কোরিয়ায় অনেক ছোট-বড় পাহাড় আছে। পাহাড়ের কোল বেয়ে বয়ে চলেছে ঝরনাধারা। বড় বড় আকাশছোঁয়া গাছপালা চারপাশে। দূরে সরু রেখার মতো পাহাড়ি নদী। এ রকমই এক ক্ষীণস্রোতা পাহাড়ি নদীর পাশে ছোট্ট এক কুঁড়েঘর। সেই ঘরে বাস করে তিনটি সুন্দরী ছোট মেয়ে আর তাদের মা। পাহাড়ের কোলে কোলে তারা খেলে বেড়ায়। গাছের ফলমূল পেড়ে খায়। ঝরনার জলে স্নান করে।
বড় মেয়েটার নাম ছিল হায়সুনি। অর্থ হচ্ছে সূর্য। মেজ মেয়েটার নাম টায়সুনি। অর্থ চাঁদ। আর ছোট মেয়েটার নাম পিওসুনি। অর্থ তারা।
তিনজনের মধ্যে ভারি ভাব। একজন আরেকজনকে বাদ দিয়ে কিছু খায় না। কোথাও ঘুরতে যায় না। একদিন তাদের মা বন থেকে কাঠ কেটে সেগুলো বিক্রি করতে গেল এক দূরের বাজারে। মা দূরে কোথাও গেলে মেয়ে তিনটিকে ডেকে এনে বারবার বলে যান—‘হায়সুনি, টায়সুনি, পিওসুনি—লক্ষ্মী তিন মেয়ে আমার। আমি যাচ্ছি দূরের বাজারে। খুব সাবধান! দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকবে। এই পাহাড়ে এক দুষ্টু বাঘ আছে। তোমরা যদি একটু উল্টাপাল্টা করো, তবে বাঘ কিন্তু তোমাদের গিলে খাবে।’
মা বারবার মেয়েদের সাবধান করে দিলেন। মা বাজারে যেতেই মেয়েরা ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিল। আর সেই যে দুষ্টু বাঘটা, সে ছিল আশপাশেই। মা বেরিয়ে যেতেই বাঘটা এসে কুঁড়েঘরের পাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। খিদেয় পেট চোঁ–চোঁ করছে তার। মা ঘরে নেই। এই তো সুযোগ। তিনজনকে যদি ধরে খাওয়া যেত, আহা, কী সুখই না পাওয়া যেত তবে! বুদ্ধি আঁটতে শুরু করল বাঘটা। কীভাবে মেয়ে তিনটাকে পটানো যায়! শুধু একবার দরজাটাকে খোলাতে পারলেই কেল্লা ফতে!
সে গিয়ে কুঁড়েঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মিষ্টি স্বরে বলতে লাগল, ‘ওগো আমার মেয়েরা, সোনার বরন মেয়েরা, হায়সুনি, টায়সুনি, পিওসুনি! তোমাদের মা এসেছে। মা এসেছে। দরজা খোলো। দরজা খোলো।’
বাঘটা মিষ্টি করে কথা বলছে। অনেক মিষ্টি স্বরে, ঠিক ওদের মায়ের মতো করে কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাঘের গলা কি মায়ের মতো মিষ্টি হয়? বড় মেয়ে হায়সুনি বলল, ‘তুমি আমাদের মা নও। আমাদের মায়ের গলা এত কর্কশ নয়। তুমি অন্য কেউ।’
বাঘ স্বরটাকে আরও নরম করে বলল, ‘আমিই তোমাদের মা। বাজারে গিয়ে অনেক চেঁচামেচি করতে হয়েছে তো, তাই গলাটা ভেঙে গেছে। অন্য রকম শোনা যাচ্ছে।’
মেজ মেয়ে টায়সুনি তখন বলল, ‘তুমি যদি সত্যি আমাদের মা হও, তবে তোমার চোখ দুটো দরজার ফাঁক দিয়ে দেখাও। তোমার চোখ দেখলেই ঠিক ঠিক আমরা চিনে ফেলতে পারব তুমি আমাদের মা কি না।’
বাঘটা তখন তার লাল চোখজোড়া তুলে ধরল দরজার ফাঁকে। টায়সুনি সেই আগুনরঙা চোখ দেখেই বুঝে ফেলল, এ আমাদের মা নয়। মায়ের চোখ এত টকটকে লাল নয়।
বাঘটা কিন্তু নাছোড়বান্দা। চট করে তার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। আর বলল, ‘না, মেয়েরা আমার! বাজারে মরিচের গুঁড়া লেগে আমার চোখের অবস্থা এখন খুবই খারাপ। মরিচের গুঁড়া চোখে লেগেছে বলেই চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। কী যে জ্বলুনি এই চোখে!’ তখন ছোট মেয়ে পিওসুনি বলল, ‘তোমার এই কথাটাও নাহয় মেনে নিলাম আমরা। কিন্তু মা বলে যে বিশ্বাস হচ্ছে না তোমাকে। তুমি যদি সত্যি আমাদের মা হও, তবে তোমার হাত দুটো দেখাও। হাত দেখলেই ঠিক ঠিক চিনতে পারব, তুমি আমাদের মা কি না!’
বাঘ কী আর করে? লোমশ হাতটা দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। সেই হাত দেখে আঁতকে উঠল পিওসুনি। চিৎকার করে বলে উঠল, ‘হলদেটে লোমশ হাতওয়ালা কে তুমি? তুমি আমাদের মা নও। মা নও।’
বাঘ কিন্তু খুবই বুদ্ধিমান। মেয়ের প্রশ্নে একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে সে বলল, ‘কী করব আর পিওসুনি, মেয়ে আমার। রাস্তা দিয়ে আসার সময় দেখি, একটা বাড়িতে রং করা হচ্ছে। আমাকেও একটু সাহায্য করতে হলো। হাতে এখনো হলুদ রং লেগে রয়েছে। সত্যি বলছি, আমিই তোমাদের মা।’
এভাবেই নানা ছলনায়, নানা ফন্দিফিকির করে চালাক বাঘটা মেয়ে তিনটাকে বিভ্রান্ত করে ফেলল। তারা তিন বোনই একসময় বুঝতে পারল যে সত্যিই সে তাদের মা। তখন তিন বোন মিলে দরজাটা খুলে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গেই ‘হালুম–হুলুম’ করতে করতে বাঘটা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল কুঁড়েঘরে। ব্যাপার দেখে তিন বোন ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। আজ বাঘের পেটেই যেতে হবে। বাঘটা ভেতরে ঢুকেই ইতিউতি তাকাতে লাগল। ‘হালুম–হুলুম...আজ মনের সুখে তোমাদের খাবই খাব। হা হা হা...।’
তিন বোন ভয়ে ঘর থেকে বেরিয়েই দিল দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে তারা গিয়ে উঠল এক গাছের ওপর। তারপর পাতার আড়ালে লুকিয়ে রইল। কাঁপতে লাগল থরথর করে তিন বোন। বাঘটা লোভে পড়ে কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। খানিক পরই টের পেল, মেয়ে তিনটা পালিয়েছে। কোথায় গেল? কোথায় গেল? বাঘটা ডাকতে লাগল, ‘হায়সুনি, টায়সুনি, পিওসুনি! কই গেলি রে তোরা? কোথায় গেলি আমায় ফেলে? জলদি আয়। কথা আছে তোদের সঙ্গে।’ চালাক বাঘটা ওদের খুঁজে বেড়াতে লাগল হন্যে হয়ে। আঁতিপাঁতি করে খুঁজল। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না। তারপর সে গেল গাছটার তলায়।
ব্যাপার দেখে তিন বোন ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। আজ বাঘের পেটেই যেতে হবে। বাঘটা ভেতরে ঢুকেই ইতিউতি তাকাতে লাগল। ‘হালুম–হুলুম...আজ মনের সুখে তোমাদের খাবই খাব। হা হা হা...।’
পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে ঝরনা। বাঘটাকে দেখেই ভয়ে-আতঙ্কে মেয়ে তিনটার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। বাঘটা ওপরে না তাকিয়ে তাকাল ঝরনার পানিতে। ওখানে তিন বোনের ছায়া পড়েছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তিনজনকে। এবারে বাঘটা ওপরে তাকাল।
‘হায়, হায়, তোরা ওপরে উঠেছিস কেন? নেমে আয়। নেমে আয়।’ ডাকতে লাগল বাঘটা। মেয়েরা বলল, ‘আমরা নামলেই তুমি তো আমাদের খেয়ে ফেলবে।’
‘না রে বোকা, খাব না। তোদের আদর–যত্ন করব।’
‘আমরা তোমার কথায় আর ভুলছি না।’
বাঘটা তখন কাতর মিনতি করল, ‘তোরা কী করে গাছে উঠলি! আমায় একটু বলে দে না!’
তখন বড় মেয়ে হায়সুনি বলল, ‘গাছে চড়া খুব সোজা। রান্নাঘরে তেল আছে। নিজের গায়ে আর গাছের গায়ে তেল মেখে সুড়সুড় করে উঠে পড়া যায় ওপরে।’
যেই বলা অমনি কাজ।
গাছে তেল মাখাতে গাছটা আরও পিচ্ছিল হয়ে গেল। বাঘ বুঝল, ওকে বোকা বানানো হয়েছে। ভীষণ ক্রুদ্ধ হলো সে। গাছে ওকে চড়তেই হবে। তিন বোনকেই ধরে এনে খেতে হবে। ঘরে গিয়ে এবার সে কুড়াল নিয়ে এল। তারপর দুমদুম করে গাছের গুঁড়িতে আঘাত করতে লাগল। মেয়ে তিনটে বুঝতে পারল আর বাঁচার উপায় নেই। এবারে বাঘের পেটে যেতেই হবে।
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। ‘হায়, হায়! এখন আমাদের কী হবে? আমরা কোথায় যাব? কে আমাদের বাঁচাবে?’
এমন সময় অবাক কাণ্ড!
মেঘের ভেতর থেকে একটা সোনার মই নেমে এল গাছের ডালে। আর বাতাসে ফিসফিস শিস দিয়ে কে যেন বলল, ‘তোমরা মইয়ে উঠে পড়ো। তোমাদের নিয়ে যাওয়া হবে মেঘের দেশে।’
তিন বোন মইটায় উঠে পড়ল। তারপর মই বেয়ে বেয়ে তারা চলে গেল মেঘের দেশে।
আরও একটা মই নেমে এল মেঘের দেশ থেকে। এই মইটা ছিল একেবারে লক্কড়ঝক্কড়। রশিটা পুরোনো, মইটাও নড়বড়ে। বাঘটা চেপে বসল সেই মইটায়। একটু উঠতে না উঠতেই পট করে ছিঁড়ে গেল দড়িটা। বাঘটা গিয়ে পড়ল দূরের গমখেতে। পড়েই বেচারার ইহলীলা সাঙ্গ। মাথা ফেটে রক্ত গড়াতে লাগল। গমগাছের গোড়ায় সেই রক্ত লেগে লাল হয়ে গেল। আজও তাই দেখা যায়, গমের নিচে লাল রং।
ওদিকে তিন বোন তো চলে গেল আকাশের দেশে। ওরা গিয়ে আকাশের দেশে নতুন অতিথি হয়ে গেল। হায়সুনিকে দেওয়া হলো দিনের বেলা আলো দেওয়ার দায়িত্ব। টায়সুনির দায়িত্ব হলো রাতের বেলা পৃথিবীকে আলোকিত করা। আর পিওসুনিকে দেওয়া হলো অন্ধকার আকাশ উজ্জ্বল করে তোলার কাজ।
এ জন্যই কোরিয়ার লোকেরা সূর্যকে বলে হায়সুনি। চাঁদকে ডাকে টায়সুনি। আর তারাদের ডাকে পিওসুনি বলে।