চশমা স্যার

অলংকরণ: রিদম

এই স্কুলে একজন চশমা স্যার আছেন। ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি চশমা বিক্রি করেন। বিনিময়ে কোনো টাকা নেন না। অবশ্য বিনা পয়সায় চশমা কিনতে হলে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। চশমা কেনার সময় মা-বাবা আর ক্লাস টিচারকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়।

এই স্কুলে কিছুতেই আসতে চায়নি রিশাদ। আগের স্কুল তার অতি প্রিয় ছিল। স্যারেরা যদিও বকাঝকা করতেন, পড়া না পারলে দাঁড় করিয়ে রাখতেন, তবু ক্লাসের ফাঁকে বন্ধুদের সঙ্গে তার দারুণ সময় কাটত। মাঠের কোনায় জাম-জামরুলের গাছ ছিল। স্যারদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রিশাদ উঠে যেত গাছে। প্যান্টের পকেট ভর্তি করে পেড়ে আনত কখনো জাম, কখনো জামরুল। তারপর সবাই মিলে মজা করে খেত লবণ-মরিচ মেখে। স্কুলব্যাগ গোছানোর সময় মায়ের কাছ থেকে লবণ-মরিচ চেয়ে নিতে ভুল করত না কেউ। 

রিশাদ যখন গাছে উঠত, বিচিত্র ব্যাপার-স্যাপার খেয়াল করত সে। দুই ডালের মাঝখানে বিশাল মাকড়সার জাল। মধ্যখানে বসে আছে মাকড়সা। কখনো দেখত শুঁয়োপোকা—নিজের দেহটাকে ঠেলে ঠেলে তার দিকে এগিয়ে আসছে।

একবার সে পিঁপড়ার কবলে পড়েছিল। জামরুল পাড়তে গিয়ে আঘাত লেগেছিল পিঁপড়ার বাসায়। অমনি পিঁপড়ার দল আক্রমণ করে বসল রিশাদকে। ভাগ্যিস পিঁপড়ার কবল থেকে বাঁচার উপায়টা তার জানা ছিল।

এই সব দুষ্টুমি করতে গিয়ে সে জেনে গিয়েছিল শুঁয়োপোকা থেকে কীভাবে প্রজাপতি হয়, মাকড়সা কোন কৌশলে এত নিখুঁত জাল বুনতে পারে। একবার সে ধরে এনেছিল দৈত্যাকার এক প্রজাপতি। মাথাটা সাপের মাথার মতো। স্কুলব্যাগে ভরে প্রজাপতিটাকে সে বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। তার সে কী উত্তেজনা! মাকে দেখাবে। মা আবার প্রাণিবিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন। প্রজাপতিটাকে দেখে মা তো আরও উত্তেজিত—তুই এটা কী করেছিস খোকা! তুই কি জানিস, কী ধরে এনেছিস তুই? রিশাদ বলল, এটা বড় প্রজাপতি মা, মাথাটা সাপের মতো। মা বললেন, এটা শুধু প্রজাপতি নয়, এটা পৃথিবীর বৃহত্তম মথ। মা তারপর মথটাকে যত্ন করে বনে ছেড়ে দিয়েছিলেন।

রিশাদ যা যা দেখত, সেসবের ছবি এঁকে রাখত খাতায়। প্রজাপতি, পিঁপড়ার বাসা, শুঁয়োপোকা। আর পড়ত বই। এসবের জন্য মা-বাবা তাকে বকতেন। মা-বাবা বলতেন, কত স্বপ্ন ছিল—আমাদের ছেলেটার রোল নম্বর এক-দুই থাকবে। কিন্তু কিসের কী! তার রোল নম্বর ১২। কাউকে বলতেও পারি না লজ্জায়।

অঙ্ক স্যার একবার রিশাদের কান মলে দিয়েছিলেন। তার অপরাধ, অঙ্কের খাতাজুড়ে সে ছবি এঁকে রেখেছিল। আর ছিল একটা বিশাল তালিকা, যে বইগুলো পড়া হয়েছে আর যে বইগুলো পড়তে হবে। 

অঙ্ক স্যার তার কান মলে দিয়ে বললেন, ভালোই তো দুষ্টুমি চলছে। বল তো, দুই হাজারের দেড় গুণ কত? রিশাদ বলল, পনেরো শ। অঙ্ক স্যার তার আরেক কান মলে দিলেন। খাতার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে তিনি বললেন, এঁকেছিস অবশ্য ভালো। মাকড়সার জালটা ভালো হয়েছে। জ্যামিতি বুঝিস? বল তো, জ্যামিতি কাকে বলে?

কদিন সে গেল চশমা স্যারের কাছে। চশমা স্যার মা-বাবা আর ক্লাস টিচারকে বসতে দিলেন। রিশাদকে বললেন, তুমি কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়াও।

রিশাদ উত্তর দিতে পারেনি। অঙ্ক স্যার বললেন, দুই কান তো মললাম, এবার কী মলব? মাকড়সা জ্যামিতি জানে, আর তুই জ্যামিতি জানিস না ব্যাটা।

তবু আগের স্কুলটাই তার পছন্দ ছিল। বাবা বদলি হওয়ার পর এই স্কুলে যখন তাকে নিয়ে এলেন, রিশাদের খুব মন খারাপ হলো। এখানে গাছ নেই, এখানে মাঠ নেই। তার মানে এখানে প্রজাপতি, শুঁয়োপোকা, পিঁপড়া, জাম-জামরুল—কিছুই নেই।

প্রথম দিনের ক্লাসে ক্লাস টিচার রিশাদকে দাঁড় করিয়ে বললেন, নতুন এসেছ, একটু বাজিয়ে দেখি। আচ্ছা বলো তো আয়তন আর ক্ষেত্রফলের মধ্যে পার্থক্য কী? 

রিশাদ মাথা নিচু করে ভাবছিল, সবাই শুধু অঙ্কের প্রশ্ন করে কেন? যেন অঙ্কই সব। কেউ জানতে চায় না—ভ্যান গঘের বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলো কী কী, কালো জামে ভিটামিন বেশি না আয়রন বেশি, লাল আলোতে হলুদ ফুল কেমন দেখায়। কেউ জানতে চায় না পথের পাঁচালীর অপু-দুর্গার কথা।

রিশাদ আয়তন আর ক্ষেত্রফলের পার্থক্য বলতে পারেনি। না পেরে সে কেঁদে দিয়েছিল।

তারপর একদিন সে গেল চশমা স্যারের কাছে। চশমা স্যার মা-বাবা আর ক্লাস টিচারকে বসতে দিলেন। রিশাদকে বললেন, তুমি কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়াও।

রিশাদ বাইরে গেলে চশমা স্যার বললেন, সমস্যা আমি জানি। রিশাদ আমাকে বলেছে। আপনাদের সবাইকে চশমা পরিয়ে দেব। আপনারা খুঁজে বের করবেন, কোনটাতে রিশাদের আগ্রহ বেশি। সেটাকে যত্নের সঙ্গে লালন করবেন। বাড়িয়ে তুলবেন। বাকি বিষয়গুলো যে একদম শেখাবেন না, তা নয়। শেখাবেন, যতটুকু সে গ্রহণ করতে পারে। তবে সাবধান, বাড়াবাড়ি করবেন না। বাড়াবাড়িটা হচ্ছে ভাইরাসের মতো। তার মেমোরিতে ভাইরাস ঢোকাবেন না। আর মনে রাখবেন, সবাই সবকিছুতে দক্ষ হয় না। সেটার প্রয়োজনও নেই।

বাবা বললেন, চশমা কই?

চশমা স্যার বললেন, দিলাম তো। অদৃশ্য চশমা।