‘রিহান! এই রিহান!’
‘হ্যাঁ মা!’
তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে জবাব দিল রিহান। এক হাতে ও পুরো চুল মুছছে আরেক হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করছে বিরক্তিভরে। মাকে খুশি করার জন্য শখের চুলগুলো কেটে প্রায় ন্যাড়া করে ফেলেছিল গত মাসে। ভেবেছিল, মা-ও খুশি হবেন, আর চুলও নিশ্চয়ই ১০-২০ দিনের মধ্যেই বড় হয়ে যাবে। কিন্তু দেখা গেল, যেখানে অন্যদের চুল তরতর করে সাপের মতো বড় হয়ে যায়, সেখানে রিহানের চুল সাপ তো দূরে থাক, কেঁচোর সমানও বড় হয়নি। চোখের সামনে চিরুনি–জেল পড়ে থাকলেও সেগুলো চুলে ছোঁয়ানো যাচ্ছে না। এর চেয়ে কষ্টের বিষয় আর কী হতে পারে!
‘এই রিহান, গোসল করতে এতক্ষণ লাগে?’
‘আহা! আম্মু আসছি তো।’
তোয়ালে হাতে নিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে হাঁটা দিল রিহান।
ড্রয়িংরুমে রিহানের মা এক হাতে টমেটো আর আরেক হাতে কিচেন নাইফ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। টমেটোটা ছোট হওয়ায় দূর থেকে শুধু চকচকে কিচেন নাইফটাই দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ এ দৃশ্য দেখে ক্ষণিকের জন্য একটু চমকে গিয়েছিল রিহান। একটু কাছে আসতেই টসটসে লাল টমেটো দেখে স্বস্তি পেল সে।
‘বলো আম্মু।’
‘বের হবি এখন?’
‘হ্যাঁ, একটু হাঁটতে বের হব।’
‘আসবি কখন?’
‘এই ৫টা–৬টা বাজবে।’
‘তাহলে আসার সময় এক ডজন ডিম, দুই হালি লেবু আর এক পোয়া মসুর ডাল নিয়ে আসবি।’
রিহান বিরসভাবে মাথা নেড়ে বলল, ‘আচ্ছা।’
‘মনে রাখতে পারবি, না লিখে দেব?’
রিহান তোয়ালে রেখে জুতা পরতে পরতে উত্তর দিল,
‘লাগবে না।’
জুতা পরা শেষ হতেই আম্মুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে বের হলো সে। আপাতত তার কোনো কাজ নেই হাঁটা ছাড়া। আর এই দুপুরের শেষে হাঁটার উপযুক্ত জায়গা হলো রমনা পার্ক। তাই সেদিকেই হাঁটতে শুরু করল। দুপুরবেলার রমনা পার্ক খুবই শান্ত। অল্প কয়েকজন টোকাই আর চা কিংবা বাদামওয়ালা ছাড়া মানুষ তেমন নেই। একটা বড় গাছ খুঁজে তার নিচে গিয়ে বসে পড়ল রিহান।
বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এক পিচ্চি বাদামের টুকরি নিয়ে তার সামনে এসে গম্ভীর গলায় বলল,
‘বাদাম লাগব?’
রিহান হাসিমুখে উত্তর দিল,
‘দাও ১০ টাকার।’
ছোট্ট একটা ঠোঙায় বাদাম ভরতে শুরু করল ছেলেটা। ওকে দেওয়ার জন্য টাকা বের করতে পকেটে হাত দিল রিহান। টের পেল, পকেটে টাকা ছাড়াও কী যেন একটা আছে, অনেকটা কাগজের মতো। বের করে এনে দেখতে পেল লাল রঙের একটা কাগজ। অনেকটা চিঠির মতো ভাঁজ করা। দেখে বেশ অবাক হয়ে ভাবল, কিসের কাগজ এটা?
‘ভাইজান, নেন।’
ছোট্ট ছেলেটার ডাক শুনে চিরকুট থেকে চোখ সরাল ও। দেখতে পেল ছেলেটা বাদামের ঠোঙা তার দিকে ধরে আছে।
‘ও আচ্ছা, এক সেকেন্ড দাঁড়াও।’ বলে রিহান পকেট থেকে টাকা বের করে ছেলেটার হাতে দিল।
এরপর আবার চোখ দিল চিরকুটটার দিকে। একটু উল্টেপাল্টে বিড়বিড় করে বলল, ‘কোথা থেকে এল এটা?’ বলতে বলতেই খুলে ফেলল চিরকুটটা। মুক্তার মতো ঝরঝরে অক্ষরে গাঢ় রঙের কালিতে চিরকুটটায় লেখা,
‘তুমি যা চাও, তা নিচে লিখতে পারো, কিছুক্ষণের মধ্যে তা তোমার কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।’
লেখাটা পড়েই হাসতে শুরু করল রিহান। এমন মজার জিনিস অনেক দিন দেখেনি ও। যা চাইব তা-ই? বিষয়টা কল্পনা করেই তো হাসি পায়। এমন মজাও কেউ করতে পারে? দ্রুত পকেটে হাত দিয়ে কলম বের করল রিহান। তারপর হাঁটুতে চিরকুটটা রেখে ভাবতে লাগল কী লিখবে। এক ডজন ডিমের কথাই প্রথম মাথায় এল রিহানের। মায়ের বলা বাকি দুটো জিনিসের নামও লিখত, তবে মনে না পড়ায় লিখতে পারল না। এরপর বাকি জিনিস দুটোর নাম আর পকেটে থাকা চিরকুটটার কথা ভাবতে ভাবতেই গাছে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে।
.................
‘বিষয়টা কী হলো?’
‘হ্যাঁ! আমিও ঠিক বুঝলাম না।’
‘ও তো অন্য কিছুও চাইতে পারত, তাই না?’
‘হ্যাঁ তা তো অবশ্যই পারত। ডেটাবেইস রেজাল্ট অনুযায়ী পৃথিবীর মানুষ যথেষ্ট লোভী আর ধ্বংসাত্মক। রেজাল্ট দেখাচ্ছে ৮০ ভাগ সম্ভাবনা ছিল ও হীরা কিংবা স্বর্ণ চাইবে বিপুল পরিমাণে।’
‘হীরা আবার কী?’
‘ওটা পৃথিবীর অন্যতম দামি খনিজ। গ্রাফাইটের পরিবর্তিত রূপ।’
‘আশ্চর্য! কয়লা এখানে এত মূল্যবান?’
‘হুম। পৃথিবীর মানুষ খুব অদ্ভুত। অথচ এখানে প্লাস্টিকের অভাব নেই।’
‘কী বলো! প্লাস্টিক? এ তো দুর্লভ জিনিস? পুরো গ্যালাক্সিতেই তো এর অস্তিত্ব নেই।’
‘হ্যাঁ! আর ২০ ভাগ সম্ভাবনা ছিল ও নিউক্লিয়ার মিসাইল বা অস্ত্রশস্ত্র চাইবে।’
‘কিন্তু তা তো ও চায়নি। তার মানে বুঝলে? পৃথিবীর মানুষ মোটেও ধ্বংসাত্মক না। লোভী তো মোটেও না। এক ডজন ডিমের আর্থিক মূল্য আর এমন কী। আমাদের সিসিন গ্রহে তো এক ডজন ডিম ১ শিনল দিয়েই পাওয়া যায়।’
‘তাহলে এই শতকে পৃথিবীর মানুষ বিষয়ে ইন্টারগ্যালাক্টিক রিপোর্টে যথেষ্ট পরিবর্তন আসবে, তাই না?’
‘হ্যাঁ! অবশ্যই। দেখতে পাচ্ছ, কত ভুল জানতাম আমরা? ভাবতাম, এই গ্রহের মানুষ যখন-তখন যুদ্ধ শুরু করে। এখন দেখছি সব ভুল।’
‘তাহলে চলো পৃথিবী থেকে বের হই। ইন্টারগ্যালাক্টিক রিপোর্ট আজই জমা দিতে হবে। এবার মনে হচ্ছে গ্যালাক্টিক কমিটি এই গ্রহের মানুষদের জন্য মহাবিশ্বের প্রাথমিক জ্ঞানগুলো উন্মুক্ত করে দেবে। এরা যথেষ্ট শুধরে গেছে।’
‘তাই তো মনে হচ্ছে। তবে যাওয়ার আগে ওকে এক ডজন ডিম দিয়ে যাই। কিসের ডিম দেব তা তো লেখেনি। উটপাখির ডিম দিই? দেখতে পাচ্ছি এই গ্রহে এদের ডিম বড় হয়, ছেলেটা খুশি হবে।’
‘না। এতগুলো ডিমের ভার ছেলেটা নিতে পারবে না, কষ্ট হবে। তুমি বরং এদের পরিচিত মুরগির ডিমই দাও।’
‘আচ্ছা তা-ই দিই।’
.................
ইন্টারগ্যালাক্টিক কমিটি থেকে আসা প্রাণীগুলো যখন পৃথিবী ত্যাগ করল, তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রিহানেরও ঘুম ভেঙেছে, উঠেই আশপাশে তাকাল সে। পাগলামি হলেও তার মনে হয়েছিল এক ডজন ডিম ওর পাশে রাখা থাকবে। আশপাশে কিছু না পেয়ে নিজের বোকামির কথা ভেবে ও নিজেই হাসল একবার। উঠে দাঁড়ানোর সময় নজর পড়ল মাটিতে পড়ে থাকা চিরকুটের দিকে। ওটাকে দেখে আরেক দফা হেসে হাঁটা ধরল বাড়ির দিকে। ঘুম ঘুম চোখে হাঁটার সময় ও খেয়ালই করল না যে একটু দূরে চুরি করে আনা এক ডজন ডিমের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে তুমুল মারামারি চলছে চারজন টোকাইয়ের মধ্যে। এরই মধ্যে নাকও ভেঙে গেছে দুজনের।