চশমা

এক সপ্তাহ আগে মনজুর চাচা আমাকে তাঁর বাসায় ডেকে নিয়েছিলেন। ভয় ভয় গলায় বলেছিলেন, ‘রিফাত রে, আমার খুব বিপদ! ও আমাকে মেরে ফেলবে।’

আমি বলেছিলাম, ‘ধুর! কী যে বলো না!’

তখনো জানতাম না, আজ চাচাকে এই অবস্থায় দেখতে হবে। হাসপাতালের আইসিইউতে জড়বস্তুর মতো পড়ে আছেন তিনি। তাঁকে ঘিরে নানা রকম যন্ত্রপাতি, মনিটর। হাসিখুশি, আমুদে মানুষটা আর কখনো চোখ খুলবেন কি না, আমি জানি না।

চাচার সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছিল গতকাল রাত সাড়ে এগারোটায়। চাপা গলায় বলছিলেন, ‘আমি জানি! আমি জানি ও কে! যা ভেবেছিলাম তাই ঠিক।’ শুনে বলেছিলাম, ‘শান্ত হও। তুমি ঘুমাও। আমি সকালে এসে সব শুনব।’ রাত দেড়টায় খবর পেলাম, কে যেন মনজুর চাচার বুকে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছি হাসপাতালে। দেখি চাচা থরথর করে কাঁপছেন। চোখের আলো প্রায় নিবুনিবু। কথা বলার মতো শক্তি নেই। ডাক্তাররা কাউকেই কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছিলেন না, কিন্তু চাচা বারবার ইশারায় আমাকে কাছে ডাকছিলেন। দেখে ডাক্তার বললেন, ‘এক মিনিট। এর বেশি না।’

আমি চাচার পাশে দাঁড়ালাম। কাঁপা কাঁপা হাতে তাঁর চশমাটা তিনি আমার হাতে তুলে দিলেন। কী যেন বলার জন্য চোখ দুটো অস্থির হয়ে উঠেছিল, কিন্তু মুখ খোলার আগেই চাচার চোখ দুটো বুজে এল। নিথর হওয়ার আগ মুহূর্তেও তিনি চশমাটা আমার হাতে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছিলেন।

মনজুর খালেদ মাহবুব আমার আপন চাচা নন। তিনি বাবার বন্ধু। বিশাল সম্পত্তির মালিক, কিন্তু বিয়ে- থা করেননি। তাঁর ভাইয়েরা কেউ বেঁচে নেই। মৃত্যুর পর ভাতিজাদেরই তাঁর সম্পত্তির মালিক হওয়ার কথা। অথচ আপন ভাতিজাদের চেয়ে তিনি আমাকেই বেশি স্নেহ করতেন।

গত সপ্তাহে ডেকে চাচা বলছিলেন, তাঁর সন্দেহ, চার ভাতিজার মধ্যে কেউ একজন তাঁকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে। মাহবুব ভিলা নামের বিশাল বাড়িটাতে চাচা-ভাতিজা সবাই একসঙ্গে থাকেন। চার ভাতিজার সঙ্গেই আমার পরিচয় আছে। প্রত্যেককেই বেশ ভালো মানুষ বলে মনে হয়। চাচাকে বেশ সম্মান করতেও দেখেছি। আমার তাই ব্যাপারটা বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু চাচা বেশ দৃঢ় গলায় বলেছিলেন, তিনি নিশ্চিত। এই চারজনের মধ্যে একজন তাঁকে মেরে ফেলতে চায়।

মনজুর চাচার বড় ভাইয়ের একটাই ছেলে। নাম রওনক হাবিব মাহবুব। বঙ্গবাজারে তাঁর সাইকেলের দোকান আছে। ছোট ভাইয়ের ছেলে তিনজন। চঞ্চল শরিফ মাহবুব, সাদমান শাহেদ মাহবুব আর আসিফ আরমান মাহবুব। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় দুজনের গার্মেন্টসের ব্যবসা আছে বলে শুনেছি। ছোটটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, আমার বন্ধু।

আইসিইউর দরজার কাছে চার ভাইয়ের সঙ্গেই দেখা হয়ে গেল। সবার চোখেমুখে গাঢ় দুশ্চিন্তার ছায়া। আসিফের কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘তোরা বাসায় যা, আমি আছি।’ তবে আমার কথা ওরা শুনবে বলে মনে হলো না।

মনজুর চাচার বয়স হয়েছে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার ভালো বন্ধুত্ব ছিল। প্রচুর বই পড়ি বলে আমাকে খুব পছন্দ করতেন। আমরা দুজনই গোয়েন্দা গল্পের ভক্ত। বিবিসির শার্লক সিরিজের সব কটি পর্ব দুজন একসঙ্গে বসে দেখেছি। আজ মনে হচ্ছে, চাচা বুঝি আমাকে কোনো রহস্যগল্পের মধ্যে ফেলে দিয়ে গেছেন।

চশমাটা দিয়ে চাচা কী বোঝাতে চাইলেন? এই চশমায় কি কোনো সূত্র লুকানো আছে? চার ভাতিজাই চশমা পরে, তাই আলাদা করে একজনকে সন্দেহ করা যাচ্ছে না। চশমাটা আমি আরও একবার ভালো করে দেখলাম। নাহ্, বিশেষ তেমন কিছুই চোখে পড়ছে না। ফরেনসিক টেস্ট করে এর মধ্য থেকে কোনো সূত্র বের করা আমার পক্ষে সম্ভব না, সেটা চাচাও জানেন। মনে হয় খুব সহজ কোনো তথ্য লুকানো আছে এই চশমায়। খুব সহজ। কিন্তু কী সেটা?

আমরা জানি তোমাদের অনেক বুদ্ধি। নিশ্চয়ই এতক্ষণে ধরে ফেলেছ কী রহস্য লুকিয়ে আছে চশমায়। কিন্তু ধাঁধাঁ যখন দিয়েছি, উত্তরটাও তো দিতে হবে, তাই না? তোমরা যারা রহস্যটার সমাধান করে ফেলেছ, তারা মিলিয়ে নাও।

উত্তর

ঞ্চল রীফ মাহমুদ