তুরফান উদ্দিনের মেঘ

আমি তুরফান উদ্দিন নামের এক লোককে চিনতাম, যে খামারবাড়ির চত্বরে ম্যাজিক দেখাত। টুকটাক হাতসাফাই আর দড়ি কচড়ার ভেলকি—কাঁচা-পাকা চুলের বয়স্ক এই লোকটার ম্যাজিক দেখত খুব কম লোকই। আজকাল ম্যাজিক দেখে কেউ পয়সা দেয় না। তাবিজ অথবা তেল হলে অন্য কথা। তারপরও উত্সাহে কোনো ঘাটতি থাকত না তুরফান উদ্দিনের। মড়ার খুলির ওপর দু-চারবার হাত ঘুরিয়ে নানান মন্ত্র পড়ে হাতের ভেতর থাকা আঙুর ফল হাওয়ায় মিলিয়ে দিত সে।

কোনো এক মঙ্গলবার দুপুরবেলা তুরফান উদ্দিনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ম্যাজিকের বাক্স বন্ধ বলেই হয়তো তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল আমার।

‘ভাইজান কি পেপারের লোক?’

‘জি না। আসলে ছবি তোলা আমার শখ।’ হাসিমুখে জানালাম।

‘পিরাই আমার ছবি তুলেন, আমি খিয়াল করছি। ব্যাপারটা ঠিক না।’

‘ওহ্ সরি।’ আমার সরল উত্তর।

‘মানুষ ছাড়া বাকি সব চোখ হইল শয়তানের চোখ!’

এবার আমি তার কথার অর্থ বুঝতে পেরে শয়তানের (ক্যামেরা) লেন্স ক্যাপ আটকে দিলাম। তাকে যখন ‘দুঃখিত’ টাইপের কিছু একটা বলতে গেলাম, তখনই আমাকে থামিয়ে দিল সে।

‘ভাইজান, একটা জাদু দেখবেন?’

‘হ্যাঁ। অবশ্যই দেখাতে পারেন।’

‘ওই যে মোটা গাছটা দেখতাছেন, ওইটার ছায়াটা দেখছেন?’

আমি দেখলাম বিশাল মেহগনিগাছটার ছায়া আমার জুতা পর্যন্ত এসে পড়েছে।

‘একটু ধিয়ান দিয়া তাকায়া থাকেন, দেখবেন ছায়াটা গায়েব হয়ে যাবে। আমি মন্ত্র পড়তেছি।’

‘আচ্ছা। ঠিক আছে।’ বেশ মজাই পেয়ে গেলাম। 

চোখের পলক না ফেলে গাছের ছায়াটার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। তুরফান উদ্দিনের বিড়বিড় করা অস্পষ্ট মন্ত্র আমার কানে আসতে লাগল। কী সুন্দর গাছটার ছায়া। ডালপালার ওপর থোকায় থোকায় ধরে আছে পাতারা। চার-পাঁচ সেকেন্ড পর হঠাত্ দেখলাম ছায়াটা উধাও! কী আশ্চর্য! আমি চমকে পাশে তাকিয়ে দেখলাম তুরফান উদ্দিন নেই। আশপাশে লোকজনও নেই তেমন। আমি একা!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পার্কের বেঞ্চে গা এলিয়ে দিলাম। এবার দেখলাম মেহগনিগাছটার ছায়া ধীরে ধীরে আবার জেগে উঠছে। তার মানে সূর্যটা এতক্ষণ মেঘে ঢাকা ছিল। আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম। তুরফান উদ্দিন লোকটা খুবই চতুর। আমাকে বোকা বানিয়ে চলে গেল সে এবং তার মেঘেরাও।

অলংকরণ: আবদুল্লাহ মামুর