ত্রপাদির ধাঁধা

অলংকরণ: জুনায়েদ আজিম চৌধুরী

‘যখনকার কথা বলছি, তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। তোর মতোই গল্পের বইয়ের পোকা ছিলাম। পত্রিকা, ইতিহাসের বিষয়-টিষয়, গল্প, উপন্যাস, নাটক, ম্যাগাজিন, খবরের কাগজ—সব একেবারে গোগ্রাসে গিলতাম। কিন্তু আসলে ঝোঁকটা ছিল গোয়েন্দাকাহিনির দিকে!’—এটুকু বলে একটু দম নেয় ত্রপাদি।

ত্রপাদি আমার চেয়ে প্রায় ১০ বছরের বড়। এই মামাতো বোনটি আমার খুব প্রিয়। ও যেমন দুর্দান্ত লেখে, ঠিক তেমনি সুন্দর করে গল্প বলে।

ত্রপাদি আবার বলে, আমি আর ঠাকুরদা তখন পানাম নগরেই থাকি। তোর হয়তো মনে নেই। সেখানে ঠাকুরদাদের বিশাল এক বাড়ি ছিল। ঠাকুরদার কাছে শুনেছি, তার মায়ের নাম নাকি চন্দ্রদেবী ছিল। ওনার নামেই সে বাড়ির নামকরণ করেছিলেন ঠাকুরদার বাবা—চন্দ্রমহল! মা-বাবা সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পরপরই আমি ঠাকুরদার কাছে চলে গিয়েছিলাম। শহরেই থেকেছি ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত। তাই বিশাল চন্দ্রমহলের ৩৩টি কামরা, বিশাল বাগান, বাঁধানো পুকুরঘাট—সব একেবারে রূপকথার মতো লাগত আমার কাছে। সারা দিন বাড়ির পেছনের বাগানটাতে ঘুরে বেড়াতাম আর নয়তো গল্পের বই পড়তাম। কতবার ও বাড়ির বিশাল ছাদে শুয়ে শুয়ে তারা গুনেছি, কতবার ভরা দুপুরবেলায় একা একা পুকুরঘাটে বসে থেকেছি, কতবার যে ভাঙা গলায় ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে, এসো করো স্নান নবধারা জলে’ গাইতে গাইতে বাগানের কদমগাছগুলোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছি! আমাকে তখন কেউই কিছুতে বাধা দিত না।

বাড়িতে একটা ঘরে অনেক পুরোনো হাঁড়িকুড়ি রাখা ছিল। একদিন কী মনে করে ও ঘরটায় ঢুকলাম। দেখি কয়েকটা পুরোনো বইখাতা। ওগুলো ঘাঁটতে গিয়ে এক টুকরো পুরোনো কাগজ পেলাম। অদ্ভুত এক ছড়া লেখা তাতে। ছড়াটা হলো—

‘নাম এর আগে পঞ্চম সুর
সন্নিধানেই এমন নগর।
বিধুর সেথায় যেথায় বাস
অন্তরে তার মীনের নিবাস।
তট ধরিয়া—
জবাব পানে
পাণি দশেক যায়।
বর্ষাবন্ধুর আশ্রয়েতে
হেমের দিশা পায়!’

ত্রপাদির গল্প শুনে আমি একেবারে অবাক। বলে উঠলাম, গুপ্তধন? ত্রপাদি বলল, ঠিক তা-ই। আমি খুঁজে পেয়েছিলামও।"

—বলো কী? কী ছিল? কোথায়?

—সংকেতটা তো বলেছি। অর্থ উদ্ধারের জন্য যা যা দরকার, তা-ও বলেছি। বাকিটা তুই বল!

আমি ভাবছি আর ভাবছি। কিন্তু কী যে এর অর্থ, বুঝতেই পারছি না! তোমরা কি পারছ?

উত্তর

নাম এর আগে পঞ্চম সুর
সন্নিধানে এমন নগর।

সা রে গা মা পা ধা নি সা—গানের মৌলিক সুর এই সাতটি। একত্রে একে সপ্তসুর বলে। তাহলে পঞ্চম সুর হলো পা। ‘নাম’-এর আগে পা বসিয়ে যে নামটি পাওয়া যায় তা হলো পানাম! তাহলে নগরটার নাম দাঁড়াল পানাম নগর।

বিধুর সেথায় যেথায় বাস
অন্তরে তার মীনের নিবাস—

বিধু অর্থ অভিধানমতে চাঁদ, চন্দ্র। তাহলে প্রথম লাইনের অর্থ দাঁড়াল চন্দ্রমহল!

অন্তরে অর্থ ভেতরে আর মীন অর্থ মাছ। সুতরাং দ্বিতীয় লাইনটি চন্দ্রমহলের ভেতর যে পুকুরটি রয়েছে তাকেই বোঝাচ্ছে।

তট ধরিয়া—
জবাব পানে
পাণি দশেক যায়।

তট অর্থ তীর। জবাবের একটি প্রতিশব্দ হলো উত্তর। পাণি অর্থও এখানে জল নয়। অভিধান খুঁজলে পাণির অর্থ হাত বা হস্ত পাওয়া যায়।

তাহলে পুরোটার অর্থ হলো তীর ধরে উত্তর দিকে ১০ হাত যেতে হবে।

বর্ষাবন্ধুর আশ্রয়েতে
হেমের দিশা পায়!—

ত্রপাদির গল্পে কদমগাছের উল্লেখ আছে। যেহেতু কদম ফুল বর্ষায় ফোটে, তাই বর্ষাবন্ধু এই কদমগাছই। হেম অর্থ স্বর্ণ। তাহলে এই দুই লাইনে বলা হয়েছে কদমগাছের আশ্রয়ে, অর্থাত্ কদমগাছের নিচেই হেমের দিশা বা স্বর্ণের সন্ধান পাওয়া যাবে।

পুরো সংকেতের অর্থ হলো, পানাম নগরের চন্দ্রমহল নামের যে বাড়িটি রয়েছে, তার পুকুরপাড় ধরে উত্তর দিকে ১০ হাত যেতে হবে। সেখানে যে কদমগাছটি রয়েছে, তার নিচেই পাওয়া যাবে গুপ্তধনের সন্ধান।