চোর দেখার ফাঁদ

বিল্টুর শখ সে চোর দেখবে। এ জন্য সে ফাঁদ পাতে। কিন্তু চোর ধরতে গিয়ে ঘটে যায় বিপত্তি। পড়ো জিয়া হাশানের গল্প চোর দেখার ফাঁদ।

গল্প : চোর দেখার ফাঁদঅলংকরণ: মাসুক হেলাল

বিল্টু চোর দেখার ফাঁদ পাতে। জানালার কাছে একটা কড়কড়ে নতুন পঞ্চাশ টাকার নোট রাখে। তারপর ঘরের অন্য সব দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়। তাতে পুরো ঘরটা অন্ধকারের আবাস হয়ে ওঠে। বাইরে থেকে তার ভেতরের অবয়ব আর দেখা যায় না। ব্যস, তখন তার এক কোণে বিল্টু নিজে ঘাপটি মেরে থেকে সতর্ক চোখ বিছিয়ে রাখে জানালায়। যাতে বাইরের কেউ নোটটায় হাত দিলে, চুরি করে নিয়ে গেলে তাকে ভালো করে দেখে নিতে পারে।

জগতের সবাই চোর ধরতে চায় কিন্তু বিল্টু চায় কেবল দেখতে। তাদের চেহারাসুরত কেমন, হাবভাব কী রকম এবং মুখজুড়ে কী ধরনের খেলা খেলে বেড়ায়—এসব। কারণ, ওর বন্ধুরা সবাই চোর দেখেছে। অন্তত গল্প করার সময় তা-ই মনে হয়। কিন্তু বিল্টুর এত বয়স হলো, চার থেকে পাঁচের ক্লাসে পা দিল, তারপরও আজ অবধি একটা চোরও দেখেনি। তাই সবাই যখন গল্প করে, লম্বা লম্বা কাহিনি ফাঁদে, কখনো কখনো বীরত্ব ফলায়, বিল্টু তখন চুপচাপ বসে থাকে। বোকা বোকা চেহারা নিয়ে কেবল শুনে যায়। বলার মতো তার কিছুই থাকে না।

তাই গলির ভেতরে নিচতলার বাসার জানালায় আজ বিল্টুর গোলাপি-সাদা নোটটা রাখা। চোর দেখার ফাঁদটা পাতা। তাতে যদি তার পঞ্চাশ টাকা মার খায়, চোর নিয়ে হাওয়া হয়ে যায়, তাতে বিল্টুর কোনো আফসোস নেই। বরং সবার সামনে বুক ফুলিয়ে চোর দেখার তরতাজা গল্প করতে পারবে, তাতেই পঞ্চাশ কেন একেবারে পাঁচ শ টাকা উশুল হয়ে যাবে। তাই সে উত্সুক চোখে জানালায় চোখ রাখে—অপেক্ষায় থাকে কখন চোর আসে, টাকাটা হাতে নেয়।

চোর দেখার সবচেয়ে দুঃসাহসী গল্পটা সাজুর। তাই সুযোগ পেলেই ফেঁদে বসে। শুনতে শুনতে বিল্টুর মুখস্থ হয়ে গেছে—একবার সাজুদের গ্রামের বাড়ির ঘরে সিঁদ কেটে চোর ঢোকে। সবাই তখন ঘুমিয়ে। সাজুও দাদুর সঙ্গে এক বিছানায়। কিন্তু তার ঘুম ঘুড়ি বানানোর রঙিন কাগজের মতো পাতলা। একটুতেই ভেঙে যায়। তাই ঘরের ভেতরে খুটখাট দু-একটা শব্দ হতেই দাদু চোখ মেলে। অন্ধকারেও ঠাহর করতে পারে—ঘরের ভেতরে কী যেন নড়াচড়া করছে। সাজুকে ধাক্কা দিয়ে জাগায়। তবে মুখ খুলতে গেলে তাতে হাত চাপা দেয়। দুজনে চুপচাপ ঘাপটি মেরে থাকে। তারপর চোরটা যে-ই খাটের কাছে আসে, অমনি তার হাত জাপটে ধরে ‘চোর’, ‘চোর’ বলে চিত্কার জুড়ে দেয় দাদু। সাজু পট করে লাইট জ্বালিয়ে দেখে—দাদুর হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য চোর ফাঁদে আটকা পড়া পাখির মতো গা-গতর মোচড়ায়। কিন্তু দাদুর লোহার মতো শক্ত হাতের মুঠি থেকে একটুও ছাড় পায় না। এ সুযোগে বাবা-চাচারা এসে তারে হাতেনাতে পাকড়াও করে ফেলে। সাজু তখন মনের আশ মিটিয়ে জলজ্যান্ত চোর দেখে নেয়।

গল্পের শেষ মাথায় হাজির হলে জিতু জিজ্ঞেস করে—তুই ভয় পাসনি?

—ভয় পাব কেন? দাদু সঙ্গে ছিল না? সে তো খুব সাহসী। একসময় সুন্দরবনের বাঘের সঙ্গে লড়াই করেছে বলে চাচাদের মুখে শুনেছি।

—চোরটা দেখতে কেমন ছিল রে?

—ইয়া লম্বা চুল। মুখজুড়ে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তবে শরীরে তেমন জোর ছিল না। রোগা-পাতলা তো। মনে হয় দু-চার দিন কিছু খায়নি। তাই তো দাদুর মতো বুড়ো মানুষের হাত ছাড়িয়ে পালাতে পারেনি।

সাজুর এমন দুঃসাহসিকতার তুলনায় ফিরুর চোর দেখার গল্পটা একেবারে সাদামাটা—ও একবার মফস্বলে খালার বাড়িতে বেড়াতে যায়। একদিন শোনে সামনের রাস্তায় হইচই। ঘর থেকে বের হয়ে দেখে—ন্যাড়া মাথার এক লোক হেঁটে যায় আর তার পিছু পিছু একদল ছেলে চেঁচায়। কিছুক্ষণ পরপর লোকটা পেছন ফিরে ধমকায়, ‘যা ভাগ। দুষ্টু পোলাপানের দল সব।’ তাতে ছেলের দলের চেঁচানিতে ঘি পড়ে। উত্সাহ বেড়ে যায়। তারা আরও উঁচু স্বর তোলে। খালাতো ভাই আলিফ জানায়, লোকটা চোর। চুরি করে ধরা পড়ায় মাথা ন্যাড়া করে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

ফিরু তখন দুই কদম এগিয়ে ভালো করে দেখে নেয়। কিন্তু লোকটার মুখ-চোখের কোথাও কোনো বিশেষত্ব খুঁজে পায় না। সাধারণ মানুষের মতোই তার চেহারাসুরত। তাই ফিরু হতাশ হয়ে পড়ে। গল্পটা আর বলতে চায় না। জোরাজুরি করলে দু-এক বাক্যে শেষ করে দেয়।

কিন্তু বিল্টু রসিয়ে রসিয়ে বলবে। আজ ফাঁদে যে ধরা পড়বে তার আর রক্ষা নেই। তার আগাগোড়া সব সবাইকে বলে দেবে। কিন্তু কই! কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না। কেউ তো পঞ্চাশ টাকার নোটটা ছুঁয়েও দেখেনি। জানালার ওপর যেমনি রেখে ছিল, তেমনি নির্বিঘ্নে শুয়ে আছে।

বিল্টুদের বাসার সামনের গলিটা অন্ধ। কিছুদূর হেঁটে গিয়ে মুখ বন্ধ করে ফেলা। তাই লোকজনের যাতায়াত কম। দিনেদুপুরেও একেবারে নিরিবিলি। সুতরাং এখানে তো চোরদের দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে আসার কথা। কিন্তু সকাল থেকে অনেকটা সময় হজম হয়ে গেছে, এখনো একজনেরও দেখা পাওয়া যায়নি। তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কেননা আজ স্কুল ছুটি। তাই বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রস্তুতি নিয়ে তবেই বিল্টুর চোর দেখার খেলায় নামা।

এই যে আসছে। হ্যাঁ, তাই। এক লোক জানালার দিকে এগিয়ে আসছে। বিল্টু সঙ্গে সঙ্গে চোখ টানটান করে ধরে রাখে। তাতে পলক ফালানো বন্ধ করে দেয়। দেখে, লোকটার হাতে লাঠি। আর কাঁধ থেকে ঝোলানো কাপড়ের ময়লা ঝোলা। মনে হয় ভিক্ষুক। তাতে কী, ভিক্ষুকেরাও তো চোর হয়। আবার চোরেরাও তো অনেক সময় ভিক্ষুকের বেশ ধরে আসে। তারপর হাতের কাছে যা পায় চুরি করে নিয়ে যায়। বিল্টু তাই সতর্ক হয়। দেখে লোকটা জানালার কাছে এসে গেছে। তার হাতের নাগালে এখন গোলাপি-সাদা রঙে ছাপানো নোটটা। কিন্তু কই! নিচ্ছে না তো। বরং আশপাশে তাকায়। নোটটার ওপরও হয়তো চোখ বোলায়। তারপর জানালা পাস করে বাসার গেটের পানে এগিয়ে যায়।

বিল্টু হতাশায় ভেঙে পড়ে—হায়! দুনিয়ার তাবত লোক দেখি আজ সাধু হয়ে গেছে। হাতের কাছে নোট পেয়েও চুরি করছে না। চোখ বুলিয়ে কেটে পড়ছে। তার চোর দেখার সুযোগকে মাটিচাপা দিয়ে দিচ্ছে।

কিন্তু মিনিট পার হতে না-হতেই গেটের কাছে শোনে ভিক্ষুকের আর্তি—আম্মাগো, অন্ধরে দুইডা ভিক্ষা দেন।

ওহ্! তাহলে লোকটা কানা। চোখে কিছুই দেখতে পায় না। নোটটাও তার নজরে পড়েনি। তাই না নিয়েই পাশ কেটে চলে গেছে। সুতরাং বিল্টুর চোর দেখার সম্ভাবনা এখনো আছে। সে তাই আবার জানালায় সতর্ক চোখ বিছিয়ে রাখে।

এখন মধ্যদুপুর, পাড়ার তাই কোনো বোলচাল নেই। চারদিক একেবারে নীরব-নির্জন। মাঝে মাঝে কেবল দু-একটা রিকশার আসা-যাওয়া। সেগুলোর ঠুংঠাং সুর-স্বরের আওয়াজ বিল্টুর কানে আসে।

আরও কিছুক্ষণ কেটে গেলে দেখে জানালার কাছে ছোট চাচা। সে ঘরের ভেতরের দিকে তাকায়—কাউকে খোঁজে নাকি কেউ দেখে ফেলে কি না তা পরখ করে নেয়। তারপর ছোঁ মেরে পঞ্চাশ টাকার নোটটা নিয়ে চলে যায়।

হায়! বিল্টু কপালে হাত দেয়—ছোট চাচা চোর! চোখের সামনে দিয়ে টাকাটা চুরি করে নিয়ে গেল? অথচ চাচা বড় বড় কথা বলে। সকাল-বিকেল নীতি কথা আওড়ায়। ঝুড়ি ঝুড়ি উপদেশ হাজির করে। অথচ দেখো পঞ্চাশটা টাকার লোভও সামলাতে পারল না। দেখামাত্র পকেটস্থ করে নিয়ে গেল? কিন্তু তার চেহারাসুরত, হাবভাব তো ভালো করে দেখা হলো না। তবে দেখলেই-বা কী লাভ হতো? কাউকে কি বলা যাবে—আমার চাচা চোর? বললেই তো সবাই হইহই করে উঠবে—তোরা চোরের বংশের? তুই চোর-ফ্যামিলির ছেলে? স্কুলে, বন্ধুমহলে এমনকি পাড়ায় ঢিঢি পড়ে যাবে। রাস্তাঘাটে আর মুখ দেখানোর জো থাকবে না।

বিল্টু তাই লজ্জায়-অপমানে দুই হাতে চুল মুঠো করে ধরে মুখ নিচু করে থাকে। জানালার পানে আর তাকায় না। তাকিয়ে লাভ কী? নোটটা তো আর নেই। সুতরাং গেম তো ওভার। খেলা তো শেষ।

তবে কতক্ষণ মাথা নিচু করে ছিল তার হিসাব নেই। একসময় উঁচু করতেই আবার জানালায় চোখ চলে যায়—ওমা! এ কী! নোটটা দেখি আবার হাজির। যেখানে যেমন ছিল তেমনভাবে শোয়া। চোখের সামনে দিয়ে ছোট চাচা নিয়ে গেল। পকেটস্থ করে হাওয়া হলো। তারপর আবার ফিরে এল কীভাবে? এ তো দেখি পুরোটাই ভুতুড়ে কারবার। দিনেদুপুরে তার আজিব খেলা। নাকি সবটাই বিভ্রম? তা পরখ করতে বিল্টু জানালার কাছে ছুটে গিয়ে নোটটা হাতে নেয়—হ্যাঁ, পঞ্চাশ টাকার নোটই বটে। তবে সে যেটা রেখেছিল সেটার মতো কড়কড়ে নতুন নয়। এটার বরং বুক ও পিঠজুড়ে ময়লার দাগ। কিন্তু তা-ইবা আবার এল কীভাবে?

বিল্টু রুম থেকে বের হয়ে ছোট চাচাকে খোঁজে। দেখে ড্রয়িংরুমের সোফায় সে গা এলিয়ে দিয়ে বসা। বিল্টুকে দেখেই জিজ্ঞেস করে—তোর টাকা ঠিকমতো পেয়েছিস?

—কিসের টাকা? বিল্টু অবাক হওয়ার ভান করে।

—ক্যান? সকালে বের হওয়ার সময় দেখি তুই পঞ্চাশ টাকার নোটটা আলগোছে জানালার কাছে রেখে দিচ্ছিস। ফিরে এসে রিকশাভাড়া দিতে গিয়া দেখি ভাংতি নেই। জানালার কাছে দেখি টাকা তেমনি আছে। তাই ঘরের ভেতরে তাকিয়ে তোরে খুঁজি। কিন্তু একেবারে অন্ধকার। বাইরে থেকে ভেতরের কিছুই দেখা যায় না। রিকশাঅলাকে কতক্ষণ আর দাঁড় করিয়ে রাখব। তাই তড়িঘড়ি করে তোর টাকাটা নিয়ে তারে বিদায় করেছি। তারপর বড় নোটটা ভাংতি করে এনে তোর পঞ্চাশ টাকা আবার রেখে দিয়েছি।

যাক বাবা! চোর-ফ্যামিলির ছেলের খেতাব পাওয়া থেকে বাঁচা গেল। বিল্টু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে রুমে ফিরে আসে। তবে আর চোর দেখার ফাঁদ পাতে না। আজকের মতো খেলায় ইতি। কাল আবার দেখা যাবে। তাই পঞ্চাশ টাকার নোটটা পকেটে পুরে খেলতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়।

কিন্তু বাথরুমে ঢুকে আয়নায় নিজের চেহারা দেখে আঁতকে ওঠে—হায়! এ কী তার হাল? চোখ দুটো লালের দখলে। মাথার পুরো চুল উষ্কখুষ্কর কবজায়। এ তো একেবারে চোরের চেহারা। আলিম, হানু ও রাফিরা চোর দেখে যে বিবরণ দিয়েছে তার সঙ্গে হুবহু মিল। সেই ফোলা নাক, কপালে ভাঁজ আর মুখজুড়ে বাঁকাত্যাড়া ভাব। বিল্টু ভয়ে মায়ের কাছে ছুটে যায়। তার দিকে পঞ্চাশ টাকার নোটটা এগিয়ে দেয়—তোমার পার্স থেকে আজ সকালে না বলে কড়কড়ে নোটটা নিয়েছিলাম। এই নাও।