
পত্রিকায় আমাকে নিয়ে খবর ছাপা হয়েছে। পত্রিকার খবর হতে হলে নিশ্চয়ই খুব আহামরি ঘটনা হতে হয়, কিন্তু ছাপানো খবরটা আমার মতে তেমন কিছু নয়। প্রকাশিত খবরের পেছনের গল্পটা বরং বেশ হইচই ফেলে দেওয়ার মতো। যে গল্পটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই, বিশ্বাসযোগ্য করার মতো ব্যাখ্যাও আমার জানা নেই। আমি বরং সেই গল্পটাই বলি, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের হিসাব পরে হবে। ওহ্ হ্যঁা, পত্রিকায় ছাপানো খবরটাও বলব। এই গল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ সেটা।
আর দশটা সকালের মতোই সেদিন ঘুম ঘুম চোখে তৈরি হচ্ছিলাম স্কুলে যাওয়ার জন্য। আমি নাইনে পড়ি, বেশ স্বনামধন্য একটা প্রতিষ্ঠানে। যখন জেএসসির রেজাল্ট বের হলো আব্বু-আম্মু আমাকে নিয়ে বেশ মুশকিলে পড়ে গেলেন। আমি ভালোও করিনি, খারাপও করিনি। মোটামুটি একটা রেজাল্ট। ক্লাসে যারা খুব ভালো বা খারাপ করে তাদের অনেক সুবিধা। তাদের দিকে সব শিক্ষকদের নজর থাকে। তাদের মাপমতো বকাবকি করতেও সুবিধা, আবার স্নেহ করতেও। কিন্তু আমার মতো হলেই মুশকিল। আমি নিয়মিত বাড়ির কাজ করি, ক্লাসে চুপচাপ থাকি, অহেতুক দুষ্টুমি করি না। রোজ পড়তে বসি। আমাকে নিয়ে নালিশ করার মতো কোনো ব্যাপার আমার মধ্যে নেই। কিন্তু ফলাফলের সময় দেখা যায় মধ্যম মানের নম্বর। কী কারণে ভালো নম্বর হয় না, সে রহস্যের জট বোধ হয় ফেলুদাও খুলতে পারবেন না। কাজেই আমার রেজাল্ট নিয়ে আব্বু-আম্মু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। আমার মেজ মামা তাঁদের বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। ফোনের ওপাশ থেকে চিত্কার করে বললেন, ‘এ প্লাস হয় নাই? তো আর্টসে দিয়ে দে।’ মানবিকের পড়ালেখা খুব সহজ, খারাপ বা মাঝারি ছাত্রদের তাই পড়তে হবে—এমন অলিখিত নিয়ম কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকে গেছে। সে যাই হোক, অর্থনীতির মজার মজার তত্ত্বের ক্লাস করতে বেশ ভালোই লাগে আমার।
যেটা বলছিলাম, স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। আম্মু বের হওয়ার সময় টিফিন খরচ পকেটে গুঁজে দিয়ে চাপা স্বরে বললেন, ‘আরেকটু সকাল সকাল উঠলেই তো পারিস বাবা। হেঁটে গেলে সকালের হাওয়াটাও গায়ে লাগে, রিকশা ভাড়াটাও বাঁচে।’ আমি কিছু না বলেই বের হলাম। সকালের চিত্রটা কল্পনায় যতটা ভালো মনে হয়, আসলে তেমনটা না। বাড়ি থেকে বের হতেই কাটা রাস্তা। রাস্তার বিভিন্ন অংশ গর্ত করে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা হচ্ছে ছয় মাস ধরে। একটু যেতেই ময়লার স্তূপ। সকালের হাওয়া গায়ে লাগানোর যে কোনো অবস্থা নেই, সেটা আম্মুও জানেন। ভাড়ার বিষয়টা একটা ব্যাপার বটে। আমার ছোট একটা ভাই আছে, সামনের বছর থেকে স্কুলে পড়বে। আর সে কথাটা আম্মু প্রায়ই আমাকে মনে করিয়ে দেন। কিছু কিনতে চাইলেই আম্মু বলবেন, ‘সামনের বছর তোর ভাইকে স্কুলে দিতে হবে। ভালো স্কুলে না পড়ালে ভালো ক্যারিয়ার হবে না। যা আয়, তাতে বুঝে খরচ না করলে উপায় আছে?’ আমি চুপ করে শুনি। আমার ক্লাসের সবাই কমবেশি ধনী। ওরা ক্লাস বা কোচিং শেষেই এখানে-সেখানে খেতে যায়। আমি বেশির ভাগ সময়ই যাই না। আবার ওদের না করাটাও বেশ মুশকিল। আমি মাঝে মাঝে ভাবি সোজাসাপ্টা বলি, আমাকে অত টাকা হাতখরচ দেওয়া হয় না। কিন্তু সেটা বলা যায় না। এই যেমন তূর্য সেদিন বলল, ‘তোরা মুভি দেখতে যা, আমার কাছে টাকা নাই।’ সবাই তখন হো হো করে হেসে উঠল। যাদের অনেক পয়সা আছে, তাদের টাকা নেই বলে দেওয়াটা বেশ ভালো ঠাট্টা। কিন্তু সত্যি না থাকলে সেটা বলা যায় না। কাজেই আমি চেষ্টা করি হেঁটে হেঁটেই স্কুলে যেতে।
কেউ যদি ভেবে বসো, আমি খুব দুঃখ নিয়ে কথাগুলো বলছি, তবে সেটা বেশ ভুল। হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাওয়া-আসার পথে আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চারপাশটা দেখি। দেয়ালে লেখা ভুল বানানের বিজ্ঞাপন, মানুষের অফিস যাওয়ার বা বাসায় ফেরার ব্যস্ততা, স্কুলের সামনে ভেলপুরি মামার নিপুণ হাতে এক প্লেটের পর আরেক প্লেট ভেলপুরি বানানো সব। একই রুটিনে প্রতিদিন চলতে কি তাদের ভালো লাগে? আর পৃথিবীর সব ভিক্ষুকের ভিক্ষা চাওয়ার গানগুলো একই সুরের হয় কীভাবে? আমি ভাবতে ভাবতে চলি। মাঝে মাঝে স্কুল থেকে ফেরার পথে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে ফিরি। গল্পের বই পড়তে আমার বেশ লাগে। একটা জগতের মধ্যেই অনেক রকম জগৎ থাকতে পারে, গল্পের বই না পড়লে সেই অদ্ভুত বিশ্বাসটা মস্তিষ্ক নামক ল্যাবরেটরিতে তৈরি হতো না হয়তো।
এমনভাবেই চলতে পারত। কিন্তু সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথেই বিষয়টা লক্ষ করলাম। স্কুলে যাওয়ার সময় গর্তময় রাস্তা আর ময়লার স্তূপের রাস্তার কথা বলেছিলাম। একটা রাস্তার কথা বলা হয়নি। একটু বেশি অলিগলি দিয়ে গেলে সারি সারি গাছে ঢাকা একটা রাস্তা পড়ে। আব্বু বছর দুয়েক আগে এই রাস্তা দিয়ে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। রাস্তাটা চেনার পর আমি প্রায়ই এই রাস্তা দিয়ে স্কুলে যাই। যদিও সময় বেশি লাগে বলে যাই না রোজ। গাছগুলোর নামও জানি না। কিন্তু ভিড়-কোলাহলের বাইরে, গাছে ঢাকা রাস্তাটা অদ্ভুত প্রশান্তি তৈরি করে মনে। মাঝে মাঝে গাছের ফাঁকে ফাঁকে একটুখানি নীল আকাশ দেখা যায়, সেটা এক অপূর্ব দৃশ্য। কে বলবে রাস্তাটা পেরোলেই আবার নীল আকাশে কটকটে সূর্যের রাজত্ব শুরু হবে?
স্কুল থেকে ফেরার পথে সেই রাস্তাটা ধরে ফিরছিলাম, হঠাৎ লক্ষ করলাম ভুল গলিতে এসে পড়েছি। কটকটে সূর্যটা মাথার ওপর, মাথা ঘামে ভিজে একাকার। আমি ভারী ব্যাগটা কাঁধে নিয়েই এদিক-ওদিক খুঁজলাম। নাহ্, রাস্তাটা কোথাও নেই! একটা রাস্তা নিশ্চয়ই দুম করে গায়েব হয়ে যেতে পারে না?
রহস্যটার সমাধান হলো মিনিট দশেক পরে। রাস্তা ঠিক জায়গাতেই আছে, শুধু গাছগুলো নেই। সবগুলো গাছ কেটে ফেলেছে! এর চেয়ে রাস্তাটা গায়েব হওয়াই ভালো ছিল। আমি অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করলাম। বাবা বলেছিলেন, গাছগুলোর বয়স এক শর কাছাকাছি হবে। এমন গাছগুলো কেটে ফেলল? মনে হলো, একঘেয়ে জীবনের শেষ
প্রশান্তিটুকুও নেই হয়ে গেল।
বাসায় ফিরলাম গোমড়া মুখ করে। আম্মু একটু পরই টের পেলেন কিছু একটা অস্বাভাবিক। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম আম্মুকে বলে লাভ নেই। দুনিয়ায় অনেক রকম সমস্যা আছে, সেখানে আমি গাছ কেটে ফেলায় কেন এত কষ্ট পাচ্ছি, সেটা আম্মুকে বোঝানো সম্ভব হবে না। কিংবা কাউকে বোঝানোই সম্ভব হবে না। তবু আম্মুর জোরাজুরিতে আমাকে বলতে হলো। ঘটনা শুনে আম্মুর কপালের দুশ্চিন্তা রেখাটুকু স্বাভাবিক হয়ে এল। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন ভঙ্গিতে বললেন, ‘কাউকে নালিশ করবি? দেশের সবচেয়ে গণ্যমান্য মানুষটাকে?’ আমি স্পষ্ট বিদ্রূপ দেখতে পাচ্ছিলাম আম্মুর মুখে। বাধ্য হয়ে নিজের রুমে এসে রুমটা বন্ধ করে দিলাম। সবাই এক রকম। কারোরই বোঝার কথা নয়।
মন স্থির করতে একটা গল্পের বই নিলাম। আচ্ছা, সত্যি একটা চিঠি লিখলে কেমন হয়?
সপ্তাহখানেক পর একটা চিঠি এল আমার নামে। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন পাঠিয়েছেন। গাছ নিয়ে আমার সুন্দর ভাবনা দেখে তিনি মুগ্ধ। গাছগুলো কেটে ফেলায় দুঃখও প্রকাশ করেছেন। আমাদের এলাকার বেশ কয়েকটা রাস্তায় সারি সারি গাছ লাগানোর কথাও চিঠিতে জানিয়েছেন। পত্রিকায় ছাপানো খবরটা এতটুকুই।
একটা অংশ বলা হয়নি। আম্মুর ওপর রাগ করে সেদিন রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করলাম। গল্পের বইটা হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলাম চিঠিটা লিখব কি না। একটু পর নজর পড়ল পড়ার টেবিলের দিকে। থমকে রইলাম কয়েক মুহূর্ত। দেখলাম, সেখানে কেউ একজন বসে কিছু একটা লিখছে। মাথা নিচু করে এক মনে লিখে যাচ্ছে। একটু পর লেখাটা শেষ করে মুখ তুলল। আমি স্পষ্ট চেহারাটা দেখতে পেলাম। অন্য কেউ না, স্বয়ং আমি!
তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গিয়েছিলাম রুম থেকে। আম্মুর রুমে গিয়ে কতক্ষণ বসে ছিলাম খেয়াল নেই। হাতের বইটা শক্ত করে ধরে রেখেই, স্থির হয়ে। কে ছিল? আম্মু যখন রুমে ঢুকলেন আমাকে অমন করে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এখনো মন খারাপ কি না। আমি কথা না বাড়িয়ে আবার নিজের রুমে চলে এলাম। কেউ পড়ার টেবিলের কাছে বসে নেই। ভুল দেখেছিলাম। পরীক্ষার খাতায় একটা কঠিন অঙ্ক মিলে গেলে যেমন স্বস্তি হয়, ঠিক তেমন শান্তি পেলাম। হাত থেকে বইটা টেবিলে রাখলাম। ক্লান্ত লাগছিল, চেয়ারটাতে বসলাম। হুট করে মনে হলো, কিছু একটা চোখ এড়িয়ে গেল। আবার বইটার দিকে তাকালাম। বইয়ের নামটা উল্টো করে লেখা। পাতা ওল্টাতেই দেখি সবগুলো পাতার অক্ষরগুলোই উল্টো!
সপ্তাহখানেক পর চিঠিটা পাই। কিন্তু আমি শপথ করে বলতে পারি, চিঠিটা আমি লিখিনি। অন্তত এই জগতের আমি নই, নিশ্চিত।
অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক