ড্রোনাবিনল প্রজেক্ট

নিজের বাগানে খুরপি দিয়ে ফুলকপির বেড তৈরি করছিলেন ড. বরিস। এ বছর বেশ আগেই শীত জাঁকিয়ে বসছে আর শীতকালে বাগানে নানা রকমের সবজি চাষ তাঁর অন্যতম প্রিয় শখ। দুই বছর হলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছেন, সময়টা কাটছে পোষা বিড়াল টেট্রা আর বাগানের সবজিগুলোকে নিয়ে। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ নেই। দুই বছর হলো ড. বরিস বাড়িতে পত্রিকা নেওয়া বন্ধ করেছেন, টেলিভিশন দেখেন না, কোনো ই-মেইল বা ফেসবুক অ্যাকাউন্টও নেই তাঁর। এক প্রকার নির্বাসনে আছেন তিনি। নানা কারণে এই পৃথিবী আর এর মানুষগুলোর ওপর তাঁর তীব্র অভিমান। তাই তিনি এই পৃথিবীর একজন হয়েও যেন কেউ নন। কাদামাখা জামা-কাপড় ঝেড়ে বাগানের পেছনে কলের পানিতে হাত-মুখ ধুতে গিয়ে লক্ষ করলেন—বাড়ির সামনের রাস্তায় একটা কালো মাইক্রোবাস দাঁড়ানো। ভ্রু কুঁচকে গেল তাঁর। এই রাস্তায় বহুদিন কারও গাড়ি আসে না। তার আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব বলে কেউ নেই। সামথিং রং—ফিসফিস করে টেট্রাকে বললেন তিনি।

এর ঠিক আধঘণ্টা পর একটা কালো মাইক্রোবাসকে দেখা গেল শহরতলির সস্তা একটি অ্যাপার্টমেন্টের দোরগোড়ায়। নোংরা এই দালানের ছয়তলার বি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা জাবের, বরাবরের মতো সারা দিন চাকরির খোঁজে শহরটা চষে বেরিয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে নিজের কুঠুরিতে ফিরে এসেছে। একটা ময়লা অস্বচ্ছ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে বলছে, এভাবে চলতে পারে না, জাবের। একটা কাজ তোমাকে পেতেই হবে। নয়তো তুমি ভ্যানিশ হয়ে যাবে। এই শহর তোমাকে আর জায়গা দেবে না। তিন মাসের ভাড়া বাকি, রেফ্রিজারেটরে একটা রুটি আর আধা বোতল জ্যাম ছাড়া কিছু নেই। গত সপ্তাহেই বাড়িওয়ালি শাসিয়ে গেছে, গালাগাল করেছে পাড়ার সুপার শপের ছেলেটা। লেটস মুভ, জাবের। কাম অন। হতাশ হলে চলবে না। নিজের সঙ্গে রোজই তার এমন কথা হয়। চোয়ালটা ভেঙে গেছে, চোখ বসে গেছে গর্তে, তবু হতাশা আর বিষণ্নতা যেন পেয়ে না বসে, তার জন্য রোজ সে এভাবে নিজের সঙ্গে কথা বলে। আর তখনই তার হঠাৎ চোখ পড়ে জানালা দিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের নিচে দাঁড়ানো কালো গাড়িটার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে যায় তার। সামথিং রং, অন্য রকম একটা কথা আজ নিজেকে বলে ওঠে সে।

দুই.

একটা ধবধবে সাদা আর ভয়ংকর শীতল ঘরের মধ্যে বসে আছে তারা দুজন। ড. বরিস নামের এক জার্মান বৃদ্ধ আর জাবের নামের এক বাঙালি তরুণ। যে সাদা চামড়ার লোকটা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তার সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই এদের। যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, লোকটি পৃথিবীর ভয়ংকর আর গোপন সব তথ্য জানে, আর সেই তথ্যগুলো বিশ্ববাসী আর মানবাধিকারকর্মীদের নিয়মিত অবহিত করাই তার কাজ। আর এ কারণে এফবিআই থেকে শুরু করে বিশ্বের বাঘা বাঘা সব গোয়েন্দা সংস্থা তার পিছু লেগেছে। লোকটি সম্ভবত এই দুনিয়ায় সবচেয়ে গোপন আর হেঁয়ালিপূর্ণ জীবন যাপন করে থাকে। হালকা শরীর, উষ্কখুষ্ক চুল আর অসম্ভব উজ্জ্বল দুটি চোখের অধিকারী এই লোকটি বিশ্বের একজন মোস্ট ওয়ান্টেড পারসন। অথচ যে দুজন মানুষকে সে ধরে এনেছে তাদের একজন মোটামুটি নির্বাসিত ও বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করে এবং আরেকজন দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামে এতখানি বিধ্বস্ত থাকে যে এরা কেউ তার সম্পর্কে আগে থেকে কিছুই জানত না। এই অভিনব ঘটনার সামনে রীতিমতো হকচকিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলেও এরা দুজন নিজেদের আশ্চর্য রকম শান্ত রেখেছে। দেখা যাক না কী হয়!

বসে থাকতে থাকতে ধৈর্যের বাঁধ প্রায় ভেঙে গেল ড. বরিসের। বাড়িতে টেট্রা একা রয়েছে, ওর দুধ খাওয়ার সময় হয়ে এল। আর এই লোক কিনা তাদের কী সব ফালতু কথা বলতে ধরে এনেছে!

ফালতু নয়, স্যার— রহস্যময় লোকটির কণ্ঠস্বর ভীষণ চাপা। আপনাদের কিছু ছবি দেখাতে চাই আমি। দয়া করে মনোযোগ দিয়ে দেখুন। এই বলে সে সাদা দেয়ালে মাল্টিমিডিয়া চালু করে।

১৯৬৪ সাল। ট্রানটর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় রসায়নবিদ রাফায়েল মেখুলাম ক্যানাবিস উদ্ভিদ থেকে পৃথক করেন এক মারাত্মক সাইকোট্রপিক উপাদান—ডেল্টা ৪-টেট্রা হাইড্রো ক্যানাবিনল। সাদা ইংরেজিতে টিএইচসি নামে পরিচিত হয় এটি। চিকিৎসাবিজ্ঞান ও কৃষিবিজ্ঞানে এই টিএইচসি নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে এত দিন, এর সবই সাধারণ ও নির্দোষ গবেষণা। আলঝেইমারস ও মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস রোগে ব্যবহার করার চেষ্টা হয়েছে কিছুদিন। কেমোথেরাপির রোগীদের খানিকটা আরাম আর উপশম দিতেও ব্যবহূত হয়েছে। কিন্তু এর আড়ালে সবচেয়ে বড় আর গোপন গবেষণাটি হয়েছে টার্মিনাসে, অধ্যাপক রাফায়েল ও তাঁর অনুসারীদের তত্ত্বাবধানে। ১৯৯২ সালে রাফায়েল মারা গেলে এই প্রজেক্টের প্রধান হন ইয়ামিন। সম্প্রতি ২০০৯ সালে আন্তালিয়ার হাডাসাহ মেডিকেল স্কুলে একদল মানসিক বৈকল্যে আক্রান্ত ও পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের রোগীদের ওপর ফেজ ৪ ট্রায়াল সমাপ্ত হয়েছে এই রাসায়নিকটির। এ পর্যন্ত বলে ড. বরিসের দিকে তাকায় লোকটি। স্যার, রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে আপনি নিশ্চয় জানেন যে এই রাসায়নিকটি ঠিক কীভাবে কাজ করে মানুষের শরীরে? এটি নির্দিষ্ট মাত্রায় স্পাইনাল কর্ডের ডরসাল রুট গ্যাংলিয়নের নিউরোট্রান্সমিটারগুলোকে পাল্টে দেয়। পেশিগুলোকে শিথিল করে দেয়, চরম ক্লান্তি আর অবসাদ এনে দেয় শরীর ও মনে। মানুষের স্বাভাবিক কর্মস্পৃহাকে অবদমন করে। শুধু তা-ই নয়, দীর্ঘদিনের ব্যবহারে স্মৃতি ধ্বংস করে ধীরে ধীরে। একজন তরতাজা দৃপ্ত তরুণ ধীরে ধীরে স্রেফ ভেজিটেবল হয়ে যায়।

ড. বরিস এবার হাই তোলেন, মিস্টার আননোন, আপনি বোধ হয় এই কেমিক্যালটির বিষয়ে একটু বাড়িয়ে বলছেন। টিএইচসির কোনো লেথাল বা টক্সিক ডোজ নেই। এতে খুব একটা বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মৃত্যুর আশঙ্কা তো নেই-ই। তাই ক্ষতিকর রাসায়নিক অস্ত্র হিসেবে এর ব্যবহার খুবই হতাশাজনক হওয়ার কথা।

না, ড. বরিস, তা নয়। লোকটি এবার চেয়ারে বসে পড়ে, আপনি জানেন কিছুদিন টিএইচসি ব্যবহার করা হলে মানুষের মারাত্মক হ্যালুসিনেশন হতে থাকে—ভিজ্যুয়াল, অডিটরি এমনকি অলফ্যাক্টরি হ্যালুসিনেশন। সে এমন কিছু দেখে, শোনে ও গন্ধ পায়, যা আসলে বাস্তবে নেই। প্রথমে একজনের কর্মস্পৃহাকে দমিয়ে দেওয়া, তারপর তার চেতনা ও স্মৃতিতে হস্তক্ষেপ আর সবশেষে অলীক কিছু দেখানো ও শোনানো। এটুকু দিয়ে আমি তো আপনার মতো যে কাউকে নিজের দাস বানিয়ে ফেলতে পারি স্যার, তাই না? এই বাঙালি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করুন, ওদের ভাষায় একটা অসাধারণ ছবি আছে, হীরক রাজার দেশে, সেই ছবিতে হীরক রাজা কীভাবে মানুষকে নিজের অধীন করে রেখেছিল?

যন্তরমন্তর দিয়ে, অস্ফুটে বলে ওঠে জাবের। লোকটির জ্ঞানের পরিধি দেখে সে বিস্মিত হচ্ছে। এ সত্যজিৎ রায়ও দেখেছে!

রাইট, যন্তরমন্তর। সেই যন্তরমন্তর তৈরি করেছে ওরা। আর প্রয়োগ করছে তরুণদের ওপর। তরতাজা বুদ্ধিমান আর চটপটে সব তরুণ আর যুবকদের নিজেদের দাস বানিয়ে ফেলছে। এমনকি ওদের হ্যালুসিনেটরি জগৎটাকে নিজেদের ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করার একটা উপায়ও কেমন করে যেন আবিষ্কার করে ফেলেছে এরা। ফলে ল্যাবরেটরিতে তৈরি হচ্ছে সারি সারি মন্ত্র পড়া মানুষ, যাদের নিজস্ব কোনো চেতনা বা জ্ঞান নেই। যারা কেবল ওদের অধীন ও ওদের আদেশ মেনে চলে। আর তাদের দিয়ে যা খুশি তা-ই করানো সম্ভব। এ পর্যন্ত বলে আরেকটু ঝুঁকে সামনে আসে লোকটা—ট্রানটরের তরুণ আর যুবকদের নিয়ে তাদের একটা বড় প্ল্যান আছে সামনে। ওদের ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য ব্যবহূত হবে টিএইচসি নামের রাসায়নিক অস্ত্র। ধীর আর গোপন বিষক্রিয়ায় দখল করে নেওয়া হবে ট্রানটরের তরুণদের মগজ। আর এই প্রজেক্টের কাজ শুরু হতে আর দেরি নেই।

ড. বরিস খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে এই অদ্ভুত লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি বুঝতে পারছেন না তাঁকে এখানে ধরে এনে এসব কথা শোনানোর অর্থ কী? নাকি একটু একটু বুঝতে পারছেন? এই লোকটি কি অন্তর্যামী? একই অবস্থা জাবেরেরও। সুদূর বাংলাদেশ থেকে এই দেশে এসে ভাগ্য বিড়ম্বনায় পড়েছে সে। চাকরি হারিয়েছে এই নিয়ে তিন-তিনবার। কোথাও চার-পাঁচ মাসের বেশি টিকতে পারেনি। অর্থাভাবে প্রায় মরতে বসেছে এখন। তার মতো একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটকে এখানে ধরে আনার মানে কী? খানিকটা আতঙ্ক নিয়ে লোকটার দিকে চেয়ে রইল সে। আর তখনই মুখ খুলল রহস্যময় লোকটি। ড. বরিস, আর মিস্টার জাবের, মানবজাতির কল্যাণে আপনাদের একটা মিশনে নামতে হবে। মিশনের ব্যয়, আপনাদের নিরাপত্তা আর গোপনীয়তা—সবকিছুর ভার আমার ওপর ছেড়ে দিন। আমাদের অর্থ জোগানদার আর সাহায্যকারী ছড়িয়ে আছে দেশে দেশে, শুনলে খুশি হবেন যে এখনো কিছু কল্যাণকামী মানুষ আছে, যারা মানবজাতির ভালো চায়। প্লিজ, দয়া করুন। ভেস্তে দিন এই নীচ পরিকল্পনা। দুনিয়াটাকে বাঁচান। কথা দিচ্ছি, এর বিনিময়ে কোটি কোটি মানুষের শুভেচ্ছা আর নীরব ধন্যবাদ পাবেন আপনারা। আর আমি জানি যে কেবল আপনাদের পক্ষেই এই কাজ সম্ভব।

তিন.

সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যান্টিকোলিনেস্টারেজ এনজাইম নিয়ে গবেষণা করতেন ড. বরিস। এ নিয়ে কাজ করতে করতে একসময় ঝুঁকে পড়েন ডেল্টা ৪ টেট্রা হাইড্রো ক্যানাবিনল নামের রাসায়নিকটির ওপর। ল্যাবরেটরিতে এই কাজের বিষয়ে নিশ্ছিদ্র গোপনীয়তা বজায় রাখতেন তিনি। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, অনেক আগেই তাঁর ধারণা হয়েছিল যে এই মারাত্মক রাসায়নিককে কোনো একদিন অপব্যবহার করবে কেউ। টিএইচসির অ্যান্টিডট তৈরির ব্যাপারে তাই অনেকদূর এগিয়েছিলেন তিনি। সিবি ১ রিসেপ্টর অ্যান্টাগনিস্ট রিমোনাবেন্ট নামের ওষুধটি ইতিমধ্যে বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে এর ক্ষতিকারক প্রভাবের জন্য। কিন্তু এই রিমোনাবেন্টই হতে পারে টিএইচসির সম্ভাব্য নির্ভুল ঘাতক। সব কাজ গুছিয়ে আনার শেষ মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটা গোলমাল বেধে যাওয়ায় হুট করে চাকরিটা ছেড়ে দিলেন তিনি। বেছে নিলেন এক নিভৃত নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। মুছে ফেললেন সব কাজ নিজের পিসি থেকে। গবেষণার সব ফলাফলও। কিন্তু আশ্চর্য, এই লোকটি সেই হারিয়ে ফেলা সব তথ্য-উপাত্তসমেত একটা সিডি ফিরিয়ে দিয়েছে তাঁকে। এসব এই লোকের হাতে কী করে এল, সেই অসম্ভব চিন্তা বাদ দিয়ে অবশ্য সত্যি সত্যি কাজে নেমে পড়েছেন বরিস। টিএইচসির অ্যান্টিডট বের করা মানে এ নিয়ে দুষ্টু লোকের নষ্ট খেলার বারোটা বাজানো। গোটা অস্ত্রটাকেই কাবু করে ফেলা। আর, বরিস জানেন, এটা তাঁর জন্য ছেলেখেলা।

তিন-তিনবার কয়েক মাসের মাথায়ই চাকরি গেছে জাবেরের। কারণটা কেউ জানে না, এমনই ধারণা ছিল ওর। চাকরিতে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পরই যখন কোম্পানির সব গোপনীয় আর লুকিয়ে রাখা তথ্য তার জানা হয়ে যেত, তখনই মালিকপক্ষ চরম আতঙ্কিত হয়ে পড়ত। কোনো প্রমাণ দিয়ে অভিযুক্ত না করতে পেরে স্রেফ ফালতু কারণে ছাঁটাই করা হতো তাকে। কিন্তু জাবের যে আসলে একজন অবিশ্বাস্য রকমের এক্সপার্ট হ্যাকার, সেটা কেউ ধরতে পারত না। কোনো এক রহস্যময় উপায়ে এই অদ্ভুত লোকটি তা জানতে পেরেছে। আর এও জেনেছে যে, জাবের আসলে একজন ভালো মানুষ, যাকে বলে হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার, আর সে কারও ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে সিস্টেম হ্যাকিং করে না। সে আসলে সিস্টেমের গলদ আর কোম্পানির দুনম্বরিগুলোকেই সাদা চোখে ধরিয়ে দেয়। লোকটার বাছাই নির্ভুল। সেটা প্রমাণ হতে মোটে দুই সপ্তাহ সময় লাগল। ড্রোনাবিনল আর সুসান—এই দুটি শব্দ দিয়ে প্রথম সার্চ করতে শুরু করে দেয় সে। ড্রোনাবিনল হলো এই রাসায়নিকের ডাক নাম, নামটা ব্যবহূত হয় মার্কিন নেশাখোরদের মাঝে। আর সুসান হলো রাফায়েলের স্ত্রীর নাম, ১৯৮৯ সালে রহস্যজনক মৃত্যু হয় সুসানের। বলা হয় যে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। কিন্তু আরেক সূত্র বলছে যে স্বামীর গোপন গবেষণার কথা ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেওয়ার কারণে তাঁকে সরিয়ে ফেলা হয় পৃথিবী থেকে। হ্যাকারদের সাধারণত গন্তব্যে পৌঁছানোর সূত্র খুঁজে বের করার জন্য নিজের ধারণা বা আঁচ করার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করতে হয়। জাবের সেটাই ব্যবহার করে সুফল পেল। আট দিনের মাথায় সে টার্মিনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রোনাবিনল প্রজেক্টের খুঁটিনাটি সব বের করে ফেলল। আট দিন পর ওই আজব ও সুরক্ষিত ঘর থেকে যখন বেরিয়ে এল সে, তখন ড. বরিসও তাঁর কাজ প্রায় শেষ করে এনেছেন। তারা দুজন নিজেদের কাজের ফলাফল অদ্ভুত লোকটার হাতে তুলে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল যেন। যাকগে, জীবনটা তাহলে এত ফালতু যাচ্ছে না তাদের। এই দুনিয়া আর এর কোটি কোটি বাসিন্দার কোনো না কোনো কাজে যে কেউ লেগে যেতে পারে যখন-তখন, এই কথাটা দুই সপ্তাহ আগেও তারা কেউ জানত না। ওদের দুজনকে বিদায় দিতে গিয়ে গলা ধরে আসে আজব লোকটার, যার নাম এখনো তারা জানতে পারেনি, গুড বাই ফ্রেন্ডস, তোমরা জানো না কী ভয়ংকর এক বিপদ থেকে পৃথিবীর বাসিন্দাদের রক্ষা করেছ তোমরা। তোমাদের তৈরি নীলনকশা নিয়ে এর মধ্যেই ট্রানটরের পথে রওনা দিয়ে দিয়েছে আমাদের স্কোয়াড। ড্রোনাবিনল প্রজেক্টের বারোটা বাজতে আর দেরি নেই। থ্যাংক ইউ বন্ধু, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ। জেনে রাখো, মানবতার জয় হবেই।

চার.

বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবছিলেন ড. বরিস, তার বাগানের তৈরি করা বেডটি নিশ্চয় নষ্ট হয়ে গেছে। চারাগুলোতে পানি দেওয়া হয়নি। আর টেট্রার কী অবস্থা কে জানে! আসার সময় ছেড়ে দিয়ে এসেছিলেন, কুড়িয়ে বাড়িয়ে যা পাবে তাই খেয়ে বেঁচে থাকবে। একটা নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি, আবার নতুন করে বীজ রোপণ করতে হবে। এ বয়সে আর কত কষ্ট করবেন! কিন্তু বাড়ি পৌঁছে তার চোখ কপালে উঠল। আঙিনায় লকলক করে বেড়ে উঠেছে শিমগাছ, ডান দিকে সারি সারি ডাঁসা আর আঁটো ফুলকপি। পুদিনা পাতায় সবুজ হয়ে আছে পেছন দিকটা। আর দুটো ইয়া বড় মিষ্টিকুমড়া যেন তাকিয়ে হাসছে তাঁর দিকে। গেট খুলতেই ছুটে এল টেট্রা, নাদুসনুদুস হয়েছে বেশ। মনটা খুশিতে ভরে এল বরিসের। নাম না জানা লোকটা আসলেই ভারী ভালো। আর এ রকম ভালো মানুষের হাত ধরেই বদলে যাবে দুনিয়াটা একদিন।

ওদিকে নিজের নোংরা আর এক কামরার হতদরিদ্র ফ্ল্যাটটায় ঢুকে সটান বিছানায় শুয়ে পড়েছিল জাবের। ভারি পরিশ্রম গেছে এ কদিন। শরীরটা যেন ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু হাল ছাড়লে তো হবে না। কাল থেকে আবার চাকরি খুঁজতে বেরোতে হবে। নতুন করে শুরু হবে জীবনসংগ্রাম। এমন সময় কলবেল বেজে উঠল। দরজা খুলে বাড়িওয়ালিকে দেখে ঘাবড়ে গেল সে। কিন্তু তাকে অবাক করে হেসে উঠল জাহাঁবাজ মহিলা, কনগ্র্যাচুলেশনস আহমেদ। নিশ্চয় একটা দারুণ দাঁও মেরেছ! তা কত ডলার বেতন? একসঙ্গে সব টাকা পরিশোধ করে দিলে যে! যাকগে, তোমাকে আর তাড়াব না। তুমি আদতে ছেলে ভালো হে। ওকে, গুডবাই। বিস্ময়াহত হয়ে দরজার নিচে পড়ে থাকা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা তুলে নেয় সে। মাউন্টেন ভিউ, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে চিঠি! গুগল এ চাকরি হয়েছে তার! পদমর্যাদা আর বেতনের অঙ্ক চোখে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছে না যে! পৃথিবীটা এখনো খারাপ মানুষে ভরে যায়নি তাহলে। লোকটার কথা বিশ্বাস করতে মন চায় তার, একদিন মানবতার জয় হবেই।

অলংকরণ : সব্যসাচী মিস্ত্রী