দাদুর খড়ম

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দাদুকে নিয়ে এই এক মুশকিল! কখন যে কী করেন ও বলেন, তার কোনো মাথামুণ্ডু নেই! আজ কদিন ধরে তিনি বায়না ধরেছেন ছোট দেখে একটা শোকেস বানাতে হবে, যার মাঝখানে তাক থাকবে। উচ্চতায় সেটা দেড় থেকে দুই ফুট হবে এবং পাশেও দেড় ফুট থাকতে হবে। ভেতরেও যাতে দেড় ফুট ডিপ থাকে, সে কথাটা বিশেষভাবে বুঝিয়ে দিলেন দাদু। আরও কথা আছে। শোকেসটা অবশ্যই দামি সেগুনকাঠের হতে হবে আর পেছনটা ছাড়া বাকি তিন পাশে কাচ থাকবে।

বাবা এতক্ষণ দাদুর নির্দেশ শুনছিলেন। এবার প্রশ্ন করলেন, ওতে থাকবে কী?

আমার খড়ম।

আপনার খড়মজোড়া তো টিনের বাক্সে তোলা আছে। ওটাতে থাকলেই তা নিরাপদে থাকবে।

না। দাদু মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ভেবে দেখলাম ওটা বাক্সবন্দী করে রাখা উচিত নয়।

তাহলে?

খড়মজোড়া থাকবে শোকেসের মধ্যে, ড্রয়িংরুমে।

খড়ম থাকবে ড্রয়িংরুমে! বাবা মনে মনে আঁতকে উঠলেন কিন্তু মনের ভাব প্রকাশ করলেন না।

ওটাই খড়মগুলো রাখার সবচেয়ে ভালো জায়গা। সবাই তাহলে দেখতে পাবে।

লোকজনকে তা দেখানোর দরকার কী?

কেন নয়? তুমি তো জানো ওগুলো কত মূল্যবান! এত দিন তা বাক্সবন্দী রেখে ভুল করেছিলাম।

আচ্ছা। ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখি। তা ছাড়া ভালো মিস্ত্রি পাওয়াও এখন কঠিন ব্যাপার। বাবার কণ্ঠস্বরেই বোঝা গেল, ড্রয়িংরুমে শোকেসে খড়ম রাখা তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। দাদুও আর কথা না বলে সেখান থেকে উঠে গেলেন।

দাদুর এ রকম অদ্ভুত আচরণ নতুন কিছু নয়। ঝলকের মনে আছে তাদের পুরোনো বাড়ির ড্রয়িংরুমে একদিকে একটা বাঘের চামড়া আর অন্যদিকে হরিণের শিং দেয়ালে ঝোলানো ছিল। দাদু বলতেন, ওগুলো নাকি আভিজাত্যের প্রতীক। কথাটার মানে ঠিক বুঝতে পারেনি ঝলক। দাদু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ওগুলো হচ্ছে বনেদি পরিবারের নিদর্শন। নিদর্শন শব্দের অর্থও দাদু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, প্রমাণ বা চিহ্ন।

ড্রয়িংরুমের আসবাবের সঙ্গে দেয়ালে ঝোলানো বাঘের চামড়া বা হরিণের মাথা ও শিং মোটেই মানাত না। ঝলক তখন স্কুলের নিচের ক্লাসে পড়ে। ওর বন্ধুরা বাসায় এলে বাঘের চামড়া আর হরিণের শিং দেখে হাসত। তাদের সেই হাসি বুকের ভেতর কাঁটার মতো বিঁধত ঝলকের। মা-বাবাকে কথাটা বলেও তেমন লাভ হয়নি। বাবা নাকি একবার দাদুকে বলেছিলেন ওগুলো সরিয়ে ফেলতে। দাদু বলেছিলেন, আমার বাড়িতে আমি গন্ডারের চামড়া আর হাতির মাথা দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখব। তাতে কার কী!

মায়াকাননের সেই পুরোনো একতলা বাড়ি ছেড়ে ঝলকেরা উঠে এসেছে গুলশানে একটা অভিজাত ফ্ল্যাটে। দাদু এতে ঘোর আপত্তি তুলেছিলেন। বলেছিলেন, ওখানটার ফ্ল্যাটবাড়িতে গিয়ে লাভটা কী হবে? ১০ তলার ওপরে ফ্ল্যাট, মাটির সঙ্গে কোনো সম্পর্কই থাকবে না।

তা ঠিক। বাবা বলেছিলেন, তবে সম্পর্ক হবে আকাশের সঙ্গে।

মাটি আর আকাশ কি এক কথা হলো? ঝলকের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, দাদুভাইয়ের পায়ে কখনো মাটি লাগবে না। মাটির স্পর্শ যে কী জিনিস, তা সে বুঝতেই পারবে না। মাটির প্রতি মায়াও জন্মাবে না তার মধ্যে।

তা হয়তো ঠিক। বাবা বলেছিলেন, তবে সে আকাশের চাঁদ আর তারাদের আলো দেখে নতুন জগৎ খুঁজে পাবে।

কোথায় মাটি আর কোথায় চাঁদ! দাদু বিষণ্ন মুখে তাঁর নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলেন।

মায়াকাননের একতলা বাড়ি ডেভেলপারদের হাতে তুলে দিয়ে ঝলকেরা গুলশানের ফ্ল্যাটে উঠে এল। এখানকার পরিবেশই আলাদা। পুরোনো বাড়ির পুরোনো আসবাব আর এখানে তোলা হলো না। মা-বাবা গিয়ে নতুন নতুন আসবাব কিনে ঘর সাজাতে লাগলেন। কিন্তু গোল বাঁধল দাদুর সেই বাঘের চামড়া আর হরিণের শিং নিয়ে। দাদু ওগুলো নতুন ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখতে চান। বলা বাহুল্য, বাড়ির আর কেউ চায় না ওগুলো ড্রয়িংরুমে থাক। ঝলকও চায় না। সারা রাত ধরে মা-বাবার মধ্যে এসব নিয়ে কথা হলো। সব কথা অবশ্য ঝলক জানে না। তবে ওগুলো যাতে নতুন বাসায় আনতে না হয়, তার জন্য উপায় বের করা হলো।

পরদিন সকালবেলা বাবা দাদুকে বললেন, বাঘের চামড়া আর হরিণের শিং এখানে আনা যাবে না।

কেন? দাদুর দৃষ্টিতে যেন আগুন জ্বলল।

ওগুলো এখন লুকিয়ে রাখতে হবে। বাবার কণ্ঠ ধীরস্থির।

এসবের অর্থ কী?

এখন নতুন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, ওরা বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনের খুব কড়াকড়ি করছে। বাঘ তো দূরের কথা, কারও বাড়িতে জ্যান্ত হরিণ পাওয়া গেলে মালিককে ধরে জেলে ভরে দিচ্ছে।

তার সঙ্গে আমাদের বাঘের চামড়ার সম্পর্ক কী?

কেউ রিপোর্ট করলে সরকারের লোকেরা আমাদের বাসায় এসে তদন্ত করবে। জানতে চাইবে এখানে বাঘের চামড়া কোত্থেকে এল? তাও আবার অর্ডিনারি বাঘ নয়, রীতিমতো বেঙ্গল টাইগার।

তাহলে চামড়ার ইতিহাসটা তাদের জানাতে হবে। এই বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমার দাদা ওটাকে হত্যা করেছিলেন, সে-কথাটা বলে দেব।

ব্যাঘ্র হত্যা মহাপাপ। এখন যে রকম, তখনো তেমনই ছিল। আসলে এখনকার প্রশাসনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাম দেওয়া হলেও দেশে সামরিক শাসন চলছে। এ সময়ে বন্য প্রাণীর মামলা হলে খুবই মুসিবতে পড়তে হবে।

তাহলে বাঘ থাক। হরিণের শিং অন্তত রাখি।

সে তো আরও সাংঘাতিক! হরিণ পোষার দায়ে সেদিন একজন সাবেক এমপিকে অ্যারেস্ট করা হলো। পত্রিকার প্রথম পাতায় ফলাও করে বেরিয়েছিল খবরটা।

ভারি মুশকিল হলো দেখছি। হরিণটা আমার বাবা সুন্দরবন থেকে ধরে এনেছিলেন। সেটাও অবশ্য ৫০ বছর আগের কথা।

এসব বিষয় এখন জানাজানি হলে আমাদের বিপদ হবে। জেনেশুনে কে আর গায়ের ওপর বিপদ ডেকে আনতে চায়?

তাই তো! বড়ই অসহায় মনে হলো দাদুর কণ্ঠস্বর।

সেদিন বাঘের চামড়া ও হরিণের শিং থেকে রক্ষা পাওয়া গেলেও আজ নতুন বিপদ ঘনিয়ে এসেছে দাদুর খড়মজোড়া নিয়ে। এগুলো যদি ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখা হয়, তাহলে বন্ধুদের কাছে ঝলকের মান-সম্মান আর কিছুই থাকবে না। এ অবস্থা থেকে কীভাবে রেহাই পাওয়া যাবে, মা-বাবা ও ঝলকের সেটাই এখন সবচেয়ে বড় ভাবনা। ঝলক একবার শুনেছিল, ওর দাদুর দাদু নাকি লাল সালু কাপড়ে মুড়িয়ে খড়মজোড়া সিন্দুকের ভেতর রেখে দিয়েছিলেন। সেই সিন্দুকের ওপর শুয়ে ঘুমাতেন তার দাদুর দাদু। ঘুমাতেন নাকি পাহারা দিতেন? খড়মজোড়া চুরি হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল বুঝি তাঁর? এহেন মূল্যবান খড়মজোড়া একবার চুপিচুপি দেখে নিয়েছে ঝলক। পুরোনো দিনের বোলওয়ালা খড়ম। তেমন আকর্ষণীয় কিছু নয়। ওগুলো অমন যত্ন করে রাখার কারণ খুঁজে পায়নি সে।

আজ অফিস থেকে ফেরার পর বাবাকে জিজ্ঞাসা করলেন দাদু, আমার শোকেসের কী করলে?

ভালো মিস্ত্রি পাওয়া যাচ্ছে না।

কাঠ খুবই ভালো হওয়া চাই। কাচগুলো কি বেলজিয়াম গ্লাস হতে পারে?

কী জানি! বেলজিয়াম গ্লাস পাওয়া যায় কি না!

তোমার কথায় তো তেমন আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছি না।

সত্যি বলতে কি, ড্রয়িংরুমে শোকেসে খড়মজোড়া সাজিয়ে রাখলে কেমন দেখাবে, ভাবছি। ঝলকের মাও বলছিল, ব্যাপারটা মানানসই হবে না।

তাই নাকি?

বাবা চায়ের টেবিলের দিকে উঠে যাওয়ার পর ঝলক দাদুর কাছে এসে বসল। বলল, দাদু! একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?

কী কথা?

খড়মজোড়া তুমি পায়ে দাও না কেন? তাহলেই তো সব সমস্যা মিটে যায়?

ওগুলো অনেক পবিত্র খড়ম। আমার পায়ের জন্য নয়। তা ছাড়া, ওতে সমস্যা কিসের?

পায়ে দিলে তোমাকে আর শোকেস বানাতে হবে না। তুমি অন্তত বাসায় তা ব্যবহার করতে পারো।

আমি ওই খড়ম পায়ে দেওয়ার উপযুক্ত নই। বলতে বলতে দাদু নিজের ঘরে উঠে গেলেন।

রাতে পড়ার টেবিলে বসে ইতিহাস বই পড়ছিল ঝলক। বইয়ের পাতায় সিপাহি বিপ্লবের কথা। ১৮৫৭ সালে সিপাহিরা বিদ্রোহ করেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। মঙ্গলপাণ্ডের নেতৃত্বে তা ব্যারাকপুরে শুরু হলেও শিগগিরই প্রায় সারা ভারতের বিভিন্ন অংশে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময়ে বাংলাদেশজুড়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। চট্টগ্রামের পদাতিক বাহিনী প্রকাশ্য বিদ্রোহে মেতে ওঠে এবং তারা অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে নেয়। এর ফলে অনেকেই মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তবে তা ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃত্ব অবসানে সহায়ক হয়েছিল।

ঝলক যখন ইতিহাস বইয়ের এসব অংশ পড়ছিল, দাদু এসে ওর পাশে বসলেন। বললেন, সিপাহি বিপ্লবের কথা পড়ছ? ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের ১০০ বছর পর এটাই ছিল আমাদের স্বাধীনতার প্রথম প্রচেষ্টা।

কিন্তু আমরা তো স্বাধীন হই ১৯৭১ সালে।

তা সত্য। কিন্তু ব্রিটিশ রাজত্বের বিভিন্ন সময়ে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করেছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানিদের কাছে আমরা আবার পরাধীন হয়ে পড়ি। শেষ পর্যন্ত আমরা, মানে বাংলাদেশের মানুষ, স্বাধীনতা অর্জন করি মুক্তিযুদ্ধ করে। কিন্তু তুমি কি জানো, আমাদের পরিবার ইতিহাসের একটি অধ্যায়?

তার মানে? ঝলক প্রশ্ন করল।

দাদু বললেন, আমার দাদার দাদা এবং তাঁর দাদার দাদা অর্থাত্ আমাদের এক পূর্বপুরুষ প্রায় দেড় শ বছর আগে সিপাহি বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন। ওই সময়ে যে ১১ জন সিপাহির মৃত্যুদণ্ড হয়, তিনি ছিলেন তাঁদেরই একজন। তাঁকে তো রক্ষা করা যায়নি, কিন্তু তাঁর ব্যবহূত খড়মজোড়া আমরা বংশানুক্রমে রক্ষা করে এসেছি আমাদের পরিবারে। আমাদের পূর্বপুরুষের সাহসিকতার স্মৃতি বহন করে আছে খড়ম দুটো।

কথা বলতে গিয়ে দাদুর গলা ধরে এসেছিল। ঝলকও অনুভব করল, কথাগুলো শুনে তার দুচোখে অশ্রুবিন্দু জমে উঠেছে।

কয়েক দিন পরে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় দাদুর খড়ম দুটির ছবি ছাপা হলো এবং একই সঙ্গে সংবাদও প্রকাশিত হলো। সংবাদে বলা হয়েছে, সিপাহি বিপ্লবের একজন শহীদ সৈনিকের ব্যক্তিগত ব্যবহূত খড়মজোড়া তাঁর উত্তরসূরি পরিবার জাতীয় জাদুঘরে দান করেছে। জাতীয় জাদুঘরে স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সংগ্রহ হিসেবে তা সযত্নে রক্ষিত হয়েছে। খড়ম দুটো পৃথক শোকেসে সর্বসাধারণের দেখার জন্য সংরক্ষিত।

পত্রিকার পাতায় সংবাদটি পড়ে ঝলক এসে দাদুর পাশে দাঁড়াল। বলল, দাদু! একটা কথা বলব?

কী ব্যাপার?

খড়মজোড়া তুমি আবার বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে এসো দাদু। ঝলক বলল, আমরা সুন্দর একটা শোকেস বানিয়ে তা ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখব।