টিপলু ও এক যে ছিল কিআ

অলংকরণ: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

আজকে আমি তোমাদের একটি অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শোনাব। তার আগে বলে নিই যে এখন আমি কোথায় আছি। আমি এখন আছি কিআর অফিসে, আনিসুল হক স্যারের টেবিলের ওপরে।

‘অ্যাডভেঞ্চারের গল্পটা তাড়াতাড়ি শুরু করো না।’

‘আহা! অধৈর্য হচ্ছো কেন? বলছি, বলছি সেই গল্প। ছোট্ট টিপলুর গল্প।’

‘সময়টা শরতের সকাল। আকাশে সাদা সাদা পুঞ্জীভূত মেঘ ভাসছে তুলোর মতো। চারপাশে সোনালি রোদ। রাস্তার একপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একটি ছোট্ট ছেলে। ওর নামই টিপলু। টিপলু বাবা-মা, স্কুলের সহপাঠী খেলার মাঠের বন্ধুরা সবাই এই নামেই তাকে ডাকে। কিন্তু কোথাও যখন সে তার নাম লেখে, তখন কখনোই ‘টিপলু’ লেখে না, লেখে ‘ফাহাদ হোসেন’। আমি আসলে মানুষের নামের কিছুই বুঝি না। একেকজনের কত্তগুলো নাম! এর চেয়ে গল্পই ভালো। একটি মাত্র নাম থাকে।

যাহোক, ফাহাদ হোসেন মানে আমাদের টিপলু মাত্র ক্লাস থ্রিতে পড়ে। কিআতে লেখা পাঠাবে বলে, বাবা তাকে কাগজ এনে দিয়েছেন। সেই কাগজে টিপলু সুন্দর একটি গল্প লিখেছে। গল্পের নাম দিল, ‘এক যে ছিল কিআ’।

‘কিন্তু এতে অ্যাডভেঞ্চারে কোথায়?’

‘আরে বলছি, বলছি!

‘আচ্ছা, একটা কথা...’

‘আবার কি হলো?’

‘টিপলু হেঁটে হেঁটে কোথায় যাচ্ছে?’

‘সেটিই তো বলব। সে যাচ্ছে ডাকঘরে।’

‘অতটুকুন একটা ছেলে ডাকঘরে গিয়ে কী করবে? কোনো বিপদে পড়ে যদি?’

‘অ্যাডভেঞ্চার মানেই তো রোমহর্ষক সব গল্প আর বিপদের গন্ধ।’

‘এই অ্যাডভেঞ্চারে কি চোর-ডাকাত না বাঘ-ভাল্লুক, কোনটি নিয়ে?’

‘আরে দূর! চোর-ডাকাতেরও নয়, বাঘ-ভাল্লুকেরও নয়।’

‘তাহলে?’

‘আসলে টিপলু যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, সেখানে কাজ চলছিল। সামনে ছিল একটি গর্ত। টিপলু খেয়ালই করেনি, আর ধপাস...!’

‘ইশ্! খুব লেগেছিল না?’

‘হুম! ও বেশ ব্যথা পেয়েছিল। হাতের কনুই একটু ছড়েও গিয়েছিল। কিন্তু ‘এক যে ছিল কিআ’কে সে একটুও লাগতে দেয়নি।’

‘আহা রে! এত মায়া?’

‘মায়া হবেই না বা কেন? এটি যে ওর প্রথম গল্প।

এবার সে খুব সাবধান। খুব দেখেশুনে চলছে। তাকে তো ডাকঘরে পৌঁছাতেই হবে।’ হঠাৎ টিপলুর হাত ধরে কে যেন একটা হ্যাঁচকা টান দিল। টিপলু পেছন ফিরে দেখে তাদের ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে গাবলু দাঁড়িয়ে আছে। আজ বোধ হয় আর ডাকঘরে যাওয়া হবে না।’

‘কেন? কেন? একসঙ্গে দুই বন্ধু গল্প করতে করতে যাবে।’

‘উহু, গাবলুর জায়গায় যদি অন্য কেউ থাকত, তাহলে হতো, কিন্তু গাবলু গর্তের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক। বললাম না, দুষ্টু ছেলে।’

‘তাহলে কি ও এখন টিপলুকে মারবে?’

‘মারবে মানে, দেখো না, সে কী মার দেয়!’

‘কিন্তু টিপলু তো কোনো দোষই করেনি!’

‘তবু গাবলুর সামনে যখন পড়েছে, মার তো তাকে খেতেই হবে।’

ধুম! দ্রিম! ধামম...

‘টিপলুর ঠোঁট ফুলে গেছে, চোখের নিচে কালশিটে পড়ে গেছে। সে কাঁদছে আর হাঁটছে। তখনই হঠাৎ অমিতের বাবা ওকে দেখতে পেল।

‘অমিত?’

‘হুম! অমিত, টিপলুর বেস্ট ফ্রেন্ড। অমিতের বাবা টিপলুকে ওই অবস্থায় দেখে জোর করে তাদের নিয়ে গেলেন বাড়িতে। ওর কাটাছেঁড়া ক্ষতগুলো ড্রেসিং করিয়ে দিলেন অমিতের মা। তারপর খেতে দিলেন পায়েস। এরই ফাঁকে টিপলুর কাছে সব ঘটনা শুনে অমিতের বাবা নিজে যেতে চাইলেন ডাকঘরে। কিন্তু টিপলু গোঁ ধরল, তার নিজের লেখা প্রথম গল্পটি সে নিজেই ডাকে দিতে চায়। তাই, অমিতের বাবা রিকশায় উঠিয়ে দিলেন তাকে।’

‘যাক! এতক্ষণে টিপলু বুঝি একটু শান্তি পেল।’

‘আর শান্তি! অ্যাডভেঞ্চারে কি শান্তি থাকে?’

‘কেন?’

‘এবার রিকশার চাকা ফুস! তাই বেচারাকে ক্লান্ত বিধ্বস্ত ছোট্ট দুটি পা নিয়ে আরও প্রায় সোয়া মাইল হেঁটে আমাকে ডাকে দিতে হলো।’

তোমাকে ডাকে দিতে হলো মানে?’

‘ইয়ে মানে, আ...আ...আসলে আমিই হলাম সেই গল্পটি—‘এক যে ছিল কিআ’, টিপলু আমাকেই লিখেছিল।’

‘আসলেই দুর্দান্ত অ্যাডভেঞ্চারে। কোনো চোর-ডাকাত নেই, নেই কোনো বাঘ-ভাল্লুক, পাহাড়-নদী সব ছাপিয়ে এ এক সমতলের অ্যাডভেঞ্চারে।’

হুম! শেষ পর্যন্ত তো আনিসুল হক স্যারের টেবিলে আসতে পেরেছি এত ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে, এখন কিআর পাতায় পৌঁছাতে পারলেই টিপলুর অ্যাডভেঞ্চার সফল।’