চিঠি

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

কোয়ারেন্টিনে বাসায় থাকতে থাকতে হাতে–পায়ে একেবারে খিল ধরার জোগাড় হয়েছে। তাই পরশু খালি রাস্তা দেখে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে নিলাম আমার কবিতার খাতাটা। আমার আবার কবিতা লেখার শখ। ভাবলাম, নিরিবিলি জায়গা দেখে কবিতা লিখতে বসব। দারুণ সুন্দর আবহাওয়া। ঝিরঝিরে বাতাস। হাঁটার উপযুক্ত সময়। কিন্তু আমার খুশি বোধ হয় প্রকৃতির সইল না। দিঘির পাড় থেকে সবে মেইন রোডে উঠেছি, আচমকা শুরু ঝোড়ো বাতাস। সেকি বাতাস! গাছগুলো লুটিয়ে পড়ল। মুহূর্তে মেঘ কালো হয়ে গেল। বৃষ্টি শুরু হলে আর দেখতে হবে না! এখন হাঁটা দিলে হয়তো আট-দশ মিনিটে পৌঁছে যাব। দৌড় লাগলাম আমি। কিন্তু সেই যে বলেছি না, প্রকৃতি আমার পিছু লেগেছে! দৌড়াতে দৌড়াতে আমার কবিতার খাতায় গোঁজা দু–চারটা ছেঁড়া কবিতার পাতা পড়ে গেল। দৌড়াচ্ছিলাম ইট–বালুর ওপর দিয়ে, এখানে নাকি আবার কিসের কাজ চলছে। ধুলাবালুর ভেতর হাতে যা ঠেকল, তা–ই কুড়িয়ে নিয়ে এলাম।

পরদিন দুপরে বসলাম কবিতার খাতা নিয়ে। দেখলাম, আমার শখের কবিতাগুলোর দু–একটা খোয়া গেছে। তবে নতুন একটা কাগজ জুটেছে। আমার কাগজগুলোর সাইজে চার ভাঁজ করা। তবে বেশ মলিন। আমার আবার স্বভাববশত কৌতূহলটা একটু বেশি। খুলে পড়তে শুরু করলাম। একটা চিঠি। কারও ব্যক্তিগত হতে পারে, কিন্তু ফিরিয়ে দিতে হলে তো নাম–ঠিকানা চাই। হয়তো চিঠিতে উল্লেখ আছে ভেবে পড়তে শুরু করলাম। পড়ে প্রথমে অবিশ্বাস, পরে বিস্মিত হলাম। বিষয়টা কতটুকু সত্য বা মিথ্যা ঠাওর করতে পারলাম না। সুতরাং, আপাতত তোমাদের হাতে তুলে দিচ্ছি।

শ্রদ্ধেয় পাঠক,

শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় বা ইচ্ছা বর্তমানে আমার কাছে নেই। আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার উদ্দেশে চিঠিটা লিখছি। আপনি যে যুগের মানুষই হয়ে থাকুন না কেন, বিস্মিত হবেন। আমাকে পাগল ভাববেন। ভাববেন রসিকতা করছি। কিন্তু অবিশ্বাস করলে মহাবিপদে পড়বেন।

আমি উনত্রিশ শতাব্দীর একজন মানুষ। আমার নাম রিটোনিরুট। বর্তমানে যে কজন খ্যাতনামা গণিতবিদ আছেন, তাঁদের একজন আমি। কিন্তু শুনে আশ্চর্য হবেন, গণিতের প্রতি আমার তীব্র ক্ষোভ। আর এই ক্ষোভের জন্যই আমার গণিতবিদ হওয়া। ছোটবেলা থেকেই গণিতের প্রতি আমার এত বিতৃষ্ণা যে আমি তখন থেকেই ঠিক করে রেখেছি, যে এই গণিত আবিষ্কার করেছে তাকে যদি পাই, তবে খুন করব। বিষয়টা অত কঠিনও না। ইতিমধ্যে টাইম মেশিনের গবেষণা অনেকখানি এগিয়েছিল আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সময়ে। সুতরাং, পড়াশোনা শেষে আমিও এই গবেষণা দলের সদস্য হয়ে গেলাম। কাজ মোটামুটি শেষ হয়ে এল, আর এক রাতে আমি শেষ ক্যালকুলেশনটা করে যন্ত্রটাকে পুরোপুরি দাঁড় করিয়ে দিলাম। ল্যাবে তখন কেউ নেই। সবাই অনেক আগেই বাড়ি চলে গেছে। এই তো সুযোগ, যার জন্য আমি এতটা বছর অপেক্ষা করেছি। তারিখ, সময় আর সালটা সেট করে আমি কন্ট্রোল রুমের চেয়ারে বসলাম। স্ক্রিনে একের পর এক কোডগুলো আসতে লাগল। একসময় স্ক্রিনটা ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হতে লাগল। একপর্যায়ে পুরো সাদা হয়ে গেল। অবশেষে...সেই সময়টাতে এসেছি আমি, যখন গণিত আবিষ্কার হয়েছিল। কন্ট্রোল রুমের স্লাইড ডোরটা খুলে যেতেই বেরুলাম বাইরে। অবাক দৃশ্য! এত ফাঁকা জায়গা জীবনেও দেখিনি আমি। এটা কি পৃথিবী? কিছুদূর হাঁটতেই কতগুলো লোকের সঙ্গে দেখা। দল বেঁধে আড্ডা দিচ্ছে। আমার ভয়েস ট্রান্সলেটর ডিভাইসটা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম এদের মধ্যে অঙ্কটঙ্ক করে এমন লোক আছে কি না। আজব! হাজার বুঝিয়েও অঙ্ক জিনিসটা এদের বোঝাতে পারলাম না। বুঝলাম, বেশ বেগ পেতে হবে এই আবিষ্কারক ব্যাটাকে খুঁজতে। কদিন পর অবশ্য খুঁজে পেলাম। জীর্ণশীর্ণ কুটিরে বসে একটা লোক কী যেন লিখছে। কী করছে, অঙ্ক? করুকগে, আমার তাতে কী? আমার পয়েন্ট মাইনাস নাইন থ্রি এইট বের করে দিলাম মাথা বরাবর গুলি করে।

কিছুক্ষণ পর শরীরটা কাগজের মতো টুকরো টুকরো হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল। যাক, অবশেষে আমার সাধ পূরণ হলো। গানটা পকেটে পুরে রওনা হলাম টাইম মেশিনের উদ্দেশে। কিন্তু হায়! আমার টাইম মেশিন কোথায়? চুরি গেছে? শুনেছি আগের দিনের মানুষ নাকি চুরি করত। কিন্তু ওটার যা ওজন, কারও পক্ষে তা তোলা অসম্ভব। শুধু কন্ট্রোল রুম থেকে তা নাড়াচাড়া করানো যায়। তবে? কিছুক্ষণ পর মাথায় এল ব্যাপারটা আর ভাবতেই মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা হলো। আগের দিনে নাকি একটা প্রবাদ ছিল, ‘খাল কেটে কুমির আনা’। আমার এখন সেই অবস্থাই হয়েছে। গণিত যদি না–ই থাকে, তবে টাইম মেশিন থাকবে কীভাবে? এখন কী যে করি, মৃত মানুষকে জীবিত করার সাধ্য তো বিজ্ঞানেরও নেই, তবে? কিছুক্ষণ ভাবাভাবির পর একটা বুদ্ধি বের করলাম। আমি নিজেই যদি গণিতের আবিষ্কারটা করি, তাহলে টাইম মেশিনটা হয়তো ফিরে আসবে। সুতরাং, যেই ভাবা সেই কাজ। সেই জীর্ণ কুটিরে ফিরে গেলাম। নোটপ্যাডে লোকটা কিছু লিখছিল চিঠি টাইপের কিছু, সেটা ছিঁড়ে ফেলে দিলাম। পকেট থেকে কলম বের করে লিখতে বসলাম। কিন্তু কী লিখব, কোথা থেকে গণিতের শুরু? সংখ্যা? হ্যাঁ, সংখ্যাই হবে। আমি সংখ্যা–সংক্রান্ত কিছু লেখালিখি করলাম। একপর্যায়ে হঠাৎ ওই আবিষ্কারকের কথা মাথায় এল। একটা চিঠি লিখছিল সে, তা–ই না? চিঠি...চিঠির কথা মাথায় আসতে একটা বুদ্ধিও মাথায় এল। আমি যদি আমার ভবিষ্যৎ আমাকে সতর্ক করতে একটা চিঠি লিখি এবং সেই চিঠি যদি মেশিনে ঢোকার আগমুহূর্তেও সে পেয়ে যায়, তবে সে অর্থাৎ আমি আর খুন করার সিদ্ধান্ত নেব না। আর আমি আবার আমার যুগে পৌঁছে যাব। সুতরাং, চিঠি লিখতে বসলাম। এখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আরও লেখোর ইচ্ছা ছিল, কিন্তু হাত দুটি কেমন অবশ অবশ হয়ে আসছে। ভাবছি আজ আর লিখব না। মাথায় হঠাৎ প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে, ভীষণ ব্যথা, ভীষণ....আমি আর

চিঠিটা এটুকুই। শেষ লাইনটা অসম্পূর্ণ। লেখেনি...কিংবা লিখতে পারেনি।

লেখক: এসএসসি পরীক্ষার্থী, সোনাইমুড়ী আইডিয়াল স্কুল, নোয়াখালী