তিতলি আর একা নয়

অলংকরণ : মাসুক হেলাল
অলংকরণ : মাসুক হেলাল

কী যেন মেয়েটার নাম! তিতলি না ফিতলি, চিতলি না চৈতালি! মনে করা যাক তিতলিই। পড়ে ক্লাস থ্রিতে। তার কোনো বন্ধু নেই। বড্ড একা সে। যেমন স্কুলে, তেমনি বাড়িতেও।

একদিন সেই তিতলি এক টুকরা সাদা কাগজে লিখল এই কথা কটা: ‘তুমি কি আমার বন্ধু হবে?’ গোটা গোটা অক্ষরে পাকা কালির কলম দিয়ে। কথাটার নিচে লিখল নিজের নাম আর ঠিকানা। জন্মের তারিখ আর সালটাও। তারপর জানালার কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে কাগজটা উড়িয়ে দিল দোতলা থেকে, বাতাসে। খেয়াল আর খেলার ছলেই।

বাতাসের ছোঁয়া গায়ে লাগতেই কাগজের সেই টুকরাটা যেন পলকে পাখি হয়ে গেল। যেন তার ডানা গজাল। উড়ে চলল বাতাসের স্রোতে ভর করে। বাতাস যে মুখো যায়, সেও যায় সেদিকেই। এভাবে এক দিন-এক রাত উড়তে উড়তে যখন সে ভীষণ ক্লান্ত, বাতাস তাকে আলগোছে নামিয়ে দিল একটা ছোট্ট পুকুরের ধারে।

দুপুরের রোদে চারপাশের সবকিছু তখন ঝলমলে। এমনকি সেই পুকুরের তিরতিরানো পানিও। ছোট্ট কাগজের টুকরাটা যখন চারপাশে চোখ বুলিয়ে সবকিছু দেখছিল, তখন তার গায়ে কার যেন হাতের ছোঁয়া লাগে। দেখে ছোট্ট একটা ছেলে আর মেয়ে। ছেলেটা তাকে মাটি থেকে তুলে ধরে বলে, ‘চল, কাগজের এই টুকরা দিয়ে নৌকা বানাই।’

মেয়েটা বলে, ‘নৌকা বানিয়ে কী করবি?’

ছেলেটা বলে, ‘কেন, পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে দেব। তখন বেশ মজা হবে। দুলে দুলে চলবে।’

ছেলেমেয়ে দুটো তা-ই করে। কাগজের টুকরাটাকে ভাঁজ করে নৌকা বানায়। তারপর ভাসিয়ে দেয় পুকুরে। পুকুরের তিরতিরানো ঢেউয়ের দুলুনিতে সে একবার এদিকে যায়, একবার ওদিকে। তা-ই দেখে ঘাটে বসে ছেলেমেয়ে দুটো হাততালি দিয়ে ওঠে, ‘কী সুন্দর, তাই না!’

কিন্তু ব্যাপারটা নৌকা হওয়া টুকরা সেই কাগজের মোটেও ভালো লাগে না। সে তাই মনে মনে বলে ওঠে, ‘আকাশে যখন ডানা মেলে দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম, মনে হয়েছিল, আমি যেন পাখি। আমার অনেক অনেক দূরে যাওয়ার ইচ্ছা। অনেক শহর, নগর আর বন্দর দেখার স্বপ্ন। এই পুকুরের পানিতে আমার একটুও ভালো লাগছে না। এর চারদিকই বাঁধা। বেরোনোর পথ নেই। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।’

মনে মনে যখন সে এ কথা ভাবছিল, তখনই ছেলেমেয়ে দুটো পানিতে নেমে তাকে তুলে নেয়। বাড়িতে নিয়ে আসে। ভাঁজ খুলে তাকে শুকাতে দেয় উঠোনের এক কোণে। কালকে আবার তাকে নৌকা বানিয়ে পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে মজা করবে বলে।

‘না, এদের হাত থেকে আমাকে মুক্ত হতে হবে’, ভাবতে লাগল কাগজের টুকরাটা। ‘বন্ধু বাতাস এসে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাক।’

বাতাস বুঝি কাগজটার কথা শুনতে পেয়েছিল। তাই চোখের পলকে তাকে মাটি থেকে ওপরে তুলে নিল। তারপর ভাসিয়ে নিয়ে চলল যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকে।

‘আহা, এখন আমার ভীষণ ভালো লাগছে,’ খুশিতে আত্মহারা কাগজের টুকরাটা। তারপর জিজ্ঞেস করল বাতাসকে, ‘আমাকে শূন্যে ভাসিয়ে দেওয়ার সময় আমার গায়ে কী যেন লিখেছিল দোতলার সেই মেয়েটা। বাতাস বন্ধু, বলবে, আমার গায়ের সেই লেখাগুলো কি মুছে গেছে?’

বাতাস তার গায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘না, ভাবনার কারণ নেই। একটুও মোছেনি। এখনো চকচক করছে লেখাগুলো।’

বাতাসের জবাবে খুবই খুশি হলো সে। মনের চিন্তা দূর হতেই সে আবার বলল, ‘বাতাস বন্ধু, তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’

বাতাস বলল, ‘তোমাকে এবার দেশের পর দেশ দেখাব। শহরের পর শহর। দেখার তো শেষ নেই।’

এই বলে বাতাস তার পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া একটা বাজপাখিকে ডাকল। সে কাছে আসতেই তাকে বলল, ‘এই কাগজের টুকরাটাকে তুমি দেশের পর দেশ দেখাবে। পারবে তো?’

‘এক শ-বার পারব। তোমার আদেশ আমি না মেনে কি পারি?’ জবাব দিল বাজপাখিটা। তারপর তাকে ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরে উড়ে চলল তার ডানায় ভর করে। এভাবে অনেক দেশ দেখা হলো। দেখা হলো অনেক শহর, বন্দর আর গাঁও। বাজপাখিটা তার খুবই ভালো বন্ধু হয়ে উঠল। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। কিন্তু সেদিন একটা দেবদারুগাছের ডালে জিরিয়ে যেই উড়তে যাবে, অমনি শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়। সেই ঝড়ের ঝাপটা সইতে পারল না বাজপাখি। চোখের পলকে কাগজের টুকরাটা তার ঠোঁট ফসকে বেরিয়ে গেল। বাতাসের ঝাপটা তাকে নিয়ে এসে ফেলল নতুন একটা জায়গায়। একটা পাঁচিলঘেরা বাড়ির উঠোনের ওপরে। তখন ঘনকালো রাত। কাগজের টুকরাটার বুদ্ধি গুলিয়ে গিয়েছিল। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না।

সকালে এ বাড়ির লোকজন ঘুম থেকে উঠেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ব্যস্ত হয়ে পড়ল ঝড়ের আঘাতে ক্ষতি হওয়া বাড়িটার এটা-সেটা মেরামত করার কাজে। এসব কিছু করতে গিয়ে এই বাড়ির সবচেয়ে কম বয়সী মেয়েটার চোখ পড়ল সেই কাগজটার দিকে। হাতে তুলে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতেই তার চোখে পড়ল কাগজটার গায়ে লেখা অক্ষরগুলো। একেবারেই অপরিচিত তার কাছে। তবে অক্ষরগুলোর ধরনধারণ তার কাছে বেশ ভালো লাগে। মনে প্রচণ্ড কৌতূহল চেপে বসে। টুকরা কাগজটায় কী লেখা আছে, তাকে উদ্ধার করতেই হবে।

ছুটে যায় তড়িঘড়ি তার স্কুলে। তাদের ভাষার যিনি শিক্ষক, তাঁর কাছে যেতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘আরে, এটা তো বাংলা ভাষা!’

মেয়েটা জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কী করে জানলেন যে এটা বাংলা ভাষা?’

শিক্ষক জবাব দেন, ‘জানো তো, আমি দশটা ভাষা জানি। তার মধ্যে বাংলা ভাষা ভীষণ মিষ্টি আর দুনিয়ার সমৃদ্ধ ভাষাগুলোর একটি।’

শিক্ষক একটু দম নেন। তারপর বলতে থাকেন, ‘এ ভাষার একজন কবি নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন।’

‘সত্যি!’ মেয়েটার চোখেমুখে বিপুল বিস্ময়।

‘হ্যাঁ, তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমার প্রিয় কবিদের একজন। বলতে পারো, তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিদেরও একজন।’

রীতিমতো বাক্রুদ্ধ তখন মেয়েটা। সেটা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘টিচার, কাগজটাতে কী লেখা আছে?’

শিক্ষক কাগজের লেখা পড়ে বলেন, ‘লেখা আছে, “তুমি কি আমার বন্ধু হবে?”’

‘কে লিখেছে এ কথা? কোন দেশের? কোনো ঠিকানা আছে?’

‘তিতলি তার নাম। মনে হয় মেয়ে। ক্লাস থ্রিতে পড়ে। বাংলাদেশের মেয়ে, ডাক-ঠিকানাও আছে।’

‘বাহ্! কী ভীষণ মজার ব্যাপার,’ মেয়েটা হইচই করে ওঠে। তার সঙ্গী-সাথিরাও। তাদের সারা স্কুল।

তিতলির মনেও ছিল না। হঠাৎ মনে পড়ে। মনে পড়ে, যখন ১২ হাজার মাইল দূরের এক দেশ থেকে চিঠি আর উপহারভরা প্যাকেট আসে তার ঠিকানায়। চিঠিটায় লেখা, ‘আমি জার্মানির স্টুটগার্ট শহরের প্রাইমারি স্কুলের একজন ছাত্রী। নাম সুজানা। তোমার চিরকুটে লেখা বন্ধুত্বের আবেদনে সাড়া দিয়ে এই চিঠি পাঠালাম। পাঠালাম উপহার হিসেবে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর নাটক। আমাদের স্কুলে আমরা মঞ্চস্থ করেছি। আমি শুভা সেজেছিলাম। খুবই ভালো নাটক। আশা করি, তুমি জার্মান ভাষা শিখবে। আমরাও বাংলা ভাষা শিখব। আমি ও আমার বন্ধুরা তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে আগ্রহী। হবে আমাদের বন্ধু?’

তিতলির চোখে পানি আসে। আবেগে সুজানাকে সে চিঠি লিখতে বসে যায়। সত্যি সে আর একা নয়।

কিন্তু তিতলি কোনোমতেই ভেবে পেল না, তার বন্ধুত্ব করার আহ্বান জানানো চিঠিটা কীভাবে অত হাজার মাইল দূরে পৌঁছেছিল! কীভাবে তারা বাংলা ভাষা বুঝতে পারল। সুজানাকে চিঠি লেখে আর ভেবে চলে তিতলি।