জাদুর কলম
দিন সাতেক আগে আমার মাথায় ভর করে গল্পটা। তারপর থেকে কেবল খোঁচাতে থাকে—লিখে ফেলো আমাকে। কলমে-কাগজে ফুটিয়ে তোলো আমার পুরো চেহারাসুরত। কেননা, এমন অ্যাডভেঞ্চার গল্প আর পাবে না। বান্দরবানের পাহাড়ের খাদে সোনার খনি আবিষ্কারের কাহিনির খোঁজ আর কারও কাছে নেই। তুমি লিখে ফেললেই হইচই পড়ে যাবে। পাঠককুল মাথায় নিয়ে নাচবে তোমাকে, দেখো।
কিন্তু সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা মুখ হাঁ করে দাঁড়ানো। পড়াশোনায় তাকে তুষ্ট করতে না পারলে যেন গিলে খাবে। রেজাল্টের তালিকায় ফার্স্ট, সেকেন্ড এমনকি থার্ডেও হয়তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না আমার নাম। তাই পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়ে গল্পটার সঙ্গে দু-চার দিন বসা, তাকে কাগজে ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব হয়ে ওঠে। ফলে বরফের চাক হয়ে আমার মস্তিষ্কে বসতি গেড়ে বসে সে।
সারাক্ষণ মাথায় এমন ভারী বোঝা কাহাতক আর বয়ে বেড়ানো যায়? আবার কত দিনই বা তাকে বেহুদা বসিয়ে রাখি? শেষে সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে আরও দুই দিন জাতীয় ছুটি পেতেই বসলাম তাকে নিয়ে। যে করেই হোক, এই চার দিনের ছুটিতে লিখে ফেলব গল্পটা। মস্তিষ্কের বরফ গলিয়ে পানি করে দেব। তাতে একদিকে যেমন ভারমুক্ত হয়ে যাব, আরেক দিকে মস্তিষ্কও পয়-পরিষ্কার হয়ে উঠবে। তখন তাতে পরীক্ষার পড়া সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে পারলে আর কথা নাই। এবারের ফাইনালে রাগিবকে হটিয়ে ফার্স্টের আসন দখল করে নিতে আর কোনো বেগ পেতে হবে না।
আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিই, যাতে কেউ টের না পায় যে আমি গল্পের সঙ্গে বসেছি। স্কুলের পড়া বাদ দিয়ে গড়েপিঠে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি তাকে।
কয়েক দিন আগে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে বড় আপু। তাই বাসার কম্পিউটারটা পুরোপুরি চলে গেছে তার দখলে। কম্পিউটার এখন তার ঘরে বন্দী। ফলে কাগজ-কলমই আমার ভরসা। তাতে ভর দিয়ে তবেই আমার গল্প সাজাতে হয়।
দু-চারটা গল্প আগেও লিখেছি। দেশের বড় বড় পত্রিকায় আত্মপ্রকাশ করেছে তারা। ছাপা হয়েছে। ফলে এখন গল্প লেখার জন্য স্কুলের খাতায় আর কুলায় না। বরং দরকার হয় রুলটানা প্যাডের কাগজের। বুকজুড়ে সারি সারি সরলরেখা টানা সেই কাগজে রাজমিস্ত্রির ইট দিয়ে দেয়াল গাঁথার মতো একটার পর একটা বাক্য সাজিয়ে গল্প গড়ে তোলা আমার অভ্যাস। তাই নতুন গল্প লেখার জন্য নতুন একটা প্যাড বের করি। তাকে খুলে টেবিলের ওপর রেখে কলমের দিকে হাত বাড়িয়ে থমকে যাই—কোনটা নেব?
কারণ, আমার টেবিলে কয়েক শ কলম হাজির। নানা রকম সাজপোশাকে সজ্জিত তারা। সবাই কালি কিংবা শিষে সশস্ত্র। আর গল্প লেখার যুদ্ধে নামতে সদা প্রস্তুত। তার ভেতর থেকে কোনটা নিয়ে এগোব? যুদ্ধজয়ের হাতিয়ার বানাব কাকে?
আসলে কলম সংগ্রহ করা আমার শখ। দোকান-শোরুমে নতুন কোনো কলম দেখলে টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কিনে আনি তাকে। আবার জন্মদিনে কিংবা ভালো রেজাল্টের কারণে কেউ কোনো উপহার দিতে চাইলে আগেভাগেই বলে দিই—কলম দিয়ো। নতুন কোনো রঙের, ভিন্ন কোনো ডিজাইনের। তাদের দেওয়া উপহার হাতে পেলেই সাজিয়ে রাখি কলমদানিতে। এভাবে মাটি ও কাঠের তৈরি গ্লাসের মতো অনেকগুলো কলমদানিতে ভরে উঠেছে আমার টেবিল। আপু তাই প্রায়ই ঠাট্টায় মুখ বাঁকায়, ‘তুই দেখি টেবিলটারে কলমের মিউজিয়াম করে তুলছিস।’
এখন এই মিউজিয়াম থেকে কোনটা তুলি? কোনটা দিয়ে আমার দুঃসাহসী অ্যাডভেঞ্চার গল্প লেখা শুরু করি? একটার পর একটা কলমদানি হাতড়ে বেড়াই—ওহ্! কী সুন্দর একেকটা কলম। কী বাহারি ডিজাইন, চমৎকার রং। তার যেকোনো একটা দিয়ে লেখা শুরু করলেই যেন তার ভেতরের রস-রক্ত সব নিঃশেষ হয়ে যাবে। নির্জীব হয়ে পড়বে দেহ। হারিয়ে যাবে রূপ-রং।
কিন্তু গল্পটা লিখতে হলে একটা তো তুলতে হবে। তাই টেবিলের একেবারে কোনার দিকের একটা কলমদানি থেকে মাথা মোটা দেখে একটা বাছাই করি। তারে তুলে নিয়ে কাগজের সঙ্গে তার মুখের মিল ঘটাই।
প্রথম কয়েক লাইন লেখার পর মনে পড়ে এই কলমটা সংগ্রহের ইতিহাস।
সেবার আমরা সবাই মিলে বান্দরবানে বেড়াতে গেছিলাম। নদী-নালা, খাল-বিল এলাকায় আমাদের গ্রামের বাড়ি। তাই সামান্য উঁচু জায়গা, বুক তোলা ভূমি দেখলেই তাকে পাহাড় মনে হয় আমাদের। ফলে দেশের পূর্ব-দক্ষিণ ওই কোণের আকাশছোঁয়া সব গিরিচূড়া দেখে আমাদের বিস্ময়ের আর শেষ থাকে না। মুখ হাঁ করে তাদের পানে তাকাই—দ্যাখো, দ্যাখো, কী সুন্দর! একটার গা ঘেঁষে আরেকটা দাঁড়ানো। তারপর মোটেলের জানালায় মেঘের আনাগোনা দেখে খুশিতে নেচে উঠি। হাত বাড়িয়ে তাদের সঙ্গে মিতালি করি। আপু তো বলে বসে, ‘আমাদের দেশের ভেতরে এমন সুন্দর জায়গা ছেড়ে আমার তো আর ঢাকায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না।’
কিন্তু ফিরতে হয়। আর ফেরার দিন মোটেলের গেটে দেখি এক পাহাড়ি বুড়ি হাজির। তার ফরসা মুখে অসংখ্য বলিরেখা। আমাকে দেখে সে এগিয়ে আসে, ‘কলম নিবে বাবু, জাদুর কলম?’
আমি অবাক হয়ে বুড়ির পানে তাকাই। সে জানল কী করে যে আমি কলম সংগ্রহ করি? আমার টেবিলে এর মিউজিয়াম গড়ে উঠেছে?
বুড়ি বলল, ‘আমার পরদাদার বানানো কলম। এত বছর আগলে রেখেছি। কিন্তু এখন আর পারছি না। চুলায় যে হাঁড়ি চড়ে না। তাই বেচে দেব। নেবে? কলমে জাদু আছে! একবার লেখা শুরু হলে শেষ না হওয়া অব্দি ক্ষান্ত দেয় না, সঙ্গ ছাড়ে না।’
এ কয় দিন পাহাড়ে ঘোরাঘুরি করে বুঝে গেছি—নিজেদের জিনিসপত্র গছানোর জন্য স্থানীয়রা এসব বলে। তাদের মালামালের গা-গতরে মাহাত্ম্য লেপে দেয়। তাই বুড়ির কথায় গা করি না। তবে তার হাত থেকে কলমটা নিয়ে দেখি—চিকন বাঁশের তৈরি। পুরো দেহে সূক্ষ্ম কারুকাজ। মুখটা একটু মোটা বাঁশের। দুই প্যাঁচে তা খুলে দেখি আগাটা নিবের মতো নিখুঁতভাবে সাইজ করা। ভেতরের ফাঁপায় কালি ভরা। পকেট থেকে কাগজ বের করে দুটো টান দিই। দাগগুলো সাধারণ কলেমের চেয়ে একটু মোটা বটে, তবে খুবই মসৃণ।
চড়া দাম হাঁকে বুড়ি। পুরোনো আমলের বনেদি জিনিস বলে কথা। কিন্তু বাঁশের সামান্য দুই টুকরোর জন্য এতগুলো টাকা খরচ করতে সম্মত হয় না বাবা, ‘ও টাকায় ঢাকায় দশটা কলম পাওয়া যাবে।’
কিন্তু আমার মিউজিয়ামে এত রকমের কলম আছে, তবে বাঁশের একটাও নাই। তাই জেদ ধরি, ‘ও কলম না নিয়ে ফিরব না।’
শেষে আগামী জন্মদিনে কোনো গিফট দেওয়া হবে না বলে দুই মণি এক ধমক দিয়ে পুরো দামেই কলমটা কিনে দেয় বাবা। তবে ঢাকায় ফিরতে ফিরতে তার প্রতি আমার আগ্রহ তলানিতে নেমে যায়। তাই তাকে আর দশটার সঙ্গে রেখে দেই কলমদানিতে। পুরো দুটো বছর সে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। তার প্রতি কোনো নজর দেওয়া হয় না আমার।
এখন তাকে দিয়েই অ্যাডভেঞ্চার গল্প লিখতে গিয়ে দেখি—সত্যি সে জাদুর কলমই বটে। কেননা, লেখা শুরু করতেই তরতর করে আগায় সে। এক বসাতেই লেখা হয়ে যায় অনেকখানি। পাহাড়ের খাদে সোনার খনির নকশা চলে আসে হাতের মুঠোয়। এখন দল গঠন, তারপরই বান্দরবানের পাহাড়পানে ছুটে যাওয়ার পালা।
এমন সময় রাতের খাবারের জন্য ডাকে আম্মু। বাসাজুড়ে তার আদালতি হুকুম জারি করা—ডাকার পর দুই মিনিট দেরি হলে খাবার বন্ধ। তাই লেখার প্যাড ও কলম দেরাজে বন্ধ করে রেখে তাড়াতাড়ি ছুটি ডাইনিং টেবিলপানে।
কিন্তু দু-তিন লোকমা খাবার মুখে তোলার পর দেখি কলমটা হাজির। আমার প্লেটের পাশেই শোয়া। অ্যাঁ! সে এখানে এল কী করে? তাকে তো নিজ হাতে দেরাজে রেখে এসেছিলাম। তার কি পা বের হয়েছে? হেঁটে হেঁটে চলে এসেছে? নাকি পাখা গজিয়েছে? উড়ালের পথ নিয়েছে? কিন্তু কই! হাতে নিয়ে দেখি তার কিছুই নেই। যেমনটি ছিল তেমনটি আছে। তাহলে কি পাহাড়ি বুড়ির কথাই সত্যি—জাদুর কলম? তাই তার জাদুর খেলা শুরু হয়ে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে?
যাই হোক, তা পরে দেখা যাবে। তার আগে তারে লুকানো দরকার। আম্মুর নজরে পড়লে আর রেহাই নেই। দশাসই ধমক খেতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি তারে বাঁ হাতের মুঠোয় পুরি। কিন্তু তার আগেই আমার মুখোমুখি বসা আপুর নজরে পড়ে, ‘কি রে সাবু! ইংরেজরা চামচ দিয়া খায়, চায়নিজ-জাপানিরা কাঠি দিয়া, তুই কি শেষে কলম দিয়া খাওয়া শুরু করবি নাকি?’ আপুর কথায় আম্মুরও নজর পড়ে, ‘অ্যা! কলম নিয়া তোর বাড়াবাড়ি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। খাওয়ার সময়ও কলম সাথে রাখতে হবে? যা পড়ার টেবিলে রেখে আয়।’
আম্মুর হুকুম হাকিমের চেয়েও কড়া। না পালন করে উপায় নাই। তাই ঘরে গিয়ে খাতাপত্রের নিচে চাপা দিয়া রাখি কলমটা—এবার দেখি কীভাবে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াও? থাকো এখানে মুখ গুঁজে।
কিন্তু খাওয়া শেষ করে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখি যথারীতি সে হাজির। বাঁ পাশের পকেটের কোনায় ঘাপটি মারা। তা-ও ভালো, কারও নজরে পড়েনি। আপুর আরেক দফা টিপ্পনী, আম্মুর ধমক থেকে বাঁচোয়া।
ঘরে ফিরে আসতেই শুরু হয় কলমের ছটফটানি। আমার প্যান্টের পকেট দাপিয়ে বেড়াতে থাকে। একবার খাড়া হয়ে দাঁড়ায়। একবার কাত হয়ে শুয়ে পড়ে। তাই তাকে বের করে আবার গল্পের সঙ্গে বসি। লিখতে শুরু করি তার বাকি অংশ। রুলটানা প্যাডের বুকে দৌড়ে বেড়ায় সে। এ-মাথা থেকে ও-মাথায় ছুটে যায়। দ্রুত আগায় লেখা। ফলে তরতর করে গড়ে ওঠে দুঃসাহসী অ্যাডভেঞ্চার গল্পের কাঠামো।
সবার জানা, অ্যাডভেঞ্চার গল্পের মূল হলো দল। অভিযানে বের হওয়ার আগে সাহসী কয়েকজন ছেলেমেয়ে নিয়া একটা টিম গঠন করা। তাদের আগের দুঃসাহসিক কাজের দু-একটা নমুনা দিলে গল্প আরও জমজমাট হয়। পাকাপোক্ত অবয়ব নেয়।
কলমের জাদুর বাহারে এসব কিছু লেখা হয়ে যায় দ্রুত। কাগজের বুকে আঁকা হয় তার নিখুঁত বিবরণ। তিন পাতাজুড়ে তারা স্থান নেয়। গুনে দেখি ভূমিকা দুই আর দল গঠন তিন, পুরো পাঁচ পাতা লেখা সারা। বাহ! দুই বসাতেই এতখানি লেখা? এ তো দেখি এক জোয়ারে এক নদীর বারো আনা সায়ের করা শেষ। বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যাই আমি।
কেননা, আগে যত গল্প লিখেছি, তার কোনোটাই একবারে লিখতে পারিনি। বরং একটু একটু করে, এক পাতা কিংবা দেড় পাতা করে লিখেছি। দেখা গেছে, কোনো দিন হয়তো লিখেছি গল্পের ভূমিকাটুকু, তারপর একটু একটু করে পরিশিষ্টে পৌঁছাতে সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। এমনকি মাস-দুমাসও লেগেছে কোনো কোনো গল্প লিখতে। তাই সন্ধ্যা থেকে শুরু করে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় গল্পের চেহারাসুরত, গা-গতরের সব ফুটিয়ে তুলতে পেরে উল্লাসে ফেটে পড়ি আমি। জাদুর কলমকে জানাই অভিনন্দন। মুখের কাছে তুলে ঠোঁটে ছুঁইয়ে আদর করি কলমটাকে।
হঠাৎ ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠি—অ্যাঁ, এগারোটা বেজে যাচ্ছে? এমনিতে রাত দশটায় আমার বিছানায় যাওয়ার সময়। তারপর ঘরে লাইট জ্বালানো দেখলে আম্মুর গলা ছুটে আসে, ‘অনেক হয়েছে। এক্ষুনি শুয়ে পড়।’ কিন্তু কাল স্কুল বন্ধ, তাই এক ঘণ্টা গ্রেস। তারপর আর এক মিনিট ঘরে আলো দেখলে আর রক্ষা নেই। আম্মু নিজেই হয়তো ছুটে আসবেন। তাই তাড়াতাড়ি কাগজ-কলম সব গুছিয়ে রেখে সুইচ অফ করে বিছানায় আশ্রয় নিই।
তবে গল্প ঘাড়ে চড়ে থাকে ঠিকই। তাই শুয়ে শুয়ে বানাই তার বাকি কাহিনি। মনে মনে নতুন নতুন বাক্য সাজাই। ঘুম আর কাছে ঘেঁষার সাহস পায় না। সে হয়তো দরজার ওপারেই থির হয়ে থাকে। আর আমি বিছানায় এপাশ-ওপাশ করি। একবার বাঁ থেকে ডানে ফিরতেই দেখি কলম হাজির। আমার বালিশের কাছে সে গড়াগড়ি খায়—এ তো দেখি আমার সঙ্গে একেবারে লেপটে আছে। তাই ধমকে উঠি, ‘তোরে নিয়া আর পারি না। রাত দুপুরে আবার কী চাস?’
তাড়াতাড়ি হাতের মুঠোয় জব্দ করি তাকে। তবে তাতেও কমে না তার ছটফটানি। মুঠোর মাঝে বসে গা মোড়ামুড়ি করে। শেষে বিছানা থেকে নামতেই হয় আমাকে।
এখন কত রাত? গভীর অবশ্যই। আম্মুর ঘরের বাতি নেভানো। ঘুমিয়ে পড়েছেন নিশ্চয়ই। তারপরও টেবিল ল্যাম্পের শেডের ওপর কাগজ চাপাই। আলোটা কেবল টেবিলের মধ্যে সীমিত হয়ে যায়। তার পাশে চেয়ার টেনে অ্যাডভেঞ্চার গল্পের বাকি অংশ নিয়া বসি। কাহিনির ঘাড়ে সওয়ার করে দিই জাদুর কলমটাকে। তাতে তার ছটফটানি বন্ধ হয়ে যায়। আর নিঝুম রাত পেয়ে ছুটে চলে দুরন্ত বেগে। শুয়ে শুয়ে সাজানো আমার বাক্যগুলো একের পর এক কাগজে বসিয়ে দেয়। আবার নতুন নতুন অনেক বাক্য গড়ে তোলে। তাতে করে অ্যাডভেঞ্চার গল্প হয়ে ওঠে জমজমাট। তার কাঠামো হয় সুগঠিত।
শেষে দাঁড়ায়—সোনার খনির সন্ধানে ঢাকা থেকে বান্দরবানের পথে ছোটে অভিযাত্রী দল। টের পেয়ে চোরাকারবারি গ্যাংয়ের সদস্যরা ছুটে আসে। চট্টগ্রামে তারা মুখোমুখি হয়। তখন সেখানকার ফেসবুক-ফ্রেন্ডদের নিয়ে টিম লিডার সাজু একটা ডামি টিম গড়ে তোলে। তাদের পিছু ছোটে গ্যাং। এই সুযোগে সাজুরা ট্রেন ছেড়ে বাসে করে নির্বিঘ্নে বান্দরবানে পৌঁছায়। নকশা ধরে ধরে আগায়। গভীর খাদে পড়তে পড়তে বেঁচে যায় দু-চারবার। রুমায় পৌঁছালে সাজুর ছোট চাচ্চুর ক্লাসমেট মেজর হায়দার আঙ্কেল যোগ দেয় ওদের সঙ্গে। পাহাড়ের আরও দুর্গম এলাকায় ঢুকে পেয়ে যায় সোনার খনি—চোরাকারবারিদের বিশাল চালান। থরে থরে সাজানো সোনার বার। ঢাকার বিমানবন্দরে কড়াকড়ি আরোপ করায় সাগর-পাহাড় ধরে চোরাচালানের নতুন রুটও খোলাসা হয়ে পড়ে আইনশৃঙঙ্খলা বাহিনীর কাছে। দেশজুড়ে তখন হইচই দেখা দেয়। সাজুদের পিঠ চাপড়ায় সবাই।
ব্যস, অ্যাডভেঞ্চার গল্প খতম। তাতে শেষ দাঁড়ি দিয়া বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যাই আমি—বাহ্! এক রাতেই এক গল্প! এ তো লোক ডেকে সেলিব্রেট করার মতো ঘটনা। আমি উদ্বাহু নৃত্য জুড়ে দিই ঘরজুড়ে। ঠিক তখন পাশের মসজিদে ফজরের আজান শুরু হয়। জানালাপথে পুব আকাশের আলোর আভা দেখা দেয়। ওহ্! সকাল হয়ে গেছে? রাতে একটুও ঘুমানো হয়নি। তার পুরোটাই গেছে অ্যাডভেঞ্চার গল্পের পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে। তাড়াতাড়ি সবকিছু রেখে বিছানায় গিয়ে চোখ বুজি।
কয়েক ঘণ্টা পর আম্মুর ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙে। উঠে সবার আগে জাদুর কলমটা খুঁজি, যার কল্যাণে এক রাতে একটা গল্প লেখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু কই? কোথাও খুঁজে পাই না তাকে। তার সঙ্গে আর কখনো আমার দেখা হয়নি। এটাই হয়তো তার শেষ জাদু—খেল খতম, পয়সা হজমের মতো গল্প লেখা শেষ আর সে-ও উধাও।