শুনে, গ্রিলের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে দেখি সেলারে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আমাকে দেখেই উধাও হয়ে গেলেন।’

‘তখন আপনি কী করলেন?’ মুসা জিজ্ঞেস করল। ‘ভেতরে গিয়েছিলেন?’

‘পাগল!’ কেঁপে উঠল ডগলাস। ‘ভূতটাকে দেখে একদৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এলাম। এখন ভূতটাকে তোমরা তাড়াতে পারলেই বাঁচি।’

‘চেষ্টা করব,’ কিশোর বলল।

তিন গোয়েন্দাকে ওদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল ডগলাস।

পাঁচ

ঘরের চারপাশে তাকাল কিশোর। মস্তবড় ঘর। তিনটা বিছানা সহজেই জায়গা হয়ে গেছে। বিছানায় বসে রহস্যটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল ওরা।

‘দুটো রহস্য আছে এখানে,’ কিশোর বলল। ‘প্রথমটা, জন ব্যানকবার্নের ভূত। দ্বিতীয়টা, ডাইনির অভিশাপ, যার ভয়ে দুর্গের সীমানায়ই ঢুকল না ট্যাক্সি ড্রাইভার। আমার মনে হয় ভূতের সঙ্গে ডাইনির কোনো সম্পর্ক আছে।’

চিবুকের নিচে আস্তে আস্তে টোকা দিচ্ছে রবিন। ‘আমিও তা-ই ভাবছি। ভূতের কথা তো সব শুনলাম। ডাইনির ব্যাপারেও বিস্তারিত জানা দরকার।’

ডিনারের ঘণ্টা বাজল। নিচে নেমে এল তিনজনে। ওখানে আবার দেখা হলো লর্ড ব্যানকবার্ন আর মিসেস বেনের সঙ্গে। একসঙ্গে খেতে বসল সবাই। নিরানন্দ পরিবেশ। গম্ভীর হয়ে খাওয়ার তদারকি করল ডগলাস। রান্নাঘর থেকে খাবার দিয়ে যাচ্ছে রাঁধুনি, তার মুখেও হাসি নেই। সবাই উদ্বিগ্ন। ভীত।

খাওয়ার টেবিলেও ভূতটাকে নিয়েই কথা হলো বেশি।

‘সেলারে আমিও ওটাকে দেখেছি,’ মিসেস বেন বলল। ‘বাগান থেকে সবজি তুলে ওপথে আসছিলাম, এ সময় একটা ভুতুড়ে শব্দ কানে এল। মুখ তুলে দেখি ভূতটা। আমাকে দেখে মিলিয়ে গেল।’

ভূতের ব্যাপারে নতুন আর কোনো তথ্য জানাতে পারল না মহিলা।

কিশোরের মনে হলো ডগলাসের মতো ভূতের ভয়ে ভীত নয় মিসেস বেন। অবাক লাগল। এ বাড়িতে এই একজনকে দেখা গেল, যে ভূতকে ভয় করে না।

ডাইনির প্রসঙ্গ তুলল রবিন। ‘লর্ড ব্যানকবার্ন, শুনলাম, দুর্গের ওপর নাকি ডাইনির অভিশাপ আছে। যে ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে, সে বলেছে। আপনি কি কিছু জানেন?’

‘জানি। তবে আমার চেয়ে মিসেস বেনই ভালো বলতে পারবে,’ লর্ড জবাব দিলেন।

বিব্রত মনে হলো হাউসকিপারকে। ‘আমি ভালো বলতে পারব—লর্ডের এ কথা মনে হওয়ার কারণ—আমি এখানকার ভিলেজ হিস্টরিক্যাল সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত। রেকর্ড বলে, প্রায় তিন শ বছর আগে কিছু ডাইনি সভা করত দুর্গটা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সেখানে। কথিত আছে, প্রথম লর্ড, জন ব্যানকবার্ন জোর করে ডাইনিদের সরিয়ে দিয়ে ওদের জায়গায় দুর্গ তৈরি করেন, ওদের সমাবেশস্থল ভেঙে দেন। এতে ভীষণ রেগে গিয়ে ডাইনিদের নেত্রী লর্ডকে অভিশাপ দেন। আমি অবশ্য কুসংস্কারই মনে করি এটাকে।’

ডিনার শেষ হলো। নিজের স্টাডিতে ফিরে গেলেন লর্ড ব্যানকবার্ন, মিসেস বেন চলে গেলেন ওপরতলায়, আর তিন গোয়েন্দাকে সেলারে নিয়ে চলল ডগলাস। ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নিচের একটা বারান্দায় নামল ওরা। দেয়ালের গর্ত থেকে একটা মশাল খুলে নিল ডগলাস। শক্ত লাঠির মাথায় মোটা কাপড় পেঁচিয়ে সেটা আলকাতরায় ডোবানো হয়েছে। পকেট থেকে লাইটার বের করে মশালটা ধরাল ডগলাস।

বারান্দা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল সে, ‘পুরোনো আমলে জলদস্যুরা এ রকম মশাল ব্যবহার করত। প্রথম লর্ড জন ব্যানকবার্নের আমল থেকে এখানে এই প্রথা চলে আসছে, সেলারে নামার সময় মশাল ব্যবহার করতে হবে, সেই পুরোনো দিনের মতো।’

মশালটা এক হাতে উঁচু করে ধরেছে সে। কালো পাথরে তৈরি সরু বারান্দায় মশালের আলো নাচছে। সঙ্গে সঙ্গে চারজন মানুষের ছায়াও নাচছে অদ্ভুতভাবে। ভুতুড়ে করে তুলেছে পরিবেশ।

বারান্দার এক-তৃতীয়াংশ পথ পেরিয়ে লোহার গ্রিলের তৈরি বিশাল এক দরজার সামনে এসে দাঁড়াল বাটলার। ভেতরে দেখিয়ে বলল, ‘এটাই সেলার। এই বারান্দার শেষ মাথায় আরেকটা দরজা আছে। ওটা দিয়ে সবজি-বাগানে বেরোনো যায়।’

পকেট থেকে মস্ত একটা চাবি বের করে তালা খুলল সে। ঠেলা দিয়ে খুলল গ্রিলটা। তিন গোয়েন্দাকে সেলারের ভেতরে নিয়ে গেল। তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ভয় পাচ্ছে সে।

চারপাশে তাকিয়ে ভালো করে দেখতে লাগল কিশোর। পাথরের বড় বড় ফলক দিয়ে তৈরি দেয়াল। প্রথম লর্ড এটাকে বন্দিশালা বানিয়েছিল। এখন মদ আর কয়লা রাখার স্টোর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। একেবারে ছাদের কাছাকাছি একটা জানালা, ভারী শিক লাগানো। দেয়ালে বড় বড় লোহার পেরেক পুঁতে তাতে শিকল আটকে দেওয়া হয়েছে। শিকলের মাথা থেকে ঝুলছে হাতকড়া আর পা-বেড়ি। একটা পেরেকে আলগাভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে লম্বা একটা শিকল।

‘এটা দিয়ে নিশ্চয় জাহাজে তার বাক্স বেঁধে রাখত জলদস্যু জন,’ বিড়বিড় করল রবিন।

‘কিন্তু এখন ভূতটা কই?’ বলে ডগলাসের দিকে তাকাল কিশোর।

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে দুই হাত নাড়ল বাটলার। অস্বস্তিভরে জবাব দিল, ‘সব সময় তো আর থাকেন না। তাঁর যখন ইচ্ছে হয়, আসেন। আবার যখন ইচ্ছে চলে যান। তোমাদের অজান্তেই কখন চলে আসবেন টেরও পাবে না। যাকগে, চলো, বেরোই।’

সেলার দেখা শেষ করে ডগলাসের পেছন পেছন বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। দরজায় তালা লাগিয়ে দিল বাটলার। বারান্দার পাশে আরেকটা ঘরে নিয়ে এল ছেলেদের। গোটা তিনেক চারপায়া বাদে ঘরটা একেবারে খালি।

ডগলাস জানাল, লর্ডের নির্দেশে তিন গোয়েন্দার জন্য এগুলো এখানে এনে রাখা হয়েছে। তারপর বলল, ‘আজ রাতে এখানেই ঘুমাবে তোমরা—যদি ঘুমাতে পারো।’

সেলারের দরজার চাবিটা কিশোরের হাতে দিল সে। জ্বলন্ত মশালের অন্য মাথাটা চেপে ঢোকাল বাইরের দেয়ালে, দরজার এক পাশের একটা গর্তের মধ্যে। মশাল লাগানোর জন্যই গর্তটা তৈরি করা হয়েছে। মুসা আর রবিনের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করল যেন লাইটারটা কার হাতে দেবে। শেষে মুসার হাতেই দিল।

বাটলার চলে গেলে তিনটা চারপায়ায় বসল তিনজনে। অন্ধকার ঘর। বাইরে থেকে আসা মশালের আলোয় মোটেই আলোকিত হয়নি, বরং ভুূতুড়ে ছায়া ছড়াচ্ছে অনেক বেশি। দরজার বাইরের বারান্দায় মশালের ঘোলাটে আলো পড়েছে।

কিশোর বলল, ‘বসে থেকে কাজ নেই। শুয়ে পড়ি। ভূত এলে নিজেই শব্দ করে জানান দেবে।’

চারপায়ায় শুয়ে পড়ল তিনজনে।

ছয়

হঠাৎ বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ওদের। প্রথম চোখ মেলল কিশোর। এক ঝলক দমকা বাতাস ঝাপটা দিয়ে নিভিয়ে দিল মশালটা।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল তিনজনে।

‘নিশ্চয় বারান্দায় ঢুকেছে কেউ!’ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।

‘আর ওটাই আমাদের মশালটাকে নিভিয়েছে,’ বলল রবিন।

‘ভূত!’ মুসা বলল।

দৌড়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল তিনজনে। চারপাশে তাকাল। কিন্তু গভীর অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ল না ওদের। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে সেলারের ভেতরে উঁকি দিল কিশোর। দেখতে পেল না কিছু।

‘মুসা, মশালটা জ্বালো তো,’ কিশোর বলল।

লাইটার ধরিয়ে মশাল জ্বালল মুসা। দুজনকে সঙ্গে আসতে বলে বারান্দা ধরে এগিয়ে চলল কিশোর। বারান্দার শেষ মাথার দরজাটার কাছে এসে দাঁড়াল ওরা। তালা নেই। ঠেলা দিতেই খুলে গেল দরজা। বাগানে বেরোল তিনজনে। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। মাঝেমধ্যে মেঘের ফাঁকে চলে যাচ্ছে চাঁদটা।

বাগানে কিছু দেখা গেল না। আবার ফিরে এল ওরা। মশালটা আগের জায়গায় বসিয়ে দিল মুসা।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

‘বাতাসেই দরজাটা খুলেছে,’ রবিন বলল। ‘দরজা বাড়ি খাওয়ার শব্দই শুনেছি আমরা।’

‘মশালটাও বাতাসেই নিভেছে,’ রবিনের কথায় সায় দিল মুসা।

কিশোর কিছু বলল না। চিন্তিত ভঙ্গিতে কী যেন ভাবছে।

আবার বিছানায় বসল তিনজনে। কিশোর আর রবিন শুয়ে পড়ল। মুসা পাহারায় রইল।

হঠাৎ একটা ভুতুড়ে কণ্ঠ জলদস্যুদের গান গাইতে শুরু করল। গানের মধ্যে রয়েছে জলদস্যুদের অভিযান আর ধনরত্নের কথা।

সেলারের ভেতর থেকে আসছে কর্কশ কণ্ঠটা। লাফ দিয়ে নেমে বিছানা থেকে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কিশোর ও রবিন। টান দিয়ে দেয়ালের গর্ত থেকে মশালটা খুলে নিয়ে মুসাও ছুটল ওদের পেছন পেছন। দ্রুত হাতে সেলারের দরজার তালা খুলল কিশোর। হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল বন্দিশালায়।

সেলারে ঢুকে যেন হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল তিনজনে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল দেয়ালের দিকে। একটা পা-বেড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে ভূতটা। পরনে জলদস্যুর পোশাক। একটা চোখ কালো কাপড়ে ঢাকা। হাতে মস্ত এক ভোজালি। মুখটা অবিকল জন ব্যানকবার্নের মতো।

হঠাৎ করে গান থামিয়ে দিল ওটা। কদর্য হাসিতে মুখ ভরিয়ে চিত্কার করে উঠল, ‘তিন গোয়েন্দা, দুর্গ ছাড়ো!’

‘আমরা কে, আপনি জানলেন কী করে?’ সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেলল কিশোর।

‘এখানে কী ঘটে, কারা আসে, সব জানি আমি!’ ভূতটা জবাব দিল।

‘কিন্তু আপনি যে বললেন দুর্গ ছাড়ো—কেন যাব আমরা?’ রবিন বলল।

‘থেকেই বা কী করবে? আমার তো কিছু করতে পারবে না তোমরা। তার চেয়ে চলে যাওয়াই ভালো। নইলে আবার আমাদের দেখা হবে। সেটা তোমাদের জন্য ভালো হবে না।’

ধীরে ধীরে আবছা হতে শুরু করল ভূতটার অবয়ব। তারপর দেয়াল ভেদ করে চলে গেল। ছুটে গেল কিশোর। সামনে হাত বাড়াল। হাতে ঠেকল শুধু একটা হাতকড়া। নিজের অজান্তেই আঁকড়ে ধরল ওটাকে।

মশালের টিমটিমে কম্পিত আলোয় পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল তিনজনে।

‘কিশোর, ভূতটা সত্যিই আছে!’ রবিন বলল। ‘আর ওটা আমাদের হুমকি দিয়ে গেল!’

কেঁপে উঠল মুসা।

ভারী কণ্ঠে কিশোর বলল, ‘এর মানে কী বুঝতে পারছি না। তবে পরের বার অবশ্যই তৈরি থাকতে হবে আমাদের, যদি আবার আসে।’

তবে সে রাতে আর ফিরল না ভূতটা। সকালবেলা লর্ড ব্যানকবার্নকে সব কথা জানাল ওরা।

‘তাহলে ভূতটা তোমাদের সঙ্গে কথা বলেছে,’ খুশি হলেন ব্যানকবার্ন। একই সঙ্গে উদ্বিগ্নও হলেন। ‘কিন্তু তোমাদের তো চলে যেতে বলেছে। কী করবে এখন, আমেরিকায় ফিরে যাবে?’

মাথা নাড়ল কিশোর। ‘না। এই ভূত রহস্যের কিনারা না করে কিছুতেই যাব না।’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন লর্ড। ‘আবার যদি তাঁর সঙ্গে দেখা হয়, জিজ্ঞেস কোরো, কেন দুর্গটাকে ভুতুড়ে বানিয়ে রেখেছেন।’

বাড়ির কাজের লোকদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিল রবিন। ‘কাল রাতে কেউ হয়তো এমন কিছু শুনে থাকতে পারে, যা থেকে আমরা কোনো সূত্র পেতে পারি।’

‘কথা বলো, আমার কোনো আপত্তি নেই,’ লর্ড বললেন। ‘কিন্তু কাল রাতে এত বেশি ঝোড়ো বাতাস বইছিল, বাতাসের শব্দ ছাড়া অন্য কিছু কেউ শুনেছে কি না সন্দেহ। আমি অন্তত কিছু শুনিনি।’

যাই হোক, রাঁধুনিকে দিয়ে প্রশ্ন শুরু করল তিন গোয়েন্দা। তারপর একে একে মালি, পশু ও মুরগি দেখাশোনা করার লোক, সবশেষে চাকরানির সঙ্গে কথা বলল ওরা। এদের সবাই থাকে চিলেকোঠার ঘরে, আর বাতাসের শব্দ ছাড়া কেউ কিছু শোনেনি।

মিসেস বেনের সঙ্গে কথা বলতে গেলে অসহযোগিতা করল মহিলা। রুক্ষ্ম কণ্ঠে বলল, ‘হাতে পেয়েও ভূতটাকে ছেড়ে দিয়েছ তোমরা! তোমাদের বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত!’

‘আমরা যাব কি যাব না, সেটা আমাদের ব্যাপার,’ রেগে গেল মুসা। ‘আপনি বলার কে?’

মাথা নিচু করল মিসেস বেন। কণ্ঠস্বর নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘আসলে, তোমাদের ভালোর জন্যই বলছি। ভীষণ বিপদের মধ্যে রয়েছ তোমরা। মারাত্মক ঝুঁকি নিচ্ছ।’

‘আমরা গোয়েন্দা, এটাই আমাদের কাজ,’ কিশোর বলল। ‘তো, আপনার কী মনে হয়? দুর্গটাকে ভূতের উপদ্রব থেকে বাঁচানোর উপায় কী?’

‘উপায় আছে, দুর্গটা বিক্রি না করা!’ তারপর আর একটা কথাও না বলে গটমট করে চলে গেল।

সাত

মহিলার আচরণে অবাক হলো তিনজনেই। কিশোর বলল, ‘মিসেস বেনকে সন্দেহ হচ্ছে আমার। মনে হয় কিছু জানে সে। মহিলার ওপর নজর রাখতে হবে।’

রবিন বলল, ‘দুর্গটা খুঁজে দেখলে হয় না? কোনো সূত্রও পেতে পারি।’

কিশোরও একমত হলো। যদিও মুসার ভয়, কোথায় কোনখানে ভূতটা আবার বেরিয়ে আসে। তবে কিশোর আর রবিনের সঙ্গে সঙ্গে চলল। সূত্র খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে টাওয়ারের ওপরে উঠে এল ওরা। জলদস্যুর পতাকাটার নিচে দাঁড়িয়ে ঢালের গায়ে কালো বন দেখতে পেল। ওগুলোর ডালে বসা বড় বড় দাঁড়কাক। কাকের নীরস কা-কা ডাক প্রতিধ্বনিত হচ্ছে গাছের গায়ে।

‘কাক হলো অশুভ লক্ষণ,’ মুসা বলল।

দূরে ছোট একটা গ্রাম দেখা গেল।

হাত তুলে দেখিয়ে রবিন বলল, ‘ওই গাঁয়ে গিয়ে খোঁজ নিলে কেমন হয়?’

‘ঠিক বলেছ,’ কিশোর বলল। ‘স্থানীয় লোকেরা হয়তো কিছু জানাতে পারে।’

তাড়াহুড়ো করে নিচে নেমে এল তিন গোয়েন্দা। বাইরে বেরিয়ে বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলল গ্রামের দিকে। একটা ব্যবসাকেন্দ্রকে ঘিরে কতগুলো বাড়ি, এই হলো গ্রাম। রাস্তায় হেঁটে চলা মানুষদের থামিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল কিশোর। কিন্তু দুর্গটার প্রসঙ্গ এলেই কোনো জবাব না দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যায় সবাই।

‘ভালো চাইলে দুর্গ থেকে চলে যাও,’ একজন সাবধান করল। ‘আমরা জানি দুর্গে ভূত আছে, কিন্তু সেটা নিয়ে কোনো আলোচনা করতে চাই না। কেউ এর সঙ্গে জড়াতে রাজি নই আমরা।’

একমাত্র গাঁয়ের পোস্টমিস্ট্রেস ওদের প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হলেন। ‘উইকেড লর্ড বেঁচে থাকতে গাঁয়ের ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার হতো। সেটা কয়েক শ বছর আগে। এখন আর অত্যাচার হয় না, তবে লোকে ভয় পায়, ভূতের বিরোধিতা করলে ভূতটা হয়তো বেরিয়ে এসে গাঁয়ে ঢুকে সারা জীবনই ওদের জ্বালিয়ে মারবে।’

‘গাঁয়ে কি কখনো ভূতটাকে দেখা গেছে?’ জিজ্ঞেস করল রবিন।

মাথা নাড়লেন মহিলা, ‘এখনো যায়নি। তবে ভূতের ব্যাপারে কিছুই বলা যায় না, তাই না?’

ভূতের কথা বাদ দিয়ে ডাইনির অভিশাপের প্রসঙ্গ তুলল কিশোর।

‘এ ব্যাপারে একটা কথাই শুধু বলতে পারি তোমাদের,’ মহিলা বললেন।

‘কী?’

‘আজ রাতে পূর্ণিমা।’

‘তাতে কী?’

কিন্তু আর কিছু বলতে রাজি হলেন না মহিলা। তার বদলে ফিরে তাকালেন একজন কাস্টমারের দিকে। স্ট্যাম্প বিক্রিতে মন দিলেন।

অবাক হয়ে দুর্গে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা।

‘ডাইনির সঙ্গে পূর্ণিমার সম্পর্কটা কী?’ প্রশ্ন করল মুসা।

‘হয়তো আজ রাতে একটা সভা হবে, মুসা,’ ধীরে ধীরে বলল কিশোর। ‘শুনেছি, পূর্ণিমার রাতে সভা করে ডাইনিরা। এমনও হতে পারে, দুর্গের সীমানার ভেতরই সভা বসবে, শত শত বছর আগে দুর্গটা তৈরি হওয়ার আগে যেমন বসত।’

উত্তেজিত হয়ে পড়ল রবিন। ‘আমার তো মনে হয় দুর্গের কেউও ডাইনিদের সদস্য। মিসেস বেনকেই আমার বেশি সন্দেহ। আসার পর থেকেই দেখছি, অস্বাভাবিক আচরণ করছে সে।’

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ‘ভূতটা আজ রাতেও বেরোয় কি না দেখব, একই সঙ্গে নজর রাখব মিসেস বেনের ওপরও।’

আট

ডিনারের পর সেলারে পাহারা দিতে গেল তিন গোয়েন্দা। পাশের ঘরটায় গিয়ে চারপায়ায় বসল। ঠিক হলো, প্রথম রাতে পাহারায় থাকবে সে। রবিন আর মুসা ঘুমাবে।

ঘণ্টা খানেক পরই নিচে নামার ঘোরানো সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনল কিশোর। তাড়াতাড়ি লম্বা বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। চোখ বুজে থেকে ঘুমানোর ভান করল। বারান্দা ধরে এগিয়ে এল পায়ের শব্দ। সেলারের দরজার কাছে এসে থামল। ঘাড়ের লোম খাড়া হয়ে গেল কিশোরের, যখন মিসেস বেনকে ভূতটার উদ্দেশে কথা বলতে শুনল।

‘তুমি কোথায়, জন ব্যানকবার্ন?’ খসখসে কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল মহিলা। ‘আমি শিগগির ফিরে আসছি!’

এগিয়ে এল আবার পায়ের শব্দ। কিশোরদের ঘরের দরজার কাছে এসে থামল। চোখের পাতা সামান্য ফাঁক করল কিশোর। মিসেস বেনকে উঁকি দিতে দেখল।

ছেলেরা ঘুমিয়ে আছে, সন্তুষ্ট হয়ে ঘুরে দাঁড়াল মহিলা।

বারান্দা ধরে এগিয়ে চলল আবার।

আস্তে করে নিজের চারপায়া থেকে উঠে এসে কাঁধে ঠেলা দিয়ে রবিন আর মুসার ঘুম ভাঙাল কিশোর।

‘মিসেস বেন,’ ফিসফিস করে বলল সে। ‘পিছু নিয়ে দেখব কোথায় যায়।’

মুহূর্ত পরেই মহিলার পিছু নিল ওরা। বারান্দার শেষ মাথায় বাগানে বেরোনোর দরজাটার কাছে পৌঁছে গেছে ততক্ষণে মিসেস বেন। পা টিপে টিপে নিঃশব্দে দরজার কাছে চলে এল তিন গোয়েন্দা। বাগানে বেরোল। আকাশে পূর্ণ চাঁদ। পূর্ণিমার আলোয় ধুয়ে দিচ্ছে যেন গাছপালা, সবকিছু।

সোজা গিয়ে বনের ভেতর ঢুকল মিসেস বেন। পায়েচলা পথ ধরে এগিয়ে এক টুকরো খোলা জায়গায় পৌঁছাল। আরও অনেক মহিলা অপেক্ষা করছে ওখানে। একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থেকে ওদের ওপর চোখ রাখল তিন গোয়েন্দা। মিসেস বেনকে স্বাগত জানাল মহিলারা। বোঝা গেল সে-ও ওদের নেতা।

মিসেস বেনকে ঘিরে হাত ধরাধরি করে একটা চক্র তৈরি করল ওরা। ধীরে ধীরে নেচে নেচে গান গাইতে শুরু করল। নাচ, গান, সবই কেমন ভুতুড়ে। প্রথমে নিচু স্বরে শুরু হলো গান। ক্রমেই চড়তে লাগল শব্দ। নাচের গতি বাড়তে লাগল। মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে যেন মুখ তুলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল মিসেস বেন।

হঠাৎ করেই থেমে গেল নাচ-গান। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মহিলারা। ‘আমরা ডাইনি!’ সমস্বরে সুর করে, ছন্দ মিলিয়ে চিৎকার করে উঠল ওরা। ‘জাদু জানি আমরা! কালো শক্তি ডেকে আনি, আঘাত করি তাদের ওপর, যারা মোদের শত্রু!’

সারিগান শেষ করে চক্রাকারে বসা মহিলারা একসঙ্গে আঙুল তুলল মিসেস বেনের দিকে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে পাখির ডানার মতো দুই দিকে দুই হাত ছড়িয়ে দিল মিসেস বেন।

‘ব্যানকবার্ন দুর্গের প্রথম মালিকের ওপর অভিশাপ আগের মতোই বলবৎ রইল!’ বলল সে। ‘তত দিনই থাকবে, যত দিন না দুর্গটা পোড়ো হয়ে গিয়ে আপনিই ভেঙে পড়ে! তারপর পুরো জায়গাটা আবার আমাদের দখলে চলে আসবে, যেমন ছিল শত শত বছর আগে!’

রবিনের গায়ে কনুইয়ের আলতো গুঁতো দিয়ে ফিসফিস করে কিশোর বলল, ‘এ জন্যই মহিলা বলছিল, ভূতের উপদ্রব থেকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় দুর্গটাকে বিক্রি না করা। ভূতের ভয়ে এর বাসিন্দারা পালিয়ে গেলে জন-মানবহীন নির্জন বাড়িটা দেখাশোনার অভাবে আপনিই ভেঙে পড়বে। ডাইনিরা তখন সমস্ত জায়গাটাই ফেরত পাবে।’

‘এ কারণেই ভূতকে ভয় পায় না মিসেস বেন,’ মুসা বলল। ‘ডাইনি আর ভূত—দুটোই অতিপ্রাকৃত শক্তি। কী বলো, কিশোর?’

‘হুঁ!’ চিন্তিত ভঙ্গিতে মুসার কথার জবাব দিল কিশোর। ‘তবে এ ক্ষেত্রে মনে হয় ভূতটার চেয়ে ডাইনি বেশি ক্ষমতাশালী।’

আবার কিছুক্ষণ নাচ আর সারিগানের পর সভা ভাঙল। একে একে চলে যেতে লাগল মহিলারা। সবাই বনের ভেতর দিয়ে দুর্গের উল্টো দিকে চলে গেল। মিসেস বেন দুর্গের দিকে রওনা হলো। গাছের আড়ালে থেকে পিছু নিল তিন গোয়েন্দা। বাগানের পথ দিয়ে গিয়ে, সেলারের বারান্দার দরজাটা দিয়ে ঢুকে পড়ল মহিলা। গোয়েন্দারাও পেছন পেছন এল।

আবার একবার সেলারের গ্রিলের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে মিসেস বেন বলল, ‘জন ব্যানকবার্ন, আছো তুমি ওখানে? ও, আসোনি এখনো।’ তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘যাকগে, এত সহজে পার পাচ্ছ না, আরও বহুদিন অপেক্ষা করতে হবে তোমাকে...’

‘কিসের অপেক্ষা?’ পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল মিসেস বেন। মশালের আলোয় চকচক করছে মহিলার চোখ, আগুনের আলো নাচছে যেন জ্বলন্ত চোখের মণিতে।

‘তোমাদের দুর্গ থেকে চলে যেতে বলেছিলাম,’ সাপের মতো হিসিয়ে উঠল মহিলার কণ্ঠ। ‘এখনো আছো তোমরা। উইকেড লর্ড তোমাদের ছাড়বে না।’

‘উইকেড লর্ড কী করবে, জানি না,’ ঝাঁজালো কণ্ঠে বলল মুসা। ‘তবে আপনি যে একজন ডাইনি, সেটা আমরা জেনে গেছি! আপনার পিছু নিয়ে বনের ভেতর গিয়ে আপনাদের সভা দেখে এসেছি আমরা। আপনারা আপনাদের জমি ফেরত চান।’

‘সর্বনাশটা করেছে জন ব্যানকবার্ন,’ মিসেস বেন বলল। ‘তাকেই আবার এর বিহিত করতে হবে।’

কঠোর দৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকাল কিশোর। ‘তার মানে আপনিই আপনার কালো শক্তি দিয়ে দুষ্ট লর্ডকে ডেকে এনেছেন দুর্গটাকে ভুতুড়ে করে তোলার জন্য?’

হাসল মিসেস বেন। ঠোঁটের দুই কোণ বেঁকে গেল কুটিল ভঙ্গিতে। ‘জবাবটা জনের কাছ থেকেই শুনো, আবার যখন তার সঙ্গে দেখা হবে তোমাদের।’

ওই মুহূর্তে বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেল কিশোর। বলল, ‘মিসেস বেন, কাল রাতে আপনিই বাগানের দরজা খুলেছিলেন। যাতে বাতাস ঢুকে মশালটা নিভিয়ে দেয়। দরজা খোলার সময় ইচ্ছে করেই শব্দ করেছিলেন, আমাদের ভয় দেখানোর জন্য। যাতে দুর্গ থেকে চলে যাই আমরা। আপনি যে ডাইনি এটা আমাদের জানতে দিতে চাননি। ডাইনির অভিশাপকে গুজব আর কুসংস্কার বলেছিলেন, যাতে এর ওপর গুরুত্ব না দিই আমরা।’

একটু থেমে আবার বলল কিশোর, ‘আপনি চান, ভূতটা এ বাড়িতেই থাকুক। থাকলে আপনার সুবিধে। আপনি বরং আমাদের তাড়াতে পারলেই বাঁচেন।’

অপরাধী ভঙ্গিতে তাকাল মিসেস বেন। কিশোর বুঝল, তার অনুমান ঠিক।

কোনো জবাব দিল না মহিলা। তাড়াহুড়ো করে উঠে গেল ঘোরানো সিঁড়িটা বেয়ে।

নয়

নিজেদের চারপায়ার ঘরে ফিরে এল ছেলেরা। পাহারা দেওয়ার পালা এবার রবিনের। অহেতুক বসে না থেকে শুয়ে পড়ল কিশোর ও মুসা। নীরবতার চাদরে ঢাকা দুর্গের ভেতরে ছোট্ট একটা ঘরে বসে কান পেতে অপেক্ষা করতে লাগল রবিন। হঠাৎ মনে হলো, সেলারের ভেতর মৃদু শব্দ হয়েছে। লাফ দিয়ে উঠে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এল বারান্দায়। সেলারের কাছে এসে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল।

জানালাটা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। হলদে আলো ছড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে। সেই আলোয় দেখতে পেল দেয়ালের গায়ে গাঁথা হাতকড়া, পা-বেড়ি, এমনকি পেরেকে ঝোলানো শিকলটাও আগের মতোই রয়েছে, কিন্তু ভূতটাকে দেখা গেল না।

‘ভুল শুনেছি,’ আপন মনে বিড়বিড় করল রবিন।

ফিরে এসে মশালটার দিকে তাকিয়ে দেখল ঠিকমতো জ্বলছে কি না, এই সময় পেছনে একটা নড়াচড়া টের পেল। ঝট করে ঘুরে তাকাল। চোখের কোণ দিয়ে দেখল মস্ত একটা কালো বিড়াল নিঃশব্দে হেঁটে হারিয়ে গেল অন্ধকারে।

বলা হয়, কালো বিড়াল দুর্ভাগ্য বয়ে আনে। ভাবল, এ বিড়ালটা কি তাহলে কোনো অশুভ লক্ষণ? নাকি ওটাও একটা ভূত? বিড়ালের ভূত! হয়তো এটার মালিক ছিল জন ব্যানকবার্ন, জাহাজে থাকতে পুষত, জাহাজ থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

‘তার মানে ভুল শুনিনি। বিড়ালটাই শব্দ করেছে।’ ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরে এল রবিন। আগের জায়গায় বসে আবার পাহারা দিতে লাগল। চারপায়ায় কিনারে বসে কান পেতে রইল সে। তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বারান্দার দিকে। ধীরে গড়িয়ে যাচ্ছে সময়। একেকটা মিনিট একেকটা ঘণ্টার মতো মনে হচ্ছে। নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে মুসা। কিশোরও গভীর ঘুমে অচেতন।

হঠাৎ আবার একটা শব্দ শুনে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রবিন। সেলার থেকে আসছে কর্কশ কণ্ঠে জলদস্যুদের সারিগান। আস্তে করে কিশোর আর মুসার ঘুম ভাঙাল সে।

ঘরের বাইরে ছুটে এল তিনজনে। সেলারের গ্রিলের কাছে এসে দাঁড়াল। দুষ্ট লর্ডকে দেখতে পেল। জানালার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ভোজালিটা এক হাতে উঁচু করে ধরে রেখেছে।

আবার গিয়ে দেয়ালের গা থেকে মশালটা খুলে আনল মুসা। চাবি দিয়ে সেলারের দরজা খুলল কিশোর। হুড়মুড় করে বন্দিশালাটায় ঢুকল তিনজনে।

জ্বলন্ত চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল ব্যানকবার্নের ভূত। ওটার ভোঁতা নাক, পেছন দিকে বেঁকে যাওয়া হলদে দাঁত, কুিসত হাসি, সবই অবিকল তার ছবিটার মতো।

ভূতের কয়েক ফুট দূরে এসে দাঁড়িয়ে গেল তিন গোয়েন্দা।

‘তোমাদের আগেও পরখ করেছি আমি, আবারও করলাম—তোমরা আমাকে ভয় পাও না, ভিনদেশ থেকে আসা আগন্তুক,’ ভুতুড়ে কণ্ঠে কথা বলে উঠল ভূতটা।

মেরুদণ্ডে শীতল শিহরণ বয়ে গেল ছেলেদের।

ভূত বলল। ‘ঐন্দ্রজালিক বিদ্যার নিয়ম অনুযায়ী, আমি এখন তোমাদের সব প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য! আমার কথা শুনতে চাও?’

‘শোনার পর আমাদের কোনো বিপদ হলে চাই না...’ বিড়বিড় করে বলতে গেল মুসা।

হাতে চাপ দিয়ে ওকে থামিয়ে দিল কিশোর। মাথা সোজা করে দাঁড়াল। ‘হ্যাঁ। শুনতে চাই। কী বলবেন বলুন।’

‘প্রায় তিন শ বছর ধরে এই দুর্গে বাস করে আসছি আমি,’ ভূত বলল। ‘ডাইনির অভিশাপে মরে গিয়েও মৃত্যুর ওপারে যেতে পারছি না।’

‘কী অভিশাপ দিয়েছিল ডাইনি?’ কিশোর ও রবিনকে অবাক করে দিয়ে প্রশ্নটা করল মুসা। প্রচণ্ড কৌতূহলে ভয় দূর হয়ে গেছে তার।

ভোজালিটা নামিয়ে বগলে চেপে ধরল জনের ভূত। কর্কশ কণ্ঠে সুর করে কবিতার ছন্দে যা বলল: তত দিন পর্যন্ত এই দুর্গে রাতেরবেলা ঘুরে বেড়াবে জনের প্রেতাত্মা, যেটাকে সে তার ঘর বানিয়েছে, যত দিন না ডাইনিদের কাছে তাদের বনসহ জায়গাটা ফেরত দেবে।

ভূতের কবিতা শুনে গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল গোয়েন্দাদের। কবিতা থামিয়ে কণ্ঠটা বলল, ‘মিসেস বেনের একজন পূর্বপুরুষ— ডাইনিদের নেত্রী, এখানে দুর্গ বানাতে নিষেধ করেছিল আমাকে। বলেছিল এটা ওদের জায়গা, এখানে ওদের সভা হয়। কিন্তু আমি তার কথা শুনিনি। জোর করে দুর্গ বানিয়েছি। তাই আমাকে অভিশাপ দিয়েছিল ও—চিরকাল এই দুর্গে প্রেত হয়ে ঘুরে বেড়াবে আমার আত্মা।’

পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল তিন গোয়েন্দা। ওরা বুঝতে পারছে, ব্যানকবার্ন দুর্গ রহস্যের সমাধান হতে চলেছে।

ভূতের দিকে তাকাল কিশোর। ‘আর সে কারণেই মিসেস বেন আপনার ওপর তার কালো শক্তির ক্ষমতা খাটাতে পারছে?’

‘হ্যাঁ!’ গর্জে উঠল ভূতটা। ‘ও যখন শুনল, দুর্গটা কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেওয়া হবে, আমাকে মানুষের সামনে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দিল। এর আগে আমি আর কোনো দিন বেরোইনি, অদৃশ্যই থেকেছি। আমি যে এখানে আছি, শুধু মিসেস বেন জানত সেটা।’

‘মিসেস বেন ভেবেছিল আপনি দেখা দিলে,’ উপসংহার টানল কিশোর, ‘ভূতের কথা ছড়িয়ে পড়বে। দুর্গটা কেউ আর তখন কিনবে না। ডাইনিরাও তাদের সভাস্থল হারাবে না। তাই না?’

মাথা ঝাঁকাল ভূতটা।

আবার বলল কিশোর, ‘বুঝতে পারছি, আমাদের ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর আদেশ দিয়েছে আপনাকে মিসেস বেন। কিন্তু তাতে আপনি সফল হননি। যাই হোক, এই অভিশাপ থেকে আপনার মুক্ত হওয়ার উপায় কী?’

ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকাতে লাগল ভূতটা। তার কুিসত মুখে অদ্ভুত হাসি ছড়িয়ে পড়ল। ‘ইতিমধ্যেই তোমরা আমাকে মুক্ত করে দিয়েছ।’

কথাটা শুনে অবাক হলো তিন গোয়েন্দা।

‘মানে?’ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল রবিন।

‘ঐন্দ্রজালিক বিদ্যার নিয়ম অনুযায়ী,’ ভূতটা জবাব দিল, ‘অচেনা কোনো দেশ থেকে যখন সাহায্য আসবে, তখনই কেবল ডাইনির অভিশাপ শেষ হবে। ওরা যখন সেলারের দরজা পাহারা দেবে, ভূতের আর দেখা দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না।’

তারপর ভূতটা বলল, ‘আমি জানি তোমরা অন্য দেশ থেকে এসেছ, এবং তোমরা সেলারের দরজার কাছে থেকে পাহারা দিয়েছ। দ্বিতীয়বার আমাকে দেখার পরও ভয় পাওনি। মিসেস বেন মনে করেছিল প্রথমবার দেখেই তোমরা ভয়ে পালাবে। কিন্তু ও ভুল করেছে।’

‘এর মানে কী?’ জানতে চাইল মুসা।

‘এর মানে হলো, ভয় না পেয়ে, আমার সঙ্গে কথা বলার সাহস দেখিয়ে, ভয়ংকর এক অপশক্তির অভিশাপ থেকে আমাকে মুক্ত করেছ তোমরা। আমার ওপর মিসেস বেন আর তার কালো শক্তির ক্ষমতা খাটাতে পারবে না। এখন আমি চিরকালের জন্য ব্যানকবার্ন দুর্গ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আর কখনো কোথাও দেখা যাবে না আমাকে।’

ভুতুড়ে কণ্ঠটা ফিসফিসানিতে পরিণত হলো, তারপর থেমে গেল। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল ছেলেরা, নিঃশব্দে দেওয়াল ভেদ করে চলে গেল ভূতটা।

দুই চোখ ডলল মুসা। ‘কিশোর, যা দেখলাম সত্যি দেখলাম?’

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ‘হ্যাঁ, সত্যিই দেখেছি! কাল সকালবেলা লর্ড ব্যানকবার্নকে সাংঘাতিক একটা ভূতের গল্প শোনাতে যাচ্ছি আমরা।’

দশ

পরদিন সকালে যখন রাতের ঘটনাটা বিস্তারিত জানানো হলো, বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেলেন লর্ড।

‘সত্যিই জন ব্যানকবার্ন চিরকালের জন্য দুর্গ ছেড়ে গিয়েছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

‘যদি ভূতটা মিথ্যে বলে না থাকে,’ জবাব দিল কিশোর।

‘তোমরা খুব কাজের ছেলে! এত ভয়ংকর দৃশ্য দেখেও সাহস হারাওনি, সেলারের কাছে বসে থেকেছ, ভূতের সঙ্গে কথা বলেছ, আমাদের সবাইকে বিপদ থেকে রক্ষা করেছ। ভূতের ভয়ে দুর্গের কাউকে আর সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে হবে না।’ একটু থেমে বললেন লর্ড, ‘মিসেস বেনের সঙ্গে এখন একটা বোঝাপড়া করতে হবে আমাকে।’

স্টাডিতে ডেকে আনা হলো তাকে। সব স্বীকার করল মহিলা। ‘দুর্গ তৈরির সময় অভিশাপ দেয় যে ডাইনি, আমি তার বংশধর। বংশপরম্পরায় আমরা জানতাম, দুষ্ট লর্ডের ভূতটা এই দুর্গের মধ্যেই থাকে।’

‘কিন্তু ভূতটা আগে কখনো দেখা দেয়নি,’ লর্ড বললেন।

‘না, দেয়নি। কারণ প্রয়োজন পড়েনি। এর আগে দুর্গ বিক্রির কথা ভাবেনি আপনার কোনো পূর্বপুরুষ। আমি ভূতটাকে ব্যবহার করে, ভয় দেখিয়ে, আপনাকে দুর্গ বিক্রি থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিলাম। রিয়্যাল এস্টেট কোম্পানির কাছে বিক্রি করলে ওরা মূল দুর্গটাকে ভেঙে ফেলে ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি করবে। আমি জানি, বনটাকেও রেহাই দেবে না ওরা, গাছপালা সব কেটে ফেলে বাড়ি তুলবে। বনের ভেতর আমাদের বর্তমান যে সভাস্থলটা আছে, সেটাও হারাব আমরা। এখান থেকে পুরোপুরি উচ্ছেদ করে ছাড়বে আমাদের।’

ফোঁপাতে শুরু করল মিসেস বেন। ‘কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছি। আমার ক্ষমতা হারিয়েছি। আমি আর এখন ডাইনি নই। গ্লাসগোতে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার।

দুচোখ থেকে গাল বেয়ে পানি পড়তে লাগল মিসেস বেনের। দেখে এতটাই স্তব্ধ হয়ে গেলেন লর্ড, আর কিছু বলতে পারলেন না মহিলাকে। স্টাডি থেকে বেরিয়ে গেল মিসেস বেন। ১০ মিনিট পরেই দুর্গ থেকে চিরকালের মতো বেরিয়ে গেল সে।

দুর্গ থেকে ভূতটাকে তাড়িয়ে দিয়েছে তিন গোয়েন্দা, খবরটা শিগগির দুর্গের কর্মচারীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ল। ওরা এসে ছেলেদের ধন্যবাদ জানাল। ভয় দূর হয়ে গেছে ওদের চেহারা থেকে। কাজ করতে গেল হাসিমুখে।

ডগলাস এসে হাত মেলাল তিন গোয়েন্দার সঙ্গে। বলল, ‘আমি খুব অশান্তিতে ছিলাম, ভেবেছিলাম এখানকার চাকরিটা আমার ছাড়তে হবে। এখন আর কোনো ভয় নেই। মালিক আমাকে যত দিন রাখবেন, তত দিনই আমি থাকতে পারব।’

‘এতটা কাল ধরে না জেনে একটা ভূতের সঙ্গে বাস করছিলেন আপনারা, ভাবতে অবাক লাগছে না?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।

মাথা ঝাঁকাল বাটলার। গম্ভীর হয়ে গেল। ‘একটা ডাইনির সঙ্গেও যে বসবাস করছিলাম, তা-ও তো জানতাম না। ঘুণাক্ষরেও মিসেস বেনকে কখনো সন্দেহ করিনি। বহু বছর ধরে এখানে একসঙ্গে ছিলাম আমরা।’

কেঁপে উঠল ডগলাস। রান্নাঘরে চলে গেল। এয়ারপোর্টে ফোন করল কিশোর, প্লেনের টিকিট বুক করার জন্য। মুসা আর রবিনকে নিয়ে ওপরতলায় এল, স্যুটকেস গোছানোর জন্য।

‘এই ঘরটা আমাদের দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু কখনো এখানে থাকা হলো না,’ হেসে বলল রবিন। ‘এই বিছানাগুলো সেলারের চারপায়ার চেয়ে অনেক আরামদায়ক মনে হচ্ছে।’

‘ঘুমোতে পারলে ভালো হতো। আমি খুব ক্লান্ত।’ কিশোর বলল। ‘যাকগে, বাড়ি ফেরার পথে প্লেনে ঘুমিয়ে নেব। ’

কাজ শেষ করে, লর্ড ব্যানকবার্নকে গুডবাই জানাতে, স্যুটকেস হাতে স্টাডিতে এল তিন গোয়েন্দা।

‘কিশোর, মুসা, রবিন, একটা অসম্ভব কাজকে সম্ভব করেছ তোমরা!’ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে প্রশংসা করলেন লর্ড। ‘আমি বিস্মিত। কিশোর, তোমার চাচাকে আমি একটা লম্বা চিঠি লিখব। তোমরা যা যা করেছ, সব জানাব তাকে।’ তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আন্তরিকভাবে হাত মেলালেন ওদের সঙ্গে। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।

গাড়িতে করে ওদের প্রেস্টউইক এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিল ডগলাস। শিগগির ওরা আকাশে উড়ল। আরেকবার আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার পালা। দুর্গে ঘটা পুরো বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করল ওরা। ঘটনাটা ঘটেছে, স্বীকার করতে বাধ্য হলো কিশোর, তবে অদ্ভুত এই অতিপ্রাকৃত ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারল না সে-ও।

‘যাক, একটা ব্যাপারে খুব আনন্দ লাগছে আমার,’ মুসা বলল।

‘কী?’ জিজ্ঞেস করল রবিন।

‘সত্যি সত্যি এমন একটা ঘটনা ঘটল,’ হেসে বলল মুসা, ‘কিশোর পাশাও যার ব্যাখ্যা দিতে পারে না।’