চোখ

অলংকরণ : সব্যসাচী মিস্ত্রী

মানুষ সিঁড়ি ভেঙে ছাদে ওঠে। আমাদের বাসার ব্যাপারটা উল্টো। সিঁড়ি দিয়ে ছাদে নামতে হয়। সেই সিঁড়ির মাত্র দুটো ধাপ। দুই ধাপ সিঁড়ি ভেঙে নামার পর পাওয়া যায় ছোট্ট একচিলতে ছাদ। রীতিমতো গুপ্ত ছাদ, চারপাশে টিনের দোচালা ঘর আর গাছপালা থাকায় বাইরে থেকে চোখে পড়ে না। আমাদের বাড়িটা দোতলা। ছাদে নামার দরজাটা আমার ঘরে। আসলে আমার না, আমার আর আপুর ঘর। আপু ছাদের ব্যাপারে তেমন আগ্রহী না। তাই ছাদটা বলতে গেলে আমারই। খুব উৎসাহ নিয়ে ছাদটা সাজিয়েছিলাম আমি। অনেক গাছ ছিল টবে। গরম আসতেই ন্যাড়া হয়ে গেল সব কটি টব। শুধু একটা ঘাসফুলের টব বাড়তে থাকল একা একা। আগের বর্ষায় লাগানো একটা আধমরা নীল অপরাজিতাগাছ বাড়তে শুরু করেছে। ফুলও ফুটেছে দুটো। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হওয়ায় চারপাশ হলুদ হয়ে আছে, জন্ডিস রোগীর চোখের মতো। বৃষ্টি হয়ে এত দিনের ধুলা পড়া গাছের পাতা, টিনের চাল পরিষ্কার হয়ে গেছে সব। ছাদের পাশেই একটা কলাবাগান।

কলাবাগান না বলে বলা যায় কলাজঙ্গল। জঙ্গলের মালিক গাছ লাগিয়ে আর কোনো খোঁজখবর রাখেন না। গাছের কলা গাছেই পচে। অবশ্য এ কলাজঙ্গলের সুবাদে অনেক পাখি আসতে শুরু করেছে আমার ঘরের পাশে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ লক্ষ করলাম, গাছগুলোর আড়ালে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এই স্যাঁতসেঁতে ঘিঞ্জির মধ্যে ঢোকার সাহস হলো কার! আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল সে। আমি লক্ষ করতেই দুই হাতে চোখ ঢেকে পালিয়ে গেল। কী অদ্ভুত সেই হাত দুটো, একদম হাড্ডিসার। ফ্যাকাশে সবুজ রং, নোংরা—যেন ভেজা মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল অনেক দিন।

তারপর থেকে ছাদে গেলে কলাগাছের ওই জঙ্গলের দিকেই তাকিয়ে থাকি আমি। শুধু সেই মানুষটাকে আবার দেখার জন্য। সেদিন তাকে শুধু দেখেছি, তার হাত দুটো ছাড়া আর কিছুই খেয়াল করিনি। সে কি ছেলে না মেয়ে, পোশাক কেমন ছিল, বয়স কত, কিচ্ছু না। একটা জলজ্যান্ত মানুষকে দেখলাম, অথচ তার কিছুই মনে করতে পারছি না। বেশ কিছুদিন পর আবার ঘটল একই ঘটনা। হঠাৎ করেই তাকে দেখলাম গাছের ফাঁকে। আমি তাকাতেই সে দুহাতে চোখ আড়াল করে লুকিয়ে পড়ল, ঠিক আগের মতো। কিন্তু এবারও স্যাঁতসেঁতে ফ্যাকাশে দুটো হাত ছাড়া কিছুই মনে রাখতে পারলাম না আমি। আমার ‘কলাজঙ্গল দর্শন’ তাই অব্যাহত থাকল। তবে আগের চেয়ে বেড়ে গেল ছাদে আমার যাতায়াত। এমনকি রাতেও ছাদে বসে থাকা শুরু করলাম আমি। তার দেখাও পেলাম আরও কয়েকবার। কিন্তু প্রতিবারই ঘটল একই ঘটনা। তবে কয়েক মাসের চেষ্টায় তার কিছুটা লক্ষ করতে পেরেছি আমি। প্রথমে মনে হয়েছিল সে থুরথুরে বুড়ি। আসলে তার পিঠের ওপর সাদা চুলের গোছাটা দেখে কখনো মনে হতো বুড়ো মানুষের বাবরি। আবার কখনো মনে হতো সেটা বৃদ্ধার বয়সের সঙ্গে শেষ হয়ে আসা পাকা চুল। তবে দিনের চেয়ে রাতে তাকে বেশি দেখা যায়। তাই প্রতি রাতেই ছাদে যেতাম। দিনে ব্যাপারটা খুব বিরক্তিকর মনে হতো। আর রাতে মনে হতো, এর চেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস বুঝি আর নেই। স্বপ্নেও একই ব্যাপার দেখতাম আমি। এমনকি একপর্যায়ে স্বপ্ন আর বাস্তবকে আলাদা করতেও বেশ কষ্ট হতো আমার। তবে তখনো তার চোখ দেখতে পাইনি আমি। ব্যাপারটা সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য, সেটাও একটা প্রশ্ন।

এর মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো আপু। ছাদের সঙ্গের ঘরটা এখন আমার। তবে হল থেকে বাসায় এলেই অতিরিক্ত ছাদে যাওয়া নিয়ে বকাবকি শুরু করে আপু। একদিন তো বলেই বসল, আমি নাকি ঘুমের ভেতর ছাদে গিয়ে বসে থাকি। শুনে খুব বিরক্ত হলাম আমি। আপুকে এখন অসহ্য লাগে।

তবে আম্মু কেন যেন ইদানীং খুব যত্ন নেয় আমার। আমি নাকি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি, চোখের নিচে পান্ডার মতো কালো হয়ে গেছে। আপু হল থেকে এসে আমার চেহারা দেখে বলল, আমার চোখ বুড়ো মানুষের মতো। আমি নাকি রাতে ঘুমাই না, তাই এমন হয়েছে। আয়নায় নিজের চোখ দেখে মনে হলো আপুর কথা মিথ্যা না, আমার চোখ বরং মৃত মানুষের চোখের মতো নিষ্প্রাণ।

আপুর চোখের দিকে তাকালাম। কী সতেজ চোখ দুটো! আমার বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগল। কষ্ট পাওয়ার মতো তেমন কিছুই হয়নি, অথচ খুব কান্না পেল। সেদিন আমি আর কারও সঙ্গে কথা বলিনি। ছাদে রোদের ভেতর বসে কেঁদেছিলাম অনেকক্ষণ।

সেবার আপু চলে যাওয়ার পর একটা ঘটনা ঘটে গেল। ঘুমের মাঝে নিজেকে ছাদে খুঁজে পেলাম, তাকিয়েছিলাম কলাবাগানের দিকে। হঠাৎ করেই গাছের আড়ালে উদয় হলো সেই বৃদ্ধ অথবা বৃদ্ধা। এ পর্যন্ত সবই আমার কাছে স্বাভাবিক ঘটনা, প্রতি রাতেই হয়। কিন্তু আজ আমাকে দেখে চোখ ঢেকে পালাল না সে। আমি তার চোখ দেখলাম। মনে হলো আমি নিজের চোখই দেখছি। সেই মৃত মানুষের মতো নিষ্প্রাণ চোখ, কোনো ভাষা নেই।

হঠাৎ আপু আমার কাছে এসে বসল। আমি নিশ্চিত হলাম স্বপ্ন দেখছি, কারণ আপু বাসায় নেই। কেন জানি আপু আসতেই হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেললাম আমি। আপু জোর করে হাত সরিয়ে আমার চোখ দেখতেই আতঙ্কে চিৎকার বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে। আমি প্রচণ্ড আক্রোশে নিজের বুড়ো আঙুল দুটো আপুর ভয়ার্ত চোখের ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম। আমার হাত ছিল ফ্যাকাশে সবুজ। সেই বিশ্রী হাত দিয়ে আঙুরের মতো করে আপুর চোখ দুটো গেলে দিলাম আমি। কোটরের ভেতর দিয়ে রক্ত, অশ্রু আর থকথকে স্বচ্ছ একটা জিনিস বেরিয়ে এল। আপুর আতঙ্কের চিৎকারটা রূপ নিল ব্যথার চিৎকারে। এত তীক্ষ্ণ চিৎকারে স্বপ্ন ও ঘুম দুটোই ভেঙে যাওয়ার কথা। কিন্তু শুধু আমার স্বপ্নটা ভেঙে গেল, ঘুম ভাঙল না।

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরই আম্মু আমাকে ধরে বিলাপ করে যা বলল তাতে বুঝলাম, আপুর চোখ হঠাৎ করেই কোনো কারণ ছাড়া নষ্ট হয়ে গেছে। সে আর কোনো দিন কিচ্ছু দেখতে পাবে না। শুধু মৃত মানুষের মতো শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। বাবা তাকে হল থেকে আনতে গেছে।

হাত-মুখ ধুতে বাথরুমে গেলাম আমি। আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার সেই মৃতের মতো চোখ আর নেই। সেখানে অন্য কারও চোখ। সেই চোখ আমার অতি পরিচিত। কী সতেজ সেই চোখ দুটো!

লেখক : শিক্ষার্থী, দশম শ্রেণি, আর ডি এ ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বগুড়া