আজ রাকিবের চোখ-মুখ শুকনো। ওর বন্ধুরাও জিজ্ঞেস করছে না ওর কী হয়েছে। আসলে আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগে ওর আদরের ছোট ভাই সাদিক এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। তাই ওদের পড়ার ‘কুল ডুড’ সাদিকের চোখ আজ ছলছল করছে। আসলে ভাই চলে যাওয়ার পর রাকিব একা হয়ে গেলেও ওর বন্ধু ও পরিচিত অন্যদের সামনে এই চাপা কষ্ট সে সচরাচর আসতে দিতে চায় না। তাই সবার কাছে রাকিব হাসিখুশি ও চঞ্চল ছেলে হিসেবে পরিচিত। এই তো সেদিন ওদের ক্লাসের নতুন মেয়েটা রাকিবকে বলল, ‘রাকিব, আমি আসার পর থেকেই সবার মুখে শুধু তোমার প্রশংসাই শুনছি। তুমি নাকি লেখাপড়া, খেলাধুলা সবকিছুতেই চ্যাম্পিয়ন!’
তবে এত জনপ্রিয়তা আর এত বন্ধুর মাঝেও রাকিব খুবই একা। কারণ, নিজের মনের কথাগুলো ভাগাভাগি করার মতো কাউকে সে কোনো দিনও পায়নি। সাদিক বেঁচে থাকতে এমন কাউকে পাওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেনি সে।
কিছুদিন পরের কথা। হোমওয়ার্ক শেষ করে বাস্কেটবল খেলতে নিচে নামল রাকিব। তখন দেখল, অপরিচিত একটি ছেলে মাঠের এক কোনায় বসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রাকিব তখন পাশে দাঁড়ানো রিসাকে জিজ্ঞেস করল—
রিসা, এই ছেলেটা কি পাড়ায় নতুন?
জানি নারে দোস্ত। মনে হয়।
ছেলেটা একটু অন্য রকম না?
কথাটা শুনে রিসা মুখটা একটু বিকৃত করে বলল—
হ্যাঁ, দেখ না চুলগুলো কেমন ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া, চোখের গ্লাসটাও কী মোটা! এতক্ষণ ধরে বসে আছে অথচ আমাদের সঙ্গে একটাও কথা বলল না!
না, দেখ ও কিন্তু অদু্ভত।
দূর, রাকিব তুই বাদ দে, খেলায় মনোযোগ দে।
হুমম...
পরদিন রাতে রাকিব ছাদে একা বসে আছে। এমন সময় পাশের বাসার ছাদে সেই ছেলেটাকে দেখল সে। রাকিবের ইচ্ছে হল ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে। ও বলল—
তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
আ...আ...আমি নাইনে, তুমি?
আমিও।
তোমার হাতে ওটা কী?
এটা একটা নতুন ধরনের টেলিস্কোপ। এটা দিয়ে বহু দূরের জিনিস যেমন দেখা যায়, তেমনি অনেক দূরে বসবাসকারী প্রাণীদের সঙ্গে যোগাযোগও করা যায়।
টেলিস্কোপ দিয়ে যোগাযোগ! এও কি সম্ভব?
হ্যাঁ, কারণ এটাতে একটি বিশেষ ধরনের অপটিক্যাল ফাইবার সংযুক্ত আছে, যার বেগ আলোর বেগের চেয়েও দুই গুণ বেশি। অর্থাৎ সেকেন্ডে প্রায় ৬০ লাখ কিলোমিটার। এর লেন্স দিয়ে যে জায়গা দেখা হবে, সেখানে এ অপটিক্যাল ফাইবারগুলো পৌঁছে যাবে। আর ওই জায়গার চিত্র ধারণ করবে, যা অনেকটা সাধারণ ভিডিওচিত্রের মতো। তাই এ চিত্রের সাহায্যে ছবি দেখা ও শব্দ শোনা, দুই-ই সম্ভব।
হুমম...।
ছেলেটা তখন বলল, আচ্ছা রাকিব, তোমার কত্ত বন্ধু। জানো, আমার না একটাও ভালো বন্ধু নেই।
আমার অনেক বন্ধু আছে, তবে খুব ভালো বন্ধু না।
তাহলে তোমার ভালো বন্ধু কে?
আমার ভাই সাদিক।
কোথায় ও? ওকে তো কখনো দেখি না।
ও তো আর এই পৃথিবীতে নেই, হয়তো অন্য কোথাও আছে।
কথাটি শুনে ছেলেটির মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল। রাকিব অবশ্য তা খেয়াল করল না। ও বলল, তাহলে আমি যাই, কালকে স্কুল আছে।
হুমম...।
প্রায় এক মাস পর একদিন সকালে রাকিব কলবেল শুনে দরজা খুলতেই বুঝতে পারল, ও স্বপ্ন দেখছে। কারণ, দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে সাদিক! রাকিব নিশ্চিত হওয়ার জন্য নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখল। না, ও স্বপ্ন দেখছে না। এটা বাস্তব, কিন্তু কীভাবে সম্ভব! বিস্ময় আর আনন্দ মিলে রাকিবের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম দিল। তখনই সেই ছেলেটি এসে ওকে বলল, দেখো তো সাদিক আগের মতোই আছে কি না?
রাকিব প্রচণ্ড অবাক হয়ে বলল, তুমি? এখানে? এটা কে?
এটা হলো সাদিক, ওর পুরো নাম intelliSadikB37
মানে কী?
আসলে ও হলো সাদিকের মতো দেখতে একটি রহঃবষষরঝধফরশ, আসল সাদিক আর ওর মধ্যে পার্থক্য একটাই। আসল সাদিক ছিল মানুষ আর ও হলো একটি ছোট্ট রোবট।
তারপর, তারপর আর কী, এই ঘটনার পর রাকিবকে আর জোর করে সবার সামনে হাসিখুশি থাকতে হলো না। ১৫ বছরের একটি কিশোরের জীবন যেমন সুন্দর হওয়া উচিত, তার জীবনও তেমনি সুন্দর হয়ে উঠল। নতুন সাদিক আর ওই ছেলেটা (যে পরে তার সত্যিকারের বন্ধু হয়ে গেল) তার জীবনটা আনন্দে ভরে তুলল।