তুষারকন্যা

কোনো এক শীতকাল। তুষারপাত সবে শুরু হয়েছে। গাছে ডালপালায় সাদা সাদা তুষার ফুল, মাঠ–ঘাটের সবুজ দুব্বা ঢেকে গেছে অবিরাম তুষারপতনে—ছাদে আস্তর পড়েছে অনেকটা পুরু হয়ে। প্রকৃতির এই দুরবস্থায় দুটি শিশু তাদের মা’র কাছাকাছি ঘুর ঘুর করছে আর বলছে, ‘যাই না, মা! বাইরে নতুন তুষার নামছে, আমরা একটু খেলি গিয়ে। যাই না—যাই?’

ছোট্ট মেয়েটিকে সবাই ডাকে ভায়োলেট বলে। তবে এটা তার আসল নাম নয়। যেমন তার ছোট ভাইয়ের নাম। সেটাও আসল নয়। তাকে ডাকা হয় পিওনি বলে। তার গাল দুটি পিওনি গোলাপের মতো লাল বলে এই নাম।

বাড়ির সামনে ছোট্ট একটুখানি মাঠ। বড় রাস্তা আর মাঠের মধ্যে সাদা একফালি বেড়া। এই বেড়ার ঠুনকো দেয়াল বাড়িটাকে বড় রাস্তা থেকে আলাদা করে রেখেছে।

গাছপালা–লতাগুল্মে এখন আর কোনো পাতা নেই। ডালপালায় তুষারের সাদা রং কেউ যেন মেখে দিয়েছে। মা বলল, ‘ঠিক আছে, যাও। খেলো গিয়ে বাইরে।’ ব্যাস, আর কি ঘরে থাকে? দুই ভাইবোন বাইরে যেন ছিটকে পড়ল। মুহূর্তে শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড ঝাঁপাঝাঁপি–লাফালাফি। ভায়োলেট পিওনিকে বলল, ‘বরফ দিয়ে একটি তুষারকন্যা বানিয়ে ফেলি, কী বলো? তুষারকন্যা। সারাটা শীত সে আমাদের সঙ্গে খেলবে, দৌড়াবে।’ খুশিতে পিওনি চিত্কার করে উঠল। ভায়োলেট বলল, ‘তবে মা কিন্তু চাইলেও মেয়েটাকে গরম ঘরে নিতে পারবে না, বুঝলে!’

যেই কথা সেই কাজ।

বাচ্চা দুটো বরফ দিয়ে কিছু একটা গড়তে শুরু করল। কিন্তু আকারটা যে তারাই বানাচ্ছে, এটা ঠিক বলা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, তাদের হাতের ছোঁয়ায় কিছু একটা আপনা–আপনি বেড়ে উঠছে। অতিদ্রুত তৈরি হয়ে গেল তুষারকন্যা। ভায়োলেট বলল, ‘হ্যাঁ হয়েছে। এবার চোখ। চোখের উজ্জ্বলতা বাড়ানোর জন্য কিছু চিকচিকে বরফকুচি লাগবে।’

কেঁদে কেঁদে বাচ্চা দুটো বলল, ‘বাবা, তুমি ওকে ঘরে নিয়ে এলে। এখন দেখো, আমাদের তুষার–বোনটা গলে গেল!’ বাবা এর কিছুই তেমন বুঝল না। না বুঝেই বলল, ‘আহা দেখো তো!

তারা যে একটা কিছু বানাচ্ছে, মাকে তো সেটা জানাতেই হয়। পিওনি চিত্কার করে মাকে বলল, ‘মা মা, দেখো! দেখো কেমন সুন্দর তুষারকন্যা বানাচ্ছি।’ মা সূচিকাজ বন্ধ করে জানালার কাছে এসে বাইরে তাকিয়ে দেখল। তুষারস্তূপের ওপর ঝকঝকে রোদ বিছিয়ে পড়েছে। ওই উজ্জ্বল রোদের ভেতর তুষারকন্যা দেখে মা একেবারে অবাক হয়ে গেল। তার মনে হলো, এমন নিখুঁত বরফের মেয়ে সে আগে তো কখনো দেখেনি!

মা ওদের কাণ্ড দেখে গিয়ে আবার তার সূচিকাজ নিয়ে বসে পড়ল, আর বাগানে বাচ্চারা তাদের কাজে ডুবে গেল। ভায়োলেট বলল, ‘দারুণ এক খেলার সাথি পেয়ে গেলাম। শীতের লম্বা সময়টা সে আমাদের সঙ্গে খেলবে।’ একে তো খেলতে পারছে, তার ওপর তুষারকন্যার মতো একটা ঘটনা ঘটছে; পিওনির মনে আনন্দ একপায়ে নাচছে। উল্লসিত হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তা–ই তো। সব সময় সে আমার গা ঘেঁষে বসে থাকবে আর মাঝেমধ্যে গরম দুধ থেকে দু–এক চুমুক খাবে। ভায়োলেট আঁতকে উঠে বলল, ‘না না, পিওনি! সেটা করতে যেয়ো না। গরম দুধ আমাদের বরফ-বোনের জন্য ভালো হবে না। তার মতো ছোট তুষার মানুষেরা ঘরের চালে যে বরফ জমে থাকে, তা–ই খায়।’

ঠিক এই সময় একঝলক বাতাস ঘরের জানালাগুলো নেড়ে দিয়ে সারাটা বাগান কাঁপিয়ে বয়ে গেল। ব্যাপারটা শৈত্যপ্রবাহের মতো লাগল। মা বাচ্চাদের ঘরে ডেকে আনার জন্য জানালার শার্শিতে টোকা দিতে যাচ্ছিল আর তখনই বাচ্চারা চিত্কার করে বলল, ‘মা! আমরা বরফ-বোন বানিয়ে ফেলেছি, এই যে দেখো, সে এখন আমাদের সঙ্গে সারা বাগান নেচে বেড়াচ্ছে।’

সূর্য এতক্ষণে অনেকটা নিচে নেমে গেছে বলে মা সবকিছু স্বাভাবিক দেখতে পাচ্ছিল। সে দেখল, সাদা ধবধবে কাপড় পরা ছোট্ট একটি মেয়ে ভায়োলেট এবং পিওনির পাশে পাশে ওদের সঙ্গে খেলছে। ভায়োলেটকে কাছে ডেকে মা জিজ্ঞেস করল, ‘ওই বাচ্চাটির নাম কী রে, মা? ও কি আমাদের কাছে কোথাও থাকে?’

ভায়োলেট মুচকি হেসে বলল, ‘কেন মা, ও তো আমাদের বরফ-বোন!’ আর তখনই একদল তুষার-পাখি ডানা ছড়িয়ে আকাশ থেকে নেমে এল। তারা নেমেই সোজা তুষারশিশুর কাছে গিয়ে তাকে ঘিরে উড়ে উড়ে নাচতে লাগল। কখনো বসছে শিশুটির কাঁধে, কখনো তার মাথায়।

মা কেমন যেন এক রহস্যের ছোঁয়া পায়। অবাক হয়ে সে যখন ভাবছে ব্যাপারটা কী এবং এ নিয়ে কী করা যায়, তখনই বাগানের গেট ঠেলে ভায়োলেট ও পিওনির বাবা ঢুকল। ঢুকতেই শুভ্রবসনে খেলায় মত্ত ছোট্ট মেয়েটিকে সে দেখতে পেল। সে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, ‘ছোট্ট এই মেয়েটি কে গো? ওর মা’টা কি পাগল নাকি—এই বিচ্ছিরি ঠান্ডার মধ্যে মেয়েটাকে ফিনিফনে সাদা একটা কাপড় পরিয়ে ছেড়ে দিয়েছে!’ বাচ্চাদের মা যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। অস্ফুটে বলল, ‘ঠিক জানি না। প্রতিবেশী কারও বাচ্চা হবে হয়তো।’

ভায়োলেট তার বাবাকে বলল, ‘বাবা, কেমন হয়েছে, বলো না? এ হলো আমাদের তুষার-বোন। সারা শীত ও আমাদের সঙ্গে খেলবে বলে পিওনি আর আমি ওকে বানিয়েছি। একজন খেলার সাথি আমাদের দরকার।’

বাবা বলল, ‘এই বোকা মেয়ে! বরফ দিয়ে কি জ্যান্ত মানুষ বানানো যায়? নাহ্, আর একমুহূর্তও অচেনা এই বাচ্চাটাকে ঠান্ডার মধ্যে রাখা যাবে না। ওকে ঘরে এনে গরম দুধ রুটি খাওয়াতে হবে। আমি বাইরে যাচ্ছি, কার বাচ্চা হারিয়েছে, জেনে আসি।’

ভায়োলেট বলল, ‘বাবা, ওকে ঘরের গরমের মধ্যে নিয়ো না। নিশ্বাসে ঠান্ডা বাতাস নিতে না পারলে ও তো বাঁচবে না।’ বাবা বলল, ‘বাজে বোকো না। যাও, ভেতরে যাও।’ শুভ্রসাদা খুকিটি কিন্তু যেতে চাইল না। সে ভয়ে পিছিয়ে গেল। কিন্তু বাবা তার পিছু ছাড়ল না। যেতে যেতে খুকি এক কোনায় গিয়ে দাঁড়াল, মনে হলো যেন তারা ঝিকমিক করছে। বাবা তাকে উঠিয়ে ঘরে নিয়ে গেল।

সাদা খুকিকে যখন গরম ঘরের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন ভায়োলেট ও পিওনির চোখে জল।

বাবা তাকে নিয়ে একেবারে চুলার সামনে বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘ওকে একটু গরম দুধ দাও।’ বলেই বাবা কার মেয়ে হারিয়েছে, সে খবর নেওয়ার জন্য বাইরে বেরিয়ে গেল। কিন্তু গেট পর্যন্ত যাওয়ার আগেই ভায়োলেট ও পিওনির ভয়ানক চিত্কার। তাই শুনে আবার সে ফিরে এল।

কেঁদে কেঁদে বাচ্চা দুটো বলল, ‘বাবা, তুমি ওকে ঘরে নিয়ে এলে। এখন দেখো, আমাদের তুষার–বোনটা গলে গেল!’ বাবা এর কিছুই তেমন বুঝল না। না বুঝেই বলল, ‘আহা দেখো তো! পায়ে পায়ে বাচ্চারা কী পরিমাণ বরফ এনেছে ঘরে। সরিয়ে ফেলো, এগুলো সরিয়ে ফেলো।’